চিলিকার প্রাণিজগৎ

চিলিকার প্রাণিজগৎ
চিলিকার প্রাণিজগৎ

চিলিকার জীবন চক্র গড়ে উঠেছে লেকের প্রাণীদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভর করে। কারণ, এর একদিকে নিরবধি সংযোগ রয়েছে অর্ধশতাধিক নদনদীর, অন্যদিকে সংযোগ রয়েছে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে। চার থেকে ছয় হাজার বছর আগে সাগর থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও দৈর্ঘ্যে ৩৫ এবং প্রস্থে ১ দশমিক ৫ কিলোমিটার নাড়ির যোগ এখনো রয়েছে চিলিকার। তাই সাগরের নোনাজল, নদীর মিষ্টিজল আর দুই জলের মিশ্রণের অনুপাতের ওপর নির্ভর করেই তৈরি হয়েছে হ্রদের পরিবেশ। জিয়ো বায়োলজিক্যাল গবেষণায় সেটা প্রমাণিত। সাগর ও নদী সংযুক্ত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম চিলিকা তার অসাধারণ ইকোসিস্টেমের কারণেই ক্রমাগত দর্শকদের সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছে পৃথিবীজুড়ে। বছরে এখানে ট্যুরিস্টের সংখ্যা আড়াই লাখের বেশি। এঁদের সবাই সাধারণ মানের ট্যুরিস্ট নন। অনেকেই পরিদর্শন করতে আসেন ভিন্ন ভিন্ন অভিপ্রায় থেকে। ট্যুরিস্টদের তালিকায় জীববিজ্ঞানী, ভূতত্ত্ববিদেরা যেমন রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন দার্শনিক, সাহিত্যিক। The Wetland International and Asian Wetland Bureau চিলিকাকে দর্শনীয় স্থানের তালিকাভুক্ত করার পর এর মর্যাদা আরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে আন্তর্জাতিক ট্যুরিজমের ক্ষেত্রে। তাই চিলিকার ট্যুরিজম ও প্রাণিসম্পদ ওডিশা সরকারের নির্দিষ্ট আয়ের উৎস। এ ছাড়া হ্রদের স্থলজ ও জলজ সম্পদের ওপর নির্ভরশীল এখানকার জেলে সম্প্রদায়, চিলিকার তীরবর্তী ১২২টি গ্রাম এবং আশপাশের আটটি শহরের নাগরিক।

চিলিকার প্রাণিজগৎ
চিলিকার প্রাণিজগৎ

রোদঝলমল আলো নিভে মেঘ সূর্যের খেলা কিছুক্ষণ আগেই শুরু হয়েছিল আচমকা। দেখতে দেখতে বহ্নিদের মনে পড়ছিল বলরামের কথা। সে বলেছিল, এখানকার প্রকৃতি বড় খেয়ালি। মাঝে মাঝেই মুডি হয়ে ওঠে। বলরাম যথার্থ বলেছিল, ক্ষণে ক্ষণে আকাশের স্বভাব বদলের নিশানা থেকেই স্পষ্ট হচ্ছিল সেটা। জেলেদের জাল পেছনে ফেলে বৃহৎ জলচর পাখি হয়ে নৌকা এগিয়ে চলেছে প্রসারিত জলরাশি কেটে কেটে। খানিকটা সামনে এগোতেই চোখে পড়ল, জলের চেহারা বদলে গেছে হঠাৎ। নীলাভ সবুজ থেকে তার রং এখন হালকা গৈরিক। সওয়ারি কাকগুলো এখনো ছাদে বসে রয়েছে কিনা কে জানে। বহু সময় হলো দৃষ্টির বাইরে অদর্শনে রয়েছে তারা। উড়ে গেল নাকি আর কোথাও? কোথায়ই বা উড়বে এমন অফুরন্ত জলরাশির বুকে? সুচরিত বহু সময় নিঃশব্দ থেকে টুকরো টুকরো কথা বলতে শুরু করেছে, নলবন থেকে ফিরতে বিকেল চারটা বেজে যাবে মনে হচ্ছে। এর তো কোনো কূলকিনারাই চোখে পড়ছে না। লাঞ্চ কখন হবে কে জানে! সুরেশ সঙ্গে থাকলে ভালো হতো। কী করত এসে? এসব ওরা অনেক দেখেছে। বহ্নি মন্তব্য শোনাল। সে জন্য নয়। ওর সঙ্গে কথা বলে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যেত। এদের জিজ্ঞেস করে তো কিছুই জানা যাবে না। না পারছি নিজে বুঝতে, না পারছি বোঝাতে। হ্যাঁ তা ঠিক।

চিলিকার প্রাণিজগৎ
চিলিকার প্রাণিজগৎ

এরপর ২০ মিনিটের মধ্যে এক জল ছুঁইছুঁই ছোট্ট দ্বীপের কোলে এসে নৌকো ভিড়ল। সেখানে লাল বেলে মাটির আস্তরণ জলের নিচ থেকে অস্তিত্বের জানান দিচ্ছিল। মানুষের সাড়া পেয়ে মুহূর্তে অনেকগুলো ছোট–বড় সবুজ কচ্ছপ ঝুপঝাপ লাফিয়ে পড়ল গৈরিক জলে। অদৃশ্য হয়ে গেল পলকে। সহসা পালিয়ে যাওয়া জীবগুলোর চেয়েও বেশি দ্রুততার সঙ্গে মাথায় বড়সড় সাঁজি নিয়ে কোথা থেকে ছুটে এল তিন বয়সের তিন মানুষ। এসেই মুহূর্তের মধ্যে নৌকায় চড়ে বসল। বহ্নি অনিঃশেষ বিস্ময়ে তাকাল। অসম্ভব বিস্মিত সুচরিতও, আশপাশে জল ছাড়া আর তো কিছুই চোখে পড়ছে না। এদের এই অলৌকিক আবির্ভাব কী করে ঘটল বলো তো? আমিও সেটাই ভাবছি। কালো দাঁতে হাসি ফোটালেন প্রবীণ কর্ণধার। ঝমঝমিয়ে একনাগাড়ে অনেকগুলো শব্দ উচ্চারণ করে ফের মধুময় হেসে তাকালেন সুচরিতের মুখে। লোকগুলো পসরা নামিয়ে বিদ্যুৎবেগে হাতুড়ি দিয়ে ঝিনুক ভাঙতে শুরু করেছিল। ততক্ষণে পুরো ব্যাপারটা পরিচ্ছন্ন। এদের সঙ্গে মাঝিদের ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে টাকার ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে। খরিদ্দার পৌঁছে দেওয়া যেমন মাঝিদের দায়িত্ব, তেমনি ওদের কাজ মণিমুক্তো বিক্রি করা। ক্ষিপ্রগতিতে অভ্যস্ত হাতে ১০–১৫টি জ্যান্ত ঝিনুক ভেঙে ফেলতেই ব্যথা পেয়ে বাধা দিল বহ্নি, এদের শুধু শুধু কেন মেরে ফেলছ এভাবে? অল্প বয়সের মানুষটা ঝিনুকের পিচ্ছিল দেহ ঘেঁটে ঝলমলে নিটোল মুক্তো টেনে বের করতে করতে হিন্দি-উড়িয়া, বাংলা মিশিয়ে হেসে বলল, আজ্ঞে, এসব জেমস তো এদের মধ্যেই জন্মায় ম্যাডাম! না ভাঙলে বের করি কী করে? বারবার বারণ সত্ত্বেও চোখের পলকে আরও কতগুলো ভাঙতে ভাঙতে দুটোর পেট থেকে জেড আর মুনস্টোন খসিয়ে প্রসন্নচিত্তে সে হৃদয়জয়ী হাসল।

চুনি, পান্না, হিরে, পোখরাজ
চুনি, পান্না, হিরে, পোখরাজ

বহ্নি গম্ভীর মুখে বলল, না, আর মারবে না! মারছি না। ওরা মরবে না ম্যাডাম। জলে ফেলে দিলেই ফের জ্যান্ত হবে। না হবে না। তা ছাড়া জেড আর মুনস্টোন কখনো ঝিনুকের পেটে জন্মায়? বহ্নির কণ্ঠস্বরের উষ্ণতায় কাজ থামিয়ে লোকটি পলকহীন তাকাল তার মুখে। হাতের চেটোয় নমনীয়ভাবে কপালের ঘাম মুছে নীরব হয়ে রইল মুহূর্তের জন্য। তারপর অসহায় চেহারায় শান্ত গলায় বলল, এভাবে ভেঙে ভেঙে না দেখালে লোকে যে বিশ্বাসই করতে চায় না। এগুলো মেকি নয় ম্যাডাম। এই বেঁচেই তো সংসার চলে। বিক্রি না হলে খাব কী? কিন্তু যে পদ্ধতিতে খাঁটি বলে প্রমাণ করতে চাইছ তাতে অনেকের মনে এর খাঁটিত্ব নিয়ে অবিশ্বাস তৈরি হবে। কেন ম্যাডাম? সবাই তো এভাবে দেখালেই বিশ্বাস করে দেখেছি। যারা করার তারা করে। যারা জানে তারা করবে না। কারণ চুনি, পান্না, হিরে, পোখরাজ কোনো দিনই শামুক ঝিনুকের পেটে জন্মায় না। ঠিক ম্যাডাম! এসব খনির শ্রমিকদের কাছ থেকেই কিনে আনি। তাহলে? অবিশ্বাসীর বিশ্বাস অর্জনের জন্য কেন শত শত অসহায় জীব মেরে ফেলছ প্রতিদিন? কষ্ট হয় না তোমাদের? লোকটির ম্লান মুখের ওপর কষ্টের ঢেউ গড়িয়ে পড়ল—তার চেয়ে বেশি কষ্ট হয় যখন ছেলেমেয়েদের মুখে দিনের পরে দিন খাবার তুলে দিতে পারি না। সুচরিত মাঝখানে এসে দাঁড়াল এবার, অসহায় মানুষগুলোকে এসব কথা বলে কী লাভ বহ্নি? যা কিনতে চাও, কিনে নাও। শিক্ষিত মানুষেরই হুঁশ নেই তো ওদের কী করে হবে?

বহ্নি আত্মস্থ হলো এতক্ষণে। সত্যিই তো, বেঁচে থাকার দুর্নিবার সংগ্রামে জীবন যাদের নিত্যদিনই অস্থির, অন্তরের খুঁটিনাটি উপলব্ধি নিয়ে উতলা হওয়ার সুযোগ কোথায় তাদের? কেনাকাটা শেষ হতে লোক তিনটি নেমে গেল নৌকা থেকে। জল ছপ ছপ দ্বীপের বুকে হাঁটতে হাঁটতে বহু দূরে সরে যেতে যেতে ছোট হয়ে গেল একসময়। সুচরিত বলল, ওরা হয়তো নৌকায় চড়ে এসেছিল। ওই দেখো, দূরে যে কালো জিনিসের মতো একটা কিছু ভাসছে, ওটা নিশ্চয়ই নৌকা হবে। কত কষ্ট ওদের জীবনে বলো তো? শুধু শুধু কষ্ট দিয়ে কথা বললে। প্রয়োজন ছিল। এরপর অকারণে হাজার হাজার শামুক–ঝিনুকের প্রাণ ওরা নষ্ট করবে না।

কর্ণধারেরা নলবন অভিমুখে যাত্রা করেছেন জানিয়ে দিলেন একটি শব্দ বার দুয়েক উচ্চারণ করে। বললেন, নলবন, নলবন। বলেই ধু ধু প্রসারিত জলের দিকটা দেখিয়ে নিশ্চিন্ত করতে চাইলেন ওদের। বহ্নি এবার কৌতূহলী হলো, আচ্ছা কাকগুলো কোথায় গেল বলো তো? সে তো কখন উড়ে গেছে! উড়ে গেছে? কোথায়? আমাদের পাশ দিয়ে দিয়ে ঘণ্টাখানেক আগে যে বিশাল নৌকাটা চলে গেল, তার ছাদে। যে নৌকায় বসে একটা ছেলে ছবি তুলছিল, মনে নেই? হ্যাঁ, হ্যাঁ! তার মানে কাকগুলো আবার বালুগাঁয়েই ফিরে গেল? ওরা তো ওখান থেকেই উঠেছিল নৌকোয়! বাব্বা, কী বুদ্ধি দেখেছ! এতে বিস্ময়ের কী আছে? বুদ্ধি জিনিসটা প্রত্যেক জীবেরই প্রয়োজনমাফিক সহজাত, বহ্নি।

নলবন চিলিকার উত্তর–দক্ষিণ সীমানার মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থিত। বহুদূর থেকেও নজরে পড়ল সেখানে পৌঁছানোর পথটুকুতে অকূল দরিয়া অশ্রান্ত উত্তেজনায় দিগন্তব্যাপী প্রমত্ত হয়েছে। দেখেই ভয়ে শিহরিত হলো বহ্নি, কেন যে মরতে এসেছিলাম। ভালোয় ভালোয় বালুগাঁয়ে ফিরতে পারলে বাঁচি। ওখানে গভীরতা কেমন কে জানে। মনে হচ্ছে যেন মহাসাগর। ওদের জিজ্ঞেস করো না। জিজ্ঞেস করলেই বা উত্তর দিচ্ছে কে? ইশারায় চেষ্টা করে দেখো। ভাগ্য সুপ্রসন্ন। যদিও সুচরিতের প্রশ্নের উত্তর মিলল না, তবে তরণী ধর হাবেভাবে বোঝাতে চাইলেন, ভয় নেই! কিচ্ছু হবে না! সাগরের সঙ্গে কানেকশন বলেই চিলিকার এমন ভয়ংকরী রূপ। মনে পড়ল বালিঘাইয়ের স্বামীজি বলেছিলেন বটে, সাগরের জলেই চিলিকার জীবন সঞ্চারণ হয়। বলতে পারো, বে অব বেঙ্গল হচ্ছে চিলিকার লাইফ ব্লাড।

অভিজ্ঞ মাঝির কথায় কিছুটা স্বস্তি ফিরল মনে। তাতে উপভোগের সীমানাও ছড়িয়ে গেল বিস্তীর্ণ চিলিকার স্তরে স্তরে। নলবন পৌঁছে ওরা জানল, সাগরকন্যা চিলিকা বহু রকম জীবের আশ্রয়দাত্রী। ওখানকার তথ্য বিভাগের কর্মকর্তাও জানালেন, চিলিকায় চার ধরনের কুমির, চব্বিশ প্রজাতির ম্যামালস (কয়েকটি বিরল জাতের ডলফিনসহ), সাঁইত্রিশ রকম রেপটাইল ও উভচর, ইলিশসহ এক শ আটান্ন জাতের মাছ, পঁয়ত্রিশ রকম কাঁকড়া, আটাশ ধরনের চিংড়ি, সবুজ রং সামুদ্রিক কচ্ছপসহ রয়েছে হাজার ধরনের জলজ কীট। ম্যানগ্রোভ ছাড়াও রয়েছে সাত শ ছাব্বিশ রকমের ফুলের গাছ, পাঁচ ধরনের স্থলজ ও জলজ ঘাস। ডাঙার প্রাণীদের মধ্যে লিম্বলেস লিজার্ড, ডাগং, মাছখেকো বিড়াল আর দুই শ জাতের স্থানীয় পাখি। এ ছাড়া শীত ঋতুতে নলবন হয়ে ওঠে যাযাবর পাখিদের সবচেয়ে অনুকূল ব্রিডিং গ্রাউন্ড। তাই ১৯৭২ সালের বন্য প্রাণী প্রোটেকশন অ্যাক্ট অনুযায়ী ভারত সরকার ১৯৮৭ সালে নলবনকে পাখিদের অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে।

ঘুরে ঘুরে চারপাশটা দেখছিল ওরা। এখনো চারপাশে প্রসারিত জলের ঢেউ বাহু তুলে ঊর্ধ্বগামী। ভেজা বালুর বিছানাজুড়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে লাল কাঁকড়ার ঝাঁক। সামনের হাত দিয়ে অবিরাম মুখে পুরছে মুঠো মুঠো কাদাবালু। সেটা এত দ্রুততার সঙ্গে যে ভেবে বিস্ময় লাগে কী অসম্ভব উপায়েই না ক্ষুদ্র প্রাণীগুলো তাদের খাদ্যভান্ডার ঠেসে দিচ্ছে পাকস্থলীতে। আরও দূরে নলবনের দেহ ছুঁয়ে পা ডোবানো শীর্ণ জলে বিবর্ণ শেওলা ধরা জলজ ঘাস। ভরহীন শরীর নিয়ে সরু সুতোর ঠাস বুনুনিতে জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে সর্বত্র। সেখানে দীর্ঘ পা, ধূসর দেহ ছোট ছোট পাখিদের ভিড়। সিরিঞ্জের মতো লম্বা ঠোঁটে ছিঁড়ে খাচ্ছে ঘাসের সুতো, জলজ কীট কিংবা চুনো মাছ।

চুনি, পান্না, হিরে, পোখরাজ
চুনি, পান্না, হিরে, পোখরাজ

সুচরিতদের পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দর্শন করছেন এক প্রবীণ ভদ্রলোক। মাথার চুলে সাদা মেঘের শুভ্র পরশ। মুখের ওপর গভীর চিন্তার ভাঁজ। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে উৎসারিত, অভিজ্ঞানের উত্তাল জোয়ার। হঠাৎ স্পষ্ট বাংলায় মুখ খুললেন সুচরিতকে উদ্দেশ করে, প্রথম এলেন এখানে? সুচরিত মাথা ঝাঁকাল দুপাশে। ফেরার সময় সাগর আর লেকের সঙ্গম স্থানটা দেখে যাবেন। চমৎকার! আমি যখনই যাই বাইনোকুলার দিয়ে দেখি। বাপরে, কী তেজ। মাঝে মাঝেই আসেন? হ্যাঁ, চিলিকা আমার গবেষণার বিষয়। সব ঋতুতেই তাই আসতে হয়। অনেক বছর ধরেই দেখছি, ডিসেম্বর থেকে মধ্য মার্চের মধ্যে অনেকটা জায়গা শুকিয়ে যায়। আয়তনটাও ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। লম্বা লম্বা সবুজ ঘাসে ভরে যায় তখন। আশপাশের গরু–মোষরা চরে বেড়ায়। বর্ষা মৌসুমে অবশ্য পুরো নলবনই তলিয়ে যায়। জেগে থাকে কেবল ওয়াচ টাওয়ারটা, বলেই হাত দিয়ে টাওয়ারটাকে দেখালেন ভদ্রলোক। মাইগ্র্যান্ট পাখিরা কত দিন থাকে? সেপ্টেম্বরের লাস্ট উইক থেকে ফেব্রুয়ারি ওদের ব্রিডিং টাইম। বেশির ভাগ পাখি অবশ্য অক্টোবরের প্রথম দিকে আসে। তবে রাশিয়ার খুব রিমোট এরিয়ার পাখিরা চলে আসে সেপ্টেম্বরে। কোন কোন জায়গা থেকে আসে ওরা? বৈকাল হ্রদ, আরব সাগর, কাস্পিয়ান সাগর, মঙ্গোলিয়া, রাশিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চল, লাদাখ, হিমালয়, মধ্য এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া থেকে। সামান্যসংখ্যক ইউরোপ থেকেও আসে। বারো তেরো হাজার মাইল পেরিয়ে আসে ওরা। এশিয়া মহাদেশের মধ্যে নলবনই তাই যাযাবর পাখিদের মিলনক্ষেত্র হিসেবে এখনো অবধি পৃথিবীখ্যাত। দ্বীপের আয়তন কত? আপাতত ১৫৫৩ হেক্টর। তবে যে হারে চর পড়তে শুরু করেছে তাতে সাইজ দ্রুত বাড়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। লেকের ইকোসিস্টেমও ভীষণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। মানুষের অতি ভিড়, অতি ফিশিং, অতি চলাচলের কারণে। তাহলে এখানকার ম্যানেজমেন্ট গ্রুপ...। পদক্ষেপ নিচ্ছে না। সেটাই তো মুশকিল!

সহসা ডান পাশে উত্তাল জলরাশির দিকে দৃষ্টি পড়ায় এক অসাধারণ দৃশ্যচিত্র চোখে পড়ল। সেখানে চারপাশে বাঁশ পুঁতে জল থেকে কয়েক ইঞ্চি ওপরে জেলেরা জাল ঝুলিয়ে রেখেছে এমনভাবে, যাতে তাদের ত্রিভুজাকৃতি ঝুড়ি বলে মনে হয়। যত রাজ্যের ডলফিনের ভিড় তার চারপাশে। উৎফুল্ল ডলফিন ডিগবাজি খেতে খেতে ঝাঁকে ঝাঁকে লাফিয়ে উঠছিল শূন্যে। ঝাঁপ দিয়ে হারিয়ে যাচ্ছিল পরক্ষণে জলের নিচে। গভীরতা সম্ভবত ছয় সাত ফুটের বেশি নয় সেখানে। হঠাৎ ডলফিনদের তাড়া খেয়ে বড় সাইজের দুটো মাছ উঁচুতে লাফিয়ে উঠে জালের ঝুড়িতে ঝাঁপিয়ে পড়ল ভয় পেয়ে। আর সঙ্গে সঙ্গে উড়ে এল সাদা বুক বিশাল আকারের গর্জিয়াস দুটি ইগল। কিন্তু মাছ তোলার চেষ্টা না করে তারা বসে রইল জালের দড়িতেই। সঙ্গের ভদ্রলোক বহ্নিদের মতোই দেখছিলেন সেই দৃশ্য। হেসে জিজ্ঞেস করলেন, কী ভাবছেন? মাছ কেন তুলছে না? বহ্নি বিস্ময় নিয়ে বলল, হ্যাঁ, কেন তুলছে না? কারণ ওরা মানুষের চেয়ে বুদ্ধিমান। মানুষের লোভ সীমার ধার ধারে না। ওরা ধারে। ওরা জানে, ওখান থেকে শিকার তুলতে গেলে নিজেরাই শিকার হয়ে যাবে। তাহলে ওখানে মাছ দেখেই ছুটে এল কেন? সহজাত ধর্ম। যা হৃদয়বোধের সঙ্গে জড়িত, বুদ্ধির সঙ্গে নয়। একটা জিনিস জানেন তো? ঈশ্বরের সৃষ্টিতে আগে অন্তর পরে মগজ! বলেই গবেষক হেসে উঠলেন হা, হা, করে।

বিদায়ের আগে দুই পক্ষেরই পরিচয় সমাপ্ত হলো চমৎকার সম্পর্ক সৃষ্টির ভেতর দিয়ে। গবেষক পকেট থেকে কার্ড বের করে ধরিয়ে দিতে দিতে বললেন, এরপর এলে ফোন করতে ভুলবেন না। বাড়িতে আসার আগাম নিমন্ত্রণ জানিয়ে রাখলাম। খুব ভালো লাগল পরিচিত হয়ে। সুচরিত মৃদু হাসল, ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে যখন আমেরিকায় যেতেই হয়, তখন আমাদের বাড়িতেও আসতে হবে ডক্টর চাউলিয়া। আপনি বাঙালি নন, কথা শুনে একবারও মনে হয়নি কিন্তু। গবেষক স্বভাবসুলভ দিলখোলা হাসি শেষ মুহূর্তেও হাসলেন, ওই যে বললাম, বাবার চাকরির সুবাদে কলকাতায় তিন বছর বয়স থেকে আঠারো বছর কাটিয়েছি। তা ছাড়া আমাদের জিওলজির প্রফেসর ড. মৃন্ময় স্যান্যাল, আমার বন্ধু। এ ভাষার চর্চা তাই অব্যাহতই আছে। তাই আপনাদের কথা শুনে যেচে আলাপ করার লোভটা সামলাতে পারিনি। বলে চাউলিয়া আবারও উচ্ছল হাসলেন।

বহ্নিদের মোটর বোট বালুগাঁওয়ের কাছাকাছি প্রায়। চাউলিয়া মাঝিদের ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যেন লেক আর সাগরের সঙ্গমস্থানটা তারা ওদের দেখিয়ে আনেন। কিন্তু চিলিকার বুকে ভাসার পর ভয়ের স্রোত আবারও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বহ্নির মগজজুড়ে। সঙ্গমের কাছাকাছি গিয়ে তেজ দর্শনের সাহস নেই আর। কর্ণধারেরা দূর থেকেই হাত দিয়ে সেই ভয়ংকর রূপের অপরূপ তেজোরাশি সাক্ষাৎ করালেন সুচরিতদের। ভীত বিস্ময়ের আলোড়নে দূর থেকেও ওরা দেখল, দুর্দান্ত সাগরের বিচ্ছেদ বেদনা তীব্র আলোড়নের উন্মত্ততায় আলিঙ্গন করতে চাইছে তার বিচ্ছিন্ন অঙ্গ চিলিকা হ্রদকে। সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে কৃতজ্ঞচিত্তের প্রণতি জানিয়ে বহ্নি বিগলিত হয়ে বলল, কেবল তোমার পক্ষেই সম্ভব প্রভু, এমন ভয়ংকর রূপের উচ্ছ্বাস দিয়েও এত অসাধারণ কবিতা রচনা করা! (চলবে)

ধারাবাহিক এ ভ্রমণকাহিনির আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন