রোদ্দুরের গান

বুরেল রোড রিভারসাইড পার্কের হ্রদ
বুরেল রোড রিভারসাইড পার্কের হ্রদ

‘ওই যে অঢেল সবুজের সমারোহ

পাহাড়ের গায়ে হালকা নরম রং
রোদ্দুরে শুধু চনমনে বিদ্রোহ
রোদ্দুরে শুধু দিগ্বিজয়ীর ঢং...।’

কবির সুমনের গানটার কথায় বারবার মনে পড়ছে অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের বুরেল রোড রিভারসাইড পার্ক থেকে ঘুরে আসার পর। অস্ট্রেলিয়ার প্রতিটি সবার্বের (উপশহর) প্রতিটি পাড়া–মহল্লাতেই অন্ততপক্ষে একটা করে পার্ক আছে। তবে কিছু কিছু পার্কের পাশে জলাশয় থাকাতে সেগুলোর সৌন্দর্য অন্য মাত্রা পেয়েছে। আমার কাছে মনে হয় পার্কের পাশে জলাশয় থাকলে পার্কটার সৌন্দর্য পূর্ণতা পায়। বুরেল রোড রিভারসাইড পার্কটা ঠিক তেমনি একটা পার্ক। সিডনির দক্ষিণ–পশ্চিমের এলাকাগুলোতে সম্প্রতি উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে এই এলাকায় নতুন এয়ারপোর্ট হওয়ার ঘোষণার পর থেকে। স্প্রিং ফার্ম সবার্বেও চলছে দুর্বার গতিতে জায়গা কেনা ও বাড়ি বানানোর কাজ।

বুরেল রোড রিভারসাইড পার্কের হ্রদ
বুরেল রোড রিভারসাইড পার্কের হ্রদ

বুরেল রোড রিভারসাইড পার্কটার অবস্থান স্প্রিং ফার্ম সবার্বের মোটামুটি কেন্দ্রস্থলে। এক পাশে পার্ক তার দুই দিকে লোকালয়। অন্য দুই দিকের একদিকে একটি জলাশয় আর অন্য দিকটাতে উঁচু গাছের বন। জলাশয়টার নাম স্প্রিং হ্রদ। স্প্রিং হ্রদ পার হওয়ার জন্য রয়েছে একটা কাঠের সেতু। কাঠের সেতু দিয়ে পার হয়ে গেলেই আবার লোকালয়। এই লোকালয়ের ওপর দিয়ে তাকালে দূরে অস্ট্রেলিয়ান বোটানিক গার্ডেনের উঁচু পানির ট্যাংকটা দেখা যায়। স্প্রিং হ্রদের পানি কাচের মতো স্বচ্ছ। তার মধ্যে সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে বুনো হাঁস আর পানকৌড়ির দল। আর আকাশে অবিরাম উড়ে চলেছে সুইচোরা পাখির দল।

পার্কটা একেবারে নতুন। খেলাধুলার সরঞ্জামগুলো অন্য পার্কগুলোর তুলনায় বেশ আলাদা। তাই এখানে খেলতে খেলতে বাচ্চারা ক্লান্ত হয়ে যায় না। বরং নিজেকে দুঃসাহসিক প্রমাণ করার জন্য একটার পর একটা রাইডে চড়তেই থাকে। বাচ্চারা যেহেতু খেলা নিয়ে ব্যস্ত থাকে তাই তাদের আলাদাভাবে দেখভাল করার তেমন দরকার নেই। পার্কে আরও আছে বার-বি-কিউ করার জায়গা। সেখানে আপনি চাইলেই পুরো পরিবার নিয়ে বার-বি-কিউ করে খেতে পারেন। পার্কের মধ্যে আছে একটা অত্যাধুনিক টয়লেট। তাই বাথরুম পেলে আপনাকে ভাবনায় পড়তে হবে না। পার্কের জায়গাটার অর্ধেক অংশজুড়ে খেলাধুলার রাইড আর বাকি অর্ধেক অংশ ফাঁকা জায়গা। তাই আপনি চাইলেই সেখানে মাদুর পেতে বসে পড়তে পারেন। তবে ছোট বাচ্চাগুলো হ্রদের পাড়ে খেলতে গেলে একটু চোখে চোখে রাখাই ভালো।

বুরেল রোড রিভারসাইড পার্কের হ্রদ
বুরেল রোড রিভারসাইড পার্কের হ্রদ

আগের দিন জেইনা ও জাহিয়া ওদের বাবা-মায়ের সঙ্গে পার্কটা থেকে ঘুরে এসেছিল। জেইনার মা ফাহিমার সঙ্গে দেখা হলে বললেন, গতকাল আমরা একটা জায়গায় গিয়েছিলাম। যেখানে যাওয়ার পর জেইনার বাবা সজিব বলেছে, এটা সিডনির বুকে তাঁর দেখা এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সুন্দর জায়গা। শুনে আমি খুবই আগ্রহবোধ করলাম। ওদিকে বন্ধু ননি ও বন্ধুপত্নী বীথি ভাবি তাঁদের সন্তান নাজিহা, নাবিহা আর প্রহরকে নিয়ে বাংলা স্কুলে আসবেন পরদিন। তাই মনে মনে পরিকল্পনা করে ফেললাম তাঁরা বাংলা স্কুল শেষ করার পর আমরা বুরেল রোড রিভারসাইড পার্কে বেড়াতে যাব। মেসেঞ্জারে সে কথা ননি আর বীথি ভাবিকে জানিয়েও রাখলাম। এদিকে আমার কন্যা তাহিয়া আর গিন্নিকেও জানিয়ে রাখলাম আমার পরিকল্পনার কথা। বললাম, তোমাদের একটা অনেক সুন্দর জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যাব। বেড়ানোর কথা শুনলে তাহিয়া বরাবরই খুশি হয়, তাই তখনই হইচই শুরু করে দিল।

বাংলা স্কুল শেষ হতে হতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল। স্কুল শেষে সবাই আমাদের বাসায় গিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নিল। ইতিমধ্যেই বাইরে হালকা বৃষ্টি হয়ে গেল, তাই বিকেলে আমরা বের হব কি না, সেটা নিয়ে গড়িমসি করছিলাম। কিন্তু বীথি ভাবি বললেন, চলেন যাই বাচ্চারা খেলতে না পারুক সৌন্দর্য দেখবে। ছোট রায়ান আর প্রহর ঘুমিয়ে পড়েছিল। তাদের সেভাবেই গাড়িতে ওঠানো হলো। নাজিহা তাহিয়ার সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ে। তাই নাজিহা আমাদের গাড়িতে তাহিয়ার সঙ্গে এসে বসল। তারপর রাস্তাজুড়ে চলল তাদের গুজুর গুজুর, ফুসুর ফাসুর। দেখতে দেখতে মেয়েগুলো বড় হয়ে যাচ্ছে। তাদের আলাদা দুনিয়া তৈরি হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে আলাদা ভাবনা। যাহোক আমাদের বাসা মিন্টো থেকে স্প্রিং ফার্ম যেতে আধা ঘণ্টার ওপরে লাগল।

বুরেল রোড রিভারসাইড পার্কের হ্রদ
বুরেল রোড রিভারসাইড পার্কের হ্রদ

আমরা যখন পার্কটার কাছে পৌঁছেছি তখনো রায়ান ও প্রহর ঘুমাচ্ছিল দেখে আমি আর ননি গাড়ি পাহারায় থেকে মেয়েদেরসহ মায়েদের বেড়াতে পাঠিয়ে দিলাম। মেয়েরা রাইডগুলোতে খেলতে শুরু করল। আর মেয়েদের মায়েরা চলে গেল স্প্রিং হ্রদের দিকে। আমরা দূর থেকে জলাশয়টাকে দেখছিলাম কিন্তু তখনো বুঝিনি হ্রদটা আসলে কতটা সুন্দর। বেশ কিছুক্ষণ পর মায়েরা ফিরে এসে আমাদের বলল, এবার আপনারা বেড়াতে যান। আমরা পার্কের খোলা জায়গাটা পার হয়ে সরাসরি হ্রদের দিকে চলে গেলাম। তারপর হ্রদের পাড় দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। নরম ঘাসের মধ্যে আমাদের পা ডুবে যাচ্ছিল। হ্রদের পাড়জুড়ে রয়েছে হোগলার বন। কোথাও কোথাও আবার হ্রদের পানিতে হাঁটু পরিমাণ ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিছু গাছ। যাদের ডালপালা হ্রদের পানিতে সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে।

হ্রদের পাড় বরাবর হাঁটতে হাঁটতে আমরা পানিতে আকাশের ছায়া দেখছিলাম। এমনকি পানিতে অপর পাড়ের বাড়িঘরগুলোর অবিকল ছায়া পড়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হতে পারে হ্রদের পানিটা যেন একটা বড় স্বচ্ছ আয়না। আমরা আমাদের মোবাইল দিয়েই দারুণ কিছু ছবি তুলে ফেললাম। ছবিগুলো দেখে ননি বলল, মনে হচ্ছে আমরা যেন ডিএসএলআর ক্যামেরার ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে ছবিগুলো তুলেছি। লেকের যেদিকটা বনের দিকে গিয়ে শেষ হয়েছে সেখানে একটা রবারের পাইপের মতো কী যেন একটা ভাসছিল। হাঁসের দল সেখানে বসে শেষবেলার বিশ্রাম নিচ্ছিল। আর পাড়ের উঁচু ঘাসের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে গিয়ে আমি বুঝতে পারলাম এখানে একটু খুঁজে দেখলেই হাঁসের ডিম পাওয়া যেতে পারে। আমি ননিকে বললাম, ছোটবেলায় আমাদের গ্রামের বাড়িতে এমন ঘাসের ঝোপের মধ্যে আমরা কোয়েল পাখির ডিম পেতাম।

বুরেল রোড রিভারসাইড পার্কের হ্রদ
বুরেল রোড রিভারসাইড পার্কের হ্রদ

পাড়ের ঘাস বরাবর পানির মধ্যে হোগলার বন ঘন হয়ে এসেছে। দেখে মনে হচ্ছিল আমি যেন বরিশাল জেলার কোনো জায়গায় বেড়াতে এসেছি। ননিকে সে কথা বলায় সে–ও আমার সঙ্গে একমত পোষণ করল। তারপর আমরা উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করলাম। হ্রদের মাঝবরাবর একটা সেতু একটু পানির ওপরে গিয়ে আবার কিনারে ফিরে এসেছে। আমরা সেটার ওপর দাঁড়িয়ে পানিতে নিজেদের ছায়া দেখার চেষ্টা করলাম। পানিতে অবিকল আমাদের ছায়া পড়েছে দেখে একটা ছবিও তুলে নিলাম। আর একটু এগোতেই কাঠের অন্য সেতুটা। আমরা কাঠের সেতু দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। কাঠের সেতু দিয়ে মানুষ পারাপার হচ্ছে। তাঁদের প্রত্যেকের সঙ্গে একটি বা দুটি কুকুর। কুকুরকে নিয়ে বিকেলে হাঁটতে বেরিয়েছেন তাঁরা।

বেশ কয়েকটা পরিবারের সঙ্গে আলাপ হলো। আমি তাদের প্রত্যেককেই বললাম, তোমাদের জন্য আমার অনেক হিংসা হচ্ছে। শুনে তারা হাসতে হাসতে কারণ জানতে চাইলেন। আমি বললাম, এমন একটা পার্ক আর হ্রদ যাদের এলাকায় আছে, তাদের ঈর্ষা করার জন্য আর কী দরকার। তোমরা সকাল–বিকেল হ্রদের পাড়ে হাঁটতে পারো আর হ্রদের শীতল বাতাস গায়ে মাখতে পারো। কিন্তু আমাদের তো সে সুযোগ নেই। শুনে তাঁরা বললেন, তোমরা কোথা থেকে এসেছ। আমি বললাম, মিন্টো। তাঁরা বেশ অবাক হলেন যে আমরা এত দূর থেকে পার্কটা দেখতে এসেছি। মিন্টোর কথা শুনেই এক বয়স্ক দম্পতি বললেন, ওহ গতকাল তোমাদের এক বন্ধু এসেছিল তার পরিবার নিয়ে। আমি জেইনাদের বর্ণনা দেওয়ার পর তাঁরা বললেন, হ্যাঁ তাঁদের সঙ্গেই আমাদের কথা হয়েছিল। তাঁরাও তোমার মতোই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছিল পার্কটা নিয়ে।

বুরেল রোড রিভারসাইড পার্কে বাচ্চাদের রাইড
বুরেল রোড রিভারসাইড পার্কে বাচ্চাদের রাইড

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল। আকাশে পাখিদের দল তাদের ঘরে ফেরা শুরু করেছে। একসঙ্গে শত শত কাকাতুয়া দল বেঁধে উড়ে গেল আমাদের মাথার ওপর দিয়ে। সূর্য ডুবে যাচ্ছিল। তার লালাভ আলোয় উল্টো দিকের আকাশ ক্রমেই লাল বর্ণ ধারণ করল। তার ছায়া হ্রদের পানিতে পড়েছে দেখে মনে হচ্ছিল যেন লেকের পানিতে আগুন লেগেছে। আমরা আরও কিছু ছবি তুলে সেখানেই ঠাঁই দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ গিন্নিদের ফোন পেয়ে সংবিৎ ফিরে পেলাম। ফিরতে হবে কারণ সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। আমরা দৌড়ে গাড়ির কাছে ফিরে এলাম। এসে দেখি রায়ান ও প্রহর ততক্ষণে ঘুম থেকে উঠেছে। কিন্তু তাদের মেজাজ খারাপ, তাই আর তাদের গাড়ি থেকে নামানো হলো না। তাদের ন্যাপি বদলে আমরা ফেরার পথ ধরলাম। তবে মনে মনে পণ করলাম রায়ানকে দেখানোর জন্য হলেও আবার আমরা বুরেল রোড রিভারসাইড পার্কে যাব। আপনিও যেতে পারেন নাগরিক ক্লান্তি থেকে নিজেকে একটু সময় দেওয়ার জন্য। সিডনি শহর থেকে মাত্র এক ঘণ্টার ড্রাইভ আর ট্রেনে–বাসে গেলে দুই ঘণ্টা লাগবে। কারণ, ওই এলাকাগুলোতে এখনো ট্রেন লাইন বসানোর কাজ শেষ হয়নি। আপনাকে ক্যাম্বেলটাউন স্টেশনে নেমে তারপর বাসে উঠতে হবে।
...

মো. ইয়াকুব আলী। ই–মেইল: <[email protected]>