বৃষ্টি মন্থন

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

ঝুমবৃষ্টি নেমেছে আজ। হঠাৎ করেই এই আচমকা বৃষ্টি। অনেক দিন হলো এমন ঝুমবৃষ্টি দেখিনি। ড্রাইভ করছিলাম হাইওয়েতে। রেডিওর ভলিউম কমিয়ে দিলাম বৃষ্টির শব্দ শুনব বলে। বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ শুনতে ভালোই লাগে। জানালার কাচ ওঠাতে ওঠাতে গায়ে যেন কাঁটা অনুভব করলাম। বিগত সাত বছরের বৈদেশিক জীবনে বৃষ্টির দর্শন আমার সঙ্গে বিরল। তুলনামূলকভাবে তুষার ঝড়ে পড়েছি বহুবার। অনুভব করেছি অন্তরে তুষারের শুভ্রতা। ইচ্ছা করছিল গাড়ি থামিয়ে রিমঝিম শুনি। কিন্তু তাড়া ছিল। রকেটের (আমার সবুজ টয়োটা) গিয়ারে পায়ের চাপ বাড়াতেই যেন তীব্র গতিতে পৌঁছে গেলাম কৈশোরে।

মনকাশে ডানা মেলল অজস্র স্মৃতি।

টাপুরটুপুর বৃষ্টি পড়া কৈশোরের দিনগুলো!

বৃষ্টির দিনে ইলিশ ভাজার সঙ্গে খিচুড়ি ছিল আব্বুর অতি পছন্দ। যত কিছুই থাকুক না কেন, ইলিশ খিচুড়ি তাঁর চাই–ই চাই। এ বিষয়ে আম্মুর ছিল ঘোর আপত্তি। খিচুড়ি রান্না করলেও ইলিশ মাছ কাটতে তাঁর বড় অস্বস্তি।

আম্মুকে ঘরের কাজে সহযোগিতা করতেন করিমন খালা।

তার কাজ বাঁধা। ঘর মোছা, বাসন মাজা আর কাপড় ধোয়া। মাঝেসাজে বাটাবাটি করলে তিনি এক্সট্রা পয়সা পেতেন। বড় কিংবা ছোট মাছ দেখলেই উনিও ঝড়তুল্য রুদ্রমূর্তি ধারণ করতেন। মাঝেমধ্যে এই দুই নারীর রুদ্রমূর্তি দেখে আব্বু সভয়ে বলে ফেলতেন—আরে এ আর এমন কঠিন কী! আমার মাছ আমিই কাটব।

মাঝেমধ্যে আব্বু কলেজে থাকতেন। এমন সময় বৃষ্টি এলে আম্মুকে বলতে শোনা যেত, এই যে বৃষ্টি নামল, তোর বাপ এখন একগাদা মাছ কিনবে। মামণির কথা শেষ হতে না হতেই পিয়ন কাকুর হাঁকডাক শোনা যেত।

ভাবি, ভাবিইইই...।

আমি আর সায়াদ দৌড়ে যেতাম লোহার গ্রিলঘেরা বারান্দায়। সাদীও (সর্ব কনিষ্ঠজন) দৌড়াত সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু হামাগুড়ি দিতে দিতে।

কাকু ছাতা মাথায় সাইকেল থেকে নামতে নামতে তাঁর পান খাওয়া দাঁতের নির্মল হাসি হাসতেন। মামণি দরজা খুলতেই আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম মাছ দেখার জন্য। জানহীন মাছগুলোর দিকে তাকিয়ে আমার কেন যেন অদ্ভুত মায়া হতো। আজও মনে পড়ে সিনেমার নায়িকার কান্না, কোরবানির পশু আর মাছ কাটার সময় কত দিন যে কাঁদিয়ে নিজের বালিশ ভিজিয়েছি। এই সব কীর্তি কলাপের জন্য আব্বু আমার নাম দিয়েছিলেন, ‘সরলা’।

বৃষ্টির দিনে সবচেয়ে মজার কাজ ছিল লুকিয়ে লুকিয়ে তিন গোয়েন্দা অথবা শরৎবাবুর বই পড়া। একবার ধরা পড়লাম মামণির হাতে। এমন জোরে একটা চড় দিলেন, মনে হচ্ছিল পুরো ১০ মিনিট মুখ বাঁকা হয়েছিল। শেষের ৫ মিনিট আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কাটিয়েছি।

বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগে আগে আমার ডাক পড়ত ছাদে যাওয়ার জন্য। রোদে শুকানো কাপড়, আচার আর লাল মরিচ নিয়ে আসার পুরো দায়িত্ব ছিল আমার। অন্য সময় ছাদে যাওয়া বারণ ছিল। কারণ বাসার ছাদ থেকে ছেলেদের মেস দেখা যেত। এ সময়টা আমি খুব এনজয় করতাম।

ছাদে খুব জোরে ঝোড়ো হাওয়া বইত। আর আমি মনে মনে আওড়াতাম—

‘আকাশে মেঘ আজ মেলেছে ডানা,
ছুঁয়ে গেছে তোর ওই নীল সীমানা।
বৃষ্টিতে ভিজে গেছে আজ সারাটা শহর,
বড় ভালোই কাটছে আমার প্রতিটি প্রহর।’