নাম কথন

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সারিকাকে আমি অনেক বছর ধরে চিনি। আমাদের পাশের বাড়িতে থাকত। একটু রাগী ধরনের মেয়ে ছিল। প্রেম ভালোবাসা ওর কাছে ন্যাকামো বলে মনে হতো। সময় নষ্ট ছাড়া এসব নাকি কিছুই না। তার বান্ধবীদের যখন বিয়ে হওয়া শুরু হলো তখন সে মুখ বেঁকিয়ে বলত, আজিব এক তামাশা এইগুলা। এত শখ করে কেমনে বিয়ের পিঁড়িতে বসে মেয়েগুলা? সেই সারিকা তৌহিদ নামের এক ছেলের এমন প্রেমে পড়ল যে দুনিয়ার কিছুই তার মনে থাকল না।

এক সন্ধ্যায় কাউকে না জানিয়ে তৌহিদের সঙ্গে পালিয়ে বিয়ে করে ফেলল সারিকা। এক বৃদ্ধ দম্পতির বাড়িতে সাবলেট থাকা দিয়ে সারিকা তার বিবাহিত জীবন শুরু করল। আজ ঝামেলা পার করে সারিকা আর তৌহিদ সামাজিক অবস্থানের দিক থেকে মোটামুটি সম্মানজনক জায়গায় এসেছে। পরিবার থেকেও ওদের মেনে নিয়েছে।

আমার সঙ্গে ফেসবুকের মাধ্যমে অনেক দিন পর যোগাযোগ হলো। ওর প্রোফাইলে ঢুকে দেখি আইডিতে ওর নাম লেখা সারিকা টি আফরিন। দেখে নিজের মনেই হাসলাম কিছুক্ষণ। সারিকা সব সময় বলত, মেয়েরা ওপরে ওপরে যতই মডার্ন ভাব দেখাক না কেন, ভেতরে ভেতরে সবগুলা একেকটা শাবানা। দেখ বিয়ে হতে না হতেই কেমন গদগদ ভাব নিয়ে নামের শেষে স্বামীর নাম লাগিয়ে বসে থাকে। আমি জীবনেও এই কাজ করব না।

মজা করে মেসেজ করলাম, কী রে, তুই না বলেছিলি স্বামীর নাম লাগাবি না? উত্তর দিল, হাসিস না, পদবি চেঞ্জ করিনি, আফরিনই আছে শেষে, শুধু মাঝখানে তৌহিদ লাগিয়েছি। ভালো লাগেরে নিজের নামের মধ্যে ওর নাম দেখতে।

আমি বললাম, ওরে প্রেম রে! তাহলে তৌহিদ ভাইকেও বল ওনার নামটার মধ্যে তোর ‘এস’ লাগিয়ে তৌহিদ এস হাসান করতে। ওনারও একটু ভালো লাগুক। প্রেমের প্রকাশ দুজন একসঙ্গে করলে বেশি সুন্দর হবে।

আমার কথা শুনে সারিকা হাসা শুরু করল।

নামে কী বা আসে যায় বলে একটা কথা আছে। এটা সম্ভবত নাম কোনো ফ্যাক্টর নয় বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। অথচ নাম খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার। ছোটবেলায় আন্টিদের যখন দেখতাম নিজেদের জামাল ভাবি, কামাল ভাবি, জসিম ভাবি, ওয়াসিম ভাবি, এই সব নামে ডাকাডাকি করছেন, তখন অবাক হয়ে ভাবতাম, আন্টিদের তো নিজেদের নাম আছে। তাহলে তাঁরা একে অপরকে আঙ্কেলদের নাম ধরে কেন ডাকেন? নিজের নামের চেয়ে প্রিয় অন্য কারও নাম কী করে হতে পারে এটা আমার মাথায় ঢুকত না। এখনো ঢোকে না। আঙ্কেলরাও যদি আন্টিদের নামে সমাজে চিহ্নিত হতে চাইতেন যেমন শায়লা ভাই, দীপালি ভাই, মণিকা ভাই তাহলেও হয়তো বুঝতাম যে, তারা স্বামী–স্ত্রী একে অপরকে ভালোবেসে একে ওপরের নামে পরিচিত হতে চান। কিন্তু নাহ, ঘটনাতো তা না।

পদবি পরিবর্তন করার ব্যাপারটি পাশ্চাত্য থেকে এসেছে। আমাদের দেশে তবুও একটি মেয়ের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে, সে আরেকজনের পদবি নেবে কিনা। কিন্তু পাশ্চাত্যে একটি বিবাহিত নারীর পদবি পরিবর্তন হবে এটাই স্বাভাবিকভাবে দেখা হয়। বিবাহিত অথচ স্বামী–স্ত্রী দুজনের পদবি দুরকমের কেন, এই সাদাদের দেশে কতবার যে এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। প্রতিবারই হাসিমুখে বলেছি আমার নিজের নাম আমার খুব বেশি পছন্দ, তাই বদলাইনি।

ইদানীং অনেকে নাম সোয়াপ করে থাকে। সারিকাকে এটার কথাই বলছিলাম। এটা নতুন শুরু হয়েছে। কিছুদিন আগে আমার এক বন্ধু জানালেন সেই সম্পর্কে। তাঁর অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের নাম ক্যারোলাইন ডলবি। বিয়ের পর নতুন নাম নিয়েছেন ক্যারোলাইনা ডলবি বিংহাম। কারণ স্বামীর নাম বিংহাম। অপরদিকে স্বামীও তাঁর নাম নিয়েছেন ম্যাথিউ বিংহাম ডলবি। এর আগে ভারতীয় তারকা সোনম কাপুরের ক্ষেত্রে এ রকম শুনেছি। বিয়ের পর দুজন দুজনের নাম নাম লাগিয়ে যথাক্রমে সোনম কাপুর আহুজা ও আনন্দ সোনম আহুজা হয়েছেন। অনেকে এই নাম সোয়াপ করার ব্যাপারটা বেশ পছন্দ করছেন। কেউ কেউ বলেন, এ রকম যদি সারা পৃথিবীতে প্রচলিত হয়ে যায় তাহলে সমতা আসবে। আবার অনেকে বলেন, দুজন দুজনের নাম গ্রহণ করলে দুজনেই ভালোবাসার প্রকাশ পাবে। ব্যাপারটা ভীষণ সুন্দর ও রোমান্টিক। যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি না যে, ভালোবাসা প্রকাশের জন্য এ রকমটা করার প্রয়োজন আছে। তারপরও যাঁরা করছেন তাদের অভিনন্দন।

ছোট্ট একটা গল্প বলে শেষ করি।

লেখিকা
লেখিকা

আমার সি সেকশনের সময় আমার হাজব্যান্ড আমার হাত ধরে আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি শারীরিক কষ্ট ভুলে থাকার জন্য অনবরত তাঁর সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছিলাম—যেমন ‘ক্যামেরা কাঁধে ঝুলিয়ে রাখ’। ‘বেবির ফার্স্ট ছবি যেন মিস না হয়’। ‘আমার গলার চেইন খুলে কোথায় রেখেছ?’ ‘সাবধানে পকেটে ঢুকাও, হারিয়ে যেন না যায়’। ‘এই আমি হাত নাড়াতে পারছি না কেন’। ‘ডাক্তারকে জিজ্ঞেস কর আর কতক্ষণ লাগবে’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

একসময় কথা বলার শক্তি কমে এল। তখন চুপ করে গেলাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম, ওটিতে সবাই আমার হাজব্যান্ডকে মিস্টার বুশরা বলে ডাকছে এবং যাকে ডাকা হচ্ছে, সে কাউকে শুধরে দেওয়ার চেষ্টা না করে চুপচাপ সেই ডাক হজম করছে। ব্যাপারটি দেখে ওই সময় অতি যন্ত্রণার মধ্যেও আমার হাসি এসেছিল। ভুলক্রমেই হোক আর যেভাবেই হোক, অল্প সময়ের জন্য হলেও জীবনে একবার দেখার সুযোগ এসেছিল একজন পুরুষকে তার স্ত্রীর নামে ডাকা হচ্ছে। কাউকে তার স্পাউসের নাম ধরে ডাকা আমার পছন্দের না হলেও, সেদিন সেই মুহূর্তে ব্যাপারটা ভীষণ এনজয় করেছিলাম।
...

সারা বুশরা: বেডফোর্ড, যুক্তরাজ্য।