অলৌকিক রাজকন্যার বাস্তবিক জন্মদিন

মারিয়ম। ছবি: মোরশেদ আলম
মারিয়ম। ছবি: মোরশেদ আলম

এক চিলতে রোদ এসে ভর করেছে হাসপাতালের বারান্দায়। বাইরে দক্ষিণের বাতাসের চাপ আছে। একটু বেশি হলে বাতাসের বেগে চোখ ছলছল করে ওঠে। হাসপাতালের ওই বারান্দা আমাদের বেশ কিছুদিনের জানা পরিচিত জায়গা। জানা পরিচিত না হওয়ার কোনো উপায় যে নেই। প্রায় দেড় মাস এ বারান্দার পাশের রুম ছিল আমাদের রুম। আমাদের রুম মানে আমার স্ত্রীর রুম। তিনি সন্তানসম্ভবা। এর আগেও দুবার তিনি সন্তানসম্ভবা ছিলেন। কিন্তু ওরা পৃথিবীর আলোয় আলোকিত হওয়ার আগেই গভীর অন্ধকারে হারিয়ে গেল। সে হারিয়ে যাওয়া অন্ধকারে আমরাও ডুবে ছিলাম এক চিলতে আলোর আশায়।

অনেক চড়াই-উতরাই করে সেই আলোর আভা আবার দেখা দিয়েছিল। আমরা যেন সেই আলোই দেখছিলাম এত দিন, যেই আলোকে খুঁজছিলাম। সেই আলোয় যে শঙ্কা ছিল, তা কিছুদিন পরেই বুঝতে পারলাম। বারো সপ্তাহের মাথায় ডাক্তার উঠে–পড়ে লাগলেন শঙ্কামুক্ত করতে। ছোট্ট একটা অপারেশন হলো আমার স্ত্রীর। আমরা আগের হারানো দুঃস্মৃতি মুছে ফেলতে চাইছিলাম। কিন্তু শঙ্কা যেন পিছু ছাড়ছে না আমাদের। ষোলো সপ্তাহ শেষে ডাক্তার সবকিছু ঠিক আছে বলে জানিয়ে দেন। কিন্তু সপ্তাহে একবার করে মনিটরিংয়ের জন্য দিন ধার্য করেন। দিন যায় সপ্তাহ যায়। আমরা নিয়মিত হতে লাগলাম হাসপাতালে। সতেরো–আঠারো সপ্তাহ গিয়ে উনিশে ঠেকল। ডাক্তার অন্য সপ্তাহের মতো চেকআপ করছেন। কিন্তু হঠাৎ করেই ভ্রু কুঁচকে বারবার কী যেন দেখতে লাগলেন। শুরু থেকে তিনিই দেখভাল করছিলেন আমার স্ত্রীকে। সব দেখেশুনে তিনি বলতে লাগলেন, আমাদের সন্তান বাঁচার সম্ভাবনা নাকি ক্ষীণ। যেকোনো সময় নাকি মিসক্যারেজ হয়ে যেতে পারে। আমি আমার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছি, সেও আমার দিকে।

দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে যেন নীরবে আমাদের আবেগ আর ভালোবাসার কথাগুলো শুনছিলাম। আমাদের স্বপ্নের কথা। মেয়ে হলে কেমন হবে। ছেলে হলে কেমন দেখতে হবে। কিন্তু নীরবতায় যেন হঠাৎ করে আমরা ভাঙনের শব্দ পাচ্ছিলাম। কিন্তু আমার স্ত্রী অনড় তার সিদ্ধান্তে।

খোদার ওপর তার অগাধ বিশ্বাস। সন্তান গর্ভধারণের আগে সে কাবা শরিফ ঘুরে এসেছে। অনেক কান্নাকাটি করে এসে আবার মা হতে চলেছে। কিন্তু স্বপ্নভঙ্গের এই দুঃস্বপ্ন যেন তাকে একটুও টলাতে পারেনি। সাত মাস রিক্সইনিং বেডের পা ওপরের দিকে দিয়ে ঘুমিয়েছে। তার ধারণা, গ্রাভিটি কাজ করবে। তার সঙ্গে যোগ হয়ে আমিও বললাম, দেখতে চাই আমরা কত দূর যেতে পারব। কারণ, এসব দেশে চব্বিশ সপ্তাহ হলে সন্তান বাঁচানোর জন্য ডাক্তার ও হাসপাতাল চেষ্টা করে। সে আশায় এবং খোদার ওপর ভরসা করে উনিশ সপ্তাহ থেকে একেকটি দিন করে পথচলা শুরু। এক দিন যায় তো দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে আরেক দিন খুঁজি।

আমার স্ত্রী প্রার্থনা করেছেন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু। বিশ্বাস থাকলে যে প্রকৃতিও সাড়া দেয়, তা আমরা প্রবলভাবে বিশ্বাস করতে লাগলাম। আমার স্ত্রী হাসপাতালে ভর্তি সেই উনিশ সপ্তাহ থেকে। ডাক্তাররা দিন গুনছেন কখন গর্ভপাত হবে আর আমরা দিন গুনছি কখন চব্বিশ সপ্তাহ পার করব। বাঁচা-মরার সংখ্যায় যেন হাডুডু খেলার মতো চলছিল। যেন দাগ ছুঁয়ে সময় পার করছিলাম।

উনিশ, বিশ, একুশ, বাইশ সপ্তাহ শেষ করে আমরা তেইশ সপ্তাহ এক দিনের মাথায় ডাক্তারের চেম্বারে। মনিটরিং শেষ করে ডাক্তার যেন আরও হতাশ হয়ে গেলেন। ওই দিন রাতেই গর্ভপাত হতে পারে বলে সহকারী ডাক্তারদের বলে গেছেন, উনি রাতে অন কলে থাকবেন। দুশ্চিন্তায় বিবর্ণ আমার মুখ। চোখ বন্ধ করে কী যেন পড়ছে আমার স্ত্রী। সেই রাতে আমার স্ত্রী ভয়ে টয়লেটে যায়নি একটিবারের জন্য। যদি কিছু একটা হয়ে যায়। রাত শেষে ভোর নেমে আসে। নির্ঘুম আমরা। কিন্তু না কিছুই হয়নি। আমার স্ত্রী আমাকে অভয় দেয়, দেখবে কিছুই হবে না। ঠিক তাই কিছুই হয়নি। আমরা চব্বিশ সপ্তাহ পেরিয়ে পঁচিশ, তারপর ছাব্বিশ, তারপর সাতাশ সপ্তাহে তিন দিনে এসে দাঁড়িয়েছি। আমার স্ত্রী ডাক্তারদের এত দিন কোনো কিছুই চেক করতে দেননি। কিন্তু সাতাশ সপ্তাহ তিন দিনের মাথায় ডাক্তাররা সিদ্ধান্ত নিলেন, ওই দিন তারা চেকআপ করবেনই। আমরা বাধা দিলাম না। পরে ডাক্তার বললেন, অপারেশন করতে হবে। না করলে কমপ্লিকেশন হবে।

সেদিন ছিল জুন মাসের ১ তারিখ। আমার স্ত্রীর জন্মদিন। তা দিব্যি ভুলে গেছি আমি। দিনটি ছিল শুক্রবার। রোজার দিন। রোদ উঠেছে। মৃদু বাতাস মন ভালো করে দেওয়ার মতো পরিবেশ। কিন্তু খুব অস্থির লাগছে আমার। জুমার নামাজ শেষ করে এলাম। ডাক্তাররা দল বেঁধে এসেছেন আমার স্ত্রীকে কাউন্সেলিং করতে।

বিকেল চারটার একটু আগে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকলাম সস্ত্রীক। এ দেশে কী সুন্দর নিয়ম, নিকটাত্মীয় থাকতে পারেন অপারেশন থিয়েটারে রোগীর সঙ্গে। সব শঙ্কা কাটিয়ে বিকেল সাড়ে চারটায় মায়ের জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর জন্য পৃথিবীর সমস্ত আলোকে হার মানিয়ে আরেক আলো এসে ধরা দিল পৃথিবীতে। আমার রাজকন্যা। মুহূর্তে ওকে ছুঁয়ে দেখতে দিল না। অন্য রুমে নিয়ে গেল। ডাক্তারদের ধারণা অনুযায়ী কাঁদার কথা ছিল না। কিন্তু না, সবকিছু ভুল প্রমাণ করে কেঁদে উঠল আমার মেয়ে। ওকে ইনকিউবেটরে রাখা হলো। কয়েক মিনিটের মধ্যে যন্ত্রপাতিতে পুরো শরীর জড়িয়ে দিলেন ডাক্তার–নার্সরা।

বাবার কোলে মারিয়াম। পাশে তার মা। ছবি: মোরশেদ আলম
বাবার কোলে মারিয়াম। পাশে তার মা। ছবি: মোরশেদ আলম

আমার স্ত্রীকে অপারেশন শেষে পাঠিয়ে দিল তার রুমে। রুমে ফিরেছে ঠিকই, কিন্তু তার মন পড়ে আছে যেন মেয়ের কাছে। আমি দুই দিকে ছোটাছুটি করছি। আমি তাকিয়ে আছি সদ্য নবজাতক কন্যার মুখের দিকে। তুলতুলে গাল। ছোট ছোট হাত। চোখ ঢেকে দেওয়া আর নাক–মুখে অক্সিজেন মাস্ক দেওয়া। সন্ধ্যায় পুরো বেড নিয়ে শুয়ে মেয়েকে দেখতে এল আমার স্ত্রী নিউ নেইটাল কেয়ার ইউনিটে। ওর দুই চোখ দিয়ে জল ঝরছে। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখল মেয়েকে। দেখে আরও যেন আবেগতাড়িত হলো সে।

দুই দিন পর ঢেকে রাখা চোখ খুলে দিল। মিট মিট করে কন্যা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দুই হাতের তালু জোড়া করলে আমার কন্যাকে রাখা যায়। খুবই ছোট্ট। এ দেশে এক আজব জিনিস করে ডাক্তাররা আমাদের খালি গায়ে কন্যাকে রেখে দিল। এটার নাম দিয়েছে ওরা ক্যাঙারু কেয়ার। এটা নাকি ওকে সাহস জোগাবে। শক্তি দেবে বাঁচার। ছোট্ট বিড়ালছানার মতো আমার বুকে মুখ লুকিয়ে রাখত আমার মেয়ে। আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতাম আমার বিড়ালছানাকে নিয়ে। একটু একটু করে বড় হতে লাগল সে। এখনো আমরা বিশ্বাস করতে পারি না ওর প্রথম জামাকাপড় দেখলে। এত ছোট্ট ছিল আমার মেয়ে। মেয়ের মা মেয়ের নাম রাখল মারিয়াম। তার সঙ্গে আমি আমার নাম জড়িয়ে দিয়েছি।

মারিয়াম জোড়া হাতের তালু থেকে বুকে এল। তারপর কোলে। আর এখন তো সে হামাগুড়ি দেয়। নিজে নিজে দাঁড়ায়। ছোট্ট দুটো দাঁত উঠেছে ওর। আমার সারা ঘর এখন তার ঘর।

আমি গান বেঁধেছিলাম ওর জন্য। সেই ছোট্টবেলা থেকে এই গান শুনে শুনে সে সময় পার করত। এখন আমি যখন গান গাই, সেও গুনগুনিয়ে গুনগুন করে ওর ভাষায়। গান লিখেছি ঠিক এ রকম—

জল কন্যা জলে ভাসে
মন কন্যা মনে
আমার কন্যা আমার বুকে মুখ লুকিয়ে কানে
কন্যা আমার বাবা প্রিয়। বাবার কন্যারে।
সে কন্যারই নাম দিয়েছি রাজকন্যারে!

সে রাজকন্যা সত্যিই আমার জীবনের সব রং বদলে দিয়েছে। আমাকে সুখ দিয়েছে। সে সুখে আমি দিব্যি ডুবে আছি। ১ জুন আমার রাজকন্যার জন্মদিন। শুভ জন্মদিন রাজকন্যা মারিয়াম।

সুন্দর এক আগামীর প্রত্যাশা রইল তোমার প্রতি। মানবিক মানুষ হবে। দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়াবে। মানবতার ফেরিওয়ালা হয়ে দেশ–বিদেশে ভ্রমণ করবে—বাবা হিসেবে এ প্রত্যাশাই রইল তোমার প্রতি। জন্মদিনে শুভেচ্ছা রইল। শুভ জন্মদিন, মা।

ও হ্যাঁ, ১ জুন মারিয়ামের মায়েরও জন্মদিন। অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইল মারিয়ামের মায়ের জন্য।
...

লেখক: অ্যাকাউন্ট্যান্ট ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক: টেক্সমার্ট অ্যাকাউনট্যান্টস লিমিটেড, লন্ডন, যুক্তরাজ্য।
ই–মেইল: <[email protected]>