চিলিকা হ্রদ

চিলিকা হ্রদ
চিলিকা হ্রদ

ভারত উপমহাদেশের বৃহত্তম হ্রদ চিলিকার প্রান্তে সুচরিতরা এখন দাঁড়িয়ে। এই সেই হ্রদ, যার ইকোসিস্টেমের বায়োডাইভার্সিটি অজস্র চিন্তাশীলদের মনে বহু বছর ধরে জন্ম দিয়েছে গভীর বিস্ময়। যার কথা পাঠ করে কৈশোর থেকে নানা দৃশ্য ছবি বহ্নির কল্পনার আরশিতে প্রতিফলিত হয়েছে বারবার। যার অনন্য চরিত্র বিশ্বের পাঁচটি বৃহত্তম লেকের মধ্যে তাকে অসাধারণ মর্যাদার স্থায়িত্ব দিয়ে আকর্ষণ করেছে দূর ও কাছের লাখ লাখ দর্শক। সাগরকন্যাকে বাস্তবে প্রত্যক্ষ করেও ওদের মনে হলো, চিলিকাকে লেক না বলে সাগর বললেই মানায় ভালো।

সাগর–মহাসাগরের উচ্ছলিত চরিত্র, প্রবল শক্তিতে গড়িয়ে চলা ঢেউ, বাতাসের বেগ, অসীম বিস্তীর্ণতা সবই রয়েছে চিলিকার সত্তাজুড়ে। যত দূর দৃষ্টি চলে চোখে পড়ে, উদ্ধত সাগরের অনির্বাণ তেজ উৎসাহের সমারোহে তার অঙ্গে অঙ্গে বিকশিত। দুরন্ত বাতাসের দুর্দান্ত ডানা ঠেলে ভুজঙ্গের মতো তরঙ্গ নিয়ে কেবলই সে আলোড়িত হচ্ছে অবিরাম। চিলিকার জন্ম ইতিহাস যাঁরা জানেন, তাঁরা প্রত্যেকে অবগত সাগরের বাহুলগ্না চিলিকা চার হাজার থেকে ছয় হাজার বছর আগেও বঙ্গোপসাগরের অংশ ছিল। কালক্রমে পাথুরে বালু, নদী প্রবাহিত পলিমাটি, জীবজন্তুর ফসিল জমাট বেঁধে সাগর থেকে এক বিরাট অংশকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। মহানদী, দয়া, লুনা, ভার্গবিসহ ছোট–বড় বহু নদী-উপনদীর জলে পরিপুষ্ট হয়ে সেই অংশটিই ক্রমে পরিণত হয় বিশ্বখ্যাত চিলিকা হ্রদে। সাগরের স্বভাব আজও এই লেকের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে ইতিউতি উঁকি মেরে পুরোনো ইতিহাসের কথা তাই জানাতে চায়।

আজ বলরাম সঙ্গে নেই। তার বদলে লাজুক স্বভাবের সুরেশ বাঞ্জোরা। কাল সূর্যমন্দির থেকে ফেরার পথে বালিঘাই আশ্রমের স্বামীজি সুরেশের সঙ্গে ওদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। স্বামীজি ওদের পূর্বপরিচিত। বহ্নির অসাধারণ লেগেছিল আশ্রমের নিভৃত পরিবেশ। প্রথমেই অনুভব করেছিল আম, জাম, নারকেল, কাঁঠালসহ অসংখ্য গাছের জড়াজড়িতে নির্জনতার আশীর্বাদ ছড়িয়ে রয়েছে চারপাশে। শান্তির পরশে পাখিরা গান গাইছে সুমধুর স্বরে। ফিনফিনে বাতাসে মধুময় ফুলের গন্ধ। প্রণাম করতেই জিজ্ঞেস করেছিলেন, আজ এখানে থাকছ তো? না স্বামীজি, হোটেলে ফিরে যাচ্ছি। কাল চিলিকা হ্রদ দেখতে যাব। তাহলে সুরেশকে সঙ্গে নাও। বাইরে থেকে আশ্রমে যারাই আসে সুরেশ সবাইকেই আনা–নেওয়া করে। ওখানেও ওর জানাশোনা লোক রয়েছে, বলেই সুরেশকে ডেকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। পরে হোটেলের ঠিকানা নিয়ে বলেছিলেন, ও কাল তোমাদের হোটেল থেকে নিয়ে আসবে। চাইলে ওকে নিয়ে অন্য প্রোগ্রামেও তোমরা যেতে পারো। খুব বিশ্বস্ত।

চিলিকা হ্রদ
চিলিকা হ্রদ

পরদিন হোটেল গেটে যথাসময়ে উপস্থিত হলো সুরেশ। ম্যানেজার দীনকৃষ্ণ ছুটে এসে খবর দিল, স্যার, শম্ভু সাতসকালে ফোন করেছিল। ওর মায়ের খুব শরীর খারাপ, তাই আসতে পারছে না। শুনে বড় খারাপ লাগল। ওর খুব ইচ্ছে ছিল যাওয়ার। কী হয়েছে ওর মায়ের? টাইফয়েড। তাই ডাক্তার দেখাতে যাচ্ছে। কী আর করা। পরে আবার দেখা যাবে। সেই ভালো। সূর্যের তেজ প্রখর হয়ে এরই মধ্যে স্পর্শ করেছে পুরি শহরের শহুরে শরীর। কালকের মতো পথের অবারিত সৌন্দর্য আজও ওদের নজর কাড়ছিল। সেই সঙ্গে অভিজ্ঞ হচ্ছিল, সুরেশের মুখে পারিপার্শ্বিকতার সব রকম খুঁটিনাটি বর্ণনা শুনে। স্বভাবে শান্ত হলেও নীরব ছিল না সুরেশ। শুধু তার ভাব প্রকাশের ভঙ্গিটি ছিল নিস্তরঙ্গ নদীর মতো। আবেগের ওঠানামা একান্তই দৃশ্যহীন। ড্রাইভ করতে করতে বিশেষ একটি স্থানের দিকে হঠাৎ সে হাত নির্দেশ করল—দুই বছর আগেও এখানে ভয়ংকর বন্য জন্তুর দেখা মিলত, এখন নেই। বহ্নি আহত হয়ে প্রশ্ন করল, কেন? মেরে ফেলা হয়েছে? না, না। সব ভেগে পড়েছে আর কোথাও। বলেই সাদা দাঁতে এক ঝলক হাসল সুরেশ। সামনের আয়নায় তার নীরব হাসি নজরে পড়ল পলকের জন্য। পরক্ষণেই যোগ করল, আগে এই অঞ্চলজুড়ে বিশাল বন আর বড় বড় গাছ ছিল কিনা, তাই ওরা থাকতে পারত। এখন সেসব সাফ করা হয়েছে। তাই...! বহ্নি ব্যথিত হলো, সাফ করা হলো কেন? আজ্ঞে, এখানে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ আর কম্পিউটার একাডেমির জন্য দুটো কম্পাউন্ড তৈরি করা হবে শিগগিরই। ওই দেখুন সাইনবোর্ড বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসবের তো অনেক দরকার ম্যাডাম!

বহ্নি বুঝল, অরণ্য ধ্বংসের কারণ নিয়ে সুরেশের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে সহানুভূতি লাভের আশা নেই। সুচরিত চোখ বুজে বিশ্রামের চেষ্টা চালাচ্ছে। কাল রাতে হোটেলে ফিরে অনেক রাত পর্যন্ত অনেকগুলো ফোন সারতে হয়েছে বিভিন্ন জরুরি কাজের জন্য। আজ বিছানা ছেড়েছে ভোরের আগে। এখন তাই নিঃশব্দে ফ্রেশ হয়ে ওঠার পর্ব চলছে। ড্রাইভ করতে করতে কিছুক্ষণ পরেই অন্য প্রসঙ্গ তুলল সুরেশ, চিলিকা হ্রদে এর আগে কখনো এসেছেন ম্যাডাম? না। ওডিশায় এবারই প্রথম আসা। তাহলে নলবনের বার্ডস স্যাংচুয়ারিটা দেখবেন। বাইরে থেকে যাঁরাই আসেন ওখানে একটা ট্যুর তাঁদের থাকেই। অনেক পাখি দেখতে পাবেন ওখানে। হ্যাঁ, সেটা আমাদের তালিকাতে রয়েছে অবশ্য। কিন্তু এখানে এসে তো শুনলাম, মাইগ্র্যান্ট পাখিরা অক্টোবর থেকে আসতে শুরু করবে! তাহলে? মাইগ্র্যান্ট ছাড়াও স্থানীয় পাখি আছে। সাদা পেট সি ইগল, ব্রামনি কাইট, সারস, বক, ফ্লেমিংগো, নানা ধরনের মাছরাঙা সব সিজনেই থাকে। ওখানে অনেক মাছ কিনা, তাই।

দেখতে দেখতে শেষ হয়ে গেল চিলিকায় পৌঁছানোর দীর্ঘ পথ। ট্যাক্সি থেকে নেমে উঁচু পাড় ধরে সামনে এগিয়ে ওরা পা রাখল বালুগাঁয়ে। বালুগাঁও থেকে নৌকা ভাসিয়েই চিলিকা ভ্রমণ আর দর্শনের পালা শুরু হবে। হঠাৎ কাছে কোথাও অদ্ভুত পতপত শব্দে উঁচুতে তাকাতেই চোখে পড়ল অদূরে বাঁশের খুঁটিতে এক টুকরা সাদা কাপড় ফ্লাগের মতো করে বাঁধা। বাতাসের নিরন্তর ঘায়ে লটরপটর হয়ে সেই টুকরা কাপড় নিরুদ্দেশের যাত্রাপথে ছুটতে চেয়ে পতপত করে শব্দ তুলছে। প্রবল বাতাসে শুকনা বালুর ধুলা পাগলের মতো উড়ে উড়ে অস্পষ্ট করে দিচ্ছিল চারপাশ। তারই মধ্যে নিচে দৃষ্টি ফেলতে নজরে এল ইঞ্জিনচালিত নৌকার কাছে দাঁড়িয়ে কর্ণধারদের সঙ্গে সুরেশ কথা বলছে বিশদভাবে। চোখাচোখি হতেই ইশারায় নামতে বলল নিচে।

চিলিকার বুকে সবুজ বেষ্টনীতে ঢাকা একটি অসাধারণ স্থাপত্য
চিলিকার বুকে সবুজ বেষ্টনীতে ঢাকা একটি অসাধারণ স্থাপত্য

ঢালু পাড় ধরে খাঁজে খাঁজে পা রেখে নামতে গিয়ে ওরা বেসামাল হলো বারকয়েক। এবড়োখেবড়ো অসম ভূমিতে অনভ্যস্ত পা স্খলিত হলো। সুরেশ এই অপটুতার দৃশ্য দেখে হাসতে হাসতে এগিয়ে এল, হাত ধরব স্যার? সেই ভালো। এক এক করে ধরে নামাও। জবাবে সুরেশ মহা যত্নে তার কর্তব্য শেষ করল বহ্নিদের উঁচু নৌকায় তুলে দিয়ে। বহু দূরে আরও একবার নজর ছড়িয়ে আরেকবার শিউরে উঠল বহ্নি। অস্ফুটে বলল, জলে আমার বড় ভয়। একবার যদি পড়ে যাই...! সুরেশ হাসল, ভয় নেই ম্যাডাম। চিলিকায় অ্যাক্সিডেন্ট হয় না। এরা খুব ভালো মাঝি। বলেই মাঝিদের উদ্দেশে অবোধ্য ভাষায় কী কতগুলো নির্দেশ দিল কে জানে।

কথা শেষ হলে দুই কর্ণধারই হাসলেন পরম কৌতুকে। তারপর অবোধ্য ভাষাতেই কতগুলো নির্ভয় বাণীই হয়তো বা উচ্চারণ করলেন অভয় দেওয়ার জন্য। বহ্নি বুঝল ভাষা যা–ই হোক মর্মার্থ সম্ভবত একটাই, ভয় নেই গো মা জননী। আমরা রয়েছি কর্ণধার!

চিলিকার দেহে বিভিন্ন পারিপার্শ্বিকতা বিরাজ করায় তৈরি হয়েছে চার ধরনের ইকোসিস্টেম। জীবদেহের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী প্রাণীরা তাদের নির্দিষ্ট পরিবেশে বাস করে। হ্রদের কোথাও রয়েছে সাগরের মতো গভীরতা ও লবণাক্ততা। কোথাও মিষ্টি জল আর স্যালাইন ওয়াটারের আধাআধি সংমিশ্রণ। কোথাও মিশ্রণের অনুপাত অতি সামান্য। কোথাও আবার ৫২টি ছোট–বড় নদীর সঙ্গে সংযুক্তির মোহনায় অবিমিশ্র মিষ্টি জলের ঢেউ। তাই সাগরকন্যা চিলিকাকে সাউদার্ন, নর্দান, সেন্ট্রাল ও আউটার এই চারটি জোনে বিভক্ত করা হয়েছে পুঙ্খানুপুঙ্খ বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে।

কূলহীন হ্রদের জলে ইঞ্জিনচালিত নৌকা ভেসে চলেছে তাদের ছেলেবেলাকার কাগজ নৌকার মতো। ঢেউয়ের দোলায়, বাতাসের ঘায়ে মাঝেমধ্যে খোলামকুচির মতো নাচছে সে। সুচরিতদের মাথার ওপরে ছাদ থাকলেও চারপাশটা খোলা। চারপাশের বিরামবিহীন তরঙ্গ, অফুরন্ত জলরাশির দুর্দান্ত দস্যিপনার পুরোটাই চোখে পড়ছে তাই। বহ্নি একটি ছাদের স্তম্ভ সারাক্ষণই আঁকড়ে রয়েছে দেখে দুই বয়োবৃদ্ধ কর্ণধার ক্ষণে ক্ষণে অভয় বাণী শোনাতে শোনাতে স্নেহ বিগলিত হাসছেন। সহসা একজন সভয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন ব্যাকুলতর কণ্ঠে। একবার। দুবার। তারপর বারবার। ইঞ্জিনের কর্ণবিদারী শব্দ, ওডিশার আঞ্চলিক ভাষার দ্রুত উচ্চারণ বোধগম্যতার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় হয়ে উঠল। এবার আর বাক্যে নয়, অভিজ্ঞ মাঝিরা তাঁদের ইঙ্গিতে বোঝাতে আকুল হয়ে উঠলেন। সুচরিত চেঁচিয়ে উঠল, বহ্নি ওই দেখো জোয়ার আসছে জোরেশোরে। সরে বসো ওদিকে। দুজনে একদিকে বসলে নৌকা ডুববে বেসামাল হয়ে। জবাবে নরম ঘাসফুলের মতো উথালপাতাল করে বহ্নির হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠল একবার। তারপরেই ভয়ে সে কাঠ হয়ে গেল। এরপরে কখন জোয়ার জলে ফুলে উঠল হ্রদের বুক, কখন চিলিকার অন্তহীন হৃদয়তল উথালপাতাল হলো, উপলব্ধি করার অবসর মেলেনি তার। চেতনা ফিরতে দেখল বিষধর ফণিনীর মতো গর্জে ওঠা সাগরকন্যা নম্র হয়ে এসেছে দূরন্তব্যাপী। জেলেদের বিছিয়ে রাখা জালের কাছাকাছি দিয়ে নৌকা ভেসে চলেছে নির্ভয়ে। তিনটে কাক নৌকার গলুইয়ে কখন আশ্রয় নিয়েছে কে জানে। চোখে পড়তেই বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করল, কী আশ্চর্য! ওরা হঠাৎ কোথা থেকে এল? কোথায় ছিল এতক্ষণ? এর আগে তো উড়তে দেখিনি আকাশে? কী করে দেখবে? তুমি তো সারাক্ষণই ভয়ে কাঁটা হয়ে আছ!

চিলিকা হ্রদে ডলফিন
চিলিকা হ্রদে ডলফিন

ঠোঁট ফাঁক করে ঝিমোচ্ছে ওরা। মুখগহ্বরের লালচে গোলাপি জিবগুলো চোখে পড়ছে স্পষ্ট। খুব ক্লান্ত নিশ্চয়ই। কতক্ষণ উড়ে উড়ে এই আশ্রয়টুকু পেয়েছে কে জানে। কিন্তু কেন এসেছে ওরা? খাদ্যের সন্ধানে? নাকি এভাবেই সমুদ্রসমান চিলিকা হ্রদ পারাপার করে প্রতিদিন? বহ্নি নিশ্চিন্ত হয়ে চোখ রাখল চোখে। ভীতির পর্দা ছড়ানো নেই তিন জোড়া চোখের ছায়ায়। কয়েকটি বিস্কুট ভেঙে ছড়িয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গেই খেল না অবশ্য। শুধু চকিত চোখ মেলে প্রত্যেকে পরখ করল তাকে। তারপর সবাই গোগ্রাসে গিলে নিল সবটুকু। সরু ঠ্যাঙে লাফিয়ে লাফিয়ে কয়েক ইঞ্চি আরও কাছে সরে এল। বহ্নি ফের ছড়িয়ে দিল আরও বিস্কুটের টুকরা। এবার ছাদের ওপর থেকেও একসঙ্গে কয়েক জোড়া লাফিয়ে নামল। তারপর ওদের উপোসি শরীরে মহাভোজ, মহাসমারোহ শুরু করে দিল। বহ্নির ঠোঁটের কোলে হাসি দেখা দিল। অস্ফুটে বলল, ও মা! তোরাও বুঝি বালুগাঁও থেকেই সওয়ার হয়েছিস আমাদের মতো? বলেই গম্ভীর হয়ে গেল সে। মনে মনে বলল, হয়তো এমন অবিচল সংগ্রামের ভেতর দিয়েই অস্তিত্বের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে ওরা। প্রজ্ঞাবানেরাও তো বলেন, Life in this world is a great struggle!

মাঝিদের একজন তাদের উদ্দেশে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলছেন। সেটা চিলিকা হ্রদ্রের গল্প, নাকি অন্য কিছু কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না সুচরিতদের। কখনো উৎসাহের তোড়ে হাতখানা নেড়ে, কখনো পানের কষে ধরা কালোরঙা দাঁতের হাসিতে, কখনো দুই চোখের ঘূর্ণিতে, কখনো বা আবেগের ওঠানামা দিয়ে কথা বলছেন কর্ণধার। কিচ্ছুটি না বুঝেও ওরাও তারই মতো চোখ বড় করছে বিস্ময়ে। তার মাথা দুলুনির ছন্দে ছন্দে মাথা দোলাচ্ছে হেসে হেসে। গম্ভীরতায় সুগম্ভীর হচ্ছে। ওরা জানে, এমন আচরণ অসাধুর। কিন্তু সাদাসিধে মানুষটির পবিত্র আন্তরিকতাকে উপেক্ষা করতেও বড় খারাপ লাগছে সুচরিতদের। সহসা চিলিকার বুকে সবুজ বেষ্টনীতে ঢাকা একটি অসাধারণ স্থাপত্য নজর কাড়ল। প্রবীণ মাঝিরা প্রণাম শেষ করে বললেন, প্রণাম করো! প্রণাম করো! বহ্নি এত সময় পরে স্বস্তি নিয়ে প্রশ্ন করল, কালিজাই? কর্ণধার আকর্ণ হেসে মুখর হলেন। বহ্নি মনে মনে ধন্যবাদ জানাল সুরেশকে, ভাগ্যিস সুরেশ পথে জানিয়েছিল, ওই মন্দিরেই রয়েছেন জেলেদের সৌভাগ্যের দেবী কালিজাই! কালিজাইকে দর্শন না করে কোনো জেলেই সমুদ্র কিংবা চিলিকায় যাত্রা করেন না। তাতেই তো কর্ণধারের আবেগে এবার সাড়া দিতে পারল তারা।

প্রণাম শেষ করে চোখ খুলেতেই এক অপ্রত্যাশিত দৃশ্যের দিকে নির্দেশ করে হাত তুললেন কর্ণধার। নৃত্যের ভঙ্গিমায় কয়েকটি প্রফুল্ল ডলফিন মেতে উঠেছে আপন সহজাত খেলায়। শরীর ঘুরিয়ে, মাথা নিচু করে, জলের ওপরে লেজে ভর রেখে, লাটিমের মতো ঘুরতে ঘুরতে, পরস্পরের দিকে মুখের জল ছুড়তে ছুড়তে তারা মেতে উঠেছে নয়নাভিরাম কৌতুকে। খেলা কখন শেষ হবে কে জানে। আকাশের অন্তরজুড়ে আবারও সূর্য ডোবা–ভাসার খেলা খেলছে। প্রবীণ মাঝিরা ততক্ষণে নৌকা ঘুরিয়েছেন অচেনা বাঁকের মুখে। (চলবে)

ধারাবাহিক এ ভ্রমণকাহিনির আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন : কোনার্ক সূর্যমন্দির