পূর্ব দিগন্তের হাতছানি-দুই

পাহাড় যেখানে সমুদ্রের সঙ্গে মিশে যায়
পাহাড় যেখানে সমুদ্রের সঙ্গে মিশে যায়

নোভাস্কোশিয়া কানাডার আটলান্টিক উপকূলবর্তী চারটি প্রদেশের মধ্যে অন্যতম। পূর্ব উপকূলবর্তী সবচেয়ে সুন্দর প্রদেশ। এখানকার এত গল্প, এত সৌন্দর্য, এত রোমাঞ্চ, বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। পাহাড় আমার কাছে সব সময় অনেক ভালোবাসার জায়গা। পাহাড়ের প্রতি পদে পদে নতুন সৌন্দর্য আর সে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে যখন সমুদ্র থাকে, তখন তার রূপ সবকিছুকেই হার মানায়।

আকাশের সব লাল রং যেন সমুদ্রের বুকে ডানা মেলে আছে
আকাশের সব লাল রং যেন সমুদ্রের বুকে ডানা মেলে আছে

ফেরি থেকে নেমে আমাদের গন্তব্য কেপ ব্রেটন আইল্যান্ড। যার সৌন্দর্য কখনো কাউকে নিরাশ করবে না। সন্ধ্যা নাগাদ আমরা আমাদের থাকার জায়গা ইনভারনেস বিচ ভিলেজে পৌঁছলাম। ভিলেজে ঢুকতেই দেখি আকাশের সব লাল রং যেন সমুদ্রের বুকে ডানা মেলে আছে। তাড়াতাড়ি করে কোনোভাবে রাস্তার পাশে গাড়ি রেখে আমরা সবাই সূর্যাস্ত দেখতে নামলাম। নীল সমুদ্রের বুকে লাল টকটকে সূর্যটাকে হারিয়ে যেতে দেখার দৃশ্য নিঃসন্দেহে ভাগ্যের ব্যাপার। ১-২ মিনিটের মধ্যে পুরো সূর্যটাই সাগরের ঢেউয়ের সঙ্গে মিলিয়ে গেল।

স্কাইলাইন ট্রেইল
স্কাইলাইন ট্রেইল

সমুদ্রের কোলঘেঁষা ইনভারনেসের এক–দুই রুমের কটেজগুলো স্বপ্নের থেকেও কোনো অংশে কম নয়। রাতের নিস্তব্ধতায় ঘরে থেকেই সমুদ্রের গর্জন শোনা যায়। জোয়ার আসার পর মনে হচ্ছিল সমুদ্রের সকল ঢেউ যেন আমাদের কটেজেই আছড়ে পড়ছে। ভিলেজের দোকান থেকে কাঠ নিয়ে এসে ক্যাম্প ফায়ারের ব্যবস্থা হয়ে গেল। পুরো টিম গোল হয়ে আগুনের পাশে বসে চলছে জম্পেশ আড্ডা আর সঙ্গে প্রিন্স অ্যাডওয়ার্ড আইল্যান্ড থেকে আনা আলু পোড়া।

কেপ ব্রেটনের প্রধান আকর্ষণ হলো কেবট ট্রেইল (পাহাড় যেখানে সমুদ্রের সঙ্গে মিশে যায়)। প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই পথের প্রায় অংশই সমুদ্রের তীর ঘেঁষে। একদিকে আটলান্টিকের বিশাল জলরাশি আর অন্যদিকে সবুজ পর্বতমালা। সবকিছুকে বুকে জড়িয়ে ধরে নীল আকাশ। কেবট ট্রেইলের এই পথটা দুভাবেই ঘোরা যায়। Clockwise ও Anti-clockwise. একই জায়গা কিন্তু দুভাবেই ঘুরলে মনে হবে দুরকম সৌন্দর্য।

কেবট ট্রেইল
কেবট ট্রেইল

খুব সকালে আমরা বের হয়ে গেলাম কেবট ট্রেইলের উদ্দেশে। একটু পর এমন হলো যে, ১০ মিনিট সামনে যাই আর ১৫ মিনিট থামতে হয়। এত সুন্দর সবকিছু, গাড়ি থেকে নামলে আর কেউ উঠতে চায় না। রাস্তার প্রতিটা বাঁক যেন মনে হয় শিল্পীর নিজ হাতে আঁকা। মাঝে মাঝে বড় বড় পাথরের চাঁইগুলোতে বিশাল বিশাল ঢেউ আছড়ে পড়ছে। আবার কোথাও সুন্দরভাবে ঢেউগুলো সৈকতে এসে মিশে যাচ্ছে। তখন সবাই একসঙ্গে নেমে পানিতে লাফালাফি শুরু করে দিই।

ট্রেইলের মাঝে কিছু জায়গায় তিমি দেখার ব্যবস্থা আছে। বিভিন্ন কোম্পানির ভাড়া করা নৌকায় তীর থেকে গভীর সমুদ্রে নিয়ে যায় তিমি দেখার জন্য। অনেক সাহস নিয়ে প্রস্তুত হলাম যাওয়ার জন্য। কিন্তু প্রকৃতির ওপর আর কার হাত থাকে। প্রচণ্ড বাতাস আর উত্তাল সমুদ্রের কারণে ওই দিন সকল নৌকাযাত্রা বাতিল। মন খারাপ হলেও আবার ভাবলাম যাক ট্রেইলটা ৩-৪ ঘণ্টা আরও বেশি ঘোরা যাবে।

কেবট ট্রেইল
কেবট ট্রেইল

পুরো ট্রেইলের মাঝে হাইকিংয়ের অনেকগুলো রাস্তা আছে। তার মাঝে স্কাইলাইন ট্রেইলটিকে বলা হয় ‘the most scenic hike on one of Canada’s most scenic driving routes’। পাহাড়ের গা ঘেঁষে আঁকাবাঁকা, উঁচু নিচু রাস্তায় নিচের গাড়িগুলো দেখতে পুরো খেলনা গাড়ির মতো মনে হয়। প্রায় সাত কিলোমিটার দীর্ঘ এ হাঁটা পথে ঘুরতে ৪-৫ ঘণ্টা সময় লাগল। ট্রেইলের একেবারে শেষ প্রান্তে সুন্দর কাঠের বাধানো সিঁড়িগুলো দিয়ে সমুদ্রের আরও কাছে চলে গেলাম। সিঁড়িতে বসে দুই পাশের শ্বাসরুদ্ধকর দৃশ্য দেখে সব ক্লান্তি এক মুহূর্তেই চলে গেল। একপাশে ফ্রেঞ্চ মাউন্টেন আর একপাশে দিগন্ত জোড়া নীল আকাশ। ঝকঝকে রোদে নীল সাগরের চারপাশে এক স্বপ্নিল অনুভূতি নিয়ে বসে রইলাম।

হাঁটার ট্রেইল থেকে বের হয়ে আবার আমরা গাড়িতে। মোটামুটি কেবট ট্রেইলের অর্ধেক পৌঁছাতেই সন্ধ্যা হয়ে গেল। নোভাস্কশিয়ার সবচেয়ে উত্তরের স্থান হচ্ছে Meat Cove। একে তো গভীর অন্ধকারে ভয়ংকর পাহাড়ি এবড়োখেবড়ো রাস্তা। সেখানে আবার মেরামতের কাজ চলছে। তাই খুবই সাবধানে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছি আমরা। অন্ধকারে রাস্তা ভুল করে আমরা একেবারে শেষ মাথায় চলে গেলাম। হঠাৎ দেখি পাশের বাড়ি থেকে ৩-৪টা অ্যালসেশিয়ান কুকুর ঘেউ ঘেউ করে তেড়ে আসছিল। আর মনে হচ্ছিল কেউ হয়তো এখনই একটা শটগান নিয়ে বের হবে।

কেবট ট্রেইল
কেবট ট্রেইল

প্রথম দিন যেখানে ঝকঝকে রৌদ্র সেখানে দ্বিতীয় দিনে সাগরে গভীর কালো মেঘ আর পাহাড়ে ঘন কুয়াশা। একটু পরপরই মনে হচ্ছে মেঘমালা আমাদের গাড়ির জানালা দিয়ে ঢুকে আবার বের হয়ে যায়। নিজেদের আসলেই ভাগ্যবান মনে হচ্ছে একই জায়গার দুই দিনে সম্পূর্ণ দুই রকম সৌন্দর্য দেখার সুযোগ পেলাম। মাঝ সাগরে বৃষ্টি হচ্ছে, বাতাসে তার আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। গাছের পাতাগুলো ঘন কুয়াশায় ঢেকে আছে। আকাশ দেখে মনে হচ্ছিল যেকোনো মুহূর্তে বৃষ্টি নামবে। কিন্তু বৃষ্টির দেখা নেই। আর হঠাৎ হঠাৎই দমকা হাওয়ায় মনে হচ্ছিল সবকিছু উড়িয়ে নিয়ে যাবে। মাঝে মাঝে দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে দূর সমুদ্রের ওপর কালো মেঘ দেখে গা হিম হয়ে যাচ্ছিল। কেবট ট্রেইলের এক পাশ যেমন অনেক সাজানো, শান্ত, অপর পাশটা মনে হলো অনেক বন্য। কিছু কিছু জায়গায় রাস্তা এতটাই ঢালু হয়ে গেছে, মনে হচ্ছে সামনে শুধু আটলান্টিক তার প্রশস্ত বুক বাড়িয়ে দিয়ে রেখেছে। সোজা নিচে গেলেই তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়া ছাড়া আর উপায় নেই।

পেগিস কোভ
পেগিস কোভ

এর মাঝে লেকিস হেড, ইঙ্গোনিশ বিচ হয়ে আমরা হ্যালিফ্যাক্সে রওনা হলাম। হ্যালিফ্যাক্সে যখন পৌঁছলাম তখন ঘড়ির কাঁটা রাত একটা ছুঁই ছুঁই। মাঝে নিউ গ্লাসগোতে ফার্মাসিস্ট স্বপ্না আপু ও হ্যালিফ্যাক্সে সাকি আপুর বাসায় দুবার নৈশভোজ করে আমাদের এয়ার বিএনবির বাসায় এলাম। ছোট্ট সাজানো সাগর পাড়ের শহর হ্যালিফ্যাক্স। হ্যালিফ্যাক্সের বিখ্যাত Peggy’s Cove–এ প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা বড় বড় পাথরের গায়ে আছড়ে পড়ছে আটলান্টিক মহাসাগরের বিশাল ঢেউ আর সাগর পারেই স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে চমৎকার বাতিঘর।

পেগিস কোভ
পেগিস কোভ

বিকেলে আমরা হ্যালিফ্যাক্স হারবার ও ডাউন টাউন ঘুরে বেড়ালাম। হারবারে ঠান্ডা বাতাসে বসে জাহাজের আসা যাওয়া দেখে আমার ফেরার কথা মনে পরে গেল। ভ্রমণের শেষটা সব সময়ই মিশ্র রকমের অনুভূতি। একদিকে যেমন মন খারাপ লাগে চলে যাচ্ছি, অন্যদিকে থাকে বাড়ি ফেরার তাড়না। এত সব স্মৃতি নিয়ে এখন শুধুই ফেরার পালা।

ফাঁকা রাস্তায় বাড়ির পথে আমদের গাড়ি ছুটে চলছে সাগর পাহাড় নদী সবকিছুকেই পেছনে ফেলে। রেখে যাচ্ছি একসঙ্গে কাটানো সুন্দর মুহূর্তগুলো। নিয়ে যাচ্ছি কিছু স্মৃতি আর ফিরে আশার একরাশ আকাঙ্ক্ষা। (শেষ)

আগের অংশ পড়তে ক্লিক করুন: https://www.prothomalo.com/durporobash/article/1598943