প্রবাসীর ঈদ পরিকল্পনা

লেখক
লেখক

প্রবাস জীবনে রমজান মাসে পরিবারবিহীন একা একা সাহরি খাওয়া, ইফতার করা কী যে কষ্ট! মাঝেমধ্যে হাঁপিয়ে উঠি। কতকাল যে ঈদ উৎসব পরিবারের সঙ্গে উদযাপন করি না, দল বেঁধে মসজিদে তারাবিহ পড়তে যাই না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল আকরাম। আমি তার দিকে তাকালাম। দেখি তার চোখেমুখে কষ্টের ছাপ ফুটে উঠেছে। দুজন বসে ঈদে কোথায় বেড়াতে যাওয়া যায়, তা নিয়ে আলোচনা করছিলাম। কিন্তু তার কথায় সব এলোমেলো হয়ে গেল। আকরাম আট বছর ধরে সিঙ্গাপুরে আছে। বিভিন্ন সমস্যার কারণে এই আট বছরে একবারও তার দেশে যাওয়া হয়নি।

আমি তাকে বললাম, ‘ঠিক বলেছেন ভাই। কত বছর হয়ে গেল একুশে ফেব্রুয়ারিতে প্রভাতফেরিতে ফুল নিয়ে শহীদদের সম্মান জানাই না। বৈশাখী প্রভাতে পাখির কল কূজন উপভোগ করি না। পিঁড়িতে বা মোড়ায় বসে গল্পগুজব করি না। কোরবানির গরু কিনতে গরুর হাটে যাই না। এসবই যেন এখন বিস্মৃত অতীত এক স্বপ্ন।’

আকরাম হতাশ কণ্ঠে বলল, ‘আমরা এখন ভালোই আছি। ইচ্ছে করলে ভিডিও কলে পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে পারি। একবার ভেবে দেখুন যখন ইন্টারনেট ও মোবাইল ছিল না। ভিডিও কলে কথা বলা যেত না। তখন যাঁরা প্রবাসে ছিলেন, তারা কতটা কষ্ট বুকে বয়ে বেড়িয়েছেন। তাদের কথা ভাবলে আমি আঁতকে উঠি। কীভাবে তাঁরা প্রবাসে ছিলেন।’

আকরাম ঠিকই বলেছে। আমি কলেজে পড়ার সময় একজন প্রবাসীর স্ত্রী আমার কাছে আসতেন তার স্বামীর চিঠি পড়ে শুনিয়ে উত্তর লিখে দেওয়ার জন্য। আমার স্পষ্ট মনে আছে, ওই ব্যক্তি স্ত্রীকে শুধু সাংসারিক বিষয়ে কথা লিখতেন। তো আমি একদিন কৌশলে কিছু রোমান্টিক কথা পড়ে শোনালাম। সেই প্রবাসীর স্ত্রী লাজুক হাসি দিয়ে বলেছিলেন, ‘না উনি এসব লেখার মানুষ না, নিশ্চয় আপনি মিথ্যা বলছেন।’ আমি তাঁকে আশ্বাস দিয়ে বলেছিলাম, তাঁর স্বামীই এ কথা লিখেছেন। তখন তাঁর চোখেমুখে ভালোবাসার আভা ফুটে উঠেছিল। তিনি আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে বলেছিলেন, ‘ভাই তাহলে আপনি এমন সুন্দর করে ভালোবাসার কথা লিখে দেন।’

তখন মাসে, দেড় মাসে একটা চিঠি আদান-প্রদান হতো। স্বামী স্ত্রীর কাছ থেকে চিঠি আসার অপেক্ষা করতেন। কখনো দেখতাম কারও স্বামী বিদেশ থেকে কথা রেকর্ডিং করে পাঠিয়েছেন। আর স্ত্রী সেই রেকর্ড গোপনে একাকী বসে শুনতেন। এরপর তিনি বাজার থেকে খালি ক্যাসেট কিনে আনতেন। সবাই যখন ঘুমিয়ে যেত তখন রাত জেগে মনের কথাগুলো রেকর্ড করে স্বামীর কাছে পাঠাতেন।

আহা! সেই দিনগুলো দম্পতিদের কত বিরহে কাটত। এখন সেই চিঠি, কথা রেকর্ডের কথা ভেবে মনে হয় তাঁরা কতই না হতভাগা ছিলেন। পরিবার ছেড়ে চলে যেত, কথা বলার সুযোগ ছিল না। চিঠিই ছিল একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম।

চিঠি আদান-প্রদানের সময়ের কথা ভেবে আমরা এখন যেমন দুঃখী হই ঠিক, আজ থেকে পঞ্চাশ বা এক শ বছর পর আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের কথা ভেবে দুঃখী হবে। তারা যখন শুনবে এক কোটি লোক প্রবাসে ছিল। পরিবার পরিজন ছেড়ে বছরের পর বছর প্রবাসে কাজ করেছে। প্রথম তারা ভাববে আমরা অতিমানব ছিলাম। পরক্ষণে আমাদের ত্যাগের কথা ভেবে তারা দুঃখী হবে।

‘ভাই এত গভীর মনোযোগ দিয়ে কী ভাবছেন?’

আকরামের কথায় কল্পনার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে আসি। থতমত খেয়ে বলি, না কিছু না। এখন বলুন ঈদের পরিকল্পনা কী?

আকরাম আমার দিকে তাকিয়ে ম্লান হেসে বলল, ‘ঈদের আগের দিন রাতে কাজ করতে হবে। অফিস থেকে ফিরে সরাসরি মসজিদে নামাজ পড়তে যাব, নামাজ শেষে বাসায় লম্বা ঘুম দেব।’

আমি তাকে আর কিছু বলতে পারলাম না। অধিকাংশ প্রবাসীর ঈদ ঘুমিয়ে কাটে। অনেককে ঈদের দিন কাজ করতে হয়। ঈদ উপলক্ষে পরিবারের সবাইকে টাকা দিয়ে নিজে কেনাকাটা করার জন্য কিছুই থাকে না। এমনকি ঈদের দিন স্পেশাল রান্নাও করা হয় না।

কয়েক দিন আগে একজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ভাই ঈদের কেনাকাটা কবে করবেন? তিনি জবাবে বলেছিলেন, ‘আমার আবার কিসের কেনাকাটা। দুই বছর আগে যা এনেছিলাম, তার অধিকাংশ এখনো পরা হয়নি। এগুলো শেষ হোক, এরপর কেনাকাটা করার চিন্তা করব।’ আমি বুঝতে পারলাম, আসলে তাঁর কাছে কেনাকাটা করার মতো টাকা নেই। তাই পরিবারের সঙ্গে যে মিথ্যে বলেছেন, আমার সঙ্গেও একই মিথ্যে বললেন।

তাঁকে আরও জিজ্ঞেস করেছিলাম, তো ঈদের দিন স্পেশাল কী রান্না করবেন? তিনি এবারও স্বাভাবিকভাবে বললেন, ‘ঈদের দিন স্পেশাল রান্না আবার কী? সেমাই, পোলাও, মাংস কি খাওয়ার জিনিস হলো। আর ঈদে এগুলো কি খেতেই হবে?’

আমি জবাবে কিছু বলতে পারিনি। আর আমারও বুঝতে বাকি ছিল না কেন তিনি এ কথা বলছেন।

প্রবাসে বিশেষত যাঁরা একা থাকেন ঈদ নিয়ে তাঁদের মাঝে তেমন উৎসাহ লক্ষ করা যায় না। ঈদের কেনাকাটা নিয়ে তাঁদের কোনো বিশেষ পরিকল্পনা নেই। ঈদে তাঁদের ভাবনা একটাই পরিবারের সবার মুখে হাসি ফোটানো।