ওরা থাকে ওধারে

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

দার্শনিক অ্যারিস্টটলের মতে মানুষ সামাজিক জীব, তাই সৃষ্টির আদি থেকেই সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করে আসছে। কখনো ব্যক্তি প্রয়োজনে আবার কখনোবা সামষ্টিক প্রয়োজনে মানুষ বিভিন্ন দল বা গোত্রে ভাগ হয়ে বসবাস করে আসছে। এতে করে একে অপরের সঙ্গে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ায় তাদের মধ্যে তৈরি হয় অদৃশ্য এক বন্ধন, যেটাকে আমরা বলি সামাজিকতা। এভাবে পাশাপাশি বসবাস করতে করতে মানুষ একে অন্যের সঙ্গে যেমন ঝগড়া–বিবাদে লিপ্ত হয়েছে, ঠিক তেমনি তারা একে অপরের বিপদের দিনেও এগিয়ে এসেছে সর্বশক্তি দিয়ে। এভাবে বংশপরম্পরায় মানুষ সেই মূল্যবোধটা ধরে রেখেছে তার মস্তিষ্কে। যদিও–বা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এতে পরিবর্তন এসেছে, কিন্তু সেটা একেবারেই বিলীন হয়ে যায়নি।

গ্রামবাংলায় এখনো সামাজিকতার বিষয়টা চালু আছে। আমাদের গ্রামে ঈদের দিন বিকেলে পাড়ার তেমাথায় প্রতি বাড়ি থেকে খিচুড়ি নিয়ে এসে সেই সব খিচুড়ি একসঙ্গে মিশিয়ে সবাইকে ভাগ করে দেওয়া হতো। প্রতি বাড়ি থেকে আমরা ছোটরা প্লেট নিয়ে বৃত্তের আকারে গোল হয়ে বসতাম। বৃত্তের কেন্দ্রে থাকতেন বড়রা। বেতের তৈরি বড় ধামাতে খিচুড়ি মিশিয়ে নিয়ে একটা বাটি দিয়ে একে একে সবাইকে খিচুড়ি দেওয়া হতো। সেদিন গরিব মানুষগুলো যাদের অনেক সন্তান, তারা অনেক খিচুড়ি পেত। তারা হয়তো বাড়ি থেকে সামান্য কিছু খিচুড়ি নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু ফিরে যেতেন প্রায় দুই গুণ, তিন গুণ খিচুড়ি নিয়ে। এরপর কয়েকটা দিন তাদের আর খাবারের সংস্থান নিয়ে ভাবতে হতো না। আমাদের গ্রামে যেহেতু বিদ্যুৎ ছিল না, তাই ফ্রিজ কী, আমরা জানতাম না। তাঁরা সেই খিচুড়ি ভাত চুলায় জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে অনেক দিন ধরে খেতেন। শেষের দিকে গিয়ে সেটা টক টক লাগলেও খেতে একেবারে অমৃতের মতো লাগত। আমি মাঝেমধ্যে আমাদের বাড়ি থেকে লুকিয়ে গিয়ে তাদের সঙ্গে সেই খাবারটা খেতাম।

ঠিক একইভাবে কোরবানির ঈদের সময় গরিব মানুষেরা স্বভাবতই কোরবানি দিতে পারতেন না। কোরবানির ঈদে পাড়ার সবার কোরবানি এক জায়গায় করে সেখানে কোরবানি দেওয়া হতো। গরিব মানুষগুলো শ্রম দিয়ে সেই কোরবানির চামড়া ছড়ানো থেকে শুরু করে মাংস কাটাকাটির কাজ করে দিতেন। তারপর খিচুড়ি বিতরণের মতো জনপ্রতি মাংস বিতরণ করা হতো। তখনো গরিব মানুষগুলো বেশ কিছুটা মাংস পেতেন এবং অনেক দিন ধরে চুলায় জ্বাল দিয়ে দিয়ে তাঁরা সেই মাংস খেতেন। নদীভাঙনের পর যখন আমরা চরভবানীপুর থেকে কুষ্টিয়ার শহরতলির বাড়াদীতে এলাম, সেখানেও এই চলটা দেখেছি। শুনেছি এখনো সেটা আছে।

এ ছাড়া প্রতিবেশীর বিপদে–আপদে এগিয়ে আসা গ্রামবাংলার চিরায়ত ঐতিহ্যেরই অংশ। যে প্রতিবেশীর সঙ্গে সকালেই বা আগের দিন ঝগড়া হয়েছে, সেই প্রতিবেশীই যদি বিকেলে বা পরদিন কোনো বিপদে পড়েন, তাহলে সবার আগে এগিয়ে আসেন তাঁর পাশের বাড়ির মানুষগুলো। গ্রামের মানুষদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ঝগড়া–বিবাদ ও সালিস বৈঠক জীবনযাত্রার নিত্য অংশ। কিন্তু এতে করেও তাঁদের মধ্যে মমত্ববোধের কোনো কমতি নেই। তা ছাড়া বিভিন্ন দরকারে পাশের বাড়ি থেকে বিভিন্ন জিনিস ধার করে নিয়ে আসা গ্রাম্য ঐতিহ্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কোনো একটা কাজে কোনো একটা জিনিস দরকার, খুঁজে দেখা গেল সেটা বাড়িতে নেই। সঙ্গে পাশের বাড়ি থেকে সেটা ধার করে আনা হয়। আবার তাঁদেরও কোনো জিনিস লাগবে, সঙ্গে সঙ্গে তাঁরাও চলে আসেন। আমার এখনো মনে আছে, আমাদের পশ্চিম পাশের বাড়ির চাচি সন্তানসম্ভবা। এই সময়টায় মানুষের শরীরে বিভিন্ন হরমোনজনিত জটিলতার কারণে মেজাজ খিটমিটে হয়ে থাকে। তাই আমাদের সঙ্গে ওনার ঝগড়া লেগেই থাকত। কিন্তু যেদিন ওনার সন্তান ভূমিষ্ঠ হবে, সেদিন সবার আগে এগিয়ে গিয়েছিলেন আমার মা।

মাঝরাতের পর চাচির ব্যথা উঠল। আলম চাচা এসে আমার নাম ধরে ডাক দিলেন। মা সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। চাচা ঘটনা বলার পর মা বললেন, ‘আমি এক্ষুনি আসছি, আপনি আল্লেকের মাকে খবর দেন। আল্লেকের মা আমাদের পরিচিত দাই। আমরা তাঁকে দাদি ডাকি। উনি থাকেন ফকির পাড়ায়। তাই চাচা বললেন, ইয়াকুবকে একটু ডেকে দেন। দুজন মিলে গেলে ভয় করবে না। মা আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে দিয়ে চাচির কাছে গেলেন। আমি আর চাচা দ্রুত হেঁটে আল্লেকদের বাড়ি পৌঁছে দাদিকে ডাক দিতেই তিনি ঘুম থেকে উঠে আমাদের সঙ্গে রওনা দিলেন। দাদি এসেই আমার মাকে বললেন, তাড়াতাড়ি এক ঢুকসা (গামলার মতো মাটির পাত্র) আগুন নিয়ে আসো। মা এসে আমাদের চুলার আগুন তাড়াতাড়ি ঢুকসায় করে নিয়ে গেলেন। এরপর একসময় একজন ছেলে ভূমিষ্ঠ হলো। সেই ছেলে আলামিন বড় হয়ে পড়াশোনা করে এখন ঢাকায় ভালো চাকরি করে। দেশে থাকলে আমি গ্রামে বেড়াতে গেলে ওই চাচির বাড়িতে যেতাম সবার আগে।

অন্য পাশে সালামদের বাড়ি। সালামের মা–বাবাকে আমরা বলতাম খালা–খালু। সালাম আমাদের খেলাধুলার নিত্যসঙ্গী ছিল। পাশাপাশি থাকলে যেটা হয়, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে একটু–আধটু লেগেই থাকে। জমিজমা, হাঁস-মুরগি এমন আরও কত বিষয় আছে। এমনই কোনো একটা বিষয় নিয়ে একটু মনোমালিন্যের কারণে কয়েক দিন ধরে তাঁদের বাসায় যাওয়া ও কথা বলা বন্ধ রয়েছে। হঠাৎ এর মধ্যেই একদিন তাঁদের বাড়িতে ডাকাতি হলো। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে খবরটা শুনেই মা তাঁদের বাড়িতে গিয়ে খালাকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। আব্বাও খালুর সঙ্গে বসে সলাপরামর্শ শুরু করলেন কীভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যায়। একটু পরেই মা বাড়ি ফিরে তাঁদের জন্য ভাত তরকারি রান্না করে নিয়ে গেলেন।

আমার এসএসসি পরীক্ষা সামনে। পরীক্ষার সিট পড়েছে কুষ্টিয়া জিলা স্কুলে। আমাদের গ্রাম থেকে কুষ্টিয়া শহর বেশ কিছুটা দূরে। রিকশা করে পরীক্ষা দিতে যাওয়ার মতো সামর্থ্য তখন আমাদের নেই। আর মা ভরসাও পাচ্ছেন না আমাকে একা ছাড়তে। এটা শুনে আমার ফুফু বললেন, ইয়াকুব আমাদের লতিফের সঙ্গে পরীক্ষা দিতে যাবে। শুনে মা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমার এই ফুফুর সঙ্গে আমাদের কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই। বাড়াদীতে এসে বসবাস করার শুরুতে একেকজনের সঙ্গে তাঁদের বয়স অনুযায়ী আমরা একেকটা সম্পর্ক দাঁড় করিয়ে নিয়েছিলাম। সেভাবেই উনি আমাদের ফুফু এবং এখন পর্যন্ত আমাদের আপন ফুফুর স্থান নিয়ে আছেন তিনি।

এবার আসি অস্ট্রেলিয়ার জীবনযাপনে। এখানে ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলে যায় জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত। তবু মানুষ একজন অন্যজনের দরকারে এগিয়ে আসেন নিঃস্বার্থভাবে। হোক তিনি পরিচিত কিংবা অপরিচিত। অস্ট্রেলিয়াতে আসা খুব কম বাংলাদেশিরই আগে থেকে এখানে আত্মীয়পরিজন থাকে। তাই তখন প্রতিবেশী বন্ধুবান্ধবই সবচেয়ে বড় আপনজন হয়ে ওঠেন। আমাদের ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। এক বাসায় বেড়াতে গিয়ে আমার গিন্নির পরিচয় হয় তৃপ্তি আপু আর তামান্না ভাবির সঙ্গে। এই দুজন মানুষ একেবারে নিঃস্বার্থভাবে অন্তরের অন্তস্তল থেকে অনুভব করে আমাদের জন্য কাজ করে গেছেন এবং এখনো করছেন। অস্ট্রেলিয়াতে গাড়ি ও ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া জীবনযাপন খুবই কঠিন। আমার ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে বছরখানেক লেগে গিয়েছিল। লাইসেন্স না থাকায় আমাদের বাসেই চলাফেরা করতে হতো। আর কাছাকাছি কাজ যেমন বাজার সদাই করতে হতো হেঁটে গিয়ে।

আমার গিন্নি সন্তানসম্ভবা হওয়ায় তাঁকে নিয়মিত হাসপাতালে যাওয়া–আসা করতে হতো। বাসে হাসপাতালে যেতে আধা ঘণ্টার মতো সময় লাগত। বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হওয়ার দিনও আমরা বাসে করেই হাসপাতালে গিয়েছিলাম। এরপর তৃপ্তি আপু আর তামান্না ভাবি খবর পেয়ে তৃপ্তি আপুর গাড়িতে করে আমাদের দেখতে হাসপাতালে চলে এলেন। তামান্না ভাবির তখনো ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল না। তাই তিনি তৃপ্তি আপুর সঙ্গেই চলাফেরা করতেন। প্রথম দিনেই তৃপ্তি আপু খাবারদাবারের সঙ্গে এক তোড়া ফুলে এনেছিলেন। তখন আমার মনে হলো তাই তো আমাদেরও তো উচিত ছিল মা ও নতুন সন্তানের জন্য ফুলে নিয়ে আসা। এরপর থেকে একেবারে নিয়ম করে প্রতিদিন তাঁরা দুজন মিলে আমার গিন্নির পছন্দের সব খাবার রান্না করে নিয়ে আসতেন। গিন্নিকে যেদিন হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিল, তৃপ্তি আপু ওনার গাড়িতে করে আমার গিন্নি ও সন্তানকে বাসায় পৌঁছে দিয়েছিলেন। এখনো তাঁরা কোনো ভালো খাবার রান্না করলে ওয়ান টাইম বক্সে ভরে আমাদের দিয়ে যান। তাঁদের এই সব দানের প্রতিদানে আমরা এখন পর্যন্ত কিছুই করতে পারিনি। কিন্তু তাঁরা নিরলসভাবে আমাদের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁদের আন্তরিকতা দেখে কে বলবে তাঁদের সঙ্গে পরিচয় মাত্র অস্ট্রেলিয়া আসার পর।

এবার আসি আমাদের সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশীর গল্পে। আমাদের সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী হচ্ছেন নাজমুল ভাই আর সন্ধ্যা ভাবি। তাঁরা বয়সে আমাদের বাবা–মায়ের চেয়েও বড় হবেন। কিন্তু যেহেতু শুরু থেকেই ভাই–ভাবি বলে সম্বোধন করেছি, তাই এখন আর সেটা পরিবর্তন করা হয়নি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তাঁদের ছেলে ও ছেলের বউদেরও আমরা ভাই–ভাবি বলেই সম্বোধন করি। একদিন নাজমুল ভাই বললেন, মজার ব্যাপার তো, বাপও ভাই, আবার ছেলেও ভাই। আমি বললাম, সকল মুসলমান ভাই ভাই। শুনে তিনি খুবই মজা পেলেন। নাজমুল ভাইদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক একেবারে বাংলাদেশের পাড়া প্রতিবেশীর মতো। আমাদের সংসারে গোছানো কোনো বিষয়ই নেই। তাই দেখা যায়, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জিনিসের দরকার হয়। তখনই আমরা শরণাপন্ন হই তাঁদের।

আমাদের বাজার করার বিষয়টা খুবই অগোছালো। কখনোই একবারে সবকিছু মনে পড়ে না। তাই সেটা কেনাও হয় না। বাসায় অতিথি এসেছে। চা বানিয়ে খেতে দিতে গিয়ে দেখি চা পাতা শেষ। দৌড়ে চলে গেলাম তাঁদের বাসায়। তন্দুরি চিকেন রান্না করতে গিয়ে মনে পড়ল বাসায় ইয়োগার্ট নেই। ডাল রান্না করতে গিয়ে কোনো দিন দেখি পেঁয়াজ নেই, আবার কোনো দিন হলুদের গুঁড়া শেষ। সবজি ভাজি করতে গিয়ে দেখি কাঁচা মরিচ নেই। এই সব বিষয়ের একটাই সমাধান—সেটা হলো তাঁদের বাসা। আর আমাদের দরকার হয়তো সামান্য কিন্তু তাঁরা দিয়ে দেন একগাদা; ফলে সেটা ফুরাতে ফুরাতে আবারও বাজার করার কথা ভুলে যাই। তবে সবচেয়ে যেটা বেশি ধার করা হয় সেটা হচ্ছে তাঁদের গাছের কাঁচা মরিচ। তাঁরা বলেই দিয়েছেন, যখন লাগবে গাছ থেকে তুলে নিয়ো। নেত্রকোনার মানুষ বলে আমার গিন্নির চ্যাপা শুঁটকি ভর্তা খাওয়ার অভ্যাস। আর চ্যাপা শুঁটকির গন্ধ দূর করার অন্যতম উপকরণ হচ্ছে লেবুর পাতা। সেটার জোগাড়ও হয় তাঁদের লেবুগাছ থেকে। হঠাৎ আমাদের গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছে না। নাজমুল ভাই এসে তাঁর গাড়ি থেকে কর্ড লাগিয়ে আমাদের গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিবেশীর সম্পর্কটা হয় লেনদেনের, কিন্তু তাঁদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা শুধুই নেওয়ার। কোনো কিছু ফেরত দেওয়ার সামর্থ্য আমাদের যেমন নেই, তেমনি আমি কখনোই চেষ্টাও করব না কোনো কিছু ফেরত দেওয়ার। আমি মনে করি গুরুজনেরা তাঁর অনুজদের জন্য কিছু করতে পারলেই অনেক খুশি হন। তাই তাঁদের এই খুশি হওয়া থেকে বঞ্চিত করা উচিত হবে না।

প্রতিবেশী বা বন্ধুবান্ধব বা স্বামী-স্ত্রী বা বাবা-মায়ের সঙ্গে জীবন চলার পথে আমাদের সম্পর্কটা কখনোই সব সময় একই রকম থাকে না। আর সেটাই স্বাভাবিক। কারণ আমরা মানুষ, যন্ত্র না। সম্পর্কগুলোর মধ্যে চলার পথে মাঝেমধ্যে কিছু ময়লা জমা হয়, তখন একটা ছোট ঝগড়া সেই ময়লাটাকে দূর করে সম্পর্কটাকে আবার সতেজ করে দেয়। যেই কারণে গ্রামের মানুষ সকালবেলা চুলাচুলি করলেও বিকেলবেলায় আবার একই বাড়ির উঠোনে বসে একে অপরের মাথায় তেল দিয়ে দেন। মাঝরাতের বিপদে এগিয়ে আসেন। কিন্তু শহুরে পরিবেশ আমাদের এমনই ভদ্র বানিয়েছে যে আমরা কারও ওপরে রাগ করে সেই রাগ মনে পুষে রেখে সেটাকে বাড়তে দিই। একসময় সেই মানুষটার ছায়া মাড়াতেও আমাদের বাধে। অবশ্য সবাই এমন নন। শহুরে অনেক ভালো ব্যাপারের মধ্যে মানুষে মানুষে ভদ্রতার এই ব্যাপারটাকে আমি কেন জানি মানতে পারি না। যেটা তাদের মধ্যে দূরত্ব বাড়িয়ে দেয়। মহানায়ক উত্তমকুমারের ‘ওরা থাকে ওধারে’ চলচ্চিত্রে শহরের পরিবারগুলোর মধ্যে যে সম্পর্কগুলো দেখিয়েছে, এখন আমাদের শহুরে জীবনে তেমনটা দেখা যায় না। শহরে মুখোমুখি ফ্ল্যাটে থেকেও একে অপরকে চেনে না অনেকেই। কে আগে যেচে পরিচিত হতে গিয়ে ছোট হবে অন্যজনের কাছে, সেই দুশ্চিন্তাতেই জীবন পার করে দেয়। সেদিক দিয়ে আমরা অনেক সৌভাগ্যবান যে আমাদের চারপাশে অনেক শুভাকাঙ্ক্ষীকে পেয়েছি, যাঁরা যেকোনো বিপদে আমাদের পাশে এসে দাঁড়ান।

পরশু বা তার পরদিন ঈদ। ঈদের দিনে আমাদের প্রতিবারের রুটিন সকালবেলা আমরা নামাজ পড়ে বাসায় এসে নাজমুল ভাই আর সন্ধ্যা ভাবিদের ওখানে মিষ্টিমুখ করি। তাহিয়া আর রায়ান তাঁদের কাছ থেকে ঈদের সালামি পায়। তারপর আমরা বেরিয়ে পড়ি। সারা দিন ঘোরাঘুরি করে দিন শেষে আবার তাঁদের বাসায় ফিরে রাতের খাবার খেয়ে সেদিনের মতো ইতি টানি। এভাবেই ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে আমরা যদি আমাদের প্রতিবেশীদের সঙ্গে মিলে যেতে পারি, তাহলে সমাজটা হয়ে ওঠে শান্তির নীড়। আর সমাজে শান্তি এলেই দেশে এমনকি বিশ্বেও শান্তি আসতে বেশি সময় লাগবে না। সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক।
...

মো. ইয়াকুব আলী। ই–মেইল: <[email protected]>