প্রবাসী ছেলের সঙ্গে বাবার শেষ দেখা

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

সারা বিশ্বে বিভিন্ন তারিখে বাবা দিবস পালিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশসহ কিছু দেশে গতকাল বাবা দিবস পালিত হয়েছে। প্রতিবছর অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম রোববার হলো বাবা দিবস। আমার বড় মেয়ে আমাকে প্রতিবছর বাবা দিবসে কার্ড ও বিভিন্ন উপহার দেয়, যা এ দেশের সংস্কৃতি।

বাবাকে ভালোবাসার জন্য আসলে কোনো বিশেষ দিনের প্রয়োজন হয় না। ৩৬৫ দিনই মা ও বাবা দিবস। আজ প্রায় দুই বছর চার মাস হলো, বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন না–ফেরার দেশে।

প্রবাসজীবন মানেই অনেকটা নির্বাসনের মতো। প্রবাস মানে বাবা-মা, পরিবার, আত্মীয়স্বজন ছেড়ে হাজার হাজার মাইল দূরে থাকা। প্রবাস মানে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ ঘণ্টা বা তারও বেশি কাজ করে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরে আবার বই–খাতা নিয়ে পড়তে বসা বা অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করা। প্রবাস মানে বাবা-মা, ভাইবোনের আদর–স্নেহ ও আত্মীয়স্বজনের সুখ–দুঃখের অংশীদার হতে না পারা।

এখানে মা-বাবা, পরিবার–পরিজনের কথা মনে পড়ে প্রতিটি মুহূর্তে। সব সময় বুকের মধ্যে আলাদা একটা ভয় থাকে, কখন কোন দুঃসংবাদ আসে। প্রবাসের এই কর্মব্যস্ততার কারণে আমরা অনেকে অনেক সময় মা-বাবার সঙ্গে ফোনে নিয়মিত কথা বলতে পারি না। বাবা-মায়ের অভাব আর স্মৃতি নিয়ে লিখে কখনো শেষ করা যাবে না। বাবা-মায়ের প্রতি মায়া মমতা আদর স্নেহের অভাব যে কত বড়, তা প্রবাসী ছাড়া অন্য কেউ ভালো বুঝবেন না।

বড় আপার মাধ্যমে দেশ থেকে প্রথম খবর পাই, বাবা খুব জ্বর এবং আরও কিছু সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছেন। ডাক্তার কিছু ব্লাড পরীক্ষা করতে দিয়েছেন। বিকেলে ডাক্তার বাবার রিপোর্ট দেখে আপাকে ফোন করে বলেন জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতাল যাওয়ার জন্য। ডাক্তার বাবাকে ঢাকায় এক নামকরা বেসরকারি হাসপাতালে রেফার করেন। অ্যাম্বুলেন্সে সেখানে যাওয়ার পর বাবাকে সঙ্গে সঙ্গে আইসিইউতে ভর্তি করা হয়।

বাবার শারীরিক অবস্থার প্রতি মুহূর্তে অবনতি হতে থাকে। দ্বিতীয় দিন পর্যন্ত কথা বলতে পারলেও ধীরে ধীরে কথা বলা ছাড়াও অন্য সব কার্যক্রম অবনতির দিকে যেতে থাকে। এই অবস্থায় আপা বাবাকে বলেন, ‘আপনার বড় ছেলেকে (মানে আমি) কি আসতে বলব?’ বাবা তখন বলেছিলেন, ও কি আসতে পারবে? যদি আসতে পারে, তাহলে আসতে বলো। কারণ, বাবা জানেন, তিনি অসুস্থ হওয়ার আগে প্রায় ১০ মাসের মধ্যে আমরা অস্ট্রেলিয়া থেকে সপরিবার তিনবার দেশে গিয়েছিলাম। তিনি জানতেন, সপরিবার দেশে যাওয়া অনেক ব্যয়বহুল। তাই তিনি হয়তোবা ভাবছিলেন, আমরা হয়তোবা যাব না বা যেতে পারব না।

৯ মার্চ মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে টিকিট কেটে সপরিবার রওনা দিই দেশের পথে। প্রতিবার যখন দেশে যাই, তা অনেক আনন্দের হয়ে থাকে। কিন্তু এবার কেমন যেন মনের মধ্যে হাহাকার ও সময় যেন আর শেষ হতে চায় না। ২২ ঘণ্টার পথ মনে হচ্ছিল যোজন যোজন দূরের। কিছুতেই যেন শেষ হতে চাচ্ছিল না। প্লেনে বসে মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করছিলাম ও দোয়া পড়ছিলাম, যেন দেশে গিয়ে বাবাকে আগের মতো সুস্থ দেখতে পাই। সবকিছু স্বাভাবিক থাকে। বাবা যেন আমাদের মাঝে আবার ফিরে আসেন।

রাত ১২টা ২০ মিনিটে আমরা বাংলাদেশে পৌঁছাই। বিমানবন্দরে নেমে সরাসরি চলে যাই হাসপাতালে। আইসিইউর নিয়ম অনুযায়ী রোগীর সঙ্গে ২৪ ঘণ্টায় শুধু একজন দেখা করতে পারেন। তাই রাতে আর দেখা হলো না। আইসিইউর দরজার কাছে বসে সারা রাত পার করে দিলাম। আর চিন্তা করলাম কত দূর থেকে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে এসে এত কাছে, অথচ বাবার সঙ্গে একটু কথা বলা, দেখা করা বা স্পর্শ করতে পারছি না। দেয়ালের এ পাশে আমরা আর বাবা অন্য পাশে। এত কাছে থেকেও কত দূরে।

পরদিন সকাল নয়টায় ডাক্তার রোগীর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানানোর জন্য আমাদের ডেকে পাঠিয়েছেন। আমরা তাঁর কাছে যাওয়ার পর তিনি আমাদের বললেন, রোগীর বর্তমান অবস্থা খুব একটা ভালো না। একজন মানুষের সাধারণত বেঁচে থাকার যেসব কার্যক্রম চলার কথা, তা কখনো স্বাভাবিক কাজ করছে, কখনো করছে না। এখন আল্লাহকে ডাকা ছাড়া আর কোনো কিছু করার নেই। কারণ, বাবার শরীরের সব কার্যক্রম খুব দ্রুত বন্ধ হয়ে আসছে। ডাক্তারের কাছ থেকে এই কথা আমরা শুনব, তা ধারণা করিনি। তারপর অপেক্ষা করতে থাকলাম কখন বিকেল হবে এবং বাবাকে একপলক দেখতে পারব।

আগেই বলেছি, হাসপাতালের নিয়ম অনুসারে প্রতিদিন শুধু একজনই রোগী দেখার সুযোগ পান। যখন দেখা করার জন্য অনুমতি পেলাম, তখন আমি নামাজের জন্য মসজিদে অবস্থানের কারণে সবাই আমার স্ত্রীকে দেখা করতে পাঠান। তাঁরা ভেবেছিলেন, পরে ডিউটি ডাক্তারের অনুমতি নিয়ে আমাকে দেখা করার জন্য আইসিইউতে পাঠাবেন। আমার স্ত্রী গিয়ে দেখা করার পর ডিউটি ডাক্তারকে শত অনুরোধ করা সত্ত্বেও আমি অনুমতি পেলাম না।

ডিউটি ডাক্তারকে বললাম, কত দূর পথ পাড়ি দিয়ে এসেও জীবিত থাকতে বাবাকে শেষবার একটু দেখতে পারব না, এটা কেমন নিয়ম! একটা মানুষ দুনিয়া থেকে চিরতরে চলে যাচ্ছে, শেষ সময়ে তাঁর ছেলের সঙ্গে বাবা বা ছেলে বাবাকে দেখতে পারবে না এটা কেমন মানবিকতা, এটা তো অমানবিক। অনেকভাবে বুঝিয়ে বলেও কোনো অনুমতি পেলাম না।

পরে বাবার শারীরিক অবস্থা দেখতে হাসপাতালের দুজন সায়েন্টিস্ট (হসপিটাল–প্রধান ও শাখাপ্রধান) আসেন। তাঁরা ডাক্তার হওয়ার কারণে সরাসরি আইসিইউতে গিয়ে বাবাকে দেখে আসেন। তাঁরাও ডিউটি ডাক্তারকে অনুরোধ করেন। নানাভাবে বুঝিয়ে, মানবিকতার কথা বলেও ডিউটি ডাক্তারের কাছ থেকে আমার আইসিইউতে যাওয়ার অনুমতি নিতে পারেননি। সর্বশেষ সন্ধ্যা সাতটার পর বাবার প্রতিষ্ঠানের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হাসপাতালের মালিককে ফোন করে আমাকে দেখা করানোর অনুমতি নেন।

অনেক অনেক চেষ্টা আর অপেক্ষার পর সন্ধ্যা সাতটার পর আমি ঢুকতে পারি আইসিইউ রুমে। পুরো কক্ষ খুব শান্ত। শুধু বিভিন্ন যন্ত্রপাতির শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। সেখানে বেশ কিছু বেডের রোগীদের মধ্যে একটা বেডে বাবা শুয়ে আছেন। সারা শরীরজুড়ে বিভিন্ন চিকিৎসার যন্ত্রপাতির তার ও পাইপে জড়ানো।

আমি যখন বাবার কাছে গেলাম, বাবাকে ডাকলাম, বাবা দেখো আমি এসেছি অনেক অনেক দূর থেকে তোমাকে শুধু একবার দেখতে। কথা বলো বাবা, চক্ষু খোলো বাবা, অভিমান করো না, কথা বলো বাবা। বাবা আর আগের মতো করে কথা বলেননি। কখন আসলি, কীভাবে আসলি, পথে কোনো কষ্ট হয় নাই তো, যা প্রতিবার বলত। বাবার শরীর পুরো শুষ্ক, নিথর ও ঠান্ডা। বাবার শরীর জড়িয়ে ধরে বাবার দাড়ি মুখে চুমু খেয়ে সারা শরীরে হাত বুলিয়ে ডাকলাম, ওঠো বাবা ওঠো, চোখ খোলো। সারা জীবন আমার সঙ্গে কত কথা বলেছ, আজ শেষ সময় কিছু বলে যাও বাবা, বলে যাও, কিছু বলে যাও। আমরা প্রয়োজনে–অপ্রয়োজনে অনেক সময় কত কথা বলি। বাবা আর কখনো কোনো কথা বলতে পারেননি। আল্লাহ কথা বলার সেই শক্তি বাবাকে আর দেননি।

আইসিইউতে বাবার বেডের কাছে থাকাকালে দেখতে পাই, বাবার দুই চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। আমি পানি মুছে দিলাম, আবার চোখ ভিজে যাচ্ছে পানিতে। বাবা তাঁর প্রিয় সন্তান অন্তরের আত্মা নিজের কলিজার টুকরোকে এত কাছে পেয়েছেন, অথচ কিছু বলতে পারছেন না। রক্তের সন্তানের সঙ্গে এত কাছে থেকেও মুখে কথা বলতে না পারলেও হয়তোবা চোখের পানিতে নিজের কষ্টের অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ করেছেন। বাবা ছেলের কথাবিহীন চোখের পানির বিদায়বেলার শেষ মিলনের সেই দুঃখের অনুভূতি আসলে লিখে বোঝানো সম্ভব নয়।

পরদিন বাবা আমাদের ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে যান না–ফেরার দেশে। আমরা যারা দেশের বাইরে থাকি, এ রকম প্রিয়জনকে শেষ বিদায়ে দেখতে না পাওয়ার কষ্ট নিয়ে থাকতে হয় সারা জীবন। বাবা দিবসে ভালো থাকুক পৃথিবীর সকল বাবা, এপারে কিংবা ওপারে।