'শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে'

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আয়ান বন্ধুদের সঙ্গে বসে চা খাচ্ছে নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের বাংলাদেশি দোকানে। বুয়েট থেকে পাস করে এমএস করার জন্য বছর দু-এক আগে এসেছে নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে। শুরুতে তিন মাসের টিউশন ফি নিয়ে চলে এসেছিল। শুনেছে সবাই এখানে কাজ করে পড়ার খরচ চালায়। নিজে না এলে কিছুতেই বুঝত না, কাজটা কত কষ্টের। রাতদিন যেখানে কাজ পায় করে—বার্গারের দোকান, কফি শপ।

বহুদিন পর ছুটির দিনে বন্ধু রাজের জোরাজুরিতে নজরুলজয়ন্তী উৎসবে এসেছে। মনে মনে ভেবেই রেখেছে জাতীয় কবি, বাস্তবতার জটিলতায় তোমার এই পাঠকের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশি পাড়ায় এসে কেন যেন মনে রিন রিন করে বেজে চলেছে, ‘আকাশে আজ ছড়িয়ে দিলাম প্রিয়’।

ক্লাবে দেখতে গেল অনুষ্ঠান। প্রথমেই শুরু হলো নাচ। ছোট ছোট বাচ্চারা কী সুন্দর করেই না নাচছে, ‘মোমের পুতুল মমীর দেশের মেয়ে নেচে যায়...।’ তারপর নাটক, কবিতা ‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’। রাত প্রায় ৯টা বাজে। পরদিন আবার গৎ জীবনের শুরু। ইলিশ মাছ দিয়ে ডিনার করে বিরতির পর সংগীত অনুষ্ঠানের জন্য অপেক্ষা করছে আয়ান। গান গাইবে শিল্পী নূপুর। শুনল ভালো গান গায়। পর্দা উঠে যেতেই শুরু হলো গান—‘মোর ঘুম ঘোরে কে এলে মনোহর’।

আয়ান মনে মনে ভাবে, এত সুন্দর গান আর পরির মতো সুন্দর এ কে? পরের গান ছিল ‘শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে...’। আয়ান হৃদয়ে ঝড়ের পূর্বাভাস টের পেল। এতকাল কী তবে...নাহ ওর বাস্তব কী কঠিন। তবু আয়ান গান শেষ হওয়ামাত্র স্টেজের পেছনে মন্ত্রমুগ্ধের মতো চলে গেল। দেখল ওর স্বপ্নপুরীর রাজকন্যা নেমে আসছে। কাছে গিয়ে বলে বলল, ‘নূপুর আপনার সেল নম্বর কি দেবেন প্লিজ?’ শুনল, কঠিন গলায় কেউ বলছে, ‘এই ছেলে যাও বাসায় যাও, এই এক সমস্যা এদের নিয়ে।’ নূপুরের পাশের বয়স্ক নারীকে দেখেনি আয়ান। লজ্জায় তাড়াতাড়ি সরে গেল সে। ট্রেন ও বাসে করে বাসায় ফিরতে ফিরতে মনে হলো, ‘হারানো হিয়ার নিকুঞ্জ পথে কুড়াই ঝরা ফুল একেলা আমি’।

আয়ান ফিরে গেল কঠিন জীবনসংগ্রামে। একদিন কফি কার্ট বন্ধ করে দেবে, সময় শেষ, এমন সময় হুড়মুড় করে নূপুর এল। ইংরেজিতে বলল, ‘এক কাপ এক্সপ্রেসো দিন না প্লিজ। কালকে টার্ম ফাইনাল, রাত না জাগতে পারলে খুব সমস্যা হবে।’ আয়ান দিল বানিয়ে। বাংলায় বলল, ‘কোথায় যাবেন বলুন, আমি কার্ট বন্ধ করে হেঁটে যেতে পারি।’ আয়ত চোখ তুলে নূপুর বলল, ‘আপনি বুঝলেন কী করে আমি বাংলাদেশি?’ আয়ান বলল, ‘এত অপূর্ব গান যে গায় তার ফ্যান থাকাটা কি খুব অস্বাভাবিক?’ আয়ানের মনে বেজে চলেছে, রুমঝুম...ভাঙল রাতের ঘুম...নাচে স্বপন পুরির রাজকন্যা।

ট্রেন স্টেশনে যেতে যেতে জেনে নিল নূপুরও নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ছাত্রী। গ্র্যাজুয়েশন করছে। নূপুর একটুও অহংকারী নয়। তাঁর নম্বরটা দিল। বাসার ছোট্ট রুমে ফিরে বেজে চলল মনে মনে, ‘পথ চলিতে যদি চকিতে কভু দেখা হয় পরাণ প্রিয়।’

লেখিকা
লেখিকা

এভাবে বছর ঘুরে গেল। মাঝে মাঝে ফোনে কথা হয়। নূপুরের গানের অনুষ্ঠানেও যায়। চলে আসার সময় মনে হয়, ‘ওই জলকে চলে লো কার ঝিয়ারি, রূপ চাপে না তার নীল শাড়ি’। কিন্তু বলা হয় না। মাস্টার্স শেষ করে চাকরি পেতে আরও এক বছর। এর মাঝে ফাইনালের আগে নূপুরের সঙ্গে দেখা ইউনিভার্সিটিতে। সঙ্গে ওর খালা, যার কাছে বকা খেয়েছিল আয়ান। না দেখার ভান করে চলে যাওয়ার চেষ্টা করতেই নূপুর ডাকল, আয়ান খালার সঙ্গে পরিচিত হয়ে যাও।

খালা বিরক্ত গলায় বললেন, ‘কোনো বাংলাদেশি ছেলেকে তুমি চেনো, বলোনি তো। যা হোক আয়ান, এ কলেজের এক প্রফেসরের কাছ থেকে নূপুরের বিয়ের প্রপোজাল এসেছে। খোঁজ নিয়ে জানিয়ো।’ আয়ান কোনো রকমে ঘাড় কাত করে চলে এল। মনে বেজে উঠল, ‘আমার যাওয়ার সময় হলো দাও বিদায়’।

পরদিন টেস্ট শেষে আয়ান সেন্ট্রাল পার্কে চলে এল। নির্জন জায়গায় বসে খুব কাঁদল। পরের কয়টা শো মিস হলো ওর। ফোন করল অভিমান ভরা কণ্ঠে নূপুর, ‘কি আয়ান, চিনতে পারছ না?’ মনে মনে আয়ান বলল, ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রানি’। বলতে পারল না। আরও এক বছর বলা হবে না। চাকরি, তার সঙ্গে ভিসা স্ট্যাটাস বদলানো তারপর। অনেক জোরাজুরিতে পরের নজরুলজয়ন্তীতে গেল আয়ান। চোখে পানি নিয়ে শুনল নূপুর কিন্নর কণ্ঠে গাইছে, ‘আমি যার নূপুরের ছন্দ...কে সেই সুন্দর...’।

অনুষ্ঠানের পরে নূপুর বলে বসল, ‘চলো বাসায় পৌঁছে দেবে। যেতে যেতে শুনল, ওর গ্র্যাজুয়েশন শেষ হলে বছরখানেক চাকরি করবে। আর খালার বাসায় থাকবে না। আয়ান বলল, ‘ওই গানটা তুমি একটু গাইবে, “শাওন-রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে...”।’ নূপুর গানটার কয়েক লাইন গাইল। তারপর ওর চোখ মুছে বলল ‘এত জল ও কাজল চোখে...’। ‘কেন কাঁদছ আয়ান? আমিও তো পড়তে এসেছি দেশ থেকে। মার সূত্রে ইমিগ্রেশন পাওয়া। তুমি যদি চাও তাহলে একটা বছর দুজনে কষ্টে চালিয়ে নিতে পারব না? মনের কথাটা কি আমাকেই বলে দিতে হবে?’ আয়ান চোখ মুছে গাইল, ‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয় একি মোর অপরাধ’।

ম্যারেজ লাইসেন্সের আবেদন করেছে ওরা। আয়ান খুব মন দিয়ে পড়ছে। বিয়ের পরপর গানের পাখির সঙ্গে অনেক কথা বলবে সে, ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে দিসনে আজি দোল’।