একই পথের পথিক

সিডনিতে বুয়েটের পথিক ’৯৮ ব্যাচের পুনর্মিলনীতে সদস্যরা
সিডনিতে বুয়েটের পথিক ’৯৮ ব্যাচের পুনর্মিলনীতে সদস্যরা

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) আমাদের ব্যাচের নাম ছিল ‘পথিক ৯৮’। অবশ্য প্রতিটি ব্যাচেরই একটা করে নাম থাকে আর ব্যাচের নামের পরের সংখ্যাটা পঞ্জিকা অনুযায়ী ব্যাচের ক্লাস শুরুর সাল বোঝাতে ব্যবহার করা হয়। যদিও আমাদের ক্লাস শুরু হয়েছিল ১৯৯৯ সালের অক্টোবরের ১৯ তারিখে। আর প্রতিটি হলের একই ব্যাচের ছাত্রছাত্রীদের জন্য আবার আলাদা আলাদা নাম আছে। যেমন রশিদ হলের নাম অতঃপর। তিতুমীর হলের নাম অশ্লীল। যার আদ্যক্ষর ‘অ’ আবার উল্টো করে লেখা। আহসানউল্লাহ হলের নাম আউলা ঝাউলা। সোহরাওয়ার্দী হলের নাম প্রহেলিকা। নজরুল হলের নাম বেদুইন। শের-ই-বাংলা হলের নাম হিমাদ্রি। আর একমাত্র ছাত্রী হলটির নাম ছিল গাঙচিল। আমরা বিভিন্ন হলে থাকলেও ব্যাচের প্রশ্নে আমরা ছিলাম এককাট্টা। বিভিন্ন প্রতিবাদ, আন্দোলনেও একে অপরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রুখে দাঁড়াতাম। আমরা বাংলাদেশের এমন একটা প্রজন্ম, যারা প্রযুক্তির অভ্যুদয় দেখতে দেখতে বেড়ে উঠেছি।

আমাদের প্রজন্ম থেকে কম্পিউটারের বহুল প্রচলন শুরু হলো। তাই বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই তখন কম্পিউটার বিজ্ঞান বিষয়টা খোলা হচ্ছিল। আর যেখানে আগে থেকেই ছিল সেখানে আসনসংখ্যা বাড়ানো হচ্ছিল। বুয়েটে তখন কম্পিউটারের আসন ছিল ষাটটা। আমার বন্ধু পাভেলের সিরিয়াল হলো মেধাতালিকায় একষট্টিতম। এতে সে বুয়েটে ভর্তির সুযোগ পেয়ে যতখানি খুশি হলো তার চেয়ে বেশি মন খারাপ করল কম্পিউটার বিজ্ঞানে ভর্তি হতে না পেরে। পরে আমাদের ব্যাচের মেধাতালিকার দশম স্থান অধিকারী ঢাকা কলেজের শিশির আমেরিকা চলে যাওয়ায় পাভেলের কম্পিউটার বিজ্ঞানে ভর্তি নিশ্চিত হলো। তখন পাভেল আবার আগের মতো প্রাণখোলা হাসিতে আমাদের সঙ্গে আড্ডা দিতে শুরু করল।

সিডনিপ্রবাসী পথিকদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম
সিডনিপ্রবাসী পথিকদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম

পাভেলের কম্পিউটার বিজ্ঞানে ভর্তি নিশ্চিত হওয়ার পর খালুজান ওকে একটা কম্পিউটার কিনে দিলেন। আমার এখনো মনে আছে সেই কম্পিউটারের হার্ডডিস্ক ছিল মাত্র ৩ দশমিক ২ গিগাবাইট। আমরা সেই কম্পিউটারে সারাক্ষণই কোনো না কোনো ছবি দেখতাম বা গান শুনতাম। ক্লাস শুরু হতে আরও প্রায় ছয় মাস লেগে গেল। সেই সময়টা নিয়ম করে প্রতিদিন সকাল থেকে মধ্যরাত অবধি পাভেলদের বাসায় আমাদের আড্ডা চলত। পাশেই শাহেদদের বাসা। এই দুই বাসা মিলিয়ে আমরা সারাক্ষণই কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত থাকতাম। দুপুরের দিকে শাহেদদের বাসার বাইরের জায়গাটাতে আমরা ব্যাট–বল নিয়ে নেমে পড়তাম। আর বিকেল হলেই ভ্যানে করে দল বেঁধে ঘুরে বেড়ানো ছিল প্রতিদিনকার রুটিন।

বুয়েটে ক্লাস শুরু হলেও পড়াশোনা তেমন একটা ভালো লাগত না। শুধু মনে মনে ভাবতাম কবে সালমান শাহের ছবির মতো এক কোনো সুন্দরীর সঙ্গে একদিন ধাক্কা লেগে একটা রোমান্টিক গল্পের জীবন শুরু হবে। কিন্তু বাস্তবতা আসলেই অনেক রূঢ়। তাই নিজের পড়া আর পড়াশোনার খরচ চালাতে টিউশনি করতে গিয়েই জেরবার অবস্থা। এর বাইরে বাকি সময়টুকু কেটে যেত একই ফ্লোরের বড় ভাই, বন্ধু আর ছোট ভাইদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে। আমি আমার ফ্লোরের মধ্যে যতটা কর্মঠ ছিলাম, বাইরের মানুষের কাছে ঠিক ততটাই অন্তর্মুখী হিসেবে পরিচিত ছিলাম।

রেজা, রাজীব, সাব্বির, শাকিল, সুব্রত, জাভেদ, আরিফ, অভি, ফাইয়াজ, ফিরোজ, চঞ্চল, হাসিব, রুমন, মফিজ, মাহমুদ, আক্তার, নিউটন, পীযূষ, রাশেদ, সমীর, তারেক, ইয়ামিন এরা সবাই আমাদের একই ব্যাচের বিভিন্ন বিষয়ের ছাত্র। ঘরকুনো স্বভাবের কারণে এদের কারও সঙ্গেই বুয়েট লাইফে তেমন একটা পরিচয় ছিল না। তবে দু–একজনের সঙ্গে হাই–হ্যালো হতো একই হলে থাকার সুবাদে। তবে তাদের সঙ্গে প্রথম পরিচয় হলো বুয়েটে আড়ি পেতে শোনা বলে বুয়েটিয়ানদের একটা অনলাইন গ্রুপে। এর বাইরে আগে থেকেই পরিচয় ছিল মিতুল আর মিনহাজের সঙ্গে। কথায় আছে ব্যাক বেঞ্চাররাই প্রকৃত মেধাবী হয়। এই ছেলেগুলোর ক্ষেত্রে সেই কথাটাই প্রযোজ্য। অবশ্য কেতাবি মেধাতেও তারা অনেক বেশি এগিয়ে। এ ছাড়া ক্যাম্পাসে থাকাকালে সব ধরনের আন্দোলনের প্রথম সারিতে ছিল ওরাই। তাই সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের চোখে ওরা ছিল বাউন্ডুলে।

বাংলদেশে পথিক ৯৮ ব্যাচের পুনর্মিলনীতে সদস্যরা
বাংলদেশে পথিক ৯৮ ব্যাচের পুনর্মিলনীতে সদস্যরা

বুয়েটে আড়ি পেতে শোনা গ্রুপে ২০ হাজারের ওপর সদস্য এবং তাদের মধ্যে সব সময়ই কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে ক্যাচাল লেগেই থাকে। সেই ক্যাচাল নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য প্রতি ছয় মাস অন্তর অন্তর অ্যাডমিন নির্বাচন হয় সদস্যদের ভোটে। একবার সেখানে অ্যাডমিন প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়ে গেল আমাদের ব্যাচের সবচেয়ে মাথা গরম ছেলে জাভেদ। আসলে যাদের অন্তর পরিষ্কার হয় তাদের মাথা একটু বেশিই গরম হয়। একই ব্যাচের হওয়ায় আমরা সবাই ওর পক্ষে ভোট চেয়ে ক্যাম্পেইন শুরু করলাম। তখনই প্রথম পরিচয় হলো তাদের সঙ্গে। তারা সবাই ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী হলেও ব্যাচের ছেলের জন্য সবাই এক জোট। এভাবে আমরা কেউ বাংলাদেশ থেকে আবার কেউ আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া থেকে যে যেখানে ছিলাম সেখান থেকে ক্যাম্পেইন করে গেলাম। তখন গ্রুপটার সবাই বুঝতে পারল ’৯৮ ব্যাচটা আসলে কতটা শক্তিশালী। সেবারের অ্যাডমিন প্যানেল নির্বাচন ছিল সবচেয়ে উৎসবমুখর নির্বাচনগুলোর একটা। এই নির্বাচনের ক্যাম্পেইন আমাকে এই ছেলেগুলোর কাছাকাছি নিয়ে এল।

এরপর থেকে আমি প্রকৃতঅর্থে একজন পথিক হয়ে গেলাম। ব্যাচের যেকোনো প্রোগ্রাম যেহেতু তারাই আয়োজন করে তাই এই সাত সমুদ্র তেরো নদীর পাড়ে থেকেও আমি যুক্ত হতে পারি সহজেই। গত বছর তারা একটা পুনর্মিলনী করেছে। যেখানে আমি যেতে পারিনি। কিন্তু ফেসবুকের কল্যাণে যুক্ত থেকেছি সারাক্ষণই। পুনর্মিলনী শেষ হয়ে গেলেও তারা আমার জন্য টি–শার্ট আলাদা করে রেখে দিয়েছিল। সেই টি–শার্ট আরও একজন পথিক মহি তাদের কাছ থেকে নিয়ে সিডনির আরেক পথিক আসাদের কাছে পাঠিয়ে দিল। সেই টি–শার্ট যেদিন পরলাম মনে হচ্ছিল যেন আমি বুয়েট ক্যাম্পাসের ব্যাগ কর্নারে দাঁড়িয়ে আছি। চারদিকে রঙের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। সবাই সবাইকে রাঙিয়ে দিচ্ছে শেষ মুহূর্তের স্মৃতিটাকে আরও উজ্জ্বল করতে। ছেলেমেয়ে–নির্বিশেষে সবার গায়েই সাদা টি–শার্ট।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পথিকেরা বুয়েট পাস করে এখন দেশে এবং দেশের বাইরে সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। আমরাও বেশ কজন পথিক সিডনিতে বসবাস করছি বিভিন্ন মেয়াদে। আমাদের মধ্যে ব্যক্তিগত পর্যায়ের বাইরেও কমবেশি যোগাযোগ হয়, বিশেষ করে একই বিষয়ে আমরা যারা পড়েছিলাম তাদের মধ্যেই যোগাযোগটা বেশি। আমাদের সিভিলের আসনসংখ্যা বুয়েটে যেমন সর্বোচ্চ ছিল, ঠিক তেমনি সিডনিতেও আমাদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। সিভিলের আশিক, সৌমেন, পিয়াস, সাইফ, আলম, তানজিলা, ইউসুফ, শান্তনু, আসাদ, মুক্তাদির, রনি, গালিব, সুজন আর রিফাত, ইলেকট্রিক্যালের রায়হান, ইয়ামিন আর বখতিয়ার, মেকানিক্যালের ননি আর হাবিব, ইউআরপির শারমীন, ওয়াটার রিসোর্সের সোহেল আর তানভীর আমাদের মধ্যে কমবেশি যোগাযোগ আছে। বিশেষ করে ছেলেদের মধ্যেই যোগাযোগটা বেশি। এ ছাড়া অন্য রাজ্যের বারী, এনথিয়া, দেবা, রউফ, তুষার, বাপেন সবার সঙ্গেই কমবেশি ফোনে কথা হয়।

পথিক ’৯৮ ব্যাচের লোগো
পথিক ’৯৮ ব্যাচের লোগো

আর কানাডাতে রয়েছে মহুয়ার নেতৃত্বে একঝাঁক পথিক। যাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয় ফেসবুকের মাধ্যমে। মাঝেমধ্যেই আমরা সিডনির পথিকেরা মিলে কফি আড্ডা দিই প্রায় ভোররাত পর্যন্ত। এ ছাড়া আছে মুভি নাইট। আমাদের দেখাদেখি আমাদের অর্ধাঙ্গিনীরাও কফি আড্ডা ও মুভি দেখা শুরু করেছে দলগতভাবে। তাদেরও একটা গ্রুপ আছে। আর প্রতিবছর অন্ততপক্ষে আমরা এক দিন একসঙ্গে ইফতার করি। আমাদের দেখাদেখি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যেও বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে গেছে। তাই আমাদের পুনর্মিলনীগুলোতে তাদের নিয়ে আর আলাদাভাবে ভাবতে হয় না। এবারের ইফতার আয়োজনের দায়িত্ব পড়েছে আমার ওপর। আমি যেহেতু সিডনি থেকে একটু দূরে থাকি, তাই তারা আমাকে দায়িত্ব দিল মিন্টোতেই আয়োজন করতে। কারণ এই সময় লাকেম্বাতে অনেক ভিড়, আবার পার্কিং পেতেও অনেক ঝামেলা হয়।

গত বছর ইঙ্গেলবার্নের ‘দাওয়াত’ রেস্তোরাঁয় হয়েছিল ইফতারের আয়োজন। এবার একটু স্বাদ পরিবর্তনের জন্য সবাই প্রস্তাব করল নতুন রেস্তোরাঁ নবাবের নাম। আমি বেশ কয়েকবার নবাবে গিয়ে খাবার ও ইফতারের মেন্যু কী হবে সেটা ফাইনাল করে ফেললাম। তারপর নির্দিষ্ট দিনে সবাই নির্দিষ্ট সময়ের আগেই নবাব রেস্তোরাঁয় চলে এল। আমরা নবাব রেস্তোরাঁর বাইরে পলিথিন দিয়ে ঘেরা জায়গাটা সিলেক্ট করেছিলাম যাতে বাচ্চারা একটু দৌড়াদৌড়ি করতে পারে। আর নবাবের পক্ষ থেকে দুটো হিটারও জ্বালিয়ে দিয়েছিল। ফলে শীতের তীব্রতা তেমনভাবে টের পাওয়া যাচ্ছিল না। ইফতারের সময় সবাইকে আলাদা আলাদা প্লেট দিয়ে গেল। আর রাতের খাবার ভেতরে সাজানো ছিল। সেখান থেকে সবাই নিয়ে খাচ্ছিল। পাশাপাশি ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে চলল জম্পেশ আড্ডা। এভাবে কখন যে রাত ১০টা বেজে গেছে আমরা খেয়ালই করতে পারিনি। অবশেষে সবাই বাসায় যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল। তখন আমি সবাইকে বললাম, আমাদের ব্যাচের ব্যানারের সামনে দাঁড়াতে। সবাই দাঁড়িয়ে গেলে রেস্তোরাঁর একজনকে দিয়ে কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম। ব্যানারটা আমি আগে থেকেই প্রিন্ট করে এনে বাসায় রেখে দিয়েছিলাম। তারপর ইফতারের দিন সবার আগে এসে টানিয়ে দিয়েছিলাম।

এ বছর আমাদের ব্যাচের ২০ বছর পূর্তি হতে যাচ্ছে। সে উপলক্ষে ঢাকায়ও পথিকেরা সমবেত হয়ে ইফতার করেছেন। তারপর সেখান থেকেই পরিকল্পনা করেছেন কীভাবে ২০ বছর পূর্তি পালন করা যায়। আমরা যেসব পথিক অস্ট্রেলিয়ায় আছি আমরাও ভাবছি অস্ট্রেলিয়ার সব পথিককে নিয়ে একটা বড় আকারের রিইউনিয়ন করার। আশা করি শিগগিরই সেটা নিয়ে আমরা কাজ শুরু করে দেব। এর মধ্য দিয়ে আমরা ফিরে যাব বুয়েটের সেই সব সোনালি দিনে, যখন আমরা নির্ভাবনায় ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াতাম। শুরুতেই বলেছি আমরা বাংলাদেশের এমন একটা প্রজন্ম, যারা প্রযুক্তির বিবর্তনটা দেখতে দেখতে বড় হয়েছি। তাই আমাদের মধ্যে যেমন আধুনিকতা আছে পাশাপাশি আছে মানবিক মূল্যবোধ। আছে নির্মোহভাবে একে অপরের বিপদের দিনে পাশে দাঁড়ানোর মানসিক শক্তি। তাই আমরা জীবিকার তাগিদে বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকি না কেন আমাদের একটাই পরিচয় আমরা সবাই ‘পথিক ৯৮’।
...

মো. ইয়াকুব আলী। ই–মেইল: <[email protected]>