বাবা ও আমি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আমার বাবা ছিলেন দাদাজানের বড় সন্তান। ছিলেন রাশভারী গুরুগম্ভীর। কিন্তু জীবনে পোড় খাওয়া একজন অতি সাধারণ মানুষ। অনেক কষ্ট, অধ্যবসায় আর সাধনা করে তিনি তাঁর জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছিলেন। তাই তিনি চাইতেন ছেলেমেয়েগুলোও যেন কষ্টসহিষ্ণু হয়। পরিশ্রম করে, লেখাপড়া শিখে নিজের চেষ্টায় বড় হয়। বাবা অনেক গল্প-কবিতার বই পড়তেন। ভালো কবিতা আবৃত্তিও করতে পারতেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা আওড়াতেন বাবা। বেশ বড় একটা বইয়ের আলমিরা ছিল আমাদের বাড়িতে।

বাবা সব সময় আমাদের বলতেন, ‘ভালো করে পড়ালেখা করো তোমরা। মানুষ হও। আমার আর কিছু চাওয়ার নেই তোমাদের কাছে। তোমাদের যা লাগবে, তা আমি তোমাদের সবই দেব। কিন্তু ভালো করে তোমরা লেখাপড়া শেখো। শুধু রেজাল্ট নয়, তোমরা পড়ুয়া হও। সুশিক্ষায় শিক্ষিত হও।’

ছোটবেলায় কেন জানি আমার মনে হতো, বাবার ভীষণ রাগী। আসলে সেটা রাগ ঠিক নয়, কড়া শাসনের নমুনা। সবকিছুই বাবার নিয়মে হতে হবে। কোনো টুঁ শব্দ করা যাবে না।

আমার মাকে দেখছি বাবার সব কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন। আমার বড় চার ভাইবোন। বড়দের দেখতাম বাবার সব হুকুম তামিল করেন যথানিয়মে। মনে হতো, বড়ই বোকা আমার অগ্রজেরা। বাবার সব কথা সুবোধ বালকের মতো শোনেন। বোন দুজন ছিলেন অসহায়। বাড়ির বাইরে বের হওয়ার জো ছিল না তাঁদের। স্কুল আর বাড়ি। কদাচিৎ মায়ের সঙ্গে কোথাও ঘুরতে যাওয়া।

বাবার শাসনের ভয়ে কিছুই আমাদের করার উপায় ছিল না। আমাদের চলাফেরার স্বাধীনতা ছিল না। বাবার মুখের ওপর কোনো কথা বলার বা কোনো বিষয়ে বাবার অনুমতি নেওয়ার সাহসও আমাদের হতো না। আবদার কিছু থাকলে তা মায়ের মাধ্যমে করা হতো।

আমি পাঁচ নম্বর সন্তান। আমার ছোট আরও তিনজন ছিল। আমি ছিলাম অতি দুরন্ত এক ডানপিটে। সেই ছোট্টবেলা থেকেই। আমি বাবার সব কথাই শুনতাম। কিন্তু কিছুই তার পালন করতাম না। এক কান দিয়ে শুনতাম আর অন্য কান দিয়ে বের করে দিতাম। এর ফলে প্রায় প্রতিদিনই আমার পিঠে উত্তম-মধ্যম পড়ত।

সকাল থেকেই আমি উসখুস করতাম স্কুলে যাওয়ার জন্য। একবার স্কুলের পথে বের হতে পারলেই হলো। ব্যস আর আমাকে কে পায়! স্কুলে পৌঁছানোর আগেই পথে সহপাঠীদের সঙ্গে এক হাত হয়ে যেত। তারপর টিফিন পিরিয়ডে আরও এক রাউন্ড। আর ছুটির পর তো কথাই নেই।

প্রতিদিন আমার নামে বাবার কাছে অভিযোগ আসত। সন্ধ্যার পর বাবা আমার কাছে কৈফিয়ত তলব করতেন। মারও দিতেন। আমি কাঁদতে কাঁদতে নিজেকে নির্দোষ বলে সবকিছুর জবাব দিতাম। আর কখনোই করব না বলে অঙ্গীকারও করতাম। কিন্তু কে কার কথা রাখে!

পরের দিনই খোঁজ নিতাম কে আমার নামে বাবার কাছে নালিশ করেছে। এত বড় স্পর্ধা। এই বলে এক হাত নিতাম স্কুলে গিয়ে।

কিশোরবেলায় স্কুল ছুটির দিনগুলোতে আমি বনে-বাদারে ঘুরে বেড়াতাম। গুলতি দিয়ে পাখি মারতে যেতাম। পাখির ছানা দেখার জন্য হন্যে হয়ে পাখির বাসায় হানা দিতাম। মগডালে উঠে ডাঁশা ডাঁশা পেয়ারা পারতাম। হাফ প্যান্টের দুই পকেট ভরে রাখতাম আর খেতাম।

বাড়ি ফিরতাম শান্ত বালকের মতো। বাবা টের পেতেন না কিছুই। ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় গাছ থেকে পড়ে একবার আমার হাত ভেঙে গিয়েছিল। সে এক জটিল ফ্র্যাকচার হয়েছিল। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে নেওয়ার সময় বাবা হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেছিলেন। বাবার মনটা যে কত নরম ছিল সেদিনই প্রথম বুঝতে পেরেছিলাম।

সারা দিন যা খুশি করি না কেন, বাবার নির্দেশ ছিল সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফিরতে হবে। মাগরিবের আজানের পর আর বাড়ির বাইরে থাকা যাবে না। আমার একদিন ফিরতে একটু দেরি হওয়ায় বাড়িতে আমাকে ঢুকতে দেওয়া হলো না। বাড়ির বাইরে আমাকে মধ্যরাত পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। পরে মা দরজা খুলে আমাকে ভেতরে ঢুকতে দিয়েছিলেন।

বাবার প্রচণ্ড শাসনের জন্যই আমরা সব ভাইবোন লেখাপড়ায় মোটামুটি ভালোই ছিলাম। বলতে গেলে বাবার জন্যই আমি ক্লাস ফাইভ ও এইটে বৃত্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পেরেছিলাম।

বাবা বলতেন, যতটুকু পাঠ করবে তার দ্বিগুণ লিখবে। ভালো করে লিখতে পারলেই সেটা মনে গাঁথা থাকবে। বাবা আমাদের হঠাৎ করে একটা টপিক দিয়ে বলতেন, ‘এক হাজার শব্দের মধ্যে কিছু লিখে দেখাও।’ আমরা লিখতে বসে যেতাম। পরে বাবা সেগুলো পড়ে দেখতেন। যার লেখা ভালো হতো, সে বাবার উপহার পেত।

স্বাধীনতার পর আমাদের বাড়িতে দু-দুটি পত্রিকা রাখা হতো—‘দৈনিক বাংলা’ আর ‘বাংলাদেশ অবজারভার’। ইয়ং অবজারভার বিভাগে কদাচিৎ আমার লেখা ছাপা হলে বাবা অনেক খুশি হতেন।

ছোটবেলায় আমি বাবার খুব একটা কাছে ঘেঁষতাম না। কিন্তু স্কুল কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে আমি বাবার বেশ কাছে চলে আসি। বাবার সঙ্গে আমার দূরত্ব কমে আসে। ১৯৭৮ সালে বাবা সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন। সে সময় আমার ছোট দুজনও পরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। অবসরপ্রাপ্ত বাবা আমাদের লেখাপড়া নিয়ে খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েন।

বড় চার ভাইবোনই তখন চাকরি করেন। তাঁদেরই আর্থিক সহযোগিতায় আমাদের ছোট তিনজনের পড়ালেখা চলতে থাকে। এরপর আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া শেষ হয়। বিয়েশাদি করি।

ঢাকায় চাকরি ও নিজের পরিবার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও বাবার সঙ্গে তখন আমার এক ধরনের সখ্য গড়ে ওঠে। ছোটবেলায় আমরা সবাই মা-ঘেঁষা ছিলাম।

এতকাল পরে অনেকটা পথ পেরিয়ে বড় হয়ে বন্ধু বেশে যেন বাবার সান্নিধ্যে এলাম।

আমার বাবা অনেক গল্পপ্রিয় মানুষ ছিলেন। ঈদের ছুটিতে তাই বাড়ি গেলে আমি বাবার সঙ্গে অনেক গল্প করতাম। চাকরি জীবনের অনেক ঘটনা বাবার সঙ্গে শেয়ার করতাম। বিছানায় বাবাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে শুয়ে খোশগল্প করতাম। ফেরার সময় বাবা ও মা দুজনের মনটা খারাপ হয়ে যেত। মা ও বাবার হাতে কিছু টাকা দিতাম। বাবা নিতে চাইতেন না।

বলতেন, ‘আমার পেনশনের টাকা তো আছে বাবা।’

আমি তবুও জোর করে পকেট মানি হিসেবে রাখতে বলতাম। বাবা তখন মনে মনে খুশিই হতেন।

বার্ধক্যজনিত কারণে ধীরে ধীরে বাবা অসুস্থ হতে লাগলেন। বাবার হাই ব্লাডপ্রেশার ছিল। ১৯৯৫ সালের এক সন্ধ্যায় হঠাৎ একদিন কুষ্টিয়ায় আমাদের নিজ বাড়িতে বাবার মাইল্ড স্ট্রোক হলো। আমি ঢাকা থেকে ছুটে গেলাম বাবাকে দেখতে।

কয়েক দিন পর একটু ভালো হলে সুচিকিৎসার জন্য বাবাকে ঢাকায় আনা হলো আমার কাছে।

এত যত্ন করে রাখার পরও বছর না ঘুরতেই আবারও বাবার স্ট্রোক করল। ম্যাসিভ সেকেন্ড স্ট্রোক। এবার কথাবার্তা বন্ধ হয়ে গেল, ডান পাশ প্যারালাইজড হলো। বাবা অসাড় ডান হাত ও ডান পা নিয়ে বিছানাগত হয়ে পড়লেন।

ডাক্তারের চিকিৎসা ও আমাদের অনেক সেবা শুশ্রূষাও বাবাকে আর সুস্থ করতে পারল না। ১৯৯৮ সালের জানুয়ারি মাসের ১১ তারিখ এবং ১১ রমজানে ঢাকার শমরিতা হাসপাতালে আমারই সামনে বাবা শেষনিশ্বাস ত্যাগ করলেন। সময়টা ছিল আমার জন্য ভীষণ কঠিন।

বাবার মৃত্যুদিনে তখন ঢাকায় প্রচণ্ড শীত পড়ছিল। সেই সঙ্গে দেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল হাড় কাঁপানো শৈত্যপ্রবাহ। ওই দিন ঢাকা শহর যেন সাদা কুয়াশার চাদরে মোড়ানো ছিল।

বাবার শেষ ইচ্ছানুযায়ী মরদেহ খুব ভোরে কুষ্টিয়ায় নেওয়ার পথে আরিচা ঘাটে ফেরিতে ওঠানো হলো। কিন্তু ঘন কুয়াশার জন্য ফেরি ছাড়তে পারছিল না। ঘণ্টাখানেক অপেক্ষার পর বেলা হলে কুয়াশা একটু কেটে গেলে পদ্মা পাড়ি দিতে ফেরি ছাড়ল। বাবার কফিনটাও ফেরির সঙ্গে সঙ্গে কুয়াশার বুক ভেদ করে পদ্মা অতিক্রম করতে লাগল।

কোনো একদিন বাবার মুখে শোনা কবি জীবনানন্দ দাশের আবার আসিব ফিরে কবিতার একটি চরণ মুহূর্তে কানে বেজে উঠল, ‘কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়।’

চোখ দুটি আমার আরও একবার অশ্রুসজল হলো।

মনে হলো আমার বাবা সত্যিই তো কুয়াশার বুকে ভেসে ভেসে ফিরে যাচ্ছেন তাঁরই প্রিয় জন্মভূমিতে, কুষ্টিয়ার কাঁঠালছায়ায়।

এরপর ২০০০ সালে আমিও একদিন প্রবাসে পাড়ি জমালাম ছোট্ট দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে। ছেলেটি এখন অনেক বড় হয়েছে। সে এখন ইউনিভার্সিটি অব ওয়াটারলুতে পড়ে।

ওর হাবভাব একদমই আমার বাবার মতো। আমার বাবার মতো করে খায়, হাঁটে, চলাফেরা করে। সবকিছু। কেমন করে মানুষে মানুষে এমন মিল হয় আমি অবাক হয়ে দেখি।

আমি ছেলেকে তাই বাবা বাবা বলেই ডাকি।

এই দূর দেশে একান্ত নিভৃতে এখনো আমার বাবার গায়ের সেই পরিচিত কেমন একটা গন্ধ যেন আমার ছেলের গায়ে পাই। আমার বাবাকে আমার ছেলের মধ্যেই দেখতে পাই।

তবুও কোনো মধ্যরাতে দুঃস্বপ্নের স্মৃতিতে মানসপটে ভেসে ওঠে মৃত্যুপথযাত্রী আমার বাবার সেই মলিন মুখ ও চিরবিদায়ের সেই সন্ধিক্ষণ। তখন মনে খুবই কষ্ট লাগে। প্রাণটা ডুকরে কেঁদে ওঠে। বাকি রাতটুকুতে আর ঘুম ধরে না চোখে।

কী যেন এক অস্ফুট অব্যক্ত ব্যথায় মনটা বাবা বাবা বলে খুঁজে ফেরে।
...

রানা টাইগেরিনা: ইমেইল: <[email protected]>