শৈশবের স্মৃতিতে রমজান

মানুষের জীবনে একটা সময় আসে যখন সে পুরোনো স্মৃতি আঁকড়ে পড়ে থাকে। পরবাসে থাকায় বারবার হারানো দিনের স্মৃতিতে ডুবে যাই। মাঝেমধ্যে অতীতে হারিয়ে যাই।

শৈশবে রমজান মাস এলেই ছোট্ট প্রাণটা নেচে উঠত খুশিতে। সবার সঙ্গে সাহরি খাওয়া, ইফতারি করা, মসজিদে দল বেঁধে তারাবি পড়ার সে কী আনন্দ! যদিও তখন নামাজের নিয়মকানুন কিছুই জানতাম না। যতটুকু মনে পড়ে আমার সামনের ব্যক্তি যতবার সেজদায় যেতেন আমিও ততবার সেজদায় গিয়ে রাকাত পূর্ণ করতাম।

এখন প্রবাসে থাকায় পরিবারের সবার সঙ্গে সাহরি খাওয়া, ইফতারি করা হয় না। আর ১৪ ঘণ্টা ডিউটি করে এসে তারাবি পড়াও কষ্টকর।

শৈশবে আমার সবচেয়ে প্রিয় সময় ছিল ভোররাতের সাহরি। ভোর রাতে ইমাম সাহেব ভরাট কণ্ঠে বলতেন, উঠুন, সাহরি খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। আর ঘুমাবেন না। মাঝেমধ্যে তিনি সুমধুর কণ্ঠে কোরআন তিলাওয়াত করতেন। মনে পড়ে এখনো গ্রামের সেই রমজান মাসের বেহেশতি পরিবেশের কথা। আহা, কত আনন্দময় সময় কাটাতাম।

ভোররাতে বড় ভাই, মেজ ভাই, সেজ ভাই সবাইকে ডেকে ওঠানো হতো। আমাকে ও ছোট দুই ভাইকে ডেকে তোলা হতো না। তবুও আমরা ইমাম সাহেবের গলার আওয়াজে জেগে উঠতাম। আমাদের দেখে মা আদর করে পাশে বসিয়ে খেতে দিয়ে বলতেন, তোমরা ১০টা বাজলে আবার খাবে। সকাল ১০টায় তোমাদের এক রোজা পূর্ণ হবে।

আমরা মায়ের কথামতো ১০টা বাজলে ইফতার করে আনন্দে নাচানাচি করতাম। মাঝেমধ্যে খেলায় মেতে থাকায় ইফতারের সময়ের কিছুক্ষণ আগে দৌড়ে বাড়ি ফিরতাম। ইফতারে প্রতি বাড়িতে নানা রকম ইফতারের আয়োজন করা হলেও আমাদের বাড়িতে তেমন আয়োজন হতো না। তবুও পরিবারের সবার সঙ্গে ইফতার করার কী যে আনন্দ, তা লিখে বোঝানো যাবে না।

এখন টাকা আছে কিন্তু পরবাসে থাকার কারণে সবার সঙ্গে ইফতার করা হয় না। তাই পুরোনো সেই স্মৃতি ঘেঁটে সুখ খুঁজে বেড়াই।

রমজান মাসে আমাদের গ্রামে গরিব–দুঃখীদের ইফতারের পর খাওয়ানো হয়। আমাদের গ্রামে এই খাওয়ানোটাকে বলে খতম পড়ানো। সমাজে যাঁদের সামর্থ্য আছে তাঁরা দাওয়াত দিয়ে প্রতিবেশীদের খাওয়ান, নেকি লাভের আশায়। যেদিন দাওয়াত থাকত সেদিন আমার আনন্দের সীমা থাকত না। দুপুর থেকে আমি প্রস্তুতি নিয়ে বসে থাকতাম। সমাজের সব শ্রেণির লোকদের সঙ্গে একই কাতারে বসে খাওয়ার কী যে আনন্দ।

লেখক
লেখক

রমজানের শেষের দিকে পবিত্র শবে কদরের রাতে বন্ধুরা মিলে দল বেঁধে মসজিদে যেতাম। একসঙ্গে তারাবি, একসঙ্গে শবে কদরের নামাজ পড়তাম। আমার বন্ধুদের খুব মিস করি এসবের জন্য। কিন্তু এই দূর পরবাসে সেই বন্ধুরা নেই, দল বেঁধে তারাবি পড়া হয় না।

কৈশোরের ইবাদত খুব নির্ভেজাল হয়। তাই বারবার ইচ্ছা করে আবার সেই কৈশোরের রমজানে ফিরে যাই। কত বছর আম্মুর সঙ্গে ইফতার করা হয় না। ভোররাত পেরিয়ে উঠানে হাঁটতে হাঁটতে সুবহে সাদিক দেখা হয় না! আর হবেও না। আম্মু নেই আমাদের মধ্যে। তবুও তাঁর সেই স্মৃতিগুলো আজও কাঁদায়।

আর কখনো সব ভাইবোন মিলে আমেজপূর্ণ পরিবেশে সাহরি–ইফতার করতে পারব না আম্মুর সঙ্গে! এই কথাটা ভাবতেই বুকের ভেতর কম্পন অনুভব করি। সবাই অনেক বড় হয়ে গেছি এখন, আর আমি এই পরবাসে একাকী জীবন যাপন করছি। তবুও যত দিন বেঁচে থাকব তত দিন কিশোর বয়সের সুখ স্মৃতিগুলো বারবার ফিরে আসবে আর নীরবে কাঁদিয়ে যাবে আমাকে।
...

ওমর ফারুকী শিপন। ই–মেইল: <[email protected]>