বিশ্বজয়ী বাংলাদেশ

ত্রিদেশীয় সিরিজের শিরোপা নিয়ে বাংলাদেশ দল। ছবি: টুইটার
ত্রিদেশীয় সিরিজের শিরোপা নিয়ে বাংলাদেশ দল। ছবি: টুইটার

মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বাংলাদেশ আর কেনিয়ার মধ্যে আইসিসি ট্রফির ফাইনাল। ১৯৯৭ সালের ১৩ এপ্রিল। মালয়েশিয়া থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ মনে মনে একটা জয়ের অপেক্ষার প্রহর গুনছে। টেলিভিশনের চল তখনো সেভাবে গ্রাম–বাংলাতে শুরু হয়নি। তাই গ্রামের উৎসাহী মানুষ বসে গেছে রেডিওর সামনে। ধারাভাষ্যকারের কণ্ঠ যেন তখন বাংলাদেশের কণ্ঠ। প্রত্যেকটা বল থেকে শুরু করে প্রত্যেকটা উইকেট পড়া সবকিছুই তাঁর কণ্ঠের মাধ্যমে পৌঁছে যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রতিটি কোনায় কোনায়।

কুষ্টিয়ায় আমাদের পাড়ার আলী হোসেনের মুদি দোকানের রেডিওটা নিয়ে আমরা বসে গেছি পাড়ার তেমাথায়। সেখানে জড়ো হয়েছেন অনেক মানুষ। এমনকি যাঁরা রাস্তা দিয়ে চলাচল করছেন, তাঁরাও থেমে জিজ্ঞেস করছেন খেলার কী অবস্থা। আগের ম্যাচে জিতে বাংলাদেশ ওয়ানডে ক্রিকেট খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে। তাই ওই ম্যাচটা বাড়তি চাপ তৈরি করেনি। কিন্তু ক্রিকেট এমনই অনিশ্চয়তার খেলা, যেকোনো সময় যেকোনো দিকে মোড় নিতে পারে। ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারণের জন্য শেষ বলে এসে বাংলাদেশের এক রান দরকার। অনেক নাটকীয়তার পর যখন শেষ বলে হাসিবুল হোসেন শান্ত দৌড় শুরু করেছেন, তখন বাংলাদেশের মানুষ যাঁরা টেলিভিশনে খেলা দেখছিলেন বা রেডিওতে ধারাভাষ্য শুনছিলেন তাঁদের সবার হৃদয়ের কম্পন অণু সেকেন্ডের জন্য হলেও থমকে গিয়েছিল। এরপরই ধারাভাষ্যকারের কণ্ঠে শোনা গেল, ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর’!

তারপর থেকে শুরু হয়ে গেল বাংলাদেশে ক্রিকেটের অগ্রযাত্রা। বাংলাদেশের পথেঘাটে, মাঠে–প্রান্তরে ফুটবল খেলার চল ছিল। কিন্তু এরপর থেকে ফুটবলের পাশাপাশি শুরু হয়ে গেল ক্রিকেট খেলার চল। শুরুতে ক্রিকেট খেলার হিসাব–নিকাশ একটু কঠিন লাগলেও আমরা দ্রুতই শিখে ফেললাম সেটা। আগে লোকের জাম্বুরা গাছ থেকে বড় বড় জাম্বুরা কুড়িয়ে এনে বা কাগজ দলা করে বেঁধে আমরা ফুটবল বানিয়ে খেলে বেড়াতাম। এরপর আমরা অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের জাম্বুরাগুলো কুড়িয়ে আনা শুরু করলাম। আর নারকেলগাছের শাখা কুষ্টিয়ার ভাষায় বাগু কেটে আমরা একটা ব্যাট বানিয়ে ফেলতাম। আর স্ট্যাম্প বানানো হতো কোনো একটা গাছকে। এভাবেই শুরু হয়ে গেল ক্রিকেটে আমাদের হাতেখড়ি। আমাদের নিয়মিত ক্রিকেট চর্চা চলত আমাদের বাড়ির পেছনের জায়গাটাতে। সেখানে আম, কাঁঠাল, বেল থেকে শুরু করে বাঁশের ঝাড় পর্যন্ত ছিল। আমাদের পশ্চিম পাশের বাড়ি আলামিন ভাইদের আর পূর্ব পাশের বাড়ি সালামদের। এই তিন বাড়ির পেছনের জায়গাটা ছিল ফাঁকা। এই জায়গাটুকুই ছিল আমাদের ক্রিকেট খেলার মাঠ। একটা কাঁঠালগাছের ডাল কেটে আমরা স্ট্যাম্প বানিয়ে নিয়েছিলাম আর বল ছিল কারও গাছ থেকে কুড়িয়ে আনা জাম্বুরা।

আমাদের ক্রিকেট টিমটা ছিল অসাধারণ। সেখানে একেবারে দুধের বাচ্চা থেকে শুরু করে আমার মতো তরুণ যুবাও ছিল। বেশির ভাগ সময়ই আমরা দাগ কেটে নম্বর দিয়ে আমাদের কে কখন ব্যাট করতে নামবে সেটা নির্ধারণ করতাম। মাটিতে নম্বর দিয়ে সেই নম্বরগুলো থেকে একেকটা দাগ একটু দূর পর্যন্ত টেনে দেওয়া হতো। তারপর সেই নম্বরগুলোকে ব্যাট দিয়ে ঢেকে দিয়ে বাকি সবাইকে ডাকলে তারা এসে একেকটা দাগে আঙুল রাখত। তারপর ব্যাট উল্টে নম্বর দেখে যার যার ব্যাটিংয়ের পজিশন নির্ধারণ করা হতো। আর খেলা শুরু হয়ে যাওয়ার পর যদি কেউ আসত তাহলে তাকে শেষের দিকে যোগ করে নেওয়া হতো। প্রত্যেকের জন্য নির্ধারিত ছিল দুই ওভার বোলিং। এর মধ্যেই ব্যাটসম্যান আউট হয়ে গেলে বা আউট না হলে দুই ওভার শেষে তার অবসর। দুই ওভারে যে যত বেশি রান করতে পারত তার অবস্থান হতো তত আগে। এই রানের সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে পরের রাউন্ডে ব্যাটিংয়ের সিরিয়াল নির্ধারণ করা হতো।

অনেক দিন চলেছিল আমাদের এই ক্রিকেট চর্চা। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শেষ করে চাকরিতে যোগ দেওয়ার পরও আমি ঢাকা থেকে গিয়ে আমার সেই ক্রিকেট বাহিনী নিয়ে মাঠে নেমে পড়তাম। পরবর্তী সময়ে অবশ্য সেটা আর সম্ভব হয়নি। কারণ, আমাদের দলের সবারই বয়স হয়ে গিয়েছিল। কেউ কেউ চাকরিসূত্রে কুষ্টিয়ার বাইরে থাকে। কারও সন্তানাদি অনেক বড় হয়ে গেছে। দুই–তিনজন আবার এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরকালে পাড়ি জমিয়েছেন অকালেই। এরপরও আমি অনেক জায়গায় ক্রিকেট খেলেছি। কিন্তু গ্রামে খেলার সেই নির্মল আনন্দ আর কোথাও পাইনি। ইদানীং যদি কোথাও খেলার সুযোগ পাই তবে হাত ঘুরিয়ে বলটা ছুড়লে মনে হয় বলের সঙ্গে সঙ্গে কবজি থেকে হাতটাও খুলে উড়ে গেল। এটা বয়স বেড়ে যাওয়ার প্রকৃষ্ট লক্ষণ। কিন্তু ক্রিকেট খেলার প্রসঙ্গ এলেই মনের বয়সটা সেই জাম্বুরা আর নারকেলের শাখা দিয়ে খেলার সময়ে আটকে যায়।

পরে একসময় ক্রিকেট খেলা দেখা শুরু করলাম। যেটা বুয়েটের হল লাইফে এসে পূর্ণ মাত্রা পেল। বাংলাদেশের প্রায় সব ম্যাচই দেখা হতো টিভি রুমে গিয়ে। টিভি রুমে এক অদ্ভুত দৃশ্যের অবতারণা হতো খেলার সময়ে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী বড় ভাই, ছোট ভাই ও বন্ধুরা সবাই এক হয়ে বাংলাদেশের খেলা উপভোগ করছে। খেলার সময় কী কী ভুল হচ্ছে সেগুলো নিয়ে নিজেদের মধ্যে চলত চুলচেরা বিশ্লেষণ। আর যদি বাংলাদেশ জিতে যেত তাহলে খেলা শেষে সবার চোখেই চিকচিক করত আনন্দাশ্রু। এভাবে খেলা দেখতে দেখতে একটা ব্যাপার আবিষ্কার করলাম, আমি খেলা দেখলেই বাংলাদেশ হেরে যাচ্ছে। তাই শেষের দিকে এমন হলো, আমি আর খেলা দেখতাম না। বরং খেলা শেষে ইএসপিএন ক্রিকইনফোর ওয়েবসাইটে গিয়ে স্কোর কার্ড দেখতাম। এখনো এই অভ্যাসটা ধরে রেখেছি।

১৭ মে (২০১৯) যখন বাংলাদেশ ট্রাইন্যাশন কাপের ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মুখোমুখি হচ্ছে তখন সময়ে সময়ে মোবাইলের স্ক্রিনে নজর রাখছিলাম। এর আগের সবগুলো ফাইনালেই বাংলাদেশ একেবারে জিততে জিততে হেরে গেছে। সেই হারগুলো দেখে আমি বরাবরই বলতাম কেন বাংলাদেশের টিম ম্যানেজমেন্ট একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞকে নিয়োগ দেয় না। যার কাজই হবে খেলোয়াড়দের কোনো কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলার আগে মানসিকভাবে তৈরি করবে। কারণ, বাংলাদেশের দলে সব তরুণ খেলোয়াড়। অসাধারণ তাদের মেধা। তারা যদি তাদের ধারাবাহিকতা ধরে রেখে ফাইনাল ম্যাচটা খেলতে পারে তাহলেই কিন্তু অন্ততপক্ষে বেশ কিছু ট্রফি আমাদের ঝুলিতে জমা হয়ে যেত। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে বাইশ বছরের ওয়ানডে স্ট্যাটাস পাওয়ার ইতিহাসে বাংলাদেশের কোনো ট্রফি অর্জন নেই। তবে দলের অবস্থা অনেক বদলে গেল একজন মাশরাফির কল্যাণে। যে একই সঙ্গে একজন খেলোয়াড় ও একজন অধিনায়ক। তবে তাঁর যে গুণটা আমাকে সব সময়ই মুগ্ধ করে, সেটা হলো তাঁর মানসিক ভারসাম্য। যেকোনো পরিস্থিতিতে খেলোয়াড়দের মনোবল ধরে রাখার ব্যাপারে তাঁর বলা কথাগুলো খুবই যুগোপযোগী। আর তিনি কখনোই খেলোয়াড়দের ওপরে ম্যাচ জেতার জন্য চাপ বাড়িয়ে দেন না। দিনে দিনে তাঁর সেই আচরণ আরও বেশি পরিপক্ব হয়েছে। গত বিশ্বকাপে তাঁর অধিনায়কত্বে বাংলাদেশ কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত খেলেছে। সেই ম্যাচে হেরে যাওয়া নিয়ে মত–দ্বিমত থাকতেই পারে, তবে সেটা খেলারই অংশ। আর সেটা মেনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

ত্রিদেশীয় সিরিজের শিরোপা হাতে বাংলাদেশ অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। ছবি: এএফপি
ত্রিদেশীয় সিরিজের শিরোপা হাতে বাংলাদেশ অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। ছবি: এএফপি

ফিরে আসি ম্যাচের আপডেটে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ ওভার ব্যাট করে একটা ভালো রান স্কোর করার পর বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৃষ্টি কখন থামবে সেটা বোঝা যাচ্ছে না। বৃষ্টি শুরু হওয়ার পর আমি এই ম্যাচের ভাগ্য কী হবে সেই বিষয়ের সবগুলো খবর পড়ে ফেললাম। জানতে পারলাম, যদি বৃষ্টি আর না থামে তাহলে বাংলাদেশ জিতে যাবে আর যদি বৃষ্টির পর খেলা শুরু হয় তাহলে সেটা হবে বিশ ওভারের এবং সেখানে বাংলাদেশকে বিশ ওভারে দুই শর ওপরে রান তাড়া করে জিততে হবে। যেটা বাংলাদেশ দল এর আগে মাত্র একবারই সম্ভব করতে পেরেছে। জেনে মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। আর মনে মনে দোয়া করে যাচ্ছিলাম যেন বৃষ্টি আর না থামে। সেদিন শুক্রবার রাত হওয়াতে আমাদের কফি আড্ডার শিডিউল ছিল। বাইরে প্রচণ্ড শীত তাই সবাইকে কফি নিয়ে আমাদের বাসায় চলে আসতে বললাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই কফি নিয়ে মিথুন ভাই, আশফাক ভাই ও মিথুন ভাইয়ের ছেলে তামজিদ আমাদের বাসায় হাজির হয়ে গেল। রাত দুইটার সময় যখন তাঁরা চলে গেলেন তখনো বৃষ্টি হচ্ছিল দেখে আমি খুশি হয়ে গেলাম। আমার খুশি দেখে মিথুন ভাই বললেন, ‘আপনি ফাঁকি দিয়ে ম্যাচ জিততে চান।’ আমি বললাম, ‘তা না।’ আসলে ম্যাচ জেতার সব রকম সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও আমরা এর আগে প্রায় সবগুলো ফাইনালই সম্মানজনকভাবে হেরে গেছি। তাই আমি চাইছি বাংলাদেশ যেকোনোভাবে এই ফাইনালটা জিতুক। বিশ্বকাপের মূল পর্ব শুরু হওয়ার আগে এই জেতাটা দলের মনোবল বহুলাংশে বাড়িয়ে দেবে।

এই ভাবনা নিয়েই ঘুমিয়ে পড়লাম। ভোরে সাহ্‌রি খেতে উঠে সবকিছুর আগে মোবাইল হাতে নিয়ে আপডেট নিতে গিয়ে দেখি বাংলাদেশ জিতে গেছে এবং খেলেই জিতেছে। তাই খুবই ভালো লাগছিল। তখন বুঝলাম আমাদের চেনা বাংলাদেশ দল আসলেই বদলে গেছে। খেলার পাশাপাশি তারা মানসিকভাবেও এখন অনেক পরিপক্ব। তাই কোনো পরিস্থিতিই এখন আর আমাদের জয়ের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। এমনকি আমাদের ম্যাচ জেতার জন্য নির্দিষ্ট কোনো খেলোয়াড়ের ওপরও নির্ভর করতে হচ্ছে না। সবাই নিজ নিজ গুণে সমুজ্জ্বল। আর আমাদের আছে মাশরাফি নামের এক পাঞ্জেরি। যে যেকোনো পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রেখে দলকে সঠিক দিকনির্দেশনা দেন। তাই সম্মানজনক হার কথাটা এখন আর আমাদের জন্য মোটেও প্রযোজ্য নয়। ট্রফি হাতে মাশরাফির ছবিটা দেখে তাই চোখ ভিজে আসছিল। ইন্টারনেট ঘেঁটে আকরাম খানের সেই ছবিটা বের করলাম, যেটাতে উনি আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফিটা ধরে আছেন। দুটো ছবিকে জোড়া লাগিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করে লিখলাম, ছবিগুলো থাকুক টাইমলাইনে কারণ আমাদের প্রজন্ম আমরা সত্যিই ভাগ্যবান যে ক্রিকেটে বাংলাদেশের উত্থানের এই ইতিহাস আমাদের দেখা।

গতবারের বিশ্বকাপটা অনুষ্ঠিত হয়েছিল অস্ট্রেলিয়াতে। আর আমরা সে বছরই অস্ট্রেলিয়ায় মাইগ্রেট করেছিলাম। তাই এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল খেলা চলাকালে। কিন্তু যেহেতু অস্ট্রেলিয়ার টিভি চ্যানেলগুলো অস্ট্রেলিয়া ছাড়া অন্য কারও খেলা দেখায় না, তাই কোনো ম্যাচ দেখা সম্ভব হয়নি। কিন্তু সময়ে সময়ে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ঠিকই খবর রাখছিলাম। এমনকি অফিসে সারাক্ষণই ইন্টারনেটে খেলার আপডেটের পেজটা খুলে রেখে দিতাম। আর বাসায় আমার মেয়ে তাহিয়া, ছেলে রায়ান আর আমি সারা দিনই বাংলাদেশের জার্সি পরে ঘুরে বেড়াই। এবারও বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অফিশিয়াল জার্সি কেনার একটা উদ্যোগ নিয়েছি। বাংলাদেশ থেকে শ্যালক প্রিতম জার্সি কিনে পাঠাবে। সেটা পরেই এবারের বিশ্বকাপ উপভোগ করব আমরা। তাই বিশ্বকাপের খেলা শুরুর দিন যতই ঘনিয়ে আসছে আমাদের মনের মধ্যে উৎসবের আমেজ তৈরি হচ্ছে।

আমরা বাংলাদেশের এমন একটা প্রজন্ম, যারা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্জন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। তবুও আমরা সেটা নিয়ে গর্ব করি। একসময় বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশ বলতে সেই পরিচয়টাই মুখ্য ছিল। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেখানেও পরিবর্তন এসেছে। এখন বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের অন্যতম আইডেনটিটি হচ্ছে ক্রিকেটের বাংলাদেশ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে প্রথম পরিচয় হলেই তারা বাংলাদেশের ক্রিকেটের প্রসঙ্গ তুলে বিভিন্ন বিষয়ে জানতে চায়। আমাদের অফিসেও একজন আছেন যিনি ক্রিকেটের সব খবরাখবর রাখেন। তাঁর নাম শন ম্যাথিউ। আমরা ডাকি শনি বলে। তিনি আসলে নিউজিল্যান্ডের নাগরিক। কিন্তু চকারিসূত্রে এখন সিডনিতে থাকেন। তাঁর কাছ থেকে ক্রিকেটের সব খবর একেবারে লাইভ পাওয়া যায়। বিশেষ করে যদি নিউজিল্যান্ডের ও বাংলাদেশের কোনো খেলা থাকে তাহলে দোতলা থেকে তিনতলায় আসেন শুধু আমার সঙ্গে ক্রিকেট বিষয়ে আড্ডা দেওয়ার জন্য। আর যদি খেলাটা হয় নিউজিল্যান্ড ও বাংলাদেশের মধ্যে তাহলে তো কথাই নেই। আমরা নিজ নিজ দলের সামর্থ্য নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ শুরু করে দিই এবং ম্যাচের আগেই একটা অনুমান জানিয়ে দিই কী হবে পরবর্তী ম্যাচের ফল।

শিরোপা মাথায় তুলে উদ্‌যাপন করছেন মুশফিক। পাশে দুই সতীর্থ মিরাজ ও সৌম্য। ছবি: এএফপি
শিরোপা মাথায় তুলে উদ্‌যাপন করছেন মুশফিক। পাশে দুই সতীর্থ মিরাজ ও সৌম্য। ছবি: এএফপি

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছাড়া এখন জীবনই অচল। মাসখানেকের জন্য আমি সেটার বাইরে গিয়ে বুঝতে পারলাম আমি দুনিয়া থেকে মাসখানেক পিছিয়ে গিয়েছি। আর সব ইভেন্টও এখন সেখানেই প্রচার করা হয় তাই অনেকগুলো ইভেন্টও মিস করে গেলাম বিশেষ করে বাচ্চাদেরগুলো মিস করে খুবই খারাপ লাগছিল। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অন্য আরেকটি দিক হলো এখানে ভালোর চেয়ে মন্দ ব্যাপারগুলো নিয়েই বেশি ট্রল হয় এবং সেগুলো রাতারাতি ভাইরাল হয়ে যায়। মানুষ বলেই আমরা কমবেশি স্পর্শকাতর মনের। এসব খারাপ খবর তাই আমাদের মন খারাপ করে দেয়। তখন একমাত্র বাংলাদেশের ক্রিকেটই মনের মধ্যে আশা জাগিয়ে তোলে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাফল্যে প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রত্যেককে খুশি হতে দেখেছি দলমত-নির্বিশেষে। তখন খুবই ভালো লাগে। অবশ্য হেরে গেলেও আমরা একটু বেশিই প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করি। আসলেই আমরা ক্রিকেট নিয়ে একটু বেশিই আবেগপ্রবণ। আমি সেটাকে খারাপ হিসেবে দেখি না।

আর বিশ্বব্যাপী এখন বাংলাদেশের একটাই পরিচয় ক্রিকেটের বাংলাদেশ। গত ক্রিকেট বিশ্বকাপে বাংলাদেশ নিজেদের জাত চিনিয়েছে। এবারের দলটা আরও বেশি ভারসাম্যপূর্ণ। আশা করি এবার আরও বড় সাফল্য বয়ে নিয়ে আসবে। সেটা নিয়ে দেশে–বিদেশে সবাই আমাদের চিনবে ক্রিকেটের বাংলাদেশ হিসেবে। এ ছাড়া এত হানাহানি ও খারাপ খবরের ভিড়ে ক্রিকেটের সাফল্যের খবরগুলো আমাদের মনে সব সময়ই প্রশান্তির পরশ বুলিয়ে যাবে। সেদিন আর বেশি দূরে নেই, যেদিন বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় শিরোপা বিশ্বকাপ জিতে আনবে। বিশ্বকাপ ক্রিকেট সামনে রেখে তাই মাশরাফি বাহিনীর জন্য অবিরাম শুভকামনা। তাদের ভালো ও খারাপ সময়ে আমরা আছি তাদের পাশে, কারণ তারাই আমাদের নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখায়।
...

মো. ইয়াকুব আলী। ই–মেইল: <[email protected]>