অধরা আলোয়

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

অধরার চিরচেনা বাড়িটাকে আজ ভীষণ অচেনা মনে হচ্ছে। পুরোনো দোতলা বাড়িটা আজ অনেক দিন পর নববধূর সাজে সেজেছে। ৩০ বছর আগে মায়ের বিয়ের সময় এভাবেই সেজেছিল এই বাড়িটা। বিশাল উঠানের দুই পাশে দুটি শিউলিগাছ। শরতের ভোরে ঝরে পড়া শিউলির বিছানায় পা ফেলতেও ভীষণ মায়া হতো। কী নরম, কোমল, আবেগি আদুরে স্নিগ্ধতায় ভরে থাকত উঠানটা। মেইন গেটের সামনে বড় একটা মাধবীলতাগাছ। লতায়পাতায় জড়ানো ভালোবাসার আলিঙ্গনে মাধবীলতা ফুলগুলো যেন সর্বদাই প্রেম নিবেদন করে।

দোতলার ঝুল বারান্দা থেকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে অধরা। বাড়ির উঠানটা আজ আর দেখা যাচ্ছে না। বিশাল শামিয়ানায় ঢাকা পড়েছে অধরার শৈশবের স্মৃতিমাখা উঠানটা। শিউলিগাছ দুটো আর মাধবীলতাগাছটাও আয়েশ করে সেজেছে আলোকসজ্জায়। সবারই যেন ভীষণ তাড়া বাড়ির একমাত্র মেয়েটিকে পাত্রস্থ করার। সময়ের বয়সটা কী এতই বেড়ে গিয়েছিল যে...চোখ দুটো কেমন ঝাপসা হয়ে এল অধরার। দ্রুত নিজের রুমে চলে এল।

রুমে এসে দেখে পরিচিত বিছানাটাও বড্ড বেশি অচেনা মনে হচ্ছে। ফুলে ফুলে সাজানো ফুলশয্যা। জীবনের কত স্বপ্ন নিপুণ সুতোয় বুনেছিল অধরা এই বিছানায় শুয়ে শুয়ে। আর আজ? ধীরে ধীরে আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল। পুরোনো এই আয়নাটা অধরার ভীষণ পছন্দ। কেমন যেন একটা মায়া মায় ভাব আয়নাটার মাঝে। যাকে দেখে, তাকেই আপন করে নেয়।

বধূ সাজে অধরাকে আজ তেমনই মায়াবী মনে হচ্ছে। আয়নায় আপন সাজসজ্জায় নিজেকে দেখে ডুকরে কেঁদে উঠল অধরা। সবেমাত্র অনার্স সেকেন্ড ইয়ার আর এখনই সংসার নামক জটিল অঙ্কের হিসাব কষতে বসে গেছে? শৈশবের এই আয়নাটাই তো অধরাকে শিখিয়েছে আকাশছোঁয়া স্বপ্ন দেখতে। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত এক স্বাবলম্বী নারী। অধরা যতবার আয়নার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, এই অপূর্ব দৃশ্য ততবারই দেখেছে। একবুক আকাশছোঁয়া স্বপ্ন বুনে বড় হওয়া অধরা আজ সব স্বপ্নের ইতি টেনে বধূর সাজে সেই আয়নার সামনেই দাঁড়ানো। দুই চোখ ভরা স্বপ্নভঙ্গের দুরাশা। বিয়ের আগে অনেকেই বলে বাড়ির বউটিকে পড়াশোনা করাবে। কিন্তু বিয়ের পর দৃশ্যপট বদলে যায়। যেমনটি বদলে গিয়েছিল অধরার মায়ের জীবনে।

: আসতে পারি?

পেছন থেকে হিমেলের কণ্ঠ শুনে অধরা দ্রুত চোখ মুছে ফেলল। আয়নার দিকে তাকিয়েই অধরা বলল, ‘এখন কি আর অনুমতি নিয়ে রুমে প্রবেশের প্রয়োজন আছে?’

হিমেল মৃদু হেসে বলল, ‘এর আগে কখনো কোনো মেয়ের বেডরুমে ঢুকিনি তো!’

হিমেল রুমে প্রবেশ করে ভেতর থেকে দরজাটা লাগিয়ে দিল।

অধরার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। অচেনা, অজানা একটা মানুষ শুধু একটা কাগজে স্বাক্ষর করেই আজ সব অধিকারের অংশীদার হয়ে গেল! নিজের পুরো জীবনটা আজ অন্য কাউকে সমর্পণ করতে হচ্ছে। কী অদ্ভুত নিয়ম! ইঞ্জিনিয়ার পাত্র পেয়ে বাবা হুট করে বিয়ে ঠিক করে ফেললেন। বাবার কড়া শাসনের ওপর জোর খাটানোর সাধ্য কারও নেই। তবুও অধরা বাবার কাছে হাতজোর করে অনুরোধ করেছিল, অন্তত অনার্স শেষ করে বিয়েটা হোক। কিন্তু সেই নিষ্ফল আবেদনে সাড়া দেননি অধরার বাবা। অধরার স্বপ্ন, লক্ষ্য নিয়ে মাথাব্যথা কোনো কালেই ছিল না তাঁর!

: আচ্ছা তোমাদের বাড়িতে এই অদ্ভুত নিয়ম কে তৈরি করল?

হিমেল অধরার পেছনে এসে দাঁড়াল। আয়নার বধূবেশে মিষ্টি মেয়েটিকে দেখে ভীষণ ভালো লাগলেও অধরার আনত চোখের অন্তরালে গভীর বেদনার ছাপ স্পষ্টত দৃশ্যমান। অধরা নিরুত্তর দাঁড়িয়ে রইল। মানুষটার প্রতি প্রচণ্ড ক্ষোভ মনে। কোনো কথার উত্তর দিতেই মন সায় দিচ্ছে না।

‘কি, আমার ওপর রাগ?’ হিমেল শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল। ‘দেখো তোমার বাবা মানে আমার শ্বশুরমশাই বললেন, কাবিনের পর বরের শ্বশুরবাড়িতে রাতযাপনের রেওয়াজ আছে তোমাদের! তাই আজ থেকেই গেলাম। কি বলো, ভালো করেছি না?’

‘রেওয়াজ না থাকলেও আপনি থাকতেন।’ অধরা মনে মনে বলল।

‘বিয়ের ব্যাপারে আমার পক্ষ থেকে এত তাড়া ছিল না। ভেবেছিলাম তোমার অনামিকায় আমার নামের একখানা আংটি পরিয়ে দুই মাস পর ধুমধাম করে বিয়ের আয়োজন করে তোমাকে একেবারে আমার ঘরে তুলব। কিন্তু মুরব্বিদের কথা, কী আর করা!’

‘দুই মাস পর অন্য কাউকে তাহলে বিয়ে করতেন। আপনার তো আর তাড়া ছিল না!’ গম্ভীর কণ্ঠে অধরা বলে উঠল।

‘তা পারতাম, কিন্তু দুই মাস পরে যদি তুমি হাতছাড়া হয়ে যেতে! এমন অপূর্ব মায়াকাড়া চোখের কাউকে এর আগে আমি দেখিনি। সত্যি বলতে প্রথম দর্শনে তোমার চোখ দুখানা আমাকে বেঁধে ফেলেছে। আমাদের নতুন ফ্ল্যাটের আরও কিছু কাজ বাকি আছে। সে জন্যই দুই মাস প্রতীক্ষা। তারপর তোমার মনের মতো করে তোমার সংসার সাজিয়ে দেব। কী বলো?’

অধরা এবার হিমেলের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। শান্ত স্বরে বলল, ‘আমার মনের মতো করে আপনি কখনো ঘর সাজাতে পারবেন না। আমার কাছে আমার এই নিজের ঘরখানা পছন্দ। ছোটবেলা থেকে এ ঘরে আমি থেকেছি। নিজের হাতে সবকিছু সাজিয়েছি। আমার অন্তরাত্মা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে এ ঘরের প্রতিটি পরতে পরতে। আপনি কী করে বুঝবেন একজন মেয়ের তার প্রিয় চেনা স্থান ছেড়ে যেতে কতখানি কষ্ট হয়?’

অধরার কণ্ঠে একরাশ ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিমেল রুমে ঢুকেই টের পেয়েছে। বিয়ে নিয়ে মেয়েটা খুশি না, সেটা চোখের ভেতরের জোর করে আটকে রাখা টলমলে জল দিব্যি বলে দিচ্ছে।

হিমেল বেশ শান্ত কণ্ঠে অধরাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আমাকে কি বলবে কীভাবে মনের মতো করে তুমি তোমার রুম সাজাতে চাও?’

অধরা নিজের রুম দেখিয়ে বলল, ‘দেখেছেন? ঠিক এভাবে। এই যে আমার বিছানা, পড়ার টেবিল, বুক শেলফ, আলমারি, ড্রেসিং টেবিল এগুলো আমার খুব আপন। আমার সমগ্র সত্তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। আপনি যতই আপনার বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে দামি আসবাব দিয়ে রুম সাজান না কেন, আমার কাছে এই পুরোনো জিনিসগুলোর কদর আজীবন থেকে যাবে। কারণ এ ঘরের প্রতিটি আসবাব আমায় চেনে। আমার স্বপ্ন ওরা জানে। আর এই আয়না...’ কথাটা শেষ করার আগেই একবিন্দু জল টপ করে গড়িয়ে পড়ল অধরার কপোলে।

হিমেল কিছুক্ষণ নির্বাক তাকিয়ে রইল অশ্রুসিক্ত নয়ন যুগলের দিকে। তারপর রুম থেকে বের হয়ে গেল। অধরা বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল হিমেলের প্রস্থানের দিকে। মনে মনে ভাবল, নববিবাহিতা বধূর মনে পিছুটানের আবদারকে প্রশ্রয় না দেওয়াই ভালো। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। সংসারে মন বসবে না, কেবল বাবার বাড়িতে মন পড়ে রইবে। আর সে জন্যই হয়তো হিমেল কথা না বাড়িয়ে এভাবে চলে গেল।

: বাবা আসুন। মা আপনিও আসুন।

হিমেল অধরার মা-বাবাকে সঙ্গে নিয়ে আবারও অধরার রুমে এল। অধরা হতবাক। মনের কিছু কথা বলাতে হিমেল এভাবে বাসরঘরে মা-বাবাকে ডেকে নিয়ে এল! কী ভয়ংকর ছেলে।

: বাবা আমি কিছু কথা বলতে চাই অধরার ব্যাপারে।

অধরার বাবা মিনতির সুরে বললেন, ‘কী বলবে বাবা? অধরা কোনো অন্যায় করেছে? কিছু বলেছে তোমায়?’

অধরার মা কেঁদেই ফেললেন, ‘আমার মেয়ে ছেলে মানুষ! না বুঝে তোমায় কিছু বলে থাকলে ওকে ক্ষমা করে দিয়ো।’

হিমেল গম্ভীর স্বরে বলল, ‘আপনার মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। দুদিন বাদে ও শ্বশুরবাড়ি যাবে কিন্তু ওর মন তো একেবারে এই রুমের ভেতর পড়ে আছে। এমনটা হলে তো অধরার সংসারে মন বসবে না!’

অধরার মা মিনতির সুরে বললেন, ‘বাবা প্রথম প্রথম সব মেয়েরই বাবার বাড়ির জন্য মন অমন করে। পরে সব ঠিক হয়ে যায়। নিজের সংসারে যখন মন বসে যাবে, তখন বাবার বাড়িতে আসার জন্য সময়ই বের করতে পারবে না। এ নিয়ে তুমি ভেব না।’

: কিন্তু এত বছর ধরে আঁকড়ে থাকা স্মৃতি একটা মেয়ে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ভুলে যাবে? এ কথা আমায় বিশ্বাস করতে বলেন?

অধরার বাবা বিরক্তির স্বরে বললেন, ‘বাবা সবেমাত্র বিয়ে হলো তোমাদের। এখনই কি আমার মেয়ে সব ভুলে যাবে? বিয়ে হলো মাত্র কয়েক ঘণ্টা, এখনই এত হিসাবের খাতা খুলে বসলে কেন বাবা? তুমি আসলে কী বলতে চাও। খুলে বলো!’

হিমেল একটু ঝেড়ে কেশে উত্তর দিল, ‘যৌতুক চাই।’

যৌতুক! তুমি না বললে, ‘তুমি যৌতুক প্রথাবিরোধী! বিনা যৌতুকে আমার মেয়েকে বিয়ে করবে। আর এখনই মত পাল্টে ফেললে?’

: জি মত পাল্টেছি, কারণ আপনার মেয়ে বলল আমি ওর মনের মতো করে ঘর সাজাতে পারব না। তাই ভাবলাম অধরার মনের মতো করে ঘর সাজাতে হলে যৌতুক নেওয়াটা জরুরি।

অধরার বাবা বললেন, ‘মেয়ের সুখের জন্য আমি সব করতে রাজি আছি। তুমি বলো কী কী চাই তোমার? আমি সব দেব। আমার একমাত্র মেয়ে।’

হিমেল রুমের চারিদিক তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলল, ‘এ ঘরের সব আসবাব অধরার সব স্বপ্ন, সব ইচ্ছা, অধরার জীবনের লক্ষ্য।’

অধরার মা হতবিহ্বল হয়ে হিমেলকে বললেন, ‘তুমি পুরোনো আসবাব নিয়ে কী করবে বাবা? এগুলো অনেক আগের। এটা অধরার দাদির রুম। অধরা দাদির সঙ্গে এ রুমেই থেকেছে শৈশব থেকে। এত পুরোনো আসবাব কেউ যৌতুক নেয়? আমরা তোমাকে অনেক ভালো মানের শোরুম থেকে দামি আসবাব দেব। আমি অধরার বাবাকে আগেই বলেছি মুখে না বললেও এ যুগেও মেয়ের সঙ্গে আসবাব দিতে হয়। তা না হলে শ্বশুরবাড়িতে মেয়ের কদর থাকে না।’

: কিন্তু মা আমার নতুন না, এই পুরোনো আসবাব চাই!

অধরা হিমেলের এমন আচরণে প্রচণ্ড বিরক্ত হচ্ছে। কী অদ্ভুত মানুষ! বিয়ের আগে যৌতুকের কথা বলেনি আর এখন বাসরঘরে শ্বশুর-শাশুড়ি ডেকে কী লঙ্কাকাণ্ডই না বাঁধিয়েছে। মা-বাবার সামনে অধরা মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারছে না।

অধরার বাবা চিৎকার করে উঠলেন, ‘তুমি কি তামাশা শুরু করছ?’

: জি না, তামাশা করছি না। আমি ভেবে দেখলাম, অধরা আমার সংসারে গেলেও ওর সমস্ত সত্তাজুড়ে বিরাজ করবে শৈশব থেকে বেড়ে ওঠা এ বাড়ির প্রতিটি অংশ, বিশেষ করে ওর নিজের এক টুকরো রুম। এ রুমের আসবাব, বুক শেলফে সারি বেঁধে রাখা বইগুলো। মা-বাবার ভালোবাসা। কিন্তু বিয়ের পর ওকে আমার সঙ্গেই থাকতে হবে। বাবার বাড়িতে মেয়েরা এক সময় অতিথি হয়ে যায়। আমি চাই না অধরা বাবার বাড়িতে বেড়াতে এসে নিজের রুমে আসার পর গোপনে পুরোনো স্মৃতি আঁকড়ে ধরে দীর্ঘশ্বাস ফেলুক।’

অধরা অবাক হয়ে হিমেলের দিকে তাকাল। মানুষটাকে এতক্ষণ ধরে কত-না নিম্ন মন মানসিকতার ভেবেছে! অথচ...।

অধরার মা-বাবা অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। অধরার বাবা হাসতে হাসতে বললেন, ‘তাহলে বাবা তুমি বরং ঘরজামাই থাকো। তাহলে আর মেয়ের মনের কষ্ট নিয়ে তোমাকে দুশ্চিন্তা করতে হবে না! কী বলো?’

: বাবা আমি তো ঘরজামাই থাকতে পারব না। কিন্তু কথা দিচ্ছি অধরা যখনই আপনাদের কাছে আসতে চাইবে তখনই আসতে দেব। আর একটা কথা, অধরার পড়াশোনার ব্যাপারে সব রকমের সহযোগিতা আমি করব। ওর লক্ষ্য পূরণের জন্য আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করব।’

হিমেলের কথা শুনে অধরার চোখ দুটো কৃতজ্ঞতার জলে সিক্ত হলো।

অধরার মা দুই চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘বাবা তোমার মতো জামাই পাওয়া বড় সৌভাগ্যের বিষয়। আমার মেয়ের পড়াশোনা নিয়ে কত স্বপ্ন। খুব মেধাবী। বিয়ের কথা শুনে মনটা ভেঙে গিয়েছিল। বিয়ের পর একটা মেয়ের লক্ষ্যে পৌঁছাতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। স্বামী যদি পাশে থাকে, তাহলে খুব সহজেই প্রত্যাশাগুলো প্রাপ্তির দুয়ারে পৌঁছায়।’

ভারী একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে অধরার মা অধরার বাবার দিকে তাকালেন।

অধরার বাবা লজ্জায় সংকুচিত হয়ে গেলেন। অধরার মাও বিয়ের পর পড়াশোনা করতে চেয়েছিল কিন্তু স্বামীর কড়া নিষেধাজ্ঞার কাছে জলাঞ্জলি দিতে হয়েছিল সব স্বপ্নের। আজ যখন মেয়ে পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে করতে চেয়েছে, তিনি জোরপূর্বক মেয়েকে পাত্রস্থ করেছেন। একবারও মেয়ের মনের সুপ্ত আকাঙ্ক্ষার কথা জানতে চাননি। কিন্তু আজ এ যুগের একটা ছেলে কত সহজে নিজের স্ত্রীর সব স্বপ্ন পূরণের দায়িত্ব নিয়ে নিল। স্ত্রীর ইচ্ছাগুলো পূর্ণ করলে কেউ কখনো ছোট হয় না, হিমেল সেটা বুঝিয়ে দিয়েছে। অধরার বাবা কিছু বললেন না, শুধু হিমেলে আর অধরার মাথায় আশীর্বাদের হাত বুলিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন।

অধরার মা অধরার হাত দুটো ধরে বললেন, ‘আর কোনো ভয় নেই মা, হিমেলের মতো জীবনসঙ্গী পেয়েছিস, তোর বাকি জীবন চলার পথ অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে।’

: বাবা তুমি আমার মেয়েটার পাশে থেকো সব সময়।

: অবশ্যই মা, আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।

অধরার মা চলে যাওয়ার পর অধরা হিমেলের মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। হিমেলের চোখের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলল, আপনি মা-বাবার সামনে যা কিছু বললেন, মন থেকে বলেছেন তো? নাকি আবেগের বসে বলে ফেলেছেন?

হিমেল মুচকি হেসে বলল, ‘তোমার কী মনে হয় আমি শুধু তোমাকে খুশি করার জন্য কথাগুলো বলেছি? ভাবো তো একবার সবার কাছে আমি আজ যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি সেটা যদি আমি ভেঙে ফেলি তাহলে সবাই আমাকে কী ভাববে? সবার কথা বাদ দিলাম, তুমি কী ভাববে? একজন প্রতারক, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী। তাকে কি কখনো শ্রদ্ধা করবে মন থেকে? আমি বাপু অত বোকাটি নই। যার সঙ্গে আজীবন এক ছাদের নিতে কাটাব, তার কাছে অন্তত প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী হতে পারব না!’

: প্রথম প্রথম সবাই এমন বড় বড় কথা বলে। তারপর সব শেষ। আবেগের সঙ্গে বিবেকটাও জলাঞ্জলি দেয়। কজন স্বামী পারে স্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে সহযোদ্ধা হতে?

: কজন পারে সেটা আমি জানি না, তবে আমি পারব অন্তত এটুকু আত্মবিশ্বাস আমার মাঝে আছে। প্রথম যেদিন তোমায় দেখতে আসি, সেদিন তোমার চোখে স্বপ্নভঙ্গের দুরাশা আমি দেখতে পেয়েছিলাম। তুমি যখন ক্ষণিকের জন্য আমাদের সামনে এসে নিজের রুমে চলে গেলে, তখন ওয়াশ রুমে যাওয়ার বাহানায় আমি লুকিয়ে তোমার রুমের জানালার কাছে এসে দাঁড়িয়েছিলাম। তুমি ঠিক এভাবে এই আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে তোমার বইগুলো জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলে। আমাদের মুরুব্বিরা সেদিন আমাদের একান্তে কথা বলার সুযোগটুকু করে দেননি। তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তোমার সঙ্গে কথা বলিনি। কিন্তু তোমার হৃদয়ের গহিনের ক্ষতটুকু উপলব্ধি করতে পেরেছি। সেদিনই আমি মনস্থির করে ফেলেছি যে আমি তোমাকেই বিয়ে করব।

অধরা আহত স্বরে হিমেলকে বলল, ‘আপনি যখন বুঝতেই পারলেন বিয়ে করলে আমার ক্যারিয়ার নষ্ট হবে সে জন্য আমি ওভাবে কেঁদেছি, তাহলে কেন বিয়েতে রাজি হলেন? আপনি রাজি না হলে তো আর আজ বিয়েটা হতো না! আমার পড়াশোনা চালিয়ে যেতাম।’

: আমার সঙ্গে বিয়ে না হলেও তোমার অন্য কারও সঙ্গে বিয়ে হতো। তোমার বাবা তোমাকে বিয়ে দিয়েই ছাড়তেন। আর অন্য কারও সঙ্গে বিয়ে হলে তোমার স্বপ্ন পূরণ না-ও হতে পারত! তাই ভাবলাম আমিই তোমার জীবনে চলার পথের সঙ্গী হই। তুমি যত দূরে যেতে চাও, আমি তোমার পাশে থেকে বন্ধুর মতো সহযোগিতা করব। আমায় তুমি সঙ্গে নেবে তো অধরা? হিমেল অধরার দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিল।

সবকিছুই যেন স্বর্গের মতো মনে হচ্ছে। হিমেলের প্রতিটি কথাই অধরার অন্তরে আশার আলো হয়ে জ্বলছে। যে আলো সব আঁধার নিমেষেই দূর করে দিতে পারে। অধরা পরম মমতায়, ভক্তিভরে হিমেলের হাতে হাত রাখল। হিমেল অধরার হাত ধরে দখিনের খোলা জানালাটার কাছে নিয়ে এল।

: দেখো অধরা রাতের আকাশটা কত সুন্দর! তারায় তারায় যেন ছেয়ে গেছে আকাশের বুকটা। রাতের আঁধারে কেউ কি আকাশের দিকে তাকাত যদি না আকাশে চাঁদ, তারারা একসুরে মিতালি করত। একজন স্ত্রী স্বামীর অর্ধাঙ্গিনী। স্বামীর সফলতা যেমন স্ত্রীর সফলতা, তেমনি একইভাবে স্ত্রীর সফলতাও স্বামীর। একে অপরের পরিপূরক। কেউ কারও প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। তুমি যেদিন তোমার লক্ষ্যে পৌঁছাবে, সেদিন সবচেয়ে বেশি গর্ব হবে আমার। কারণ আমার আকাশ তোমার প্রত্যাশা পূরণের আলোয় ঝলমল করবে। তুমি যেদিন তোমার অধরা আলো স্পর্শ করবে, সেদিনই আমি হব জয়ী।

অধরা হিমেলের হাতটা শক্ত করে ধরে বলল, ‘আমি সত্যিই ভাগ্যবতী আপনার মতো একজন জীবনসঙ্গী পেয়েছি। বিয়ের পর কত মেয়ের জীবনের সব আকাঙ্ক্ষা আঁধারে মিলিয়ে যায়। কিন্তু আপনি ব্যতিক্রম। আমি আমার সবটুকু দিয়ে আপনাকে সুখী করার চেষ্টা করব। আমার ভালোবাসার চাদরে আজন্ম আবৃত করে রাখব আপনাকে।’
...

শাহীন আক্তার স্বাতী: কানাগাওয়া কেন, জাপান।