ছয় হাজার কিলোমিটার। ১০ দিন। পাঁচটি প্রদেশ। ছয়জন। এই রকম একটা পরিকল্পনা করেই আমাদের কানাডার পূর্ব উপকূলে যাত্রা শুরু। অনেক দিন ধরেই এ রকম একটা রোমাঞ্চকর ভ্রমণে যাওয়ার ইচ্ছে। কিন্তু এত লম্বা সময় ও ভ্রমণপিপাসু কাউকে সঙ্গী হিসেবে পাওয়া নিয়ে চিন্তায় ছিলাম।
এ রকম দীর্ঘ ভ্রমণে দুই-তিন পরিবার একসঙ্গে যেতে পারলে ভ্রমণ আরও বেশি উপভোগ্য হয়। মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মতো আমার ভ্রমণপিপাসু বন্ধু সম্রাট ও তার স্ত্রী রিক্তা কিছুদিন আগে এডমন্টন থেকে টরন্টো চলে আসে। আর আমিও আমার বন্ধুকে আমার পরিকল্পনা বর্ণনা করলে সে–ও উৎসাহী হয়ে ওঠে। অবশেষে আমরা ছয়জন আর একটা ভাড়া করা ডজ ক্যারাভান নিয়ে আমাদের ১০ দিনের দীর্ঘ সফর শুরু। যাত্রা শুরু হলো কুইবেক প্রদেশ দিয়ে।
হ্যালো ক্যান হাই স্পিক উইথ সুসান?
ওপাশ থেকে শুরুতেই উত্তর, নো ইংলিশ, নো ইংলিশ। আমিও নো ফ্রেঞ্চ, নো ফ্রেঞ্চ বলে বলটা তার কোর্টে দিয়ে দিলাম। কিন্তু দরকার তো বেশি আমাদেরই। এখন কোনোভাবে yes, no, very good ইংরেজি দিয়ে সুজানকে বোঝালাম যে আমাদের কুইবেক সিটিতে পৌঁছাতে দেরি হবে। সে যাতে তার এয়ার বিএনবির বাসার চাবিটা কোথাও রেখে যায়। আমি আর সম্রাট অদলবদল করে ১০ ঘণ্টা টানা গাড়ি চালিয়ে গভীর রাতে কুইবেক পৌঁছালাম।
রাস্তাগুলোর বেশ বড় বড় ফ্রেঞ্চ নাম। জিপিএস পুরো নাম বলা শেষ করার আগেই দেখি আরেক রাস্তা চলে আসে। ইংরেজির কোনো চিহ্নও নেই। রোড সাইনগুলো দেখতে দেখতে একটা শিখেও গেলাম, Rue মানে Street আর Arret মানে Stop। কুইবেকে অধিকাংশ লোক ফ্রেঞ্চ বলে, ইংরেজি জানলেও বলতে চায় না। তার মধ্যে গুগলের সাহায্যে অনুবাদ করে যা যা দরকার তাই দিয়ে সুজানের সঙ্গে কথা বললাম। চমৎকার সুন্দর গোছানো বাসা। নাদিয়া ও রিক্তা মিলে ঝটপট রাইস কুকারে ভাত বসিয়ে দিল। টরন্টো থেকে ৮০০ কিলোমিটার দূরে রাত দুটোয় গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত আর সঙ্গে নিয়ে আসা কোরবানির মাংস ভুনা। আহ জীবনটাই অন্য রকম। মাত্র ১০ ঘণ্টা, কিন্তু মনে হচ্ছিল কত দিন না খাওয়া আমরা।
পরদিন সকালে আমাদের গন্তব্য কুইবেকের মন্টমোরেনসি ঝরনা। কানাডার অন্যতম উঁচু ঝরনা (২৭২ ফুট)। মন্টমোরেনসি নদীর সব ভালোবাসা যেন এই ঝরনার মাঝ দিয়ে মিশেছে সেন্ট লরেন্স নদীতে। ঝরনার ওপর দিয়ে ঝুলন্ত সেতু থেকে নিচে যখন তাকালাম মনে রোমাঞ্চের শিহরণ বয়ে গেল। শরীরের এড্রেনালিন হরমোন বহুগুণে বেড়ে গেল ঝরনার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত ছুঁয়ে যাওয়া জিপ লাইন দেখে। আর সেটা আরও বেড়ে গেল যখন আমি আর নাদিয়া জিপ লাইনে করে হাজার ফুট উঁচুতে ঝরনার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে এলাম। পুরো শরীরটাকে শূন্যে ভাসিয়ে শীতল হাওয়ার দোলে লাইন ধরে এগিয়ে চললাম, এক পাশে মনোমুগ্ধকর মন্টমোরেনসি ঝরনা, আর অন্য পাশে সেন্ট লরেন্স নদী।
তারপর আমরা রওনা হলাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ইউনেসকো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ, কুইবেক ওল্ড সিটি। কুইবেক ওল্ড সিটির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সেন্ট লরেন্স নদীর পাড়েই অবস্থিত বিখ্যাত FAIRMONT LE CHÂTEAU FRONTENAC হোটেল, স্থাপত্যকলার এক অনন্য নিদর্শন। হোটেলের ডকে দাঁড়িয়ে পুরো নদীর এক অনিন্দ্য সুন্দর দৃশ্য দেখা যায়। ইতিহাস, সাহিত্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আঁধার কুইবেক ওল্ড সিটির সাজানো–গোছানো নানা রঙের বাড়িগুলো দেখলে মনে হয় হয়তো ইউরোপের কোনো শহরে চলে এসেছি। গলিতে গলিতে আঁকা ছবি, জমজমাট দোকানপাট, প্রাচীন সতেরো-আঠারো শতকে তৈরি নানা রঙের বাড়ি, রাস্তার পাশের ক্যাফে, পাবলিক স্কয়ারগুলো আমাদের ইউরোপ ঘুরতে না পারার দুঃখ অনেকখানিই মিলিয়ে দিয়েছে। প্রতিটি গলি যেন এক মোহ নিয়ে সবাইকে টানছে, মনে হচ্ছে দূরে কোথাও হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালা আমাদের ডাকছে। বন্ধুর কাছ থেকে উপহার Quebec লেখা টি-শার্টের ইউরোপের স্মৃতি নিয়ে বিকেল নাগাদ রওনা দিলাম নিউ ব্রান্সউইক প্রদেশের উদ্দেশে।
কুইবেক থেকে প্রায় ৬০০ কিলোমিটার। আমি আর সম্রাট মিলেমিশে গাড়ি চালাই। চালক ছাড়া সবাই মোটামুটি ক্লান্ত হয়ে ঘুম। আমার মনে হচ্ছিল মি. বিনের হলিডে মুভির মতো ম্যাচের কাঠি দিয়ে চোখ খুলে রেখে গাড়ি চালাই। নিউ ব্রান্সউইকে রাতে গাড়ি চালান খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। রাতে প্রচুর Moose রাস্তা পারাপার করে। সব সময় সাবধানে থাকতে হয়। নিউ ব্রান্সউইকের রাজধানী ফ্রেডরিকটনে থাকেন প্রিয় আনিস ভাই ও সালমা ভাবি। রাত দুটোয় তাঁদের বাসায় পৌঁছে দেখি রাজকীয় অভ্যর্থনা। মনে হচ্ছিল ভুল করে বিয়েবাড়ির দাওয়াতে চলে এসেছি। সারা রাত ধরে চলল অনেক দিনের জমানো গল্প আর খাওয়াদাওয়া।
সময়, জোয়ার ও প্রকৃতির বিশালতার এক অসাধারণ গল্পের জায়গা ‘হোপ ওয়েল রক’। দিনদুপুরে আমরা রওনা হলাম রক দেখতে। ফ্রেডরিক্টন থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে। ফান্ডি উপকূলে অবস্থিত ‘হোপ ওয়েল রক’ বিখ্যাত পৃথিবীর সর্বোচ্চ জোয়ারের (৫২ ফুট) জন্য। জোয়ারে যেখানে সবাই নৌকা চালায় আবার সেখানেই ভাটার সময় সমুদ্রসৈকতে হেঁটে বেড়ায়। সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে উঁচু উঁচু বিভিন্ন আকৃতির পাথর। হাজার বছর ধরে পানিতে ক্ষয়ে ক্ষয়ে চমৎকার সব দানব আকৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু কিছু পাথর তো পুরো মানুষের মুখাবয়ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রকৃতির বিশাল বৈচিত্র্যের এক পটভূমি হোপ ওয়েল রক।
দূর থেকে দেখলে মনে হয় বড় বড় পাথরের ফুল সমুদ্রে বসানো। এ জন্য এখানের পাথরগুলোকে ‘Flower Pot Rock’-ও বলা হয়। আমরা যখন পৌঁছালাম তখন ভাটা শুরু হয়ে গেছে। সম্রাট ও রিক্তা দুজনেই ভূতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী। এই জায়গা দেখে ওদের এত আনন্দ যে আমিও ওদের কাছ থেকে প্রথম বর্ষের সাধারণ জ্ঞান পেয়ে গেলাম। নিউ ব্রান্সউইকে আরেকটি মজার জায়গা ম্যাগনেটিক হিল (Magnetic Hill), ঢালু রাস্তার নিচ থেকে ওপরে গাড়ি এমনি এমনি উঠে যায়। উল্টো করে গাড়ি নিউট্রাল গিয়ারে রেখে দিলাম, ওরে বাবা গাড়ি তো দেখি নিজে নিজেই নিচ থেকে ওপরে উঠে গেল। সবাই একবার দুবার করে গাড়ি চালিয়ে রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করতে গিয়ে রাত করে ফেললাম। কিন্তু রহস্য অজানাই থেকে গেল। এ রহস্য মনে নিয়েই আমরা রওনা দিলাম আমাদের পরবর্তী প্রদেশের পথে। আমাদের এবারের গন্তব্য প্রদেশ প্রিন্স অ্যাডওয়ার্ড আইল্যান্ড।
সেতুর ওপর দিয়ে গাড়ি চলছে। কিন্তু সেতু আর শেষ হচ্ছে না। অধৈর্য হয়ে গুগল করে দেখলাম সেতুর দৈর্ঘ্য প্রায় ১৩ কিলোমিটার। কনফেডারেশন ব্রিজ-আটলান্টিকের ওপর দিয়ে নিউ ব্রান্সউইক ও প্রিন্স অ্যাডওয়ার্ড আইল্যান্ডকে সংযুক্ত করে রেখেছে। অসম্ভব সুন্দর এই সেতু পার হয়ে আমরা পা রাখলাম প্রিন্স অ্যাডওয়ার্ড আইল্যান্ডে।
‘এখন অনেক রাত, খোলা আকাশের নিচে, জীবনের অনেক আয়োজন, আমায় ডেকেছে’—এই গান মনে হলো আমাদের জন্যই লেখা। ভরা পূর্ণিমায় রুপালি জ্যোৎস্নার আলোয় আমরা তাঁবু টানাচ্ছি আটলান্টিকের তীর ঘেঁষে। পাশে সমুদ্রের গর্জন আর মাথার ওপর রুপালি চাঁদ। সবকিছুই যেন এক স্বপ্নের ডাকে সাড়া দেওয়া। প্রিন্স অ্যাডওয়ার্ড আইল্যান্ডের কেন্সিংটন শহরে টুইন শোর-এ আমাদের তাঁবু। রাতে বারবিকিউ করা ঝলসানো মাংস আর ভরপুর আড্ডা দিয়ে এবার আমদের বিশ্রামের পালা।
পরদিন সকালে প্রিন্স অ্যাডওয়ার্ড আইল্যান্ডের একেবারে পশ্চিম প্রান্তের বাতিঘর (Light House) দেখা দিয়ে শুরু করলাম দ্বীপের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত ঘুরে বেড়ানো। তারপর একে একে শারলট টাউন, বারক্লে সমুদ্রসৈকত, গ্রিনউইচ ন্যাশনাল পার্ক ঘুরে বেড়ানো। আটলান্টিকের পাশে এত দিন ঘুরলেও বারক্লে বিচেই প্রথম পানিতে নামার সুযোগ পেলাম। সারা দিন খাওয়াদাওয়া নেই কিন্তু পানি দেখে সবাই দৌড়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। নামিরা-নেহান তো পানি থেকে উঠবেই না। ঠান্ডা শীতল লোনা পানিতে আমরা পুরো শরীরের ক্লান্তিকে ডুবিয়ে দিলাম।
প্রিন্স অ্যাডওয়ার্ড আইল্যান্ড অনেকটা আমাদের চিরচেনা গ্রামবাংলার মতো। চারদিকে শুধু ফসলি জমি বিশেষ করে আলুখেত। প্রিন্স অ্যাডওয়ার্ড আইল্যান্ডের আলু অনেক বিখ্যাত। তাই মনে হলো এখানে এলাম আর আলু পোড়া খাব না! বিখ্যাত আলু নিয়ে নিলাম নোভাস্কশিয়াতে গিয়ে পুড়িয়ে খাওয়ার জন্য। চারদিকে আঁকাবাঁকা রাস্তা আর মাঠের পর মাঠের সবুজ ফসলি জমি। উত্তর-পূর্ব দিকে গ্রিন উইচ পার্কে যাওয়ার পথে উঁচু–নিচু পাহাড়ি রাস্তার পাশে সাজানো–গোছানো বাড়িগুলো দেখে মনে হয়, একেকটা ছবি দাঁড়িয়ে আছে। গ্রিন উইচ পার্কে সমুদ্রসৈকতে সূর্যাস্ত দেখে আমরা যখন আমাদের তাঁবুতে ফিরছি, মনে হচ্ছে কোনো ভুতুড়ে শহরের মাঝ দিয়ে যাচ্ছি। সন্ধ্যা হতেই পুরো দ্বীপ মনে হয় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে যায়। হঠাৎ করে রাস্তার মাঝখানে মাঝখানে জাদুকরি ধোঁয়া, সুনসান নীরবতা আর জিপিএসের উলটাপালটা নির্দেশনায় একসময় নিজেদের আলুখেতের মাঝে আবিষ্কার করলাম। একদিকে প্রচণ্ড ক্ষুধা আর অন্যদিকে মনে হচ্ছে পথ শুধু বেড়েই যাচ্ছে।
সকালবেলা ঝটপট নাশতা করে তাঁবু গুটিয়ে আমরা গেলাম কনফেডারেশন সেতু দেখতে। দিনের আলোয় সেতুর দুই পাশের দৃশ্য খুবই চমৎকার। উত্তাল আটলান্টিকের দুই পাড়কে এক করে রেখেছে এই সেতু। এপাশ থেকে অন্য পাশটা পুরোপুরি দেখা যায় না। সাগরের মাঝে পিলারগুলো লম্বা লাইনে আস্তে আস্তে একটু বাঁক নিয়ে হারিয়ে গেল নীল সমুদ্রের মাঝে—ও পাড়েতে সর্ব সুখ, আমাদের এই বিশ্বাস দিয়ে।
সাগর পাড়ে এসে সামুদ্রিক কোনো খাবার খাব না, তা কীভাবে হয়। যাওয়ার পথে শারলট টাউনে রেস্টুরেন্টে বসে এবার লবস্টার খাওয়ার পালা। লবস্টার খাওয়ার চেয়ে এটাকে খাবার জন্য ভাঙাটাই সবচেয়ে মজার। প্রতি টেবিলে ছবিসহ ডায়াগ্রাম দেওয়া। ছবি দেখে দেখে অনেক কষ্টে ভেঙে দুই কিলো লবস্টারে খাওয়ায় অংশ পেলাম মাত্র ২০০ গ্রাম।
প্রিন্স অ্যাডওয়ার্ড আইল্যান্ড থেকে নোভাস্কশিয়া যাচ্ছি ফেরিতে করে। ড্রাইভিংয়ে একটু বিশ্রামও হলো আবার ফেরিতে যাওয়ার মজাও পাওয়া গেল। প্রিন্স অ্যাডওয়ার্ড আইল্যান্ডের উড আইল্যান্ড থেকে নোভাস্কশিয়ার কেরিবু ঘণ্টা দেড়েকের যাত্রা। চারতলা ফেরিতে বিশাল গাড়ি পার্ক করার জায়গা, রেস্টুরেন্ট, আইসক্রিম, পারলার সবই আছে। ফেরিতে আইসক্রিমের দোকান পেয়ে নামিরা-নেহানকে আর বাইরে নিয়ে আসা যায় না। অবশেষে আইসক্রিমের আবদার মিটিয়ে ফেরির ডেকে বসার সুযোগ পেলাম। সাগরের নীল জল কেটে সামনে যাচ্ছি আর এক ঝাঁক গাঙচিল আমাদের সঙ্গে উড়ে চলছে দিগন্তের পানে। (চলবে)