চন্দ্রা চক্রবর্তীর শ্বাসরুদ্ধকর সুফি কালাম পরিবেশনা
পূর্ব লন্ডনের রিচমিক্সে মিলনায়তন উপচে পড়া বাঙালি ও বিপুল অবাঙালি দর্শক-শ্রোতা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন সুফি আমীর খসরুর কালাম, সন্ত কবীরের দোহা, বৈষ্ণব হোলি সংগীত। তাঁরা সংবিৎ ফিরে পান যখন প্রতীচ্যে শাস্ত্রীয় সংগীতের অসামান্য শিল্পী চন্দ্রা চক্রবর্তী এক মন্ত্রমধুর ভজন দিয়ে তাঁর বিচিত্র সব পরিবেশনার সমাপ্তি টানেন। দর্শকদের কারও চোখে টলমল করছে। কারও কারও চোখ বেয়ে আবার গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুধারা।
রাধারমণ সোসাইটি আয়োজিত তিন দিনব্যাপী এই উৎসবের শেষ দিনে চন্দ্রা চক্রবর্তীর পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের অধিবিদ্যা দর্শন নিয়ে আলোচনা ও সংগীত পরিবেশন করেন ব্রিটেনের অন্যতম রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। ‘আমারে তুমি অশেষ করেছ’ দিয়ে শুরু করে রবীন্দ্রনাথের মর্মস্পর্শী মরমি সংগীত ‘মরিলো মরি আমায় বাঁশিতে কে ডেকেছে গো’ দিয়ে ইমতিয়াজ শেষ করেন তাঁর অতলস্পর্শী ও ধ্যানমগ্ন পরিবেশনা।
সংগীতশিল্পী অমিত দের কণ্ঠে বাংলা দরবেশি সংগীতের অপূর্ব রূপায়ণ রিচমিক্স মিলনায়তনে সঞ্চার করে এক ভক্তিবিধুর আবেশ। হাসন রাজার ‘মাটির পিঞ্জিরার মাঝে’ গান দিয়ে শুরু করে অমিত শেষ করেন এক বিরল প্রায় বিলুপ্ত ধামাইল গান দিয়ে। গানের সঙ্গে নৃত্যশিল্পী সোহেল আহমেদের নেতৃত্বে ধামাইল নাচ শুরু হলে এতে যোগ দেন অণু দেব, মৌলি ধর ও বেশ কয়েকজন অবাঙালি দর্শকও।
অমিতের গাওয়া বাউল রাশিদ উদ্দিনের ‘মানুষ ধর মানুষ ভজো শোন বলি রে পাগল মন’ গানের সঙ্গে সুফি নৃত্যে অংশ নেন সোহেল আহমেদ।
কত্থকশিল্পী ইন্দ্রাণী দত্ত পার্সিয়ান কবি রুমির কবিতার সরাসরি পাঠের সঙ্গে মোহময় সব মুদ্রা ও দেহভঙ্গিমা দিয়ে কবিতার দৃশ্য রূপায়ণ করেন। কবিতা পাঠে অংশ নেন কবি আহমেদ কায়সার। পরে চন্দ্রা চক্রবর্তীর গাওয়া হোলি সংগীতের সঙ্গে কত্থক নাচের এক অপূর্ব যুগলবন্দী পরিবেশন করেন।
তবলায় সংগত করেন সলিল তাম্বে ও পিয়াস বড়ুয়া। কি-বোর্ডে ছিলেন অমিত দে। চন্দ্রা চক্রবর্তীর সঙ্গে কণ্ঠ সহযোগিতায় ছিলেন তাঁর দুই সংগীত শিষ্য ড. প্রিয়া ভগবত ও শিল্পী শতরূপা ঘোষ।
অনুষ্ঠানের শুরুতে ব্রিটিশ-বাংলাদেশি শিশুশিল্পী সানিয়া আলম বাউল ও বৈষ্ণব সংগীতের ওপর একটি সংক্ষিপ্ত অথচ তথ্যবহুল পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপন করে।
গত শুক্রবার (২৪ মে) পূর্ব লন্ডনের কবি নজরুল সেন্টারে উৎসব শুরু হওয়ার পর দ্বিতীয় দিন শনিবার সেন্টা মার্গারেট হাউসে রবীন্দ্রনাথের বাউল ভাবনার গান ও নিজের সুরারোপ করা বৈষ্ণবসংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী সঞ্জয় দে। সুফি ও বাংলা মরমি সংগীত পরিবেশন করেন অমিত দে ও বাপিতা বাপী। সংগীত সহযোগিতায় ছিল ফিউশন ব্যান্ড লন্ডন ডিসি।
রিচমিক্সে শেষদিনে উপস্থিত পর্তুগিজ দর্শক বার্থি লাসামানে বলেন, এটি এক অভূতপূর্ব সন্ধ্যা। বারবার এ রকম অনুষ্ঠানে আসতে চাই। বন্ধুদেরও এ রকম শক্তিশালী, গতিময় ও মর্মস্পর্শী সংগীত অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পরামর্শ দেব। সত্যিই এক উপলিফটিং অভিজ্ঞতা।
ফেস্টিভালের কিউরেটর আহমেদ কায়সার জানান, ‘তিন দিনই বিপুলসংখ্যক অবাঙালি দর্শকদের উপস্থিতি এবং অনুষ্ঠান সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানাতে তাঁদের বাকরুদ্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা আমাদের যারপরনাই অনুপ্রাণিত করেছে। ভারত উপমহাদেশে উদ্ভূত এই ভক্তিবাদী সংগীতকে যারা এত দিন গেঁয়ো মানুষের গান বলে অবজ্ঞা করে আসছেন, এবার তাঁদের অবাক হওয়ার পালা।’