শাপলার ঢ্যাপ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ছোট্ট নৌকাটা তোরাব আলী মেরামত করে রেখেছে। কয়েক মাস আগেই জামগাছের কাঠ দিয়ে নৌকাটা বানিয়েছিল। কয়েক দিন ধরেই নৌকা নিয়ে বের হলেই নিচের থেকে পানি ওঠা শুরু করে। সালেহা, কালাম মাঝে মাঝে বাবার সঙ্গে যায়। শাপলা, শালুক তোলে। সালেহা বলে, ‘আব্বা দেখেন। একটু একটু কইরা পানি উঠতাছে। নাওতো ডুইবা যাইব।’ এরপর হাতের কাছে মাঝারি সাইজের বালতি পায়। তোরাব আলী মাছ ধরার জন্য রেখেছিল। সালেহা সেই বালতি দিয়ে নৌকার থেকে পানি ফেলা শুরু করে। কালাম বসে থাকে। মাঝে মাঝে শাপলা তোলে।

তোরাব আলী নৌকা চালিয়ে চালিয়ে বর্ষাকালে বিলঝিল, ডোবা থেকে মাছ ধরে আনে। কাউকে না দেখলে কালা মোল্লার পাটখেত থেকে কিছু পাটও তুলে আনে। নৌকা চালাতে চালাতে কখনো পশ্চিমের শেষ প্রান্তে যায় না। একদিন কিছুদূর গিয়েই মেয়েকে দেখায়, ‘দেখছস মা ওই বড় বটগাছের নিচে একটা কবর। আর এইহান থেইকা দেখ সব কালাপানি দেখা যাইতাছে। ওইডা হইল সখিনা বিবির কবর। লগে তার ঘোড়ার কবর। উনি এই এলাকার জমিদার আছিলেন। ওনার প্রিয় ঘোড়া বেবাকসময় ওনার লগে লগে থাকত।

‘একবার এক দুর্ঘটনায়, ওনার লগে ওনার ঘোড়াডাও মইরা যায়। মরার আগে উনি কইয়া গেছিল, ওনার ঘোড়ারে যেন ওনার লগে কবর দেয়। সবাই মিল্যা ওইহানে কবর দিসে। বড় বটগাছটার তলায়।

‘ওনার ঘোড়া ভূত হইয়া গ্যাছে। রাইত বিরাইতে মাইনষেরে ধরে, ঘাড় মটকাইয়া দেয়। দিনের বেলাও ভরদুপুরে ধরে। আজানের সময় হইল গিয়া খেইনের সময়, তহনও ধরবার পারে।’

সালেহা শিউরে ওঠে। কালামকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘আব্বা আমার ডর করতাছে।’

কালাম বোনের হাত দুটো ভালোভাবে ধরে বলে, ‘আব্বা আমারও ডর করতাছে।’

তোরাব আলী হেসে বলে, ‘আরে ডরের কিচ্ছু নাই। আমি আছি না! আব্বা থাইকলে আর কোনো ডর নাই।’

সালেহা বলে, ‘আব্বা আপনি কি সখিনা বিবিরে দেখছেন?’

তোরাব আলী বলে, ‘আমিও তোগো মতন, তোগো দাদার কাছ থেইক্যা শুনছি। তয় শুনছি, সখিনা বিবি নাকি খুব সুন্দরী আছিল। ঘোড়া চালাইত। ঘোড়া লইয়া যহনতহন বাইর হইয়া যাইত। তলোয়ার চালাইতে পারত। ওনার বাবা আসল জমিদার সাব মইরা যাওনের পর উনি আমাগো এলাকা দেখভাল করছে।’

তোরাব আলী কথা সরিয়ে বলে, ‘কী করতে আইছি আর কী করতাছি! লও কয়ডা পাট তুইল্যা যাইগা।’ কালাম বলে, ‘আব্বা আমার এই সব গল্প হুইনতে খুব ভালা লাগে। বুবু হুদা মিছা ডরায়। আপনে আরও কন। আমি হুনুম।’ তোরাব আলী বলে, ‘নাহ অহন আর সময় নাই। বাড়িত যাইতে হইব। তোমগো আম্মা বইয়া রইছে, আমি গেলে রান্দব।’

তোরাব আলী কিছু ট্যাংরা, পুঁটি, কই মাছ ধরেছে। পাটখেত থেকে পাট তুলেছে। সালেহা, কালাম কিছু শাপলাও তুলেছে, শালুক তুলেছ। শাপলার ফল ঢ্যাপগুলো দুজনে নৌকায় বসেই খেতে থাকে।

সালেহা বলে, ‘আব্বা, আপনি শাপলার ঢ্যাপ খাইবেননি?’

: না, মা তোমরা খাইয়ো। আমি নাও চালাই।

: আমি ঢ্যাপ খুইলা আপনার মুখে দিয়া দিলে খাইবেন?

: নাহ। লাগব নাহ। তোমরা খাইয়ো, আমি খামু নাহ।

: নাহ, আপনারে খাওন লাগব।

বলে সালেহা নিজে এসে বাবার মুখে দিয়ে দেয়। তোরাব আলী মুখে নিয়ে খেতে থাকে। নিজের ছেলেবেলার কথাও মনে পড়ে যায়। এখন তো সালেহা, কালাম নৌকায় করে শাপলা, শালুক তোলে। তখন তোরাব আলীরা নৌকায় করে নামত না। বাবার নৌকাও ছিল না। যেখানে পানি কম, সেখানে দেখে দেখে নামত। লুঙ্গির কাছা মেরে হাঁটুপানি কিংবা তার অধিক পানিতে নামত। আর যদি তারও বেশি পানিতে নামতে হতো তাহলে, লুঙ্গিটা খুলে উঁচু ঢিপির ওপর কোথাও রেখে তারপর নেমে যেত। শাপলা তুলত, শালুক তুলত, ফেনার ফুল ছিঁড়ে নিত। এই আল আর ওই আলের মাঝে খোলা থাকলে, যদি পানির স্রোত থাকত সেখানে আন্তা বসিয়ে মাছ ধরত।

তোরাব আলীর সংবিৎ ফিরে আসে মেয়ের কথায়, ‘আব্বা দেখেন দেখেন একখান সাপ দেখা যাইতাছে। ঢোরা সাপ মনে হইতাছে। ছই দিয়া বাড়ি মারবেন?’

: কাম কী সাপ কি আমগোরে কিছু করছে! সাপরে কিছু না করলে সাপও করে না। আর যদি সাপরে হুদা কামে না মাইরা খোঁচাইয়া বাড়িত যাই। তাইলে রাইত আইসা কামড়াইব।

কালাম বলে, ‘আব্বা আমি একদিন উঠানের ওই পাশে একটারে লাঠি দিয়া বাড়ি মারছিলাম। হেইডা আমার খেলনার ওপর বসছে। কিন্তু মারতে পারি নাই, অল্প বাড়ি লাগছে, তাই মরে নাই। কই আব্বা, রাইতে দেহি আসে নাই। আমি মশারিরে ভালো কইরা গাঁইথ্যা আম্মার লগে ঘুমাইছিলাম। কয় রাত অপেক্ষা করছি। আহে নাই।’

: হেইডা তাইলে মাইট্যা সাপ আছিল। আর কোনো দিন এরম করবা না, নিজে মারতে যাইবা না। সাপ দেখলে, আম্মারে ডাক দিবা। চল বাড়িত আইয়া গেছি।

সালেহা বলে, ‘আব্বা একটু জিরান। আমি একটু ওই উঁচা টিলার মতো জায়গার থেইক্যা ঘুইরা আসি। ওইহানে মাঝে মাঝে হাঁসে ডিম পাইড়া যায়। ডিম পাইলে আমি লইয়া যাই।’ সালেহা খেতের ধারে যে উঁচু জায়গা আছে, তার ঢালুর কাছে যায়। সেখানে অনেকক্ষণ পায়চারি করে দুইটা ডিম পায়। হাঁসের ডিম নিয়ে এসে সবাই একসঙ্গে বাড়িতে যায়।

ছমিরন বাড়ির থেকে বের হয়ে পথে দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের দেখে এগিয়ে আসে। তোরাব আলীর হাত থেকে মাছের বালতি, শাপলা আর পাট নিয়ে ঘরে এসে রান্নার আয়োজন করে। তোরাব আলী সকালে রেখে যাওয়া চিড়া আর গুড়ের বাটি নিয়ে মুখের মধ্যে চিবাতে থাকে। ছমিরনকে বলে, ‘জাননি আমার মাইয়ার মাথায় অনেক বুদ্ধি। আমার মাইয়া অনেক জ্ঞানী হইব।’

: কেন, জ্ঞানের কী করছে?

: আমার নাওয়ে ফুঁটা ছিল। অহন মেরামত করছি। কিন্তু ফুঁটা আমি দেহি নাই। একটু একটু কইরা পানি উঠতাছে দেইখা সে এই মাছের বালতিটা দিয়া একটানা পানি ফেলছে। না হইলে তো নাও ডুইবা যাইত। আমি তারে কিছু কই নাই। নিজে নিজে বুদ্ধি কইরা করছে। তোরাব আলী খুব স্নেহের স্বরে বলে, আমি নাও চালাইতেছিলাম, হাত আটক দেইখা আমার রাজকইন্যা শাপলার ঢ্যাপ খুইলা খুইলা আমার মুখে দিসে। আল্লাহ আমার মাইয়ারে অনেক বছর বাঁচাইয়া রাখুক।

চুলায় লাকড়ি দিতে দিতে ছমিরনের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। তারপর বলে, ‘ডর করে বুঝছেন সালেহার বাপ। মাইয়া মাইনষের বেশি বুদ্ধি থাকন ভালা না। আমিও দেখি ওর কামকাজে অনেক বুদ্ধি। আমি কিছু না বুঝতে পারলে, ওরে জিগাই। ও কতক্ষণ ভাইবা বুদ্ধি কইরা বুইঝা ফালায়, আমারেও বুঝাইয়া দেয়।’

: ওর দাদির মতন হইছে। আমার আম্মারও অনেক বুদ্ধি আছিল। আমগোরে বড় করছে, আব্বা সব সময় কইত, তোগো আম্মার এত গুণ। এই গেরামে কোনো বেটির এত গুণ নাই। তোমার বিয়ার কয়েক বছর আগে যক্ষ্মা হইয়া আম্মা মইরা গেছে।

ছমিরন আর কথা বাড়ায় না। চুপ করে নিজের কাজে মন দেয়।

তোরাব আলী কলসি থেকে পানি টিনের মগে ঢেলে খেতে খেতে বলে, ‘আমার খুব শখ পোলা-মাইয়া দুইডারে পড়ালেখা করাইয়া বিরাট পাস দেয়ামু। সালেহা এখন সবে চার কেলাসে যায়। ওরে আমি সবাইর মতো চার–পাঁচ কেলাস পর্যন্ত পড়াইয়া পড়া বন্ধ করুম না। আইএ, বিএ পাস করামু।’

: হ। আইএ, বিএ পাস করতে টেকা লাগে। কই পামু এত টেকা। আপনি তো কোনো কামের না। এইটা ওইটা আইনা দেন আর আমি বাকি সবকিছুর ব্যবস্থা কইরা সংসার চালাইয়া নিই। এভাবে কী জীবন যাইব।

: যাইব, যাইব। আমার বেশ কিছু জমিজমা আছে, তোমার বাপের থেইকাও তো কিছু পাইছি। এগুলা দিয়াই তো খাইতাছি, চলতাছি। দরকার হইলে বেইচা দিমু। এক ব্যবস্থা হইবই।

সালেহা আর কালাম বাড়ির উঠোনে খেলছে। শাপলার ফুল দিয়ে মালা বানিয়ে গলায় পরেছে। নারিকলপাতা আর পাতার শলা দিয়ে চশমা বানিয়ে পরেছে। নারকেলপাতা দিয়ে ঘড়ি বানিয়ে হাতে পরেছে। নিজেরা নিজেরা খেলছে, একসময় আর বনিবনা হয় না। কালাম সব সময় নিজেরটা বেশি বেশি চায়। নিজেরগুলো লাগিয়েছে আবার বোনেরটাও লাগাতে চায়। হ্যাঁচকা টান মেরে বোনের চশমা খুলে নেয়। নিজের চোখে লাগাতে যায়, সালেহা আবার টান দিয়ে নিয়ে নেয়। টানাটানি শুরু হয়ে যায়, চশমা ছিঁড়ে দুই ভাগ হয়ে যায়। সালেহা রাগে দিগ্বিদিক কোনো দিকে না তাকিয়ে দুম দুম করে কালামের পিঠে কিল মারে। কালাম সালেহার চুল টেনে ঝুলে থাকে, আর চিৎকার করে কাঁদে। ছমিরন আসে, ছমিরনের হাতে তরকারি নাড়ানোর কাঠের লম্বা হাতল ছিল সেটা দিয়ে দুজনকে দুইটা ঘা মেরে বলে, ‘সারা দিন মারামারি ছাড়া আর কিচ্ছু নাই। তোগো যন্ত্রণায় আর পারি না।’ সালেহাকে বলে, ‘তুই তো বড় হইছস, স্কুলে যাস। ভাইটা এখনো ছোট, স্কুলে যায় না। তুই ওরে আদর করতি পারস না! তুই কী ওর সমান, ওর সঙ্গে লাগতে যাস কেন। এক্কেবারে আবুঝ।’

সালেহা–কালাম দুজন দুই দিকে ফিরে কিছুক্ষণ কাঁদে, তারপর আবার থেমে যায়। কালাম বাবার কাছে চলে যায়, ‘আব্বা, আম্মায় মারছে। বুবুও আমারে মারে, আম্মায়ও আমারে মারে।’ তোরাব আলী ছেলেকে কাছে টেনে বলে, ‘বেটা মানুষের এত অল্পতে গোস্যা করলে হয় না, বাজান। আস, আমি তোমারে পাতা দিয়া বাঁশি বানাইয়া দিই।’ সালেহাও আসে দুজনকে তোরাব আলী পাতা দিয়ে বাঁশি বানিয়ে দেয়। বাঁশি বাজাতে বাজাতে দুজনে আবার খেলায় মেতে ওঠে। আবার লাগবে মারামারি, আবার ঝগড়া, আবার মায়ের বকুনি, মার, তারপর আবার ঠিক হয়ে যায়।

দুপুরে সবাই খেতে বসে। সালেহা বলে, ‘আম্মা আমি যে হাঁসের ডিম আনছিলাম সেগুলো কই। ডিম দুইটারে চুলার ভেতরে গরম ছাইয়ের মধ্যে পোড়া দেন নাই?’ ছমিরন বলে, ‘হ পোড়া দিসি, এখন খাবি?’ সালেহা খুশি হয়ে বলে, ‘হ খামু। আম্মা আমার পোড়া ডিম খাইতে ভালা লাগে, তাই ওই খেতের কাছে, উঁচু জায়গাটার থেকে ঢালু হইয়া পানির কাছে নামছে যেখানে, সেখানে হাঁসে মাঝে মাঝে ডিম পাইড়া যায়। আমি কুড়াইয়া পাইলে লইয়া আসি।’ ছমিরন বলে, ‘নাহ মা। সব সময় যাইস না। ওসব জায়গা বড় নিরিবিলি।’ সালেহা চুপ করে পোড়া ডিম দিয়ে ভাত খাওয়া শেষ করে, কালামও ভাত খাওয়া শেষ করে।

সন্ধ্যা হলে তোরাব আলী আর ছমিরন ছেলেমেয়েদের বই নিয়ে বসিয়ে দেন। নিজেরা পড়াশোনা জানে না। কিন্তু খুব শখ ছেলেমেয়েরা পড়বে। মেয়ে বই নিয়ে বসে, কী কী পড়ে তা দেখে। জোরে জোরে পড়তে বলে। তাহলে বোঝা যাবে পড়ছে। মেয়ে পড়ায় ভালো। স্কুলের মাস্টার সাব একদিন তোরাব আলীকে ডেকে বলেছে, ‘তোরাব আলী তোমার মেয়ে পড়ায় খুব ভালো। ঠিকমতো যত্ন করলে, ভালো কিছু হবে।’ সেই থেকে মেয়ের প্রতি তোরাব আলীর বড় আশা। আর মেয়ের জন্য যেন বাবার আলাদা মায়া। মেয়েও কোনো কিছু হলেই আগে বাবা তারপর দুনিয়ার সব।

সেদিন সালেহা স্কুলের থেকে আসছিল। লাল জামাটা পরে গিয়েছিল। বাড়িতে প্রবেশের রাস্তা দিয়ে একটা ষাঁড় লাল জামা পরা সালেহাকে দেখে তেড়ে আসছিল। সালেহা আব্বাগো আব্বাগো করে চিৎকার করে, বইখাতা নিয়ে খেতের মধ্যে নেমে দৌড়াতে থাকে। তোরাব আলী ঘরের থেকে চিৎকার শুনে দৌড়ে গিয়ে ষাঁড় সামলে মেয়েকে ঘরে আনে, সেই সঙ্গে ষাঁড়ের মালিকের কাছে গিয়েও বিচার দিয়ে আসে। বাড়িতে এসে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানায়। আল্লাহ ছেলেমেয়েকে যেন আরও অনেক হায়াত দেয়, বাঁচিয়ে রাখে।

ছমিরন সন্ধ্যার পর মেয়েকে রাতের খাবার দিতে দিতে বলে, ‘সালেহা আর কোনো দিন ওই রাস্তা দিয়া যাইবা না। পাশে যেই রাস্তাডা আছে, হেইডা দিয়া যাইবা-আইবা, একই তো কথা।’

সালেহা বলে, ‘সমস্যা নাই আম্মা। প্রতিদিন তো আর ষাঁড় থাকে না। আর আমি লাল জামা না পিন্দা গেলেই তো হয়। লাল জামা দেইখাই তো ষাঁড় খেপছে।’ ছমিরন মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে, ‘তবু মা সাবধানে থাইকতে হয়। অন্য রাস্তা দিয়াই তুমি যাইবা।’ সালেহা মাথা নিচু করে বলে, ‘আইচ্ছা আম্মা।’ তারপর একটু থেমে বলে, ‘আম্মা কাইলকা তো স্কুল বন্ধ আছে, আমি আপনার লগে রাইন্ধুম। আপনি আমারে চুলার দুয়ারে না যাইতে দিলে কী হইব। আমি কিন্তু রান্নাবান্না সব জানি। আমি দেইখা দেইখা শিখা ফালাইছি। আমি আরও কিছু রান্ধাও জানি হেগুলা তুমি জান না! বড় জেঠুরা যহন ঢাকার থেইকা আইছিল। তাগো রসুইঘরে কাঁচা আম দিতে গিয়া দেখছি। কত মজার মজার রান্ধা রান্ধে। আমারে তুমি রান্ধতে দিবা?’

ছমিরন হেসে বলে, ‘ওরে বাবা তা কী কী রান্ধা শিখলি?’

সালেহা বলে, ‘আমি খুব সুন্দর কইরা ডিম ভাজা শিখছি।’ সালেহা হাতকে বিশেষ ভঙ্গি করে দেখায়, এই এমনে কইরা ডিম ভাইঙা পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ দিয়া গুইলা তেলের ওপরে ভাজে।

ছমিরন বলে, ‘ও আইচ্ছা। এইডা আমিও জানি। কাইলকা তাইলে ভাইজা দিমু।’ সালেহা বলে, ‘নাহ আমি নিজে ভাজমু।’ ছমিরন ভাত–তরকারি সব গুছিয়ে রাখতে রাখতে বলে, ‘আগে কাইলকা আসুক, তারপর দেখা যাইব।’

পরদিন সকাল সকাল চিড়ামুড়ি, গুড় দিয়ে খেয়েই সালেহা হাঁসের ডিম কুড়ানোর জন্য সেই টিলার মতো উঁচু জায়গার ঢালু অংশ যা জলের দিকে গেছে, সেখান গিয়ে ডিম খুঁজতে থাকে।

ছমিরন, গুড় দিয়ে মুড়ি নাশতার পাট চুকিয়ে রান্না বসিয়ে দেয়। তোরাব আলী গঞ্জের দিকে যায়। চাল, ডাল কিছু বাজার–সদাইয়ের জন্য। কালাম একা একা নিজের খেলনা দিয়ে খেলতে থাকে। ক্রমেই সময় যেতে থাকে। মায়ের রান্না শেষ হয়, গোসল করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, কালামকেও গোসল করাবে। সালেহা নিজেই করতে পারে। কিন্তু ধুন্দলের শুকনা খোলসের গায়ে সাবান লাগিয়ে সেটা দিয়ে মা গা ডলে দেয়, গোসল শেষ হলে আবার গা মুছে দেয়। বাকিটা সালেহা নিজেই করতে পারে।

নুর নাজমা
নুর নাজমা

ছমিরন নিজের সব কাপড়চোপড় নিয়ে, কালামের, সালেহার কাপড়চোপড় নিয়ে সালেহাকে ডাকতে থাকেন। কোনো জবাব আসে না। কালামকে জিজ্ঞেস করেন। কালাম বলে সে একাই সকাল থেকে খেলছে, বুবুকে একবারও দেখেনি।

ছমিরনের বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে। অজানা আশঙ্কা এসে ভর করে। কালামকে নিয়ে পুকুর থেকে শুরু করে বাড়ির পাশের ডোবা, ডাঙা, বাগান সবকিছুতে খোঁজে। দুপুর গড়িয়ে যায়, সালেহার কোনো খবর মিলে না, নাওয়া-খাওয়া সব ফেলে রেখে ছমিরন নামাজের বিছানায় দাঁড়িয়ে যায়। মেয়ের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকে।

তোরাব আলী বাজার নিয়ে বাড়ি ফেরে। সবকিছু শুনে আর স্থির থাকতে পারে না। পরিচিত কয়েকজনকে নিয়ে সব জায়গায় খোঁজে, শেষে উঁচু টিলার মতো জায়গায় মেয়ের স্যান্ডেল দেখতে পায়, আরও কিছু যাওয়ার পর মেয়ের ছেঁড়া কিছু চুল, আরেকটু যাওয়ার পর ফ্রক এরপর মেয়ের থেঁতলানো লাশ। পাথর বা ইটজাতীয় কিছু দিয়ে মুখে, মাথায় আঘাত করে থেঁতলে মেরেছে। তোরাব আলী মেয়ের লাশ কোলে নিয়ে ভেঙে পড়ে। হাতে একটু শক্তিও নেই, মুখের জবান বন্ধ। কাঁদতেও পারছে না। আল্লাহ কপালে এই কী রেখেছিল!

কারা যেন পুলিশকে খবর দিয়েছে, পুলিশ এসে ময়নাতদন্তের জন্য লাশ নিয়ে যায়।

ছমিরন খবর শুনেই মাথা ঘুরে পড়ে যায়। একবার জ্ঞান ফেরে তো আবার বিলাপ করতে করতে জ্ঞান হারায়। আবার জ্ঞান ফেরে, আবার জ্ঞান হারায়। তোরাব আলীকে কয়েকজন মিলে ঘরে নিয়ে আসে। তোরাব আলীর কোনো সাড়াশব্দ নেই। চোখ দিয়ে শুধু অশ্রুপাত হতে থাকে।

ময়নাতদন্তের পর মেডিকেল টেস্টের রিপোর্ট আসে। ধর্ষণ করে সালেহাকে মারা হয়েছে। পত্রপত্রিকায় এই খবর যায়। সাংবাদিকেরা বাড়িতে আসে। এই নিয়ে অনেক খবর ছাপা হয়। দেশজুড়ে মানববন্ধন হয়, ‘সালেহা হত্যার বিচার চাই’। কিন্তু আসামিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। কোনো আসামিই ধরা পড়ে না। কোনো আসামির নামও প্রকাশ করা হয় না।

গ্রামের কয়েকজন দেখেছে, এলাকার প্রভাবশালী চেয়ারম্যানের ছেলেকে কয়েকজনকে নিয়ে সেই উঁচু টিলার কাছে গিয়ে নেশা করতে। সেদিনও ওই ছেলেগুলা সেখানে গিয়েছিল। তোরাব আলী চেয়ারম্যানের ছেলের বিরুদ্ধে মামলা করে। তোরাব আলী নিজের স্ত্রীর কিছু গয়না বিক্রি করে, মামলা চালিয়ে যায়। কিন্তু এই মামলার কোনো সুরাহা হয় না। আসামিরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়। চেয়ারম্যানের সঙ্গে এমপির হাত আছে। মামলা সেখানেই থেমে যায়।

কয়েক মাস পর সবাই ভুলে যায়। মিছিল, মানববন্ধন সব শেষ হয়ে যায়। অন্য আরও সব খবরের ভিড়ে এই খবর আর কারও মনে থাকে না। শুধু ভুলতে পারে না, তোরাব আলী আর ছমিরন। কালামও মাঝে মাঝে কিছু করতে গেলে আগের কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলে সালেহার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তোরাব আলী আর ছমিরন সঙ্গে সঙ্গে নীরব হয়ে যান। নিজের অজান্তেই ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। কখনো কখনো ছমিরনের চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াতে থাকে। মাঝে মাঝে নিজে নিজেই সালেহার ছবি বের করে দেখে আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে।

তোরাব আলী নৌকা নিয়ে বের হয়, মাছ ধরতে। কালাম চুপটি মেরে নৌকায় বসে থাকে। শাপলা, শালুক তোলে। নিজে খুলে শাপলার ঢ্যাপ খায়। বাবাকে বলে, ‘আব্বা বুবু শাপলার ঢ্যাপ খুলে খুলে আমারে খাওয়াই তো। লগে আপনার মুখেও দিত। বুবু খুব ভালা আছিল, মাইনষের বুবুরা এত ভালা হয় না, তাই না বাজান!’

তোরাব আলী নৌকা চালানো বন্ধ করে দেয়। হাতে আর শক্তি পায় না, হাত যেন অবশ হয়ে যাচ্ছে। স্থির দৃষ্টিতে কালামের হাতে শাপলার ঢ্যাপের দিকে চেয়ে থাকে। চোখের কোণে দু–তিন ফোঁটা জলও চলে আসে।
...

নুর নাজমা : সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।