গ্যালারি কাহন: বাংলাদেশ বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা

গ্যালারিতে লেখক ও তাঁর স্ত্রী
গ্যালারিতে লেখক ও তাঁর স্ত্রী

আগেই আঁচ করেছিলাম, দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচের দিন ওভাল স্টেডিয়াম হয়ে উঠবে আরেক মিরপুর স্টেডিয়াম। আইসিসির অফিশিয়াল সাইটে এই ম্যাচের টিকিট কয়েক মাস আগে থেকেই ছিল ‘সোল্ড আউট’।

রোববার ছুটির দিন বলে আমরাও পুরো পরিবার ওভালে হাজির। ওভাল আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন থেকে বের হতেই মনে হলো ম্যাজিক ট্রেনে চেপে বাংলাদেশের কোনো শহরে চলে এসেছি। রাস্তার ধারে বিক্রি হচ্ছে বাংলাদেশ ও দক্ষিণ আফ্রিকার পতাকা আর বাহারি টুপি। হঠাৎ কানে এল ম্যাচ টিকিট, ম্যাচ টিকিট। টিকিটের কালোবাজারি তাহলে লন্ডনেও হয়! আমাদের টিকিট কিনেছিলাম এক বছর আগের অফিশিয়াল ব্যালটিং থেকে। এই টিকিটই এখন কয়েক গুণ দামে বিক্রি হচ্ছে।

গ্যালারিতে লেখক ও তাঁর স্ত্রী
গ্যালারিতে লেখক ও তাঁর স্ত্রী

খেলা শুরু হতে তখনো ঘণ্টাখানেক বাকি। অনেক এন্ট্রান্স গেট থাকায় ঢোকার মুখে তেমন লম্বা লাইন নেই। অবশ্য আমরা অনেক আগেই এসেছি, যাতে জাতীয় সংগীত মিস না হয়। ভেতরে ঢুকে তো অবাক। আমাদের আসন বাংলাদেশের ড্রেসিং রুমের ঠিক নিচে। খেলোয়াড়েরা যে সিঁড়ি দিয়ে যাওয়া-আসা করছেন, তার পাশেই। দক্ষিণ আফ্রিকানরা দেখি হাশিম আমলার সঙ্গে সেলফি তুলছেন। হাশিম আমলা আমার প্রিয় একজন খেলোয়াড় কিন্তু আজ প্রতিপক্ষ। তাই আর সেলফি তুললাম না। মনে হলো মাশরাফি বসকে ধরতে হবে।

টস শেষে ক্যাপ্টেন যখন ফিরছিলেন ড্রেসিংরুমে, বস বলে ডাক দিলাম। বস ঠিকই থামলেন সেলফি তোলার জন্য। আমি আমার ছোট মেয়ে ইনায়দাসহ সেলফি তুললাম মাশরাফি বসের সঙ্গে।

গ্যালারিতে লেখকের মেয়ে ইসরা
গ্যালারিতে লেখকের মেয়ে ইসরা

গ্যালারি তখন সবুজে সবুজে ভরে উঠছে। খেলার সঙ্গে সঙ্গে চলছে বাংলাদেশ-বাংলাদেশ স্লোগান। বিভিন্ন বাহারি ক্যাপ আর পোশাকে গ্যালারি তখন বর্ণিল। প্রতিটি রানেই আমরা লাফিয়ে উঠছি। আর একটু পর পর গ্যালারিজুড়ে চলছে মেক্সিকান ওয়েভ। যেন ঢেউগুলো হাজার মাইল দূরের বঙ্গোপসাগর থেকে আমাদের আনন্দে ভাসিয়ে দিতে চলে এসেছে।

আলাপ হলো পাশের আসনে বসা এক ভাইয়ের সঙ্গে। তিনি নিউইয়র্ক থেকে ছুটে এসেছেন বাংলাদেশের দুটি খেলা দেখার জন্য। তার সঙ্গে তো একটা সেলফি তুলতেই হয়। তাঁকে বললাম, আমার দুই বন্ধু আসছেন নিউইয়র্ক থেকে, বাংলাদেশ-পাকিস্তানের ম্যাচ দেখতে সামনের মাসে। একজন আবার ২০ বছর আগে নটিংহামে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের প্রথম জয়ের মাঠের দর্শক। এবারও নিশ্চয় আমরা আরেকটা জয় দেখব।

গ্যালারিতে বাংলাদেশি সমর্থকদের উল্লাস
গ্যালারিতে বাংলাদেশি সমর্থকদের উল্লাস

মাঠের কথায় ফিরে আসি। সাকিব আর মুশফিকের কল্যাণে বাংলাদেশ তখন শক্ত অবস্থানে। আমরা যখন কার সেঞ্চুরি আগে হবে তা নিয়ে ভাবছি, তখন পরপর দুই উইকেটের পতনে একটু ভয় খেলা করে। এত সুন্দর শুরুর পর কি ৩০০ পার করা যাবে না। কিন্তু মোসাদ্দেক আর মাহমুদউল্লাহ থাকতে ভয় কোথায়।

বউ আমার খবর পেয়েছে। তাকে 'Go Bangladesh Go’ ব্যানার হাতে টিভিতে দেখা গেছে। আমি আগে বসের সঙ্গে একা সেলফি তুলেছি বলে তার মন খারাপ ভাব নিমেষে উধাও। রসিক ক্যামেরাম্যান পাশে দাঁড়ানো আমাকে আউট করে দিয়েছেন। জগতের সব ক্যামেরাম্যান শুধু মেয়েদের ছবি তুলতেই ভালোবাসেন।

পাশের আসনেই বসেছেন দক্ষিণ আফ্রিকান এক নারী। তাঁর স্বামী ইংরেজ আর তিনি দক্ষিণ আফ্রিকান। জিজ্ঞেস করলাম, ইংল্যান্ড-দক্ষিণ আফ্রিকার আগের ম্যাচে নিশ্চয় মন খারাপ গেছে তোমাদের। হেসে বললেন, সেদিন বাচ্চারা বাপের সঙ্গে ইংল্যান্ডের জার্সি গায়ে এসেছিল। তিনিই শুধু দক্ষিণ আফ্রিকাকে সমর্থন করেছিলেন। বেচারি কী জানতেন আজও তাকে শূন্য হাতেই ফিরতে হবে। ভদ্রমহিলার স্বামী কিন্তু তখনই আমাকে বলেছেন, ‘তোমাদের ভালো চান্স আছে আজকে। শুধু ফিজের ভালো স্পেল দরকার।’ স্কোর বোর্ডে তখন বাংলাদেশের পাশে ৩০০+ রান।

গ্যালারিতে দক্ষিণ আফ্রিকান পরিবার
গ্যালারিতে দক্ষিণ আফ্রিকান পরিবার

চারদিকে তখন উৎসব উৎসব ভাব। কিছু দক্ষিণ আফ্রিকান সমর্থকেরা তখন এক জায়গায় জড়ো হয়ে নাচ শুরু করেছেন। আলাদা আলাদা অল্প কিছু সমর্থক সুবিধা করতে পারছিলেন না বিশাল বাংলাদেশ সমর্থকদের সঙ্গে। তাই একতাই শক্তি নীতিতে এক হয়েছেন।

কিন্তু দিনটি বাংলাদেশের। দক্ষিণ আফ্রিকার নিয়মিত উইকেট পতনে আসকিং রান রেট বাড়া শুরু হয়েছে। হঠাৎ দেখি আমাদের পাশের দক্ষিণ আফ্রিকান পরিবার আর্লি এক্সিট নিয়েছে। ক্রিকেটের সমঝদার স্বামী নিশ্চয় আসন্ন হার টের পেয়েছেন। শুধু ফিজ না, সব বোলারই যে চেপে ধরেছেন দক্ষিণ আফ্রিকাকে। প্রতিটি ডট বলেই গ্যালারিতে বাঘের গর্জন।

বলে কয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানো। খেলোয়াড় থেকে দর্শক সবাই তো আমরা জানতাম, যে কাউকে হারাবার সামর্থ্য রাখি আমরা। তাই তো মাশরাফি বসের ‘আপসেট’ শব্দে আপত্তি। আপসেটের দিন তো আমরা ফেলে এসেছি অনেক আগে।

মাশরাফির সঙ্গে ছোট মেয়ে ইনায়দাসহ লেখকের সেলফি
মাশরাফির সঙ্গে ছোট মেয়ে ইনায়দাসহ লেখকের সেলফি

জিতে ড্রেসিংরুমে ফেরার পথে মাশরাফি বসের অটোগ্রাফ নিলাম। বস বলে ডাক দিতেই তাকালেন, এগিয়ে দিলাম আমার মেয়ে ইসরার নিয়ে আসা ক্রিকেট ব্যাট। বস নামটা তো তাঁকেই মানায়। ভাবতেই কষ্ট লাগে, বস থাকবেন না সামনের বিশ্বকাপে। কোটি মানুষের মনে জায়গা করে নেওয়া বসকে ছাড়া বাংলাদেশ ক্রিকেট তো ভাবাই যায় না।

শুভ কামনা টিম টাইগারদের পরবর্তী ম্যাচের জন্য। আগামীকাল আবারও থাকব ওভালে বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড ম্যাচ দেখতে। দেশে তো আগামীকাল ঈদ, খেলোয়াড়দের কাছ থেকে কি আরেকটা ঈদি আমরা আশা করতে পারি না?