প্রবাসে পলাশ-শিমুল-শাপলার খোঁজে

সিডনির এক রাস্তার পাশে পলাশ ফুল
সিডনির এক রাস্তার পাশে পলাশ ফুল

বাংলাদেশের হাজার বছরের গ্রামীণ ঐতিহ্যে এমন অনেক আচার প্রচলিত ছিল বা আছে, যেগুলোকে ঠিক ধর্মের বিচারে আলাদা করা যায় না। আমাদের পরিবারে নারী-পুরুষ সবাই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার পাশাপাশি কিছু আচার পালন করত। যেমন ভিটি কুমোরের পূজা। এই পূজা কেন করা হতো বা কার উদ্দেশে করা হতো, সে বিষয়ে কারোই ধারণা ছিল না। তবুও সেটা যথাযথ মর্যাদায় পালন করা হতো। বছরের একটা সময় যত দূর মনে পড়ে, শীতের শুরুতে বাড়ির পেছনে বাঁশবাগানের মধ্যে আমার ফুপু ময়না খাতুন এই পূজা করতেন। ময়না ফুপু ছিলেন আমার দাদির মেজ বোনের মেজ মেয়ে। সেই হিসেবে তিনি আমাদের সম্পর্কে ফুপু ছিলেন।

এই পূজার কিছু নিয়ম ছিল। শুরুতে একটা ছোট জায়গা নির্বাচন করে সেখানকার ঘাস কেটে খোলার মতো বানানো হতো। এরপর সেখানে নদী থেকে নিয়ে আসা পলিমাটি দিয়ে একটা ছোট ঘর বানানো হতো। শুরুতে ঘরের দেয়াল, তারপর সেটা শুকিয়ে শক্ত হয়ে গেলে তার ওপর বাঁশের কঞ্চির ছোট ছোট টুকরা সাজিয়ে সেটাকে আবার কাদা দিয়ে লেপে ছাদ বানানো হতো। ছাদ বানানো হয়ে গেলে সেখানে প্রতিদিন সকালে নিয়ম করে পূজা দেওয়া হতো।

খুব ভোরে আমরা ঘুম থেকে উঠে চোখ মুছতে মুছতে বাঁশবাগানে হাজির হয়ে যেতাম। সেখানে আগে থেকেই ময়না ফুপু হাজির থাকতেন। কাঁসার একটা গোল বাটিতে চাল ভিজিয়ে রাখা হতো। অনেক সময় সেই চালের মধ্যে গুড়ের কোলা (গুড় সংরক্ষণ করার জন্য মাটির কলসির চেয়ে বড় এবং লম্বাটে মাটির পাত্র) থেকে সামান্য গুড় মিশিয়ে দেওয়া হতো। ফলে সেটা খেতে আমাদের কাছে অমৃতের মতো লাগত। পূজার সরঞ্জাম আগের দিনই আমরা জোগাড় করে রাখতাম। পায়ে হেঁটে নদীর চরে গিয়ে কই-উকরা (সবুজ একধরনের লতানো উদ্ভিদ, যেটা বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর নতুন মাটি পড়া জায়গায় জন্মায়) এবং কাঁঠালচাঁপা ফুল আনা হতো। আর পূজার দিন সকালেই বাড়ির শিমুলগাছের তলা থেকে কুড়িয়ে আনা হতো সদ্য গাছ থেকে পড়া শিমুল ফুল।

শিমুল ফুল আনার পর শুরু হতো পূজার আসল প্রক্রিয়া। আগে থেকেই বাড়ি থেকে এনে রাখা হতো কেরোসিনের কুপি বাতি। ম্যাচের কাঠি দিয়ে সেটা জ্বালিয়ে তার শিখার ওপরে ধরা হতো শিমুল ফুলের পাপড়ি। এতে করে শিমুল ফুলের পাপড়ির গায়ে কুপি বাতির কালি জমে চোখের কাজলের মতো একটা স্তর জমা হতো। এরপর সেই পাপড়িকে ঠান্ডা করে সেখানে আঙুলের মাথা ছুঁয়ে সেটা দিয়ে মাটির ঘরটার মেঝে ও আশপাশের জায়গায় ফোটা দিয়ে সাজানো হতো। সাজানো হয়ে গেলে ময়না ফুপু বিভিন্ন মন্ত্র পড়তেন বেশ কিছুক্ষণ ধরে আর অন্য উদ্ভিদগুলো মাটির ঘরটার মধ্যে রাখতেন। পূজা শেষ হয়ে গেলে সবার হাতের তালুতে একটু করে ভেজানো চাল দিতেন। আমরা সেটা চেটে খেতে খেতে বাড়ি ফিরে আসতাম।

যত দূর মনে পড়ে, পালাক্রমে আমরা একেকজন একেক দিন চাল ভেজানো নিয়ে যেতাম। এভাবেই শিমুল ফুলের সঙ্গে শৈশবে আমাদের প্রথম পরিচয়। অবশ্য কুষ্টিয়ার আঞ্চলিক ভাষায় আমরা শিমুল ফুলকে বলি মাদার ফুল আর পলাশ ফুলকে বলি পালতিমাদার ফুল। এখানে একটা ব্যাপার উল্লেখ করতে চাইছি। গ্রামের মানুষদের নামকরণের ক্ষেত্রে প্রকৃতির প্রভাব ছিল প্রকট। আমার দাদির এক চাচাতো ভাইয়ের নাম ছিল মাদার প্রামাণিক।

সিডনির মিল স্ট্রিম হ্রদে শাপলা ফুল
সিডনির মিল স্ট্রিম হ্রদে শাপলা ফুল

এরপর থেকে শৈশবের আরও অনেক বিনোদনের উপকরণ ছিল শিমুল ফুল। শিমুলগাছের তলা থেকে আমরা কুড়িয়ে আনতাম শিমুল ফুল। এরপর সেগুলো থেকে পুংকেশরগুলোকে আলাদা করে শুরু হতো আমাদের খেলা। দুজন দুজন করে দলে ভাগ হয়ে আমরা খেলতাম। একজন একটা পুংকেশর ধরে রাখত আর অন্যজন তার হাতে ধরা পুংকেশর দিয়ে অন্যটার সঙ্গে লাগিয়ে দিতাম হ্যাঁচকা টান। হ্যাঁচকা টানে যার পুংকেশরের মাথাটা আলাদা হয়ে যেত, সে হেরে যেত। আর যে টান দিয়েছে, তার পুংকেশরের মাথা আলাদা হয়ে যেত, তাহলে সে হেরে যেত। যে হেরে যাবে, সে আবার পুংকেশরটা ধরে রাখবে আর যে জিতে যাবে, সে দেবে টান। এভাবেই চলত আমাদের খেলা।

এ ছাড়া শিমুলের তুলা নিয়ে আমরা মজার খেলা খেলতাম। শিমুল তুলা পরিপক্ব হয়ে গেলে সেগুলো সূর্যের তাপে সশব্দে ফেটে গিয়ে তুলাগুলো বাতাসে উড়তে থাকত। সেগুলো যখনই নিচে চলে আসত, সেটাকে আমরা আবার ফুঁ দিয়ে ওপরে উঠিয়ে দিতাম। এভাবে কারটা কত দুর উড়ে যায় সেটা নিয়ে চলত আমাদের প্রতিযোগিতা। তখনো জানতাম না, শরৎকালের নীল আকাশে ভেসে বেড়ানো সাদা মেঘের ভেলাগুলোকে পেঁজা তুলার সঙ্গে তুলনা করা হয়। কুষ্টিয়ার শহরতলি বাড়াদীতে আমাদের বাড়ির পেছনেই ছিল একটা শিমুলগাছ। সেটার নিচেই চলত আমাদের এসব খেলাধুলা। গাছটা ছিল কম বয়সী। তাই তেমন তুলা হতো না। যেটুকু তুলা হতো, সেগুলো পরিপক্ব হয়ে সূর্যের তাপে ফেটে যাওয়ার আগেই মা লম্বা বাঁশের মাথায় একটা আংটা বেঁধে তুলার ফলগুলো পেড়ে সেগুলোকে পুরোনো মশারির মধ্যে রেখে রোদে শুকাতে দিতেন। যাতে করে তুলার ফলগুলো ফেটে গেলেও যেন সেগুলো বাতাসে উড়ে না যায়। আমি শক্ত বালিশ ছাড়া ঘুমোতে পারতাম না। তাই আমি যখন বুয়েটে পড়ার জন্য হলে থাকা শুরু করলাম, তখন মা শিমুলগাছটার একবারের সব তুলা দিয়ে একটা ঢাউস আকারের বালিশ বানিয়ে দিয়েছিলেন, যেটা এখনো আছে।

ঢাকায় আসার পর মনে মনে শিমুল ফুল খুঁজে বেড়াতাম। হঠাৎই একদিন খুঁজে পেলাম পলাশ ফুল। আমি, রুমমেট ফরহাদ, তৌহিদ, ড. এম এ রশিদ হলে আমাদের ফ্লোরের কবি তারিক, আমরা কজন মাঝেমধ্যেই ছুটির রাতে বেরিয়ে পড়তাম ঢাকা শহরের রাস্তায় হাঁটতে। এভাবে হাঁটতে গিয়েই চারুকলার গাছ থেকে আম পেড়ে আনতাম কখনো, আবার কখনো ঘুমিয়ে পড়তাম রাস্তার পাশের ফুটপাতে।

একদিন আমরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বেদিতে শুয়ে পড়লাম। শুয়ে শুয়ে আকাশে তারাদের মিটিমিটি আলোর খেলা দেখছিলাম। হঠাৎই রুমমেট ফরহাদ বলে উঠল, ইয়াকুব ভাই পাইছি। আমি জিজ্ঞেস করলাম কী পেয়েছ। উত্তরে ফরহাদ আঙুল দিয়ে ওপরের দিকে দেখিয়ে দিল। ওর আঙুল অনুসরণ করে আমরা বাকি তিনজন তাকিয়ে দেখি, শহীদ মিনারের বেদিকে ঘিরে রয়েছে এক সারি পলাশ ফুলের গাছ। আর সেই সব গাছে থোকায় থোকায় ফুটে রয়েছে হাজার হাজার পলাশ ফুল। আমি সঙ্গে সঙ্গে একটা গাছে উঠে গেলাম। এরপর পেড়ে নিয়ে এলাম একগাদা পলাশ ফুল। সেই ফুলগুলো আমাদের রিডিং টেবিলের শোভা বর্ধন করেছিল বেশ কদিন ধরে।

এরপর অবশ্য আমরা চারুকলার মেইন গেটের পাশেও আবিষ্কার করলাম একটা পলাশ ফুলের গাছ। কর্মজীবনে এলজিইডির মেইন গেটের পাশে দেখেছিলাম একটা পলাশ ফুলের গাছ। পাসপোর্ট অফিস ও এলজিইডির বিভাজন দেয়াল বরাবর ছিল সেই গাছটা। বসন্তকালে পলাশের রঙে রাঙিয়ে যায় সেখানকার এক টুকরো আকাশ। আমরা অফিসে ঢোকার মুখে গাছের তলা থেকে কুড়িয়ে আনতাম পলাশ ফুলগুলো।

ছোটবেলায় আমাদের বাড়ির আশপাশের পুকুর থেকে গোসলের সময় আমরা সাদা শাপলা তুলে সেটা দিয়ে মালা বানিয়ে গলায় পরে ঘুরে বেড়াতাম। আমাদের এই ফুল তোলা দেখে বড়রা ভয় দেখানোর জন্য বলতেন, শাপলা ফুলের লতার সঙ্গে নাকি সাপ প্যাঁচানো থাকে। কিন্তু আমরা সে কথা শুনেও পিছপা হতাম না। শাপলা ফুলের অনেক গুণ। শাপলা ফুলের ডাঁটা আর ছোট মাছ দিয়ে চচ্চড়ি করলে খেতে দারুণ একটা তরকারি হয়ে যায়। এ ছাড়া শাপলা ফুলের গোড়াটাকে তুলে এনে রোদে শুকিয়ে ঠিক ওলের মতো করে রান্না করা যায়। আমরা মাঝেমধ্যে ডুব দিয়ে গোড়াটাও তুলে আনতাম। আর শাপলা ফুল পরিপক্ব হলে তাকে আমরা বলতাম ঢ্যাপর। এই ঢ্যাপর গোসল করতে গিয়ে আমরা মাঝেমধ্যেই তুলে খেয়ে ফেলতাম। আমাদের গোসলের সময় ছিল প্রায় দিনব্যাপী। গোসল করতে করতে খিদে পেলেই ঢ্যাপর দিয়ে আমাদের ক্ষুধা নিবারণ হতো। অপরিপক্ব ঢ্যাপর দেখতে হতো টকটকে লাল বর্ণের।

প্লাস্টিকের তৈরি কৃত্রিম শিমুল ফুল
প্লাস্টিকের তৈরি কৃত্রিম শিমুল ফুল

এটা নিয়েও একটা কথা প্রচলিত আছে। সেটা হচ্ছে কাঁচা ঢ্যাপর খেলে গলা দিয়ে রক্ত উঠে নাকি মানুষ মারা যায়। তবে আমরা প্রায়ই ঢ্যাপর তুলে আনলে মায়েরা সেগুলো রোদে শুকিয়ে তার দানাগুলো বালির মধ্যে দিয়ে চুলায় ভাজতেন। এতে করে ছোট ছোট আকারের অনেক সুন্দর খই তৈরি হয়ে যেত। এরপর সেটাকে বয়ামে ভরে সংরক্ষণ করা হতো। আমরা সারা বছর সেই খই বাটিতে নিয়ে খেতাম।

অস্ট্রেলিয়ার প্রবাসজীবনেও মনে মনে খুঁজে ফিরতাম পলাশ, শিমুল ও শাপলা ফুলকে। ঋতু বদলের নিয়মে এখানেও আসে বসন্ত। তখন প্রকৃতিতে অনেক রকমের ফুল ফোটে। কিন্তু আমার চোখ খুঁজে ফিরত বাংলাদেশের বসন্তকালের ফুলগুলোকে। এভাবেই খুঁজতে খুঁজতে একদিন পেয়েও গেলাম। আমার বর্তমান কর্মস্থলের খুব কাছেই রাস্তার দুই পাশে একটা ছোট বন আছে। সেই বনের পাশেই আছে একটা হ্রদ, যার নাম মিল স্ট্রিম, আর তার পাশে পাতা আছে দুটি বেঞ্চ। আমি দুপুরের খাবারের বিরতিতে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে সেখানে মাঝেমধ্যে বসি। এভাবেই একদিন আবিষ্কার করলাম হ্রদের পানিতে ফুটে আছে হাজার হাজার হলুদ শাপলা ফুল। বাংলাদেশের জাতীয় ফুল সাদা শাপলা। এই হলুদ শাপলা ফুলগুলো দেখে কুষ্টিয়াতে আমাদের ছোটবেলার স্মৃতি মনে পড়ে গেল। বেশ কিছুটা সময় সেখানে বসে থাকলাম। এ ছাড়া প্রায় প্রতিদিনই দুপুরের খাবারের বিরতিতে ওখানে বসে থাকতাম, যত দিন ফুলগুলো জীবিত ছিল।

আরেক দিন হঠাৎ রাস্তার অন্য পাশে নজর গেলে দেখি সেখানে ফুটে আছে থোকায় থোকায় পলাশ ফুল। আমি রাস্তা পার হয়ে সেগুলোর কাছাকাছি গেলাম। সব মিলিয়ে গোটা পাঁচেক পলাশ ফুলের গাছ পাশাপাশি লাগানো। তার মধ্যে একেবারে রাস্তার পাশেরটার একটা ডাল আবার মাটির সঙ্গে লেগে আছে। সেটার শাখাতেই ফুটে আছে আগুনরঙা পলাশ ফুল। এরপর থেকেই প্রায়ই দিনই সেখানে গিয়ে বসে থাকতাম। তবে এই পলাশ ফুলগুলোর আকার ঠিক বাংলাদেশের পলাশ ফুলের মতো অতটা বড় নয়। তবুও পলাশের মতো একটা কিছু খুঁজে পেয়েছি, এটা ভেবেই আনন্দ হচ্ছিল। পটাপট বেশ কিছু ছবি তুলে নিলাম। একদিন সেখান থেকে একটা ডাল ভেঙে বাসায় নিয়ে গিয়ে আমার মেয়ে তাহিয়াকে দেখলামও। সে দেখেই চিৎকার করে উঠল, পলাশ ফুল বলে। তাহিয়া একটা গ্লাসে পানি ভরে সেটা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল।

এরপর থেকেই মনে মনে খুঁজে ফিরছিলাম শিমুল ফুল। কিন্তু কোথাও তার সন্ধান পাচ্ছিলাম না। সেই সুযোগটা হঠাৎই চলে এল। আশফাক ভাই আর দিশা ভাবিকে আমরা মানি আমাদের আপন বড় ভাই আর ভাবি হিসেবে। তাঁদের সূত্রেই অমিত ভাই আর অ্যাপোলো ভাবির সঙ্গে পরিচয়। অমিত ভাই আর অ্যাপোলো ভাবি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আশফাক ভাইয়ের ইয়ারমেট ছিলেন। তাই তাঁরা অনেক ভালো বন্ধু। আর যেহেতু আমরা আশফাক ভাইদের ভালো বন্ধু, আমরাও তাঁদের বন্ধু হয়ে গেলাম। সিডনিতে এবারের রোজার ঈদ পালিত হয়েছে সপ্তাহের মাঝামাঝি বুধবার। কর্মদিবস হওয়াতে সেদিন নামাজ ছাড়া আর কোনো কিছু উদযাপন করা সম্ভব হয়নি। তাই ঈদের উৎসব পালন শুরু হয়েছে পরের শনিবার থেকে। অ্যাপোলো ভাবি আর অমিত ভাই, আশফাক ভাই, দিসা ভাবি, মিথুন ভাই, নিলা ভাবিকে দাওয়াত দেওয়ার পাশাপাশি আমাদেরও দাওয়াত দিলেন।

সেদিন আবার চলছিল ক্রিকেট বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ও ইংল্যান্ডের মধ্যে খেলা। আমরা তাঁদের বাসায় গিয়েই খেলা দেখা শুরু করে দিলাম। খেলা দেখার এক ফাঁকে অ্যাপোলো ভাবি এসে জানিয়ে গেলেন খাবার গরম করা হয়েছে। আমরা নাকেমুখে দুটো খেয়ে নিয়ে আবার খেলা দেখতে বসে গেলাম। বাংলাদেশ টসে জিতে বোলিং নিয়েছে। কার্ডিফের আবহাওয়া থেকে শুরু করে পিচ কোনো কিছুই বাংলাদের দলে অনুকূলে যাচ্ছে না। ফার্স্ট বোলাররা গায়ের জোরে বল করেও কোনো বাউন্স পাচ্ছেন না। শুধু মাশরাফির বলই একটু লাফিয়ে উঠছে। আর কাটার মোস্তাফিজের ইয়র্কার বলগুলো ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যানদের সাময়িকভাবে ঠেকিয়ে রাখলেও রানের অঙ্ক হু হু করে বেড়ে যাচ্ছিল। স্পিনারদের মধ্যে সাকিব আর মিরাজ নিয়ন্ত্রিত বল করে যাচ্ছিল। এভাবে একসময় ইংল্যান্ডের রানের চাকা ৩৮৬–তে এসে থামে।

খেলা দেখতে দেখতে অনেক রাত হয়ে যাচ্ছিল। তাই ইংল্যান্ডের ইনিংসের শেষে আমাদের উঠে পড়তে হলো। কারণ আমাদের বাসায় ফিরতে হবে ঘণ্টাখানেক ড্রাইভ করে। ফেরার সময় হঠাৎ তাঁদের ডাইনিং টেবিলের দিকে আঙুল দেখিয়ে তাহিয়া বলল, বাবা মোমবাতি। ইদানীং সে সুগন্ধি মোমবাতি খুব পছন্দ করা শুরু করেছে। মাদারস ডেতে সে তার মাকেও একটা সুগন্ধি মোমবাতি কিনে দিয়েছে। আমি ওর আঙুল অনুসরণ করে তাকিয়ে আশ্চর্য হয়ে গেলাম। মোমবাতিগুলোর সামনে তিনটি শিমুল ফুল। তার মধ্যে দুটি ফুটে আছে আর একটি কুঁড়ি। দূর থেকে দেখে আমার কাছে একেবারে সত্যিকারের শিমুল ফুল বলে ভ্রম হচ্ছিল। ফুলগুলো দেখে মনের মধ্যে এক অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করছিল। আমি টেবিলের কাছে গিয়ে ফুলগুলো ধরে দেখলাম। আমার দেখাদেখি আমার গিন্নি আর তাহিয়াও ধরে দেখল। আমাদের উচ্ছ্বাস দেখে পাশে বসে থাকা একজন নারী ফুলগুলোর নাম জানতে চাইলে আমি বললাম, এগুলো শিমুল ফুল। লোকলজ্জার ভয় না করে পটাপট কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম।

মানুষ যত বড় হতে থাকে, ততই তার জীবন থেকে প্রাকৃতিক ও বিনে পয়সার আনন্দ উপকরণগুলো হারিয়ে যেতে থাকে। ধীরে ধীরে সেখানে স্থান করে নেয় কৃত্রিমতা ও যান্ত্রিকতা। আর তখনই মানুষ সুখে থেকেও একঘেয়েমি ও বিষণ্নতার মতো রোগে ভোগা শুরু করে। এগুলো থেকে মুক্তির একটাই পথ—প্রকৃতির মধ্যে আনন্দের উপকরণ খুঁজে নেওয়া, বিশেষ করে শিশুরা যদি শৈশবে প্রকৃতির সুনিবিড় সংস্পর্শে বেড়ে ওঠে, তাহলে আর তাকে ভবিষ্যতে কোনো প্রকার একঘেয়েমিতে পেয়ে বসার সুযোগ খুবই কম থাকে। আপনি তখন পৃথিবীর যে দেশেই যান না কেন, সেখানে আপনার মতো করে আনন্দ উপকরণ খুঁজে নিতে পারবেন। আর ক্ষণিকের জন্য হলেও হারিয়ে যাবেন নিজের ফেলে আসা রংধনু রঙের বর্ণিল শৈশবে।