বেশ আছি পরবাসে

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

দুই চোখে প্রচণ্ড ঘুমের উপদ্রব। মাঝেমধ্যে মনে হয় ঘুমিয়েই সারা দিন-রাত পার করে দিই। কিন্তু যে ভাবা সেই কাজ করা হয়ে ওঠে না। শুধু ভাবনায় থাকে ঘুম। বাস্তবে আর আসে না। বাস্তবে হলে হয়তো ভালোই হতো। অন্তত পৃথিবীর সব অশান্তি থেকে মুক্ত থাকা যেত।

বাজার করা, রান্না করা, কাপড়চোপড় ধৌত করা, কর্মক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতামূলক সময় দেওয়া, তারপর ঘুম। যতটুকু সময় পাই, ঘুমাই। তখন কোনো চিন্তা মাথায় ঢোকাই না। ঢোকানোর ব্যর্থ চেষ্টাও করি না। নিজের কাজ নিজে করি। সিঙ্গাপুরে সবাই নিজের কাজ নিজে করতে পছন্দ করেন। আমিও করি। না করে উপায় নেই। আমার তো এখানে সহধর্মিণী নেই যে আমার সব কাজের অংশীদার হবে। মিষ্টি করে কথা বলবে। নিজ স্বার্থে ঝগড়া করবে। মাঝেমধ্যে বায়না করবে। পাগলির মতো ভালোবাসবে।

কখনো কখনো ভাবি, ভুবনমোহিনীর কাছ থেকে কিছু হাসি কর্জ করে আমিও হাসি তুমুল বেগে। কিন্তু এতটা হাসি কর্জ করলে ভুবনমোহিনী যদি সুদে-আসলে ফেরত চায়; সেই ভয়ে চাপা হাসি হেসে মুখাবয়বের গঠন পরিবর্তন করি। আমার সহকর্মী অথবা বন্ধুরা যেন বুঝতে না পারে আমার মনের বরফগলা নদীর স্তব্ধতা। শুধু আমি নই, আমার মতো আরও অনেক পরবাসীর মনের কথা একই। এদের সুখও থাকে, স্বপ্নও থাকে। অধীর আগ্রহে নিয়ে প্রিয়জনের সান্নিধ্য পাওয়ার প্রতীক্ষা থাকে।

ঘুমকে ঘরে বন্দী করে বের হলাম। বের হয়ে দেখি বাইরে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। ছাতা নিইনি। আমার কোনো ছাতা নেই। নেই বললে একপ্রকার ভুল হবে। কারণ আমার কাছে ছাতা বেশি দিন থাকে না। হারিয়ে যায়। গাড়িতে চড়লে ভুলে রেখে আসি। কর্মক্ষেত্রেও তাই। পরিশেষে বাসায় আসি খালি হাতে। ভোলা মনের কারণে ছাতা আর কিনি না। কেনার আগ্রহ দেখাই না।

বৃষ্টিতে কখনো কখনো অল্প ভিজি আবার কখনো তুমুল ভেজা ভিজি। বৃষ্টিতে ভিজতে ভালো লাগে। ভিজে ভিজে ক্লান্তি দূর করা যায়। সকল গোঁড়ামি আর কালিমা ধৌত করা যায়। আমি বৃষ্টিকে ভালোবাসি। বৃষ্টিও আমাকে ভালোবাসে। দুইয়ে মিলে একাকার।

বাসা থেকে বের হলাম জুরং ইস্ট যাওয়ার জন্য। উদ্দেশ্য, বাংলাদেশে টাকা পাঠানো। ভাবলাম আগামীকাল থেকে বাংলাদেশে ব্যাংক বন্ধ ঈদের ছুটির কারণে, আজ যদি টাকা না পাঠাই তাহলে পরিবারের প্রিয় মুখগুলোর মুখের হাসি ম্লান হয়ে যাবে। সারা মাস পরিশ্রম করে যা বেতন পাই, তা শুধু নিজের জন্য নয়। এই টাকায় আরও মানুষের অধিকার আছে। নিজে কতটা আনন্দ পেয়েছি, সেটা গোপন থাক। প্রতিটা মাস প্রতীক্ষায় থাকে যে মানুষগুলো, তাদের কথা ভাবি। যেই ভাবা, সেই কাজ। দেশে টাকা পাঠাতে হবে। আর যদি টাকা না পাঠাই, তাহলে তাদের মুখের হাসি ক্রমাগত নিঃশেষ হতে থাকে। আমার সব সুখ তাদের নিয়ে। আমি তো আর আলাদাভাবে কোনো কিছু চিন্তা করতে পারি না। তাদের সুখে আমি সুখী হই। তারা সুখে থাকলে গোপনে তাদের কাছ থেকে কিঞ্চিৎ সুখ ছিনিয়ে এনে নিজের গায়ে মাখি। সুখ-দুঃখ মাখামাখি করে সতেজ থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করি। হাসতে শিখি। ভালোবাসতে শিখি। নিত্যনতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করি।

এসবিএস বাসে উঠে যথারীতি জুরং ইস্ট নামলাম। মাত্র ১৫ মিনিটের রাস্তা। ব্যাংকের ভেতর ঢুকে দেখি স্বাস্থ্যবতী একজন নারী। তাঁকে আগে কখনো দেখিনি এই শাখায়। তাঁর নরম সুরে কথা বলার ধরন দেখে যতটা মুগ্ধ হয়েছি, তার চেয়ে বেশি মুগ্ধ হয়েছি তাঁর দ্রুতগতির কাজ দেখে। মনে মনে ভাবলাম, আমাদের দেশের বিভিন্ন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যদি এতটা দ্রুতগতিতে কাজ করতেন, তাহলে সাধারণ মানুষের প্রয়োজনীয় কাজগুলো যথাসময়ে করতে পারতেন। কখনো কখনো পাঁচ মিনিটের কাজে লেগে যায় এক দিন। আবার এক দিনের কাজে লেগে যায় এক সপ্তাহ!

মেঘলা আকাশ, গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাসায় এলাম। প্রিয়জনদের সঙ্গে ফোনে কথা বলে তাদের হাসিভরা কণ্ঠ শুনে সুখ অনুভব করলাম। আর তখনই মনে হলো অট্টহাসিতে সবাইকে জানিয়ে দিতে চাই আমিই পৃথিবীর সেরা সুখী। এই তো বেশ আছি। প্রিয় মুখগুলোর সান্নিধ্য পাওয়ার প্রতীক্ষায় আছি। ভালোবাসা দেওয়ার আশায় আছি। ভালোবাসা পাওয়ার প্রতীক্ষায় আছি।

সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা।