অর্জুনের পৃথিবী

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

মেঘলা এক বিকেলে বাসায় ফিরছে রুমন। ফেয়ার ব্যাংকসের অভিজাত ফুলে ফুলে ঘেরা এক বাসা থেকে নিজ বাসায়। সেদিন হাসপাতালে অসম্ভব কাজের চাপ ছিল। কাজের পর ডাক্তার অর্জুনের বাসায় দাওয়াত ছিল তাঁর। পৌঁছাতে বেলা হয়েছিল দেড়টা। তখন ড্রাইভ করে চলেছেন নিজ বাসার পথে। বৃষ্টিস্নাত প্রকৃতির মতোই ওর মনের আকাশও মেঘলা। যেকোনো সময় ঝরে যাবে অশ্রু একপশলা বৃষ্টি হয়ে।

কাহিনির শুরু বছর পাঁচেক আগে। রুমন জয়েন করেছে স্যানডিয়াগোর এক হাসপাতালে। রেসিডেন্সির পরপরই জয়েন করেছে হসপিটালিস্ট হিসেবে। রাতে কাজ করতে গিয়ে ইমার্জেন্সি ডাক্তারের কাছ থেকে একজন রোগী পেল। বয়স ২৭। বুকে ব্যথা নিয়ে এসেছেন। ইকেজি দেখে মনে হলো এক্ষুনি ক্যাব (মানে হার্ট অ্যাটাক হলে হার্টের আর্টারি ডাই দিয়ে দেখা) করে রিং পরানো বা ওপেন হার্ট সার্জারি দরকার। ইমার্জেন্সির ডাক্তারের সাফ কথা। তারপরও রুমনের মনে হলো অল্প বয়সী রোগী। কত কারণে বুকব্যথা হতে পারে। রুমন কার্ডিওলজির ডাক্তার অর্জুনকে সাহস করে কল করল। তিনি চলে এলেন সঙ্গে সঙ্গে। রোগীকে রাতের মধ্যে ক্যাথ করে রিং পরানো শেষ। সেই থেকে বন্ধুত্ব ওদের।

হাসপাতালের সবাই ভীষণ বন্ধুবৎসল। কিন্তু তার মধ্যেও ডাক্তার অর্জুন একটু আলাদা। যেন তাঁর জন্ম হয়েছে নিজের সব বিলিয়ে মানুষের সেবা করে যাওয়ার জন্য। নিজের ছুটিতে অন্য দেশে চলে গিয়ে সেবা দিয়ে আসেন। হোমলেস শেল্টারে সপ্তাহে এক দিন কাজ করেন ফ্রি। সেদিন ক্যাফেটেরিয়াতে খাবার নিয়ে বসতেই তিনি হাজির। এত দিন রুমনের ধারণা ছিল, ডাক্তার অর্জুন ইন্ডিয়ান বা তাঁর বাবা বা মা ইন্ডিয়ান। ওদিকে রুমনকেও তিনি ইন্ডিয়ান ভেবেছেন। রুমন বাংলাদেশি শুনে পরিষ্কার বাংলায় অর্জুন বললেন, কত দিন আছ এ দেশে? রুমন খুব অবাক হয়ে বলল, এত সুন্দর বাংলা কীভাবে শিখেছেন? অর্জুন বললেন, মায়ের ভাষা যে! ভালোবেসে শিখেছেন।

সেদিনের পর থেকে তাঁরা দুজন সব কথা বাংলাতেই বলতেন। একদিন অর্জুন রুমনকে বলেছিলেন, আমার মা তোমাকে দাওয়াত দিতে চান। কবে অফ আছে বলবে?

লেখিকা
লেখিকা

সেদিন ছিল সেই দিন। ফেয়ার ব্যাংকসের অভিজাত এলাকার গেটেড কমিউনিটির গেটে ওর নাম বলা ছিল। ১৫ মাইল বেগে গাড়ি চালিয়ে বিশাল বাড়ির ড্রাইভ ওয়েতে গাড়ি রাখল রুমন। বেল বাজাতেই অসম্ভব রূপবতী প্রৌঢ় এক মা দরজা খুলে দিলেন। ভেতরে গিয়ে বসতেই ডাক্তার অর্জুনের বাবা নেমে এলেন। জানালেন, তাঁরা চট্টগ্রাম শহরের। ছোট্ট অর্জুনকে কোলে নিয়ে ৩৫ বছর আগে দেশ ছেড়েছেন। স্যানডিয়েগো এসে অর্জুনের আরও চার ভাইবোনের জন্ম। এখন সবাই পড়াশোনা শেষ করে যার যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু থাকে একই শহরেই। সপ্তাহে এক দিন সবাই আসে আর এই বাসায় বসে চাঁদের হাট।

দুপুরে খাবারের অনেক আয়োজন ছিল। রুমন দেশ ছেড়েছে ১৭ বছর। কিন্তু খাবারের অভ্যাস রয়ে গেছে একই। প্রতিবছর দেশে যায় দেশের টানে। কিন্তু আজ পেয়ে গেল দেশের স্বাদ। খাবারের পর রুমন সুইমিংপুলের পাশে বসে দূর পাহাড়ের দিকে চেয়ে আছে। এমন সময় একজন প্রৌঢ় নারী ধীরে ধীরে হেঁটে এলেন। রুমনের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার ছেলে কই? আমার ছেলে? বুঝিয়ে তাঁকে ভেতরে নিয়ে গেলেন একজন নারী কর্মচারী।

রূপবতী প্রৌঢ় মা বেরিয়ে এলেন তখন। বললেন, বহু বছর আগে চট্টগ্রামের পাঁচলাইশে বাসা ছিল তাঁদের। ছিল বিশাল ব্যবসা। তাঁরা ব্রাহ্মণ বংশীয়। তাঁদের বাড়ির সামনের রাস্তায় মানসিক প্রতিবন্ধী এক নারী ছিলেন। মানুষের কাছে চেয়ে খেতেন। সন্ধ্যে হলে কাছের কোনো বস্তিতে চলে যেতেন। তাঁর একদিন পিতৃপরিচয়হীন বাচ্চা হলো। কাছের কেউ নেই দেখার। তিনি জানালা দিয়ে দেখলেন, ছোট্ট শিশু অবহেলায় পড়ে আছে। নিয়ে এলেন বাসায়। তাঁদের ছেলে হিসেবে বড় হবে এই শিশু। ব্রাহ্মণ পরিবারে এত বড় অনাচার! আত্মীয়–বন্ধু সবাই ছি ছি করতে লাগলেন। সেই ছোট্ট শিশুই অর্জুন। ওর প্রতিবন্ধী মাসহ শর্মা পরিবার পাড়ি জমিয়েছে আমেরিকায়। অনেক বছর চিকিৎসার পর এখন আর হইচই করেন না তিনি। নিজের রুমে থাকেন। শুধু ছোট্ট অর্জুন বড় হয়েছে এটা কেন যেন মনে রাখতে পারেন না। মাঝেমধ্যে খোঁজেন।

রুমন চলে আসার আগে আগে পাঁচ ভাইবোন পরিবারসহ অর্জুন ড্রয়িংরুমে এলেন। মধ্যমণি অর্জুন সবাইকে রুমনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ওঁদের আনন্দ আলো গায়ে মেখে বিদায় নিল রুমন। গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসে বললেন, এ ভালোবাসা স্বর্গে সৃষ্টি রুমন। আমাকে তো কিছুটা হলেও ছড়িয়ে যেতে হবে সারা পৃথিবীতে। আমি যা করি এ তো সাগরে শিশির বিন্দুমাত্র। এমন সময় অর্জুনের ছোট্ট ছেলে দৌড়ে এল। বলল, বাবা খাবে না?
...