বাবাকে কিছু বলার ছিল

মা-বাবার সঙ্গে লেখিকা
মা-বাবার সঙ্গে লেখিকা

বিয়ের দুই দিন আগে যখন নিজের লাগেজটা শেষবারের মতো গুছিয়ে নিচ্ছিলাম, কিছুটা ক্ষণ থ মেরে বসেই রইলাম সেই লাগেজটা ধরে। বুক ফেটে দম আটকে কান্না পাচ্ছিল ভীষণ। মনে হচ্ছিল, নিশ্বাস বুঝি গলার কাছে এসে আটকে গেল আমার। খুব খালি খালি লাগছিল নিজের কাছেই নিজেকে।

ভাবছি আমি, কীভাবে সম্ভব! আমি তাহলে চলেই যাচ্ছি প্রিয় ঘর, প্রিয় মানুষগুলো ছেড়ে অন্য কারও সংসারে। ২০টা বছর তোমাদের সঙ্গে থাকা, জীবনের দৈনন্দিন সবকিছুতে থাকত তোমাদের ছায়া। সেই মায়া ছেড়ে আমিও যাচ্ছি তাহলে দূরে, বহু দূরে। আগের মতো ভার্সিটি যাওয়ার সময় কেউ তুলে দেবে না রিকশা অথবা ট্যাক্সিতে। আব্বা যেদিন বাসায় থাকবেন, সকালে আর নুডলস বানাতে হবে না আমাকে।

আমার বারবার গলা ছেড়ে সবাইকে বলতে মন চাইত, এখন বিয়ে করব না, আমি আরও কিছুদিন থাকতে চাই তোমাদের সঙ্গে। আরও কিছুটা সময় থাকতে চাই তোমাদের পাশে। জানি আমি, তখন তা সম্ভব হতো না কিছুতেই। আব্বা তখন ভীষণ ব্যস্ত বিয়ে বাড়ির হাজার রকমের কাজে। সবকিছু তো একা হাতে সামলাচ্ছিলেন তিনি।

চট্টগ্রামের পাঁচলাইশের বাসার তৃতীয় তলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কাঁঠালিচাঁপাগাছটাকে দেখতাম ফুল ফুটে ঝকঝক করছে। ঠিক দুই দিন পরে আমি অন্য কোনো ঘরের ব্যালকনি থেকে দাঁড়িয়ে আকাশছোঁয়া অট্টালিকা দেখতে পেতাম। খুব কষ্ট হতো আমার আর ভাবতাম রাতারাতি নিজের ঠিকানাটুকুও বদলে গেল আমার।

লেখিকার সন্তানদের সঙ্গে তাঁর বাবা
লেখিকার সন্তানদের সঙ্গে তাঁর বাবা

সেদিন ঈদের দিন ছিল। দাওয়াতে এক বাসায় জড়ো হয়েছিলাম আমরা সবাই। কীভাবে যেন বাবা-মায়ের কথা উঠল। সবার মুখে ছিল এক কথা, মা-বাবা ছাড়া ঈদ কাটানো কতটা কষ্টের। ততক্ষণে ভিনদেশি ঈদের আনন্দটুকু ফিকে হয়ে আসে আমার। জল জমে চোখের কোণে। বুকভরা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ভাবি, এবার ঈদেও সালাম করা হলো না বাবা-মাকে।

বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে মধ্যরাতে আমি ছবি খুঁজে বেড়াই। অনেক খুঁজে হাতে পেলাম মাত্র একটা ছবি। আমার গায়েহলুদে তোলা আব্বার সঙ্গে ছবি। আমার গুরুগম্ভীর আব্বার সঙ্গে এত দিন পর্যন্ত আমার তোলা তেমন কোনো ছবিই নেই, যা প্রচণ্ড কষ্ট দিল আমাকে।

আমার এই পুরো জীবনে আমি আমার সেই মেয়েবেলাটা ভীষণ মিস করি, নীল ড্রেস আর সাদা স্কার্ফ পরে যে মেয়েটি তার বাবার মোটরবাইকে করে স্কুলে যেত।

আমাদের অনেক ভালো রেখেছেন আব্বা। আল্লাহপাক যেন আপনাকে সব সময় সুস্থ রাখেন এবং দীর্ঘায়ু দান করেন এই প্রার্থনাই করি।

অনেক ভালো থাকুন। শুভ বাবা দিবস।
...

রিফাত নওরিন: নর্থ সেন্ট্রাল টেক্সাস কলেজ, ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র।