অস্ট্রেলিয়ান ললনা অ্যাঞ্জেলা

দুর্জয়–দুর্দান্ত অশান্ত সাগর
দুর্জয়–দুর্দান্ত অশান্ত সাগর

পড়ন্ত বিকেলে সুরেশের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজন সেরে হোটেলে ফিরতে আটটা বেজে গেল সুচরিতদের। লাউঞ্জে একেবারেই ভিড় নেই আজ। রিসেপশন টেবিলে ম্যানেজার দীনকৃষ্ণর বদলে গুরুগম্ভীর চেহারার এক ভদ্রলোক বসে। তীক্ষ্ণ চোখের পলক পাতে একনজর লক্ষ করেই সুচরিতের দিকে রুমের চাবি বাড়িয়ে ধরে বললেন, খাবার দিতে বলব? একটু পরে দিন। হালকা কিছু দেবেন প্লিজ। আর কাউকে দেখছি না যে? সবাই মহারাজজীর সঙ্গে। কাল একাদশীর পাবন ছিল, তাই মন্দিরে অনুষ্ঠান হচ্ছে। মন্দির অনেক দূরে? না, না। ওই তো ডান দিকের দরজা দিয়ে এগোলেই সিঁড়ি। যাবেন? এতক্ষণে ভদ্রলোকের মুখে মৃদু হাসির পরশ লাগল। হ্যাঁ, যাই। দেখে আসি একবার।

ভারী দরজা পেরিয়ে ভেতরে যেতে চোখে পড়ল পূজাপার্বণের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়েছে অনেকক্ষণ। বেদির সামনেই নানা রঙের ফুলের স্তূপ। ধূপ–চন্দনের গন্ধ, রাধা-মাধবের বিগ্রহ পবিত্র করে তুলেছে আবহ। রাধা-মাধবকে প্রণাম করে মহারাজজীকে প্রণাম করল ওরা। হাত তুলে স্বামিজী নিঃশব্দে আশীর্বাদ করলেন। বহ্নি দেখল, তাঁর সুন্দর মুখে প্রশান্তির স্থিরতা। অন্তরের স্নিগ্ধতা গড়িয়ে পড়ছে দুই চোখের সুগভীর দৃষ্টিতে। কথা না বলে হাতের ইঙ্গিতে জানালেন, প্রসাদ না খেয়ে চলে যেয়ো না যেন। সহসা কানের পাশে নারী কণ্ঠের বিদেশি উচ্চারণ শুনে বহ্নি কাঁধ ঘুরিয়ে বিস্ময়ে দেখল, পরশুর স্বর্ণকেশী তাঁকে বলছেন, মহারাজজী তোমাদের খেয়ে যেতে বলছেন। বলেই নমস্কার করে হাসলেন, আমি অঞ্জলি। তুমি? একটু পরেই স্বামিজী ঘুমাতে চলে গেলেন। কাল সারা দিন একাদশীর উপোস ছিলেন। আজ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের পর উপবাস ভেঙেছেন। বয়স ৮০ পেরিয়েছে। শরীর আজকাল ধকল নিতে পারে না। এসব কথা অঞ্জলিই শোনালেন ওদের। পরে মোহন হেসে বললেন, মহরাজজীর আজ মৌনব্রতের দিন, তাই কথা বলবেন না! কাল দীনকৃষ্ণর কাছে শুনেছেন, পাকা পেঁপে খেতে তোমরা বড় ভালোবাসো। আর হোটেলের রান্নার বদলে প্রভুজীর ভোগ প্রসাদ। কাল থেকে তাই সেই ব্যবস্থাই তিনি করেছেন তোমাদের জন্য। এখানকার চার্জ কি তাহলে আলাদা দেব, নাকি...? সুচরিত সপ্রশ্ন দৃষ্টি ছুড়ল। না, ম্যানেজারের কাছে দিলেই হবে।

অঞ্জলির সঙ্গে আলাপ জমছে ধীরগতিতে। দু-চারটি প্রশ্নের উত্তর প্রসঙ্গে। ভদ্রমহিলাকে বহ্নির যতটা তরুণী মনে হয়েছিল সেদিন, তার থেকে খানিকটা প্রবীণা তিনি। মুখের দিকে তাকালে মনে হয় অস্তিত্বের অনেকটাই যেন বুকের অতলে লুকিয়ে রেখেছেন। নীল চোখের গভীরে প্রসন্নতার স্পর্শ। শাড়ির সঙ্গে আজ তিলক চন্দন পরেছেন। মাথার সোনালি চুল চুড়ো করে বাঁধা। সব মিলিয়ে ভারি চমৎকার দেখাচ্ছে তাঁকে। কিন্তু সাধারণ মামুলি বিষয় নিয়ে কথা বললেও ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে এখনো মুখ খোলেননি অঞ্জলি। বহ্নির বড় জানতে ইচ্ছে করছে কেন তিনি নিজ দেশের মানুষ, সমাজ, সংস্কৃতিকে পেছনে ফেলে এখানকার পরিবেশে আবাস খুঁজতে এসেছেন? ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করা উচিত কি না, ভাবছিল সে। সেই মুহূর্তেই অঞ্জলি বললেন, আমার নাম অ্যাঞ্জেলা। অ্যাঞ্জেলা অ্যান্ডারসন। তবে স্বামিজী বলেন অঞ্জলি। এ নামের অর্থ আমার নিজেরও বড় ভালো লাগে। তাই সবাইকেই বলি, আমি অঞ্জলি। কাল কোথায় যাচ্ছ? বুড্ডিস্ট সাইটে। ঐতিহাসিক কারণে জায়গাগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। হ্যাঁ নিশ্চয়ই। দেখে এসো। এবার চলো, বাইরে গিয়ে বসি। প্রভুজীকে এখানে শয়ান দেওয়া হয়েছে। অবশ্য তোমাদের আপত্তি না থাকলে কিছুটা সময় একসঙ্গে কাটাতে পারি। একটুও নেই। খুব ভালো লাগছে কথা বলতে। বহ্নির উৎসাহ তার কৌতূহল ছুঁয়ে গেল। অ্যাঞ্জেলা সুচরিতের মুখের দিকে তাকালেন, তুমি বোধ করি ক্লান্ত? হ্যাঁ। আমি বরং যাই। ঠিক আছে। এটা নাও। স্বামিজী তোমাদের জন্য রেখে গিয়েছেন, বলেই সুচরিতের হাতে বড়সড় একটি পাকা পেঁপে তুলে দিয়ে অঞ্জলি ঘরের দরজা বন্ধ করলেন।

বহ্নিকে নিয়ে পেছনের সুইমিংপুলের পাশে ব্যালকনিতে গিয়ে বসলেন অ্যাঞ্জেলা। সামনেই দুর্জয়–দুর্দান্ত অশান্ত সাগর। জীবন উল্লাসে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অনন্ত জলরাশি সঙ্গে নিয়ে। বিস্তীর্ণ সৈকতভূমি নীরবতায় স্থির। বাতাসের প্রবলতা ওদের শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে বারবার। অঞ্জলি শান্ত গলায় কোনো কথার সূত্র ছাড়াই হঠাৎ বলে উঠলেন, তা প্রায় ২৫ বছর হলো, মহারাজজীর সঙ্গে আছি! তিনি আমার গুরু ও শিক্ষক। কী করে? বহ্নির প্রশ্নে বিস্ময় ঝরে পড়ল।

আমি তখন ব্রিসবেন ইউনিভার্সিটিতে আন্ডার গ্র্যাজুয়েটের ছাত্রী। স্বামিজী Health and Behavioural Science-এর শিক্ষক। ছেলেবেলা থেকে ইউনির্ভাস নিয়ে বহু প্রশ্নের ভিড় জমেছিল মনে। বিশেষ করে ১০ বছর বয়সে বাবা-মায়ের অকালমৃত্যুর পর কেন আমরা জন্মাই, কেনই বা মারা যাই এসব প্রশ্নের ভিড় বড় ডিপ্রেশন তৈরি করতে থাকে আমার মধ্যে। শান্তির সন্ধানে তখন থেকেই মরিয়া হয়ে উঠি। একদিন মহারাজজীর সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হই, এসব জিজ্ঞাসার উত্তর ওঁর কাছেই পাওয়া যাবে। মহারাজজী কি তখনই সন্ন্যাসী? না। তিনি বিবাহিত ও দুই সন্তানের জনক। তারপর? ক্লাস শেষে রোজ তাঁর কথা শুনতে যেতাম। এরপর একদিন শুনি, উনি ভারতে ফিরে যাচ্ছেন। আমি অবশ্য যোগাযোগ রাখতে ছাড়িনি। এর মধ্যে লেখাপড়া শেষ করে বিয়ে করি। তত দিনে উনি সন্ন্যাস নিয়েছেন। সেই সঙ্গে ওঁর স্ত্রীও।

স্বর্ণকেশীর জীবনকাহিনি শুনতে শুনতে বহ্নি মনে মনে ততক্ষণে অ্যাঞ্জেলার জীবনের গভীরে প্রবেশ করেছে। ভাবছে মানুষের জীবনচক্র কোন রহস্যময়ের হাতে রচিত হয় অন্তহীন কাল ধরে, অঞ্জলি কি সত্যিই নিশ্চিত হয়েছেন তার সম্পর্কে? নাকি তিনি উপলব্ধি করেছেন জীবনে দুঃখ–বেদনার অনন্ত সাগর এমনই অবস্থায় জড়িয়ে, যেখানে মানুষ কখনো সম্পূর্ণ তলিয়ে যায়, কখনো বা আবার ভেসে ওঠে নিয়তির অদৃশ্য হাতের টানে। কিন্তু জীবন থেকে তাকে কখনো বিচ্ছিন্ন করা যায় না। কেবল নির্মোহভাবে অগ্রাহ্য করে জয় করা যায়। অঞ্জলি কিছুক্ষণ হলো নিঃশব্দ। কিছু কি আড়াল করতে চাইছেন তাঁর জীবন ঘটনার স্রোত থেকে? বহুদূরের আকাশের দিকে তাকাল বহ্নি। অগণিত তারা ফুল বুকে নিয়ে সে ঝুঁকে রয়েছে সাগরের দিকে। অঞ্জলির মতোই হৃদয়ের কথা বলছে কি? অ্যাঞ্জেলার চোখের কোলে অশ্রুর স্রোত ভাসল হঠাৎ। বহু সময় পর তিনি একনাগাড়ে কথা বললেন, আমার স্বামী ফ্লিন অ্যান্ডারসন, সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু আমার। আর আমাদের তিন বছরের মেয়ে অ্যামেলিয়া ভালোবাসার ধন! একদিন সমুদ্রের দ্বীপে বেড়াতে গিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে ফ্লিন কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলে। আমরা সবাই সাগরজলে তলিয়ে যাই। কিন্তু প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে আমার পাশের দরজাটা খুলে যায়। অজান্তেই সাঁতার কেটে ভেসে উঠি ওপরে। তারপর আর মনে নেই। শুনেছি, এক সামুদ্রিক জেলে দেখতে পেয়ে তাঁর নৌকায় তুলে নিয়েছিলেন। বহ্নির মন বলল, এমন ঘটনার পরও কি অঞ্জলি শান্তি খুঁজে পেয়েছেন? অঞ্জলি বললেন, স্বামিজীর মেসেজ পেলাম ঠিক তারপরই। বললেন, অঞ্জলি এবার সময় হয়েছে আমার সঙ্গে যোগ দেওয়ার। ঈশ্বরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইলে সব ছেড়ে চলে এসো এবার। ছাড়াছাড়ির তো কিছু ছিল না। সহজেই তাই চলে এলাম। বলে অ্যাঞ্জেলা পবিত্র হাসলেন। বহ্নি অজান্তেই জিজ্ঞেস করল, এ ঘটনার পর ঈশ্বরকে তোমার কী মনে হয়? পরম দয়ালু? নাকি চরম নিষ্ঠুর? অস্ট্রেলিয়ান ললনা চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়িয়ে উদাসী গলায় উত্তর দিলেন, কী করে বলি বলো তো? শুধু জানি, তিনি অনন্তের সাগর। সেখানে ডুব দিলে মন হারিয়ে যায়। মন যখন হারায়, তখন কে কার বিচার করে?

বহ্নির ঘুম আসছে না সেদিন রাতে। অঞ্জলি তাঁর চিন্তার স্রোতজুড়ে সারাক্ষণ ডোবা–ভাসার খেলা খেলছেন। কেন তিনি তার সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন হঠাৎ? কেন অতীত থেকে তুলে আনলেন বিয়োগান্ত জীবনের এত সব ঘটনার স্রোতকে? এত বছর সাধনার পথে থেকেও কি অ্যাঞ্জেলা নির্লিপ্ত হতে পারেননি? বহ্নি নরম বালিশে মুখ গুঁজে ঘুমানোর চেষ্টা করতে করতে অস্ফুটে বলল, সেটা মানুষ সহজে পারে না! জীবনের হাজার রকমের বাঁধন বড় সহজে যে মুক্তি দেয় না পার্থিব মানুষের মনকে! (চলবে)

ধারাবাহিক এ ভ্রমণকাহিনির আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন