রানি দুদুমা জলপ্রপাত

রানি দুদুমা জলপ্রপাত
রানি দুদুমা জলপ্রপাত

প্রকৃতিপ্রেমিক যাঁরা, তাদের কাছে দেওমালি পাহাড়ের পাশ দিয়ে ছুটে চলার অনুভূতি সত্যিই অসাধারণ। পাহাড়ের রেঞ্জজুড়ে ধাপে ধাপে অন্তহীন ছড়িয়ে গিয়েছে আরণ্যক প্রকৃতি। নগর দূষণের বাইরে নির্মল পরিবেশে বুক ভরে নিশ্বাস নিতে গেলে মুহূর্তেই সতেজ হয়ে ওঠে ফুসফুস। এর পাদদেশ ছুঁয়ে সর্পিল গতিতে এগিয়ে চলেছে রেললাইন। গাড়িতে বসেই ওদের চোখে পড়ল, মাছকুন্দ ড্যাম (মাছকুন্দ হাইড্রো ইলেকট্রিক পাওয়ার স্টেশন) তার সদম্ভ অস্তিত্বে মুখরিত হচ্ছে। ওডিশার কোরাপুট ও অন্ধ্র প্রদেশের বিশাখাপট্টনামের সীমান্ত জংশনের অবস্থান। ওডিশা ও অন্ধ্র প্রদেশের সরকার যৌথভাবে এই জলবিদ্যুৎ প্ল্যান্টটি নির্মাণ করেছে বিশ শতকের শেষ অধ্যায়ে। মাছকুন্দ গোদাবরীর শাখা নদী। এই নদীর ওপরে এক শটি আদিবাসী গ্রামের মানুষ সর্বতোভাবে নির্ভরশীল। এখানে মূলত তিন রেসের আদিবাসী রয়েছে—দ্রাবিড়, মুন্ডা ও অস্ট্রো-এশিয়ান। বোঁদারা এদের মধ্যে আদিমতম।

কাল চিলিকা হ্রদ থেকে ফেরার পরে সুরেশ বাঞ্জারা সুচরিতদের স্যার-ম্যাডামের পরিবর্তে দাদা, দিদি বলে সম্বোধন করতে শুরু করেছে। বহ্নির বড় ভালো লাগছে তাতে। সুরেশের চেহারা থেকে লজ্জার আভাস মুছে গিয়েছে। আচরণেও আগের নিস্তরঙ্গ ভাবটি আর বজায় নেই। থেকে থেকেই সে মুখর হচ্ছে। হাসছে প্রাণ খুলে। হিন্দি ও ওড়িয়া মিশিয়ে কথা বলতেও এখন আর কসুর করছে না। আনুকাদালি গ্রামের পাশ দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ সে উৎসাহী হয়ে উঠল, দাদা, এই গাঁয়েই কিষণ শিশার বাড়ি। যাবেন? সুচরিত অবাক হলেও হতাশ করল না তাকে। বলল, রানি দুদুমা আর গুপ্তেশ্বর গুহা দেখার পর এমনিতেই তো হোটেলে ফিরতে রাত হয়ে যাবে সুরেশ। তারপর ওখানে ঘুরতে গেলে আরও বেশি দেরি হয়ে যাবে না? হ্যাঁ, দেরি হবে ঠিক কথাই। তবে ওখানে গেলে একটা অবাক জিনিস দেখতে পাবেন দাদা! কী? ওখানে কিষণের এক জ্যাঠা আছেন। মানুষ দেখে সবকিছু বলে দিতে পারেন! কী রকম? তিন বছর আগে পোল্যান্ড থেকে দুজন টুরিস্ট এসেছিলেন রানি দুদুমা জলপ্রপাত দেখতে। তো জ্যাঠার কথা বলতেই তাঁকে দেখার জন্য ওরা রাজি হয়ে যান। তাঁদের একজনকে উনি বলেছিলেন, পরের দিন রাতে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হবে তাঁর। আমরা তাঁকে আগেই হাসপাতালে ভর্তি হতে বলেছিলাম। কিন্তু তাঁর বিশ্বাস হয়নি জ্যাঠার কথা! সত্যিই মারা গিয়েছিলেন? হ্যাঁ। তো সাংঘাতিক ব্যাপার তো! তাহলে বোধ হয় ভয় পেয়ে হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। না, না দাদা, ভয় পাবেন কী। উনি তো সে কথা বিশ্বাসই করেননি। তাহলে দেখা করতে গিয়েছিলেন কেন? নিছক কৌতূহল থেকে। কৌতূহল সুচরিতের মনেও জেগে উঠল এরপর। সুচরিত স্ত্রীর মুখে তাকাল, একবার যাবে নাকি বহ্নি?

রানি দুদুমা জলপ্রপাত
রানি দুদুমা জলপ্রপাত

মাথার ওপর প্রখর তেজে সূর্য জ্বলছে বহু সময় ধরে। বিশাল এক মহুয়াগাছের নিচে ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে সুচরিতদের নিয়ে বন্ধুর বাড়িতে প্রবেশ করল সুরেশ। চারপাশের দৃশ্যপট মুহূর্তে দেখে নিল বহ্নি। বাড়িতে তিনটে ছোট ছোট নিচু ঘর। খড়ের চাল, মাটির দেয়াল দিয়ে তৈরি। চারপাশে মুরগির ঝাঁক চরে বেড়াচ্ছে মুক্ত বিহঙ্গ হয়ে। দুটো কুকুর অশ্রান্ত ভঙ্গিতে দাঁত দিয়ে খিঁচে খিঁচে গায়ের উকুন সাফ করছে সম্ভবত। তার কাছে শুয়ে শুয়ে জাবনা কাটছে চারটি গরু। আর উঠোনের মাঝখানে একজন বৃদ্ধা ধুলো মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে শুকনো লতাপাতা ভেঙে বাঁশের সাজিতে তুলছেন। তাঁর সামনে এসে সুরেশ অচেনা ভাষায় কিছু বলতেই ডান হাতের পাতা কপালের ওপর রেখে বহ্নিদের দিকে মুখ তুলে তাকালেন। কয়েক মিনিট ধরে তাঁদের মধ্যে কী বাক্যালাপ হলো কে জানে।

সুরেশের মুখে হতাশার ছায়া ভাসল—হবে না দাদা। বুড়ি মা ছাড়া বাড়িতে আর কেউ নেই। আজ রোববার তো, মেয়েরা হাটে গেছে। আর জ্যাঠা এখন অনেক দূরের গাঁয়ে। সঙ্গে তাঁর দুই ছেলে আর কিষণের দাদা। রোগী দেখতে বেরিয়েছেন। ফিরতে কয়েক দিন পেরিয়ে যাবে। ডাক্তার নাকি? প্রশ্ন শুনে হাসল সুরেশ, হ্যাঁ। এই যেসব শুকনো লতাপাতা দেখছেন, এগুলো দিয়েই সব রোগের ওষুধ তৈরি হবে। বনবাদাড় থেকে এসব সংগ্রহ করা হয়। জ্যাঠার হাতযশও খুব ভালো। গত বছর আছাড় খেয়ে আমার বাবার পিঠের হাড় ভেঙেছিল। জ্যাঠার ওষুধেই ভালো হয়। বা, তাহলে তো বেশ! হ্যাঁ। কিন্তু জ্যাঠার ছেলেরা কেউ ও রকম হয়নি।

কিষণ শিশার জ্যাঠার বাড়িতে একটা বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা সুচরিতদের হোক, এমনটাই চেয়েছিল সুরেশ। ইচ্ছেটা অপূর্ণ থাকায় অনেক সময় এরপরে সে নীরব হয়ে রইল। ছোট ছোট টিলার রাজ্য পেরিয়ে সুরেশের গাড়ি এগোচ্ছে পলকা পায়ে লাফাতে লাফাতে। পথের পাশে পাশে বুনো কচুর ঝাড়। তার মূল, কুন্দ খুঁচে খুঁচে নানা মাপের শুয়োরগুলো খাচ্ছে। এদের মাংস সাঁওতালসহ অনেক আদিবাসীরই প্রিয় খাবার। হঠাৎ অদূরেই একটি গণমিছিল আসতে দেখে পথের পাশে গাড়ি থামাল সুরেশ। নারী-পুরুষনির্বিশেষে লাঠি হাতে, ঝাঁটা হাতে দৃঢ় সংকল্পে এগিয়ে চলেছে নির্দিষ্ট কিছু শব্দ উচ্চারণ করতে করতে। তাদের কারও কারও চোখেমুখে উলকি আঁকা। কিন্তু বোঁদাদের মতো কেউ উলঙ্গ নয়। মেয়েদের মাথার চুলে খোঁপা বাঁধা। নারী-পুরুষ কারওর চুলই কুঞ্চিত নয় মোটে। বহ্নিরা প্রশ্ন করার আগেই কথা বলল সুরেশ, এরা বন কেটে ফেলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে সবাই। এরা চায় না অরণ্য ধ্বংস করে এখানে শহর তৈরি করা হোক। শিল্পপ্রতিষ্ঠান তৈরি করে ওদের অরণ্যের জীবন ধ্বংস করা হোক। বহ্নি হঠাৎ বলে উঠল, ঠিকই তো, সব জঙ্গল সাফ করা হলে, বনের পশুপাখিরাই বা বাঁচবে কী করে? সেসব কথা কে শুনছে দিদি? এখানে এখন একদিকে সরকার থেকে, অন্যদিকে প্রাইভেট সেক্টর থেকে আয় বাড়ানোর জন্য ট্যুরিজমের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ওদিকে গৌড়াগুডা গাঁয়ের কুমোরপাড়ায় দুই একর জায়গার ওপর ফরেনারদের জন্য আধুনিক গেস্টহাউস তৈরি হয়েছে। কোরাপুটের প্রত্যেকটা ব্লকেই তৈরি হচ্ছে মাঝারি থেকে ছোট সাইজের নানা ইন্ডাস্ট্রি। ওরা তাই ক্ষেপে যাচ্ছে! মাঝে মাঝেই ওরা মিছিল করছে তাই।

কোরাপুট ডিস্ট্রিক্টকে বলা হয় ওডিশার সুইজারল্যান্ড। এর চারদিকেই ছড়িয়ে রয়েছে অসাধারণ ল্যান্ডস্কেপ। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য, নিষ্কলুষ সান্নিধ্য কামনা করেন না এমন সুস্থ, অনুভূতিশীল মানুষের সংখ্যা জগতে বিরল। অতএব রানি দুদুমা দেখতে গিয়ে সুচরিতদের সঙ্গে পরিচয় হলো সুদূর আয়ারল্যান্ড থেকে ছুটে আসা এক জোড়া দম্পতি, মিস্টার অ্যান্ড মিসেস ম্যাককার্থির সঙ্গে। সুচরিতদের মতো তারাও নির্দিষ্ট স্থানে গাড়ি পার্ক করে গৈরিক পাহাড়ি পথে হাঁটছিলেন। অবশ্য ট্যুরিস্ট হিসেবে এখানে কেবল যে প্রকৃতিপ্রেমিকরাই রয়েছেন, তা নয়। ঐতিহাসিক গুরুত্ব থাকায় এই স্থান অনেক গবেষকদেরও আকর্ষণ করে আনছে। এককালে অঞ্চলটি নন্দ বংশীয় মগধরাজের শাসনাধীন ছিল। সম্ভবত সেই কারণেই জলপ্রপাতটির নামকরণ হয়েছে ‘রানি দুদুমা’। পার্কিং লট থেকে এক কিলোমিটার দূরে থাকায় লালচে মাটির অমসৃণ পথে সুচরিতদের হাঁটতে হলো কিছুটা। চোখে পড়ল দূরে অদূরে ইতস্তত ছড়িয়ে রয়েছে অনেকগুলো ছোট বড় টিলা। কোথাও তা সবুজ গালিচায় মোড়া। কোথাও বা তাদের এবড়োখেবড়ো পাথরের পাঁজর উঁচু হয়ে ঝুঁকে পড়ে আদিমতম জন্মবৃত্তান্তের কথা ঘোষণা করছে।

কিষণ শিশার জ্যাঠার বাড়ি
কিষণ শিশার জ্যাঠার বাড়ি

মাছকুন্দ নদী থেকে উৎপন্ন রানি দুদুমার উচ্চতা ৫৭৪ ফুট। সেখান থেকে সাদা জলের ফোয়ারা ছুটিয়ে রানি দুদুমা ঝাঁপিয়ে পড়ছে খাদের দিকে। তার স্রোত জমে তৈরি হয়েছে আরও একটি গৈরিক জলের ছোট নদী। দেখতে দেখতে মুগ্ধবিস্ময়ে মিস্টার ম্যাককার্থি বলে উঠলেন, বা! অসাধারণ! বিশেষত যেখানে রংধনু ফ্লাশ করছে, সেখানে কত সহজেই না সূর্যের সব রং স্পষ্ট হয়ে ফুটছে।

সুচরিত ম্যাককার্থির দৃষ্টিশক্তির প্রশংসা করতে গিয়ে বলল, যাঁরা সিনসিয়ার অবজারভার, তারাই প্রকৃতির চেহারা ভালোভাবে দেখতে পান। আইরিশ সাহেব হাসলেন উত্তরে, ঠিক কথা! আর চিত্ত যাঁদের সমাহিত, তাঁরা প্রকৃতির সব কথা শুনতেও পান! এ বছর মার্চে আদিবাসী জনসমাজের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে ওয়ার্ল্ড কনফারেন্সে আমার যোগ দেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেখানকার সব আলোচনা থেকে বুঝেছি, আসলে এই মানুষগুলোই প্রকৃতির ভাষা সবচেয়ে ভালো বুঝতে পারেন। আমাজনের আদিবাসীদের সঙ্গেও মেলামেশার সুযোগ হয়েছিল। তখনো বুঝেছিলাম, প্রকৃতির সঙ্গে ওরা কত বেশি একাত্ম। যেমন জলের ভেতরে মাছ। হ্যাঁ। এই তো এখানে আসার সময় দেখতে পেলাম, আদিবাসীরা মিছিল বার করে প্রতিবাদ করছেন প্রকৃতি ধ্বংস করে ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করার জন্য। ম্যাককার্থি উত্তরে কাঁধ নাড়ালেন কয়েকবার, কিন্তু দুঃখের বিষয়, প্রতিবাদ করে লাভ হবে না!

গুপ্তেশ্বর গুহার উদ্দেশে সুরেশের ট্যাক্সি ছুটছে ছত্তিশগড় সীমান্তের দিকে। সবুজের তরঙ্গ উপচে পড়ছে ভূমিতল থেকে মহাশূন্যে। পাহাড়, জঙ্গল, অরণ্য পেরোতে পেরোতে দূর থেকে ওদের চোখে পড়ল, অনেকগুলো বগি সঙ্গে নিয়ে ট্রেন ছুটে চলেছে গন্তব্যের নিশানায়। লোহার ব্রিজ পেরিয়ে ঢুকে পড়ছে এক টানেল থেকে আরেক টানেলের মধ্যে। তার কালো ধোঁয়া যান্ত্রিক দেহের মাথার ওপর দিয়ে উড়তে উড়তে মিলিয়ে যাচ্ছে পরিমল পরিবেশের মধ্যে। তার রেশ মিলিয়ে যাচ্ছে হাওয়ায়-হাওয়ায়। দেখতে দেখতে সুচরিতদের মনে হচ্ছে এখানেও অপাপবিদ্ধ প্রকৃতি নিঃশব্দে প্রতিবাদ করছে কি? (চলবে)

ধারাবাহিক এ ভ্রমণকাহিনির আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন