মন্ট্রিয়েলে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মিলনমেলা

প্রস্তুতি সভা
প্রস্তুতি সভা

একটি অনুষ্ঠানকে ঘিরে কানাডাপ্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ–উদ্দীপনা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে ১৯৮২ ও ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ থেকে মন্ট্রিয়েলে আগত প্রবাসীদের মধ্যেই এই উৎসাহটা বেশি। কারণ, তাঁরাই আয়োজন করছেন এই অনুষ্ঠানের। ‘ফিরে দেখা ৮২-৮৩’ নামে আয়োজন করা এই অনুষ্ঠানটি মূলত একটি পুনর্মিলনী উৎসব। এটি অনুষ্ঠিত হবে আগামী ১৩ ও ১৪ সেপ্টেম্বর (শুক্র ও শনিবার) মন্ট্রিয়েলের পাঁচ তারকা হোটেল ম্যারিয়টে।

অনেক জল্পনাকল্পনা আর মতবিনিময় সভার পর মন্ট্রিয়েলের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, সাবেক ফোবানা কনভেনর শামীমুল হাসানকে সমন্বয়কের (কনভেনর) দায়িত্ব দিয়ে সম্প্রতি উৎসবের তারিখ ও স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। দুই দিনব্যাপী এই আনন্দমেলার কর্মসূচিতে রয়েছে ১৩ সেপ্টেম্বর শুক্রবার সপরিবারে হোটেল লবি ও হলরুমে জম্পেশ আড্ডা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ক্রেস্ট বিতরণ, স্যুভেনির প্রকাশনা পর্ব ও নৈশভোজ। ১৪ সেপ্টেম্বর সম্মিলিত প্রাতরাশ, সাইট-সিয়িং, মধ্যাহ্নভোজ, প্রীতিসম্মেলন, নৈশভোজ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

আয়োজকেরা জানান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে উত্তর আমেরিকা ছাড়াও বাংলাদেশ ও ভারতের নামকরা শিল্পীরা অংশ নেবেন। পুনর্মিলনী উৎসবকে স্মরণীয় করে রাখতে একটি মানসম্মত স্যুভেনিরও প্রকাশ করা হচ্ছে।

উৎসবকে সর্বাত্মক সফল করে তোলার জন্য ইতিমধ্যেই কানাডার বিভিন্ন শহরে বেশ কয়েকটি মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম সভাটি গত ৭ এপ্রিল মন্ট্রিয়েলের ক্যাফে রয়্যাল রেস্টুরেন্টে অনুষ্ঠিত হলেও এর আগে ছোট পরিসরে বেশ কয়েকটি পরিকল্পনা সভা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতা মাসুম রহমানের মহারানি রেস্টুরেন্টে। ৭ এপ্রিলের সভাটি অনুষ্ঠিত হয় সাংবাদিক রুমু ইসলামের সভাপতিত্বে। পরে টরন্টোর সভা ছাড়া অন্য সভাগুলোতে সভাপতিত্ব করেন সমন্বয়ক শামীমুল হাসান।

প্রস্তুতি সভা
প্রস্তুতি সভা

পর্যায়ক্রমে ২১ এপ্রিল কিংসটন শহরের মানতানাস রেস্টুরেন্টে, গত/////// ২০ মে মন্ট্রিয়েলের ক্যাফে রয়্যাল রেস্টুরেন্টে ও ৮ জুন টরন্টোর ঘরোয়া ক্ল্যাসিক রেস্টুরেন্টে অনুষ্ঠিত হয় সভা। ৮ জুনের টরন্টোর সভায় সভাপতিত্ব করেন কমিউনিটি নেতা আলম মোড়ল। উৎসবে সবার উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, এ লক্ষ্যে ৮ জুনের আগেও টরন্টোপ্রবাসীরা নিজেদের মধ্যে আরেকটি সভা করেন। সবার সঙ্গে যোগাযোগ আরও ঘনিষ্ঠ করার লক্ষ্যে মন্ট্রিয়েলে বসবাসরত ’৮২-’৮৩ সালের প্রবাসীরা এক ইফতার পার্টিও করেন। একই লক্ষ্যে আগামীকাল রোববার (১৬ জুন) ক্যাফে রয়্যাল রেস্টুরেন্টে তাঁদের আয়োজনেই অনুষ্ঠিত হবে ঈদ পুনর্মিলনী ও মতবিনিময় সভা।

মন্ট্রিয়েল, কিংসটন ও টরন্টোর সভাগুলোতে আলোচনায় অংশ নেন শামীমুল হাসান, রুমু ইসলাম, মাসুম রহমান, ফয়সল আহমেদ চৌধুরী, আলিমুর রহমান হায়দরী, মোমিনুল হক, সৈয়দ নাজমুল হক মনা, ফৌজিয়া হোসেন, মনির মাসুদ বাদল, আলম মোড়ল, আল মামুন, আবদুল্লাহহিল বাকি, দীপক ধর অপু, মোমিনুল হক, মাসুম আহমদ, প্রদীপ সরকার দোলন, আবদুর রশীদ খান, বিজন সাহা, আলী ইমাম সিজার, আলী হোসেন খান, এজাজ আক্তার তৌফিক, আমজাদ হোসেন, কাজী শহীদ, শংকর বণিক, নজরুল ইসলাম পিরু, কামরুল ইসলাম, সমীর আহমেদ, রাশেদ চৌধুরী, আবদুল খালিক, খুকু চৌধুরী, রেজাউল করিম তালুকদার, রনি প্রেন্টিস রয়, মোহাম্মদ চৌধুরী নাজমুল, সাধন সরকার, মোহাম্মদ নাসিম শাহজাদা, এম আর জাহাঙ্গীর, অশোক সাহা, মইনুল ইসলাম খান নিরু, মাহবুব হোসাইন মুন্না, মাহবুবুর রহমান চৌধুরী, সবুর শিকদার, শমসের আলী হেলাল, আশরাফ হাসান প্রমুখ।

বিভিন্ন প্রস্তুতি সভায় অংশগ্রহণকারী
বিভিন্ন প্রস্তুতি সভায় অংশগ্রহণকারী

এদিকে আসন্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে ১৯৮২-১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ থেকে মন্ট্রিয়েলে প্রথম আসা এবং পরে কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে স্থায়ীভাবে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে দল-মত, জাতি-ধর্ম ও অঞ্চলনির্বিশেষে যেমন দেখা দিয়েছে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ, তেমনি পরিলক্ষিত হচ্ছে অনন্য ঐকমত্য। প্রায় চার দশক আগে মাতৃভূমি ছেড়ে আসা বন্ধুদের সঙ্গে আবার মিলিত হওয়া, গল্প, পুরোনো স্মৃতি রোমন্থনের আশায় ওই দিনটির জন্য দিন গুনছেন এখন তাঁরা।

প্রায় ৪০ বছর আগে মন্ট্রিয়েল বিমানবন্দরে পা ফেলার সময়টার সেই যুবকদের অনেকেই আজ ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিয়ে দাদা কিংবা নানা হয়েছেন। বলা বাহুল্য, পরিবেশ, আবহাওয়া ও ভাষাসহ নানা রকম ভিন্ন সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদের সমন্বয় করে প্রবাস জীবনে থিতু হতে তাঁদের বেশ বেগ পেতে হয়েছে।

স্বাধীনতার আগে ও পরে বাংলাদেশ থেকে কানাডায় আসার হার বিবেচনা করলে দেখা যাবে একসঙ্গে সবচেয়ে বেশি লোক এসেছেন আশির দশকের শুরুতে ১৯৮২ ও ১৯৮৩ সালে। এর আগে কানাডায় বাঙালির সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। প্রচণ্ড ঠান্ডা আর তুষার, ফরাসি (ফ্রেঞ্চ) ভাষা, ইমিগ্রেশন জটিলতা, বাঙালি খাবারের দুষ্প্রাপ্যতা, কাজ পাওয়ার অনিশ্চয়তা, অন্যদিকে দেশে রেখে আসা পরিবার–পরিজনের মায়া—সবকিছু মিলিয়ে এক কঠিন সময় পার করতে হয়েছে প্রবাসের এই প্রথম প্রজন্মকে।

বিভিন্ন প্রস্তুতি সভায় অংশগ্রহণকারী
বিভিন্ন প্রস্তুতি সভায় অংশগ্রহণকারী

প্রতিকূলতার যুদ্ধ জয় করে এখন তাঁদের অনেকেই এখানে ব্যবসা–বাণিজ্য ও নানা পেশায় প্রতিষ্ঠিতই শুধু নয় কোনো কোনো ক্ষেত্রে পথিকৃৎ। ছেলেমেয়েরাও পড়াশোনা করে মূলধারার কর্মকাণ্ডে অবদান রাখছেন। আবার তাঁদের সেই বন্ধুমহলের মাঝে কয়েকজন পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন পরপারে। একই শহরে বাস করেও কাজ আর সাংসারিক ব্যস্ততায় হয়তো দেখা হয় না, খোঁজখবর নেওয়ার সুযোগ হয় না বন্ধুটির বহু বছর। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নস্টালজিয়া তাড়িত এই মানুষগুলো এখন একসঙ্গে বসে একে অপরের জীবনের গল্প শেয়ার করার তীব্র তাগিদ অনুভব করছেন, এমনটিই বললেন, বর্তমানে টরন্টোতে বসবাসকারী লেখক রেজাউল করিম তালুকদার।

একটি জাঁকজমকপূর্ণ সফল অনুষ্ঠান করার লক্ষ্যে কানাডার বিভিন্ন শহরে তোড়জোড় চলছে। ’৮২-’৮৩ সালের এই প্রবাসীরা কে কোথায় আছেন, খুঁজে বের করতে পরস্পরের মধ্যে চলছে আলাপ–আলোচনা, টেলিফোন। খোলা হয়েছে একটি ওয়েবসাইট। ফেসবুকেও আপডেট দেওয়া হচ্ছে নিয়মিত। আগামী ১ আগস্টের মধ্যে সংশ্লিষ্টদের রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করার জন্যও বলা হয়েছে।

পুনর্মিলনী উৎসবের অন্যতম উদ্যোক্তা ব্যবসায়ী মাসুম রহমান বলেন, বহুদিন ধরেই এ রকম একটি গেট-টুগেদার করার ইচ্ছে হচ্ছিল। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে আমরা একত্র হতে পারছিলাম না। এবার সবাই বিষয়টাকে খুব গুরুত্ব দিয়ে নিয়েছি। ব্যস্ত প্রবাস জীবনের চরম একঘেয়েমি থেকে একটু স্বস্তির আবেশ ছড়াবে এ পুনর্মিলনী, এটি দৃঢ়ভাবেই বিশ্বাস করি। তিনি জানান, সবার একই কথা, একটি স্মরণীয় সমাবেশ আয়োজন করার ব্যাপারে যা যা দরকার কেউ এতটুকু কার্পণ্য করব না।

বিভিন্ন প্রস্তুতি সভায় অংশগ্রহণকারী
বিভিন্ন প্রস্তুতি সভায় অংশগ্রহণকারী

উৎসবটি সফল ও অংশগ্রহণমূলক করার ব্যাপারে সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাওয়া মন্ট্রিয়েলের আরেক কমিউনিটি নেতা ফয়সল আহমেদ চৌধুরী জানান, উদ্যোগটি আলোর মুখ দেখার পর এত স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া পাওয়া গেছে যে এখন পুরোনো বন্ধুদের মধ্যে আবার এক হৃদয়ের বন্ধন তৈরির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের আশা, সেই সব বন্ধুদের নিয়ে আমরা আবার আশির দশকের যুবকবেলায় ফিরে যাব। তিনি বলেন, কাউন্ট ডাউন শুরু। এখন শুধু আমাদের স্বপ্নের উৎসবটির মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় আমরা সবাই।

ফিরে দেখা ৮২-৮৩ উৎসবের সমন্বয়ক শামীমুল হাসান দল ও মতাদর্শের ঊর্ধ্বে উঠে সবাই সহযোগিতার হাত বাড়াবেন এ প্রত্যাশা করে বলেন, কানাডায় এই মিলনমেলাকে কেন্দ্র করে প্রবাসীদের মধ্যে সৌভ্রাতৃত্বের যে শুভসূচনা হবে, তা কমিউনিটির জন্য একটি অভূতপূর্ব উদাহরণ হয়েই শুধু থাকবে না, এই চেতনাটি ধরে রাখতে পারলে এর কল্যাণকর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী।

উল্লেখ্য, প্রধানত মন্ট্রিয়েলই ছিল কানাডায় বাংলাদেশিদের প্রথম পদার্পণের স্থান। এখানে থেকে ইমিগ্রেশনের পর্ব শেষ করে বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়েন অনেকেই। যদিও কানাডায় ইংরেজি ও ফরাসি দুটি সরকারি ভাষা, তবু কুইবেক প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত মন্ট্রিয়েলে ফরাসির দাপটই বেশি। ফলে ভাষাগত দখল সামলাতে ও কর্মসংস্থানের আশায় বহু লোক চলে যান অন্য প্রদেশে। এখন বেশির ভাগ বাংলাদেশির বাস টরন্টোতে হলেও যেহেতু তাঁরা মন্ট্রিয়েল থেকে প্রথম কানাডার প্রবাস জীবন শুরু করেছিলেন, সে জন্য সেই স্মৃতির শহর মন্ট্রিয়েলে আবার একত্র হওয়ার ইচ্ছে পোষণ করেছেন। ফলে মন্ট্রিয়েলেই হচ্ছে পুনর্মিলনীর এই মহা উৎসবের আনন্দ মেলা।