ঐতিহাসিক উদয়গিরি

ঐতিহাসিক উদয়গিরি
ঐতিহাসিক উদয়গিরি

অজানাকে জানার আগ্রহ, অদেখাকে দেখার ইচ্ছে সৃষ্টিশীল মানুষের মজ্জাগত। ভবিষ্যতের মতো দূর অতীতকে জানার আগ্রহও অন্তহীন তার মধ্যে। এই আগ্রহ থেকেই আধুনিক যুগের ঐতিহাসিকেরা মানবসভ্যতার ইতিহাস খুঁজতে খ্রিষ্টজন্মের আগে ৯৫০০ অব্দ পর্যন্ত ছুটে গিয়েছেন। বিস্তারিত জেনেছেন, ইতিহাস পূর্ব প্রাগৈতিহাসিক যুগ সম্পর্কে।

যদিও এই যুগের সুনির্দিষ্ট সময়সীমা এখনো অবধি স্থির করা যায়নি নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ফলে। কারণ নতুন নতুন আবিষ্কার, বারবারই ইতিহাসের সময়সীমার বাঁধন খুলে দিয়েছে। তবে গবেষণার ফলাফলে এই বিষয়ে কারও সংশয় নেই যে ঐতিহাসিক যুগের তুলনায় প্রাগৈতিহাসিক যুগ অনেক বেশি লম্বা। সে যুগের মানুষকে ইতিহাসবিদেরা তাঁদের প্রথম দিককার গবেষণায় যতটা আনস্মার্ট বলে মনে করেছিলেন, তাঁরা ছিলেন তার চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধিমান।

যা হোক আপাতত সর্বস্বীকৃত তথ্য হলো, পাঁচ মিলিয়ন বছর আগেও পৃথিবীতে মানবজাতির অস্তিত্ব ছিল এবং লাখ লাখ বছর ধরে তাদের জীবনধারা বয়ে গিয়েছিল বিভিন্ন রকম ভাঙাগড়ার পথ ধরে।

ওডিশার উদয়গিরি আর খণ্ডগিরিও প্রাচীন ভারতের এমনই এক সুদূর অতীতের নিদর্শন। খ্রিষ্টজন্মের দুই শ বছর আগের সভ্যতাকে যা ধারণ করে রেখেছে। যে কারণে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বহু মননশীল দর্শক বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন এর আকর্ষণে। সভ্যতা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ধর্ম, স্থাপত্য, ভাস্কর্যশিল্পের সঙ্গে এর ঐতিহাসিক আর প্রত্নতাত্ত্বিক দিক তাই অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ। উদয়গিরি ও খণ্ডগিরি যমজ পাহাড়। যার গুহা দেশে সঞ্চিত রয়েছে প্রাচীন যুগের সভ্যতা সংস্কৃতির অমূল্য সম্পদ। ভুবনেশ্বর সিটি সেন্টার থেকে ছয় কিলোমিটার পশ্চিমে পাহাড় দুটির অবস্থান। ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দে গভীর অরণ্যের আড়াল সরিয়ে হঠাৎই একদিন এগুলো আবিষ্কার করেছিলেন তখনকার কটকের ইংরেজ কালেক্টর অ্যান্ড্রু স্টার্লিং। এখানে সব মিলিয়ে ১১৭টি গুহাদেশ রয়েছে। মহাকালের স্পর্শে বেশির ভাগই জরাজীর্ণ। মাত্র ৩৫টি গুহা প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে। অফিশিয়ালি গুহাগুলোর নাম কটক গুহা।

টিকিট কিনে তার প্রাঙ্গণে পা রাখতেই সকাল ১০টা বেজে গেল। সুরেশ বহুদিনের পরিচিত গাইড অম্বরিশ প্রধানকে সব বুঝিয়ে দিয়ে ফিরে গেল তার ট্যাক্সিতে। কারণ, খানিক আগেই স্বামীজীর ফোন এসেছে তার কাছে। ভুবনেশ্বর এয়ারপোর্ট থেকে স্বামীজীর তিন শিষ্যকে দুপুরের ভেতর হোটেলে পৌঁছে দিতে হবে। ফোন পেয়েই সুরেশ নিশ্চিন্ত করতে চাইল সুচরিতকে, এখান থেকে এয়ারপোর্ট আর রেলওয়ে জংশন তো খুব দূরে নয়। আমি ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই এসে পড়ব। ওদের হোটেলও এখান থেকে মাত্র ৪০ মাইলের মধ্যে। আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি তাহলে তাদের পৌঁছে দিয়ে এসো। কিন্তু যদি বেশি দেরি হয়ে যায়? না, না দাদা, হবে না! আর যদি হয়ও, তাহলে বড়জোর আধা ঘণ্টা! তবে সবটা ঘুরে দেখতে এর কম সময়ে আপনাদের তো হবে না। অম্বরিশও জোর দিয়ে বললেন, হ্যাঁ। হ্যাঁ। সুরেশ ঠিক কথাই বলেছে। ভালো করে দেখতে গেলে অনেকটা সময়ই লেগে যায়। তিন ঘণ্টার কমে হবে না। আমি তাহলে ফিরে এসে ওপরে মন্দিরের সামনে থাকব অম্বরিশদা। দাদাদের নিয়ে ওখানেই আসবেন। আচ্ছা, তাই হবে।

প্রখর তেজে খাড়া হয়ে সূর্য জ্বলছে মাথার ওপরে। রোদ উঠেছে চড়চড়িয়ে। এরই মধ্যে বেশ কিছু দর্শনার্থীর আগমনে ছোটখাটো ভিড় জমেছে খণ্ডগিরির পর্বতচূড়ায়। ঝকঝকে জৈন মন্দিরের সামনে। গাইড অম্বরিশ প্রধান, উঁচু জায়গা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে মুখ খুললেন, এই মন্দিরে রোজ পূজা আর প্রার্থনা হয়। আগে অবশ্য এটি ছিল না। কটক গুহা আবিষ্কারের অনেক পরে মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়। এখানকার সব মূল্যবান স্থাপত্য আর চারুশিল্প রক্ষার জন্যই এই ব্যবস্থা। এখানে নিরাপত্তাকর্মীরা রয়েছেন। পূজা–আচ্চার জন্য পুরোহিতও আছেন। আচ্ছা, কোনার্কের সূর্যমন্দিরে কেন পূজা করা হয় না? বহ্নির প্রশ্নে তখনই জবাব না দিয়ে সবশেষের সিঁড়ি থেকে নেমে অম্বরিশ ওদের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালেন। কী ভেবে যেন গম্ভীর হতে চাইলেন পলকের জন্য। তারপর বললেন, সত্যি–মিথ্যা জানি না মা। তবে শুনেছি, ধর্ম দাস নামে ১৩ বছরের একটি বালক ওখানে আত্মহত্যা করার পরই পূজা বন্ধ হয়ে যায়।

আত্মহত্যা? আহা! আত্মহত্যা কেন করেছিল? সে সম্পর্কে অনেক রকম প্রচলিত গল্প আছে। গল্প নয় অম্বরিশজী! যেটা যৌক্তিক ও সত্য বলে বিশ্বাস করা হয়, আপনি সেটাই বলুন। হ্যাঁ, আমি সেটাই বলছি। এটুকু বলেই হঠাৎ থেমে পড়লেন গাইড। সুচরিতের মুখে তাকালেন, সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় ওভাবে চারদিকটা দেখবেন না। এবড়োখেবড়ো সিঁড়ি তো, পা হড়কে পড়ে যেতে পারেন। এরপরই শুরু করলেন, ধর্ম দাস মাতৃগর্ভে থাকতেই ওর বাবা রাজার হুকুমে নির্মাণশিল্পী হিসেবে ওখানকার কাজে যোগ দিয়েছিলেন। রাজামশাই খুবই প্রতাপশালী আর শক্ত মনের মানুষ। কাজ শেষ করার সময় বেঁধে দিয়ে বললেন, নির্দিষ্ট সময়ে শেষ না হলে কঠিন শাস্তি পেতে হবে। ওদিকে ধর্ম দাসের জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে গাঁয়ের মানুষ নানান কথা বলে তাকে অপমান করতে শুরু করেছে। নিজের পরিচয় জানার জন্য বালক তাই ব্যাকুল হয়ে পড়ল। পথে বহুজনকে জিজ্ঞেস করে শেষে সূর্যমন্দিরে পৌঁছাল ধর্ম দাস। কিন্তু দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেও বাবার সঙ্গে দেখা করতে ব্যর্থ হলো সে। কারণ, বাবা খুব ব্যস্ত। দেখা করার সময় নেই। একদিন প্রচণ্ড অভিমানে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে বসল ধর্ম দাস।

এ ঘটনা কবেকার? বহুকাল আগের। ১২২০ থেকে ২৫–এর মধ্যে কোনো একসময় হবে। রাজা নরসিংহ দেবই তো সূর্যমন্দির শেষবার নির্মাণ করেছিলেন। তারপর আর নতুন করে তৈরি করা হয়নি কখনো? না। এরপর অম্বরিশ সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গে এলেন। মুখের ওপর সন্তুষ্টি ছড়িয়ে বললেন, আপনাদের সম্পর্কে কাল রাতে সব কথাই জানিয়েছে সুরেশ। এখানে বছরে ট্যুরিস্ট দর্শনার্থী নিয়ে ওর তিন–চারবার আসাই হয়। তাদের মধ্যে কদাচিৎ দু–একজন বাঙালিও থাকেন। আপনাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে বেশ লাগছে তাই। কথা শেষ করে ওদের নিয়ে ডান দিকের বাঁকে পা রাখতে না রাখতেই পেছন ফিরে একঝলক তাকালেন এবার। তারপর কুণ্ঠিত হয়ে বললেন, আসলে আমার ঠাকুরদা বাঙালি মেয়ে বিয়ে করেছিলেন। ছেলেবেলায় ঠাকুমার কাছে শখ করে একটু আধটু বাংলা বলার অভ্যাস তাই হয়েছিল। এখনো কেউ বললে কিছুটা বুঝতে পারি। কিন্তু বলার অভ্যাসটা একেবারেই নেই। কিন্তু বাঙালি কেউ এলে বেশ লাগে, বলেই অবারিত হাসলেন।

অম্বরিশ প্রধানের বয়স সম্ভবত ষাটের ওপর। মুখের ওপর অনাবিল হাসির স্রোত শুরু থেকেই বইছে। চমৎকার গৌরবর্ণ গায়ের রং। সামনের ছায়াহীন প্রান্তে এসে দাঁড়াতেই সূর্যের আলোয় তার কেশহীন মাথা ঝকঝক করে উঠল গৌরবর্ণ দেহের মতোই। সূর্যমন্দিরের প্রবীণ গাইড অনন্ত রাঠের কথা বহ্নির সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল। তার মন বলল, অনন্ত রাঠের ব্যক্তিত্বে যতখানি রাশভারী গভীরতা, অম্বরিশের চরিত্রে ততটাই স্বচ্ছ নদীর নিটোলতা। তাই তার মুখের দিকে তাকালে অন্তরের সব পাঠ, চোখের ওপর ধরা দেয়। যেন বুকের ভাষা পুরোটাই পড়ে ফেলা যায় মুহূর্তে। এবড়োখেবড়ো সিঁড়ি ভেঙে এরপর আরও নিচে নেমে এলেন গাইড, চলুন। উদয়গিরির কেভগুলো আগে দেখা যাক।

সুচরিত সূর্যমন্দির দেখার অভিজ্ঞতা ঝালিয়ে জানতে চাইল, এত পুরোনো গুহার স্থাপত্য অক্ষত আছে অম্বরিশজী? না নেই! বেশির ভাগই ধসে গিয়েছে। যেগুলো দাঁড়িয়ে আছে, তাদের মধ্যেও অনেকগুলোতেই প্রবেশ নিষেধ। কিন্তু তাতে ক্ষতি কিছু নেই। যেগুলো দেখানো হয়, মোটামুটি সব প্রশ্নের উত্তর তাতেই মেলে। গুহাগৃহ কতগুলো আছে? সব মিলিয়ে ৩৫। উদয়গিরিতে ১৮ আর খণ্ডগিরিতে ১৭। এগুলো ন্যাচারাল নাকি মানুষের তৈরি? দুই রকমই আছে। যখন চেদি রাজবংশের মহারাজ খরবেলা, জৈন সন্ন্যাসীদের থাকা আর সাধনভজনের জন্য এখানে গুহাগৃহ নির্মাণের কাজ শুরু করেন, তখন প্রকৃতির হাতে তৈরি অনেকগুলো গুহাই ছিল। পরে পাহাড় কেটে মহারাজ ও তাঁর উত্তরপুরুষেরা আরও কিছু নির্মাণ করেছিলেন। সেটা কখন? খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় থেকে প্রথম শতাব্দীতে। মহারাজ খরবেলা জৈনধর্মের অনুসারী ছিলেন না। তাঁর উত্তরসূরিরা এর অহিংসার আদর্শে মুগ্ধ হয়ে প্রথম অনুসারী হন। পাথরের দেয়ালে ব্রাহ্মী ভাষায় যে শিলালিপিগুলো লেখা রয়েছে, সেখানেই সব লেখা আছে। ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে এর পাঠোদ্ধার করা হয়।

গাইড অম্বরিশ প্রধান পথপ্রদর্শক হয়ে এগিয়ে চলেছেন সামনের দিকে। তাঁকে অনুসরণ করে একটি দোতলা গুহাঘরের সামনে এসে দাঁড়াল সুচরিতরা। প্রথমেই চোখে পড়ল, ওপরে আর নিচে বেলে পাথরের লালচে পিলারের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা সুদীর্ঘ টানা বারান্দা। আশ্চর্য কৌশলে তৈরি করা ঈষৎ ধনুকাকৃতি দরজার বিশাল খিলান। অম্বরিশ বললেন, এই গুহাগৃহের নাম রানি গুম্ফ। আকারে সবচেয়ে বড় ও অনন্যসুন্দর!

ঐতিহাসিক উদয়গিরি
ঐতিহাসিক উদয়গিরি

রানি গুম্ফের বিশাল কক্ষে প্রবেশ করতে এক লহমায় ওদের মন উড়ে গেল মহাকালের সীমান্তে। যখন সে যুগের স্বনামধন্য কবিরা মিলে সংস্কৃত ভাষায় মহাসমারোহে লিখে চলেছেন, রাজা উদয়ন আর রাজকুমারী বাসবদত্তার প্রেমকাহিনির গল্পগাথা। যে কালের নির্যাস দিয়ে আধুনিক যুগের সবচেয়ে সফল রোমান্টিক কবি জীবনানন্দ দাস লিখেছিলেন, ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা/ মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য’!

কক্ষের ভেতরে চারপাশের পাথুরে দেয়ালজুড়ে অতুলনীয় কারুকাজের খোদাই করা দৃশ্যচিত্র। মহাসমারোহে সবাই মুখরিত হয়েছে স্বপ্নিল অতীতের ভাষ্যকার হয়ে। খানিকটা এগোতে নজর কাড়ল উজ্জ্বল পোশাক পরা যুদ্ধবিজয়ী মহারাজার সমৃদ্ধ সৈন্যবাহিনী। বিজয় গৌরবের মহিমায় তাদের উদ্দীপ্ত শোভাযাত্রার মিছিল এগিয়ে চলেছে নগরের পথ ধরে। কোথাও যজ্ঞের উৎসব পালিত হচ্ছে। পাশেই ধূমায়িত অগ্নিশিখার দিকে মুখ করে মুদিত চোখে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ভক্তিপরায়ণ নরনারী। তার পাশে রাজদরবারের ছবি, চলমান জীবন সংস্কৃতির ডকুমেন্ট পুরো দেয়ালজুড়ে বর্ণিত। যেখানে কান পাতলে এখনো মুখরিত হয় দূর অতীতের সমাজ আলেখ্য।

অনুভব করা যায় অজস্র ঘটনার ওঠাপড়ার স্পন্দন। দেখতে দেখতে ওদের চেতনা থেকে বর্তমান কখন হারিয়ে গেল। আড়াল হয়ে গেল ভবিষ্যতের ভাবনা। কেবল মুগ্ধ বিস্ময়ের স্তরে স্তরে সরব হয়ে রইল, সহস্র বছর আগেকার পেছনের সময়। আজ যা বিস্মৃত অতীত।

শুরু হলো দোতলার ঘরে পরিক্রমা। প্রধান ঘরগুলোর বাইরে ছিমছাম ছোট্ট দুটি ঘর দ্বারের প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে ডান পাশে। এখানকার দৃশ্য ছবি নিচের ঘরের থেকে একেবারেই আলাদা। এখানে রয়েছে, বন্য হাতির কবল থেকে উদ্ধারকৃত ভীত তরুণী। শবর পুরুষদের হরিণ শিকারের দৃশ্য। নানা ধরনের পশুমূর্তি। জৈন সাধকদের স্বস্তিকা, সাপ ও নীল পদ্ম। অম্বরিশ প্রধান বিশেষ বিশেষ চিত্রে আঙুল তুলে বহ্নিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে অভ্যস্ত ভাষণে ব্যাখ্যা করে চলেছেন। হঠাৎ অনেক সময়ের নীরবতা ভেঙে সুচরিত জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, সাধকেরা যেখানে সাধনার জন্য বাস করতেন, সেখানে এসব দৃশ্য কেন এত গুরুত্ব দিয়ে খোদাই করা হলো?

এমন প্রশ্নে সম্ভবত মনে মনে খুশি হলেন গাইড। তাঁর ঠোঁটের ফাঁকে সন্তুষ্টির হাসি দেখা দিল, আসলে মহারাজ খরবেলা চেয়েছিলেন, জীবন বাস্তবতার সব চালচিত্রই উন্মোচিত হোক। আমাদের সেকালের সভ্যতা সবার সহাবস্থানে আর সমান অধিকারে বিশ্বাসী ছিল, বিরোধের নীতিতে নয়। এখানে তাই অধ্যাত্ম জীবনের সঙ্গে সংসারের কোনো রকম সংঘর্ষ ছিল না। বরং কীট, পতঙ্গ, পশুপাখিসহ সব ধরনের জীবনযাত্রা নিয়েই তাদের মনে একটি শ্রদ্ধাবোধ ছিল। আর সেটাই ছিল আমাদের প্রাচীন সভ্যতার সৌন্দর্য ও গৌরবের দিক। বহ্নি এবার জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, মানুষের সভ্যতার বয়স কত? অম্বরিশ একটুও না ভেবে সঙ্গে সঙ্গে বললেন, সেসব নিয়ে কত শত গবেষকেরা গবেষণা করছেন, এ নিয়ে আমি আর কী বলব? তবে সাধারণ বুদ্ধিতে যেটা বুঝতে পারি সেটা হলো, হাজার হাজার বছরের উন্নত সভ্যতার সংস্পর্শ ছাড়া এত বড় মাপের শিল্পী, সাধক কিংবা দার্শনিক জন্মানো সম্ভব ছিল না। দেখুন, মহারাজ খরবেলা কিন্তু জৈনধর্মের অনুসারী ছিলেন না। তারপরও তিনি এই ধর্মের সন্ন্যাসীদের জন্য অকুণ্ঠভাবে করেছেন! ঠিক কথা। কোনার্কে যা দেখে এলাম এবং এখানেও যা দেখছি, তাতে সত্যিই খুব অবাক হচ্ছি। আপনার সব ব্যাখ্যা শুনেও মনে হলো, বৈচিত্র্যের ভেতর ঐক্যের সন্ধান এঁরা জানতেন। তাই কেবল জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্পসংস্কৃতি আর ধর্ম-দর্শনের চর্চা করাই সে যুগের শিক্ষিত মানুষের লক্ষ্য ছিল না। পরস্পরের জন্য শ্রদ্ধা রেখে সমাজজীবনকে একটি সুশৃঙ্খল বন্ধনে বেঁধে রাখার মানসিকতাও তাঁদের রপ্ত ছিল।

উদয়গিরির হাতি গুম্ফ, বাঘ গুম্ফ, গণেশ গুম্ফ, ধ্যান গুম্ফ, সর্প গুম্ফসহ আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ গুহাগৃহ দেখতে দেখতে সময় কখন উড়ে গেল। অম্বরিশ প্রধানের মুখে এদের প্রত্যেকটির স্বতন্ত্র নামকরণ, কাহিনি, শিল্প, ইতিহাস, জ্যোতিষ শাস্ত্র, মেডিকেল শাস্ত্র, গণিত শাস্ত্র, মহাকাশ নিয়ে গবেষণার বিষয়গুলো উচ্চারিত হলো বারবার। সুচরিতদের নিয়ে খণ্ডগিরি পর্বতের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললেন, সারা বছর ধরে এখানে ট্যুরিস্টদের আসা–যাওয়া থাকলেও বিদেশের ট্যুরিস্টরা বেশির ভাগই আসেন অক্টোবর মাসের শেষ ভাগ থেকে মার্চের প্রথম দিকে। তাঁরা দেখেই কিন্তু চলে যান না। রীতিমতো সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করে জেনে নেন। পাহাড়ি পথের উঁচু–নিচুতে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্তির পরশ অনুভব করছে বহ্নি। এককালে সবুজ অরণ্যে ঢাকা এই জায়গাটি কেমন ছিল দেখতে, কল্পনায় একবার দেখার চেষ্টা করল সে। আর তখনই চোখে পড়ল, একজন শীর্ণ শরীর বৃদ্ধ মানুষ পাশের থেকে হাত বাড়িয়েছেন তার দিকে। তাঁর দুই চোখে ব্যাকুলতার আকুতি। কথা না বলে সে নিঃশব্দে তাঁর নোংরা থালার ওপর কয়েকটি রুপি ঢেলে দিল। পলকের জন্য হাসির রেখা আলোক ফেলল মানুষটার মুখে। বহ্নি দেখল, সে হাসি সন্তুষ্টির পরিতৃপ্তিতে ভরা। অসাধারণ, অমলিন হাসি মানুষটার হৃদয় থেকে ঝরে পড়ছে! (চলবে)

ধারাবাহিক এ ভ্রমণকাহিনির আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন