মাটির বুদ্ধ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বের হওয়ার আগে আয়নায় আর এক ঝলক নিজেকে দেখে নিলাম। নতুন শহরের নতুন আবহাওয়ায় শীতের ভারী ওভারকোট আর মাথায় স্কার্ফ জড়ানো এই নতুন বেশে আয়নায় নিজেকে একটু একটু অচেনা লাগল।

অফিসে পৌঁছাতে খানিক দেরি হলো। ঢুকতেই পাশের কিউব থেকে উঁকি দিয়ে বস বলল, ‘হ্যাপি ফ্রাইডে’! তার চেহারায় একটু আলগা হাসি দেখে সন্দেহের পাশাপাশি মনে হলো, তার মনে হ্যাপি ফ্রাইডে ছাড়া আরও কিছু রয়ে গেছে। কোট-গ্লাভস-স্কার্ফ খুলে কেবিনেটে ঝুলিয়ে রাখতে রাখতে আমিও বললাম, হ্যাপি ফ্রাইডে।

রাতভর তুষারপাত হওয়ায় রাস্তার অবস্থা ভালো না। স্নো ট্রাক্টরগুলো রাস্তায় জমে থাকা তুষার সরিয়ে লবণ ছিটিয়ে যাচ্ছে বরফ গলিয়ে রাস্তার পিচ্ছিলতা কমানোর জন্য। তবু বেশ কয়েকটা গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশের খাদে পড়ে থাকতে দেখলাম। সবাই বলে, গত ১০ বছরে অর্থাৎ ১৯৯৫-এর পর থেকে এই শহরে এত তুষারপাত আর হয়নি। রাস্তায় ট্রাফিক চলছে ধীরগতিতে। আরও অনেকের মতো আমারও তাই অফিসে পৌঁছাতে বেশ দেরিই হয়ে গেল। অবশ্য বস এসব খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে মাথা ঘামান না। সময়মতো কাজ শেষ করলেই হলো। তা ছাড়া সামনে ক্রিসমাসের লম্বা ছুটি। তার ওপর আজ শুক্রবার। সবাই বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছে। সবাই ফুরফুরে মেজাজে আছে বটে, শুধু আমি বাদে।

আমি বরং কিছুটা চাপের মধ্যে আছি। ছুটির আগে জমে থাকা অনেক কাজ শেষ করতে হবে। তার মধ্যে বেশির ভাগ কাজই আমি বুঝি না কিংবা পারি না। সোজাসাপটা কাজ না যে নিজে নিজে করে ফেলতে পারি। অন্যদের সাহায্য লাগবে এ রকম কাজ। পাস করে সবেমাত্র নতুন চাকরি পেয়েছি। সবকিছু বেশ চ্যালেঞ্জিং মনে হয়। কফি মেশিন চালু করা থেকে কম্পিউটার চালানো সবকিছুই চ্যালেঞ্জিং।

সকালবেলা বাচ্চাদের রেডি করে স্কুলবাসে তুলে দিয়ে সময়মতো অফিসে পৌঁছানোর চ্যালেঞ্জ। ক্লাসরুমে পড়া বইয়ের থিওরিগুলোর সঙ্গে বাস্তবের কাজের যোগসাজশ করার চ্যালেঞ্জ। প্রতিদিন নতুন নতুন কাজ শেখার চ্যালেঞ্জ। গুবলেট না পাকিয়ে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করে রিপোর্ট জমা দেওয়ার চ্যালেঞ্জ। অফিসের হালচাল আর কোম্পানির ব্যবসার অবস্থা বোঝার চ্যালেঞ্জ। আর সদ্য ভিন দেশে আসা আমার মতো মানুষের জন্য নতুন পরিবেশে সহকর্মীদের নাম-চেহারা মনে রাখাটাও বাড়তি চ্যালেঞ্জ বৈকি।

আমাদের টিমের ১৫-১৬ জন ইঞ্জিনিয়ারের মধ্যে যারা আমেরিকান, তারা বেশির ভাগই দেখতে আমার কাছে একই রকম মনে হয়। তাদের উচ্চতা, গড়ন, চুলের স্টাইল, হাঁটার ভঙ্গি, কণ্ঠস্বর, একসেন্ট—সবকিছুই যেন এক রকম। নামও প্রায় এক রকম। জিনকে জিম বলে ভুল করি। ডেভিডকে ডেরেক বলে সম্বোধন করি। যে প্রশ্ন নিককে করার কথা, সেটা গিয়ে রিককে জিজ্ঞেস করাতে সে চোখ কপালে তুলে তাকায়। যে জিনিস টমকে দেওয়ার কথা, সেটা গিয়ে টিমকে দিয়ে আসি। তার ওপর চলতি ভাষার ইংরেজি বোঝার চ্যালেঞ্জ তো রয়েছেই।

প্রথম সপ্তাহে একদিন লাঞ্চের সময় বস এসে যখন জিজ্ঞেস করল, ‘what’s on your plate today?’ আমি তখন মাত্র ক্যাফেটেরিয়া থেকে সালাদ নিয়ে এসে ডেস্কে বসেছি। স্টাইরোফোমের বাক্সের সালাদের দিকে তাকিয়ে কিছুটা ইতস্তত করে বললাম ‘on my plate? Umm. . lettuce...tomato...cucumber’ তখন বসের হাসি দেখে বুঝতে পারিনি সে আসলে খাবারের প্লেটের কথা জিজ্ঞেস করেনি। সেদিন আমার লিস্টে কী কী কাজ করার কথা, তা জিজ্ঞেস করেছে।

তবে চেহারার মতো তাদের সবার সৌজন্যবোধও এক রকম। ধৈর্য ধরে আমার ভাঙা ইংরেজি বোঝার চেষ্টা করে, কথা বলার সময় ধীরে বলে, যেন আমি বুঝতে পারি। কোনো সাহায্য চাইলে হাত বাড়িয়ে দেয়।

সবার সহযোগিতায় আমিও প্রথম ধাক্কা কিছুটা সামলে নিয়ে আমেরিকান কালচারে অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করছি। ইতিমধ্যে সহকর্মীদের সবার কার কটা বাচ্চা, কার কী পোষা প্রাণী, কার স্ত্রীর হবি কী, কে কী গাড়ি চালায়, সামনের ভ্যাকেশনে কে কোথায় যাচ্ছে, ইত্যাদি জেনেছি। সবারটা, শুধু হেনরি বাদে।

হেনরির কিউব আমার কিউবের মুখোমুখি। সেই সুবাদে উঠতে বসতে তার সঙ্গে চোখাচোখি হয়। কম্পিউটার স্ক্রিন থেকে চোখ সরালেই তাকে দেখি। রিভলভিং চেয়ারে আড়মোড়া ভাঙতে গেলে তাকে দেখি। কফি আনতে গেলেও তাকে দেখি। মাঝে মাঝে নিতান্তই চোখে চোখ পড়ে গেলে সে সংক্ষেপে ‘হাই’ বলে। ব্যস, আর কিছু না।

শুধু আমি না, হেনরির সঙ্গে অন্য কারও তেমন মেলামেশা নেই। লাঞ্চের সময় বাইরে আবহাওয়া ভালো থাকলে আমরা পেছনের লনে ফোয়ারার সামনের পিকনিক টেবিলগুলোতে বসে খাই। মাঝেমধ্যে বসও যোগ দেয় আমাদের সঙ্গে। কিন্তু হেনরি কখনো আসে না। সে একা একা তার ডেস্কে বসে কাজ করতে করতে খায়। কফি রুমের আড্ডাতেও কখনো তাকে দেখি না। তার কিউবটাও বেশ এলোমেলো। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে খোলা পড়ে আছে ভারী ভারী সব ডিজাইন ম্যানুয়াল। লাল কালি দিয়ে দাগ দেওয়া বড় বড় ডিজাইনের প্রিন্টগুলো ডেস্কে বিছানো। চেয়ারের ওপর একাধিক সোয়েটার ঝুলছে। তার নাম ছাপানো বেশ কিছু পেটেন্ট আর সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ সারি সারি সার্টিফিকেট ফ্রেমে ধুলো কুড়াচ্ছে। আর তার সঙ্গে ঝুলছে কতগুলো কাঠের পুঁতির মালা।

হেনরি ৩০ বছর ধরে এই কোম্পানির সঙ্গে কাজ করছে। তার অভিজ্ঞতা অনেক। তবে সে আপন মনে কাজ করতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করে। টিমওয়ার্ক করা তার কাজ নয়। তার এই অবন্ধুসুলভ স্বভাব এখন অন্যরাও মেনে নিয়েছে। বসও দেখি পারতপক্ষে হেনরিকে বিরক্ত করে না।

শুরুর দিকে তখনো সবার সঙ্গে তেমন পরিচয় হয়নি। সে সময় একদিন হেনরির কাছে কিছু জিনিস বোঝার জন্য কাগজপত্র নিয়ে গিয়েছিলাম। সে বেশ বিরক্ত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল ‘are you sure you can’t solve this on your own?’ আমি অবাক হয়ে মনে মনে ভাবলাম, ‘নিজে নিজে সমাধান করতে পারলে বুঝি তোমার মতো বেরসিকের কাছে আসতাম?’ তারপর থেকে আমিও আর তার কাছে যাইনি।

তবে আজ সকাল থেকে দেখছি বস ব্যস্তভাবে বেশ কয়েকবার হেনরির কিউবে আসা-যাওয়া করছে। সকালে বসের মুখে আলগা হাসির রহস্য এতক্ষণে উন্মোচন হলো।

আমাদের এই কোম্পানি অটোমটিভ সাপ্লাইয়ার কোম্পানি। আরও অনেক সাপ্লাইয়ার কোম্পানির মতো আমরাও গাড়ির কিছু বিশেষ অংশ বানিয়ে বড় কোম্পানিগুলোকে সাপ্লাই দিই। তারপর বড় কোম্পানিগুলো সেগুলোকে একসঙ্গে অ্যাসেম্বল করে পুরো গাড়ি বানায়। আমরা কাজ করি আমেরিকায় অবস্থিত কোম্পানির হেডকোয়ার্টারে। তবে ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের খরচ কম পড়ে বলে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গাড়ির কোম্পানির প্ল্যান্ট রয়েছে বলে তাদেরকে সেই সব সাপ্লাই দেওয়ার সুবিধার জন্য আমাদের কোম্পানিও পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে প্ল্যান্ট তৈরি করেছে। তার মধ্যে একটি বড় প্ল্যান্ট হচ্ছে থাইল্যান্ডে।

থাইল্যান্ডের প্ল্যান্টে কয়েক দিন ধরে কিছু ম্যানুফ্যাকচারিং সমস্যা চলছে। সেখানে যে পার্টগুলো তৈরি হচ্ছে তার rejection rate খুব বেশি হচ্ছে। আমাদের কাস্টমাররা নাখোশ। তাদের অভিযোগ করা সমস্যাগুলোর কারণ বা উৎস এখনো শনাক্ত করা যায়নি। প্ল্যান্টের প্রোডাকশন বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা। প্ল্যান্ট ম্যানেজার আমাদের কাছে সাহায্য চেয়েছে। হেড কোয়ার্টার থেকে এক্সপার্ট কাউকে পাঠিয়ে সমস্যা সমাধানে সাহায্য করার অনুরোধ জানিয়ে।

এক্সপার্ট হিসেবে হেনরিকে থাইল্যান্ডে পাঠানো হচ্ছে। আর তার সঙ্গে সহকারী হিসেবে আমাকেও। হেনরির সঙ্গে আমাকে পাঠানোর খবরটি দিতে বসকে বেশ কসরত করতে হচ্ছে মনে হয়। আর সে জন্যেই সকাল থেকে এত ভণিতা চলছে।

গাড়ির পার্টগুলোর সত্যিকার প্রোটোটাইপ বানানোর আগে সেগুলো কম্পিউটারে মডেল বানিয়ে সেগুলোর পারফরম্যান্স যাচাই করে দেখা হয়। আমার কাজ হলো পার্টগুলো কম্পিউটারে মডেল বানিয়ে সেগুলোর noise & vibration-এর দিকগুলো দেখা। হাতে-কলমে ম্যানুফ্যাকচারিং প্ল্যান্টের সঙ্গে আমার তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। অভিজ্ঞতাও নেই। কিন্তু সামনে ক্রিসমাসের ছুটি, অনেকেই এই সময় লম্বা ছুটি নিয়ে ইতিমধ্যেই চলে গেছে। যারা আছে, তারাও ক্রিসমাসের সময় পরিবারেরে সবাইকে ছেড়ে থাইল্যান্ডে যেতে উৎসাহ দেখাচ্ছে না। হেনরি একাই হয়তো সমস্যা সমাধান করতে পারবে, তবে সঙ্গে একজন সাহায্যকারী থাকলে কাজ দ্রুত হবে। সে জন্যই আমাকে তার সঙ্গে পাঠানোর প্রস্তাব এসেছে। তা ছাড়া নতুন হিসেবে আমার জন্যও এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগবে ভেবে আমাকেই পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

থাইল্যান্ড যেতে আমার কোনো আপত্তি নেই বরং নতুন জায়গা দেখতে আমি সব সময় পছন্দ করি। কিন্তু আর কেউ না, হেনরির সঙ্গে? এক-আধ দিন নয়, পুরো এক সপ্তাহ! এ যেন রীতিমতো দণ্ড। যা হোক, মনকে সান্ত্বনা দিলাম, হেনরি কাজপাগল মানুষ, সে একাই সব সামাল দেবে আর আমি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে নতুন দেশে নতুন সব জায়গায় ঘুরে বেড়াব।

ব্যাগ গোছালাম। যাওয়ার আগে বাচ্চাদের সাত দিনের জন্য বাড়তি ‘bed time story’ পড়ে শোনালাম। এই প্রথম তাদের রেখে মা দূরে কোথাও যাচ্ছে। তাদের বাড়তি ‘good night kiss’ আর ‘hug’ দিলাম গুনে গুনে আগাম সাত দিনের জন্য। তারপর বাচ্চাদের আর তাদের বাবার পুরো সপ্তাহের খাবার আর পোশাক গুছিয়ে রেখে সংসার থেকে ছুটি নিয়ে ক্যাথে প্যাসিফিকের ইকোনমি ক্লাসে হেনরির পাশের সিটে চড়ে বসলাম।

হেনরি বসেছে উইন্ডো সিটে। আমি মাঝের সিটে। আমার অন্যপাশে আইল সিটে একটা চায়নিজ মেয়ে। প্লেন ওড়ার আগেই হেনরি তার ল্যাপটপের ব্যাগ থেকে একটা চটি বই বের করে পড়া শুরু করেছে। আমাকে যেন সে চেনেই না, এমন ভাব। আমি আগ বাড়িয়ে দুই-একটা হালকা কথা বলার চেষ্টা করলাম। yes-no ছাড়া তেমন কোনো সাড়া পেলাম না। আড় চোখে দেখলাম তার হাতের বইটার নাম ‘Compation’। মনে ভাবলাম, যার যেটার অভাব...। চোখে পড়ল হেনরি তার কাঠের মালাগুলো গলায় পরে এসেছে। সবুজ চোখের আইরিশ বংশোদ্ভূত এই অদ্ভুত মানুষটি কেন বুদ্ধর মালা পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তা বোঝার চেষ্টা করছি। আমার কৌতূহলী দৃষ্টিতে মোটেই কর্ণপাত না করে সে নিবিষ্ট মনে বই পড়তে থাকল। মাঝে একটি ট্রানজিটসহ দীর্ঘ ২৫ ঘণ্টার পুরো পথ আমি তার কাছে অদৃশ্য হয়েই রইলাম।

পৃথিবীর সব রকম ভ্রমণের মধ্যে প্লেন ভ্রমণ সম্ভবত সবচেয়ে কম জনপ্রিয়। নৌকা ভ্রমণ, জাহাজে চড়ে সমুদ্র ভ্রমণ, রেলগাড়ির ভ্রমণ নিয়ে কত সব রোমান্টিক গল্প-কাহিনি-কবিতা লেখা হয়েছে। কিন্তু প্লেনে ভ্রমণ নিয়ে সে রকম কিছু চোখে পড়েনি। আমার কাছেও প্লেন ভ্রমণ তেমন আকর্ষণীয় কিছু মনে হয় না। প্লেনে চড়ার পর কিছুই করতে ইচ্ছে হয় না। বই পড়লে ঘাড় ব্যথা করে। গান শুনলে কান ব্যথা করে। মুভি দেখলে চোখ ব্যথা করে। চা খেলে গা গুলিয়ে ওঠে। আর পাশের সিটে যদি থাকে হেনরির মতো সহযাত্রী, তাহলেই হয়েছে।

হেনরিকে ভুলে আমি অন্যপাশের যাত্রীর দিকে মনযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলাম। প্লেনে ওঠার পর থেকে আমার পাশের চায়নিজ মেয়েটি তার ল্যাপটপ বের করে ঝড়ের গতিতে টাইপ করছে, পাতার পর পাতা লিখে চলেছে। ব্যাংককে নামার সময় মেয়েটি যদি বলে, প্লেনের সময়টা কাজে লাগিয়ে সে তার পিএইচডি ডিসার্টেশন লিখে ফেলেছে, তাহলে অবাক হব না।

হেনরি বেশ কয়েকবার এয়ার হোস্টেসের কাছ থেকে কফি নিয়ে খেল। খুক খুক করে কাশছে একটু পর পর। শেষের দিকে দেখলাম সে মাফলার দিয়ে মাথা আর কান পেঁচিয়ে চোখ বন্ধ করে জড়সড় হয়ে বসে আছে।

স্থানীয় সময় সন্ধ্যার দিকে আমরা ব্যাংককে নামলাম। হোটেলের শাটল এসে আমাদের এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে নিয়ে গেল। পরদিন সকালে প্ল্যান্টের ইঞ্জিনিয়ার এসে আমাদের প্ল্যান্টে নিয়ে যাবে। সকালে সেখানে প্ল্যান্ট ম্যানেজারসহ অন্যদের সঙ্গে মিটিং হবে। তারপর কাজ শুরু।

এসব নিয়ে আমাকে ভাবতে হবে না। হেনরি নিশ্চয়ই সবকিছুর নীলনকশা বানিয়ে এনেছে। আমি শুধু তার নির্দেশনা অনুসরণ করব। সে যেভাবে বলবে, যা বলবে, তা-ই করব।

বাচ্চাদের ছেড়ে আসার অভিজ্ঞতা আমার নতুন। ওদের জন্য একটু মন খারাপ হলো। এখন আমেরিকাতে ভোর হবে। একটু পরে তারা স্কুলের জন্য তৈরি হবে। বাবা ঠিকমতো লাঞ্চ প্যাক করে দিতে পারবে তো? সময়মতো বাস ধরতে পারবে তো? বিকেলে ফেরার সময় বাবা বাসস্ট্যান্ডে সময়মতো আসতে পারবে তো? হোমওয়ার্ক করতে ভুলে যাবে না তো?

রাতের খাবারের পর একা একা হোটেলের সামনের রাস্তা ধরে হাঁটতে বের হলাম। ওহাইওর ডিসেম্বরের কনকনে ঠান্ডা থেকে রাতারাতি থাইল্যান্ডের উষ্ণ বসন্তের আবহাওয়ায় এসে মন কিছুটা ফুরফুরে হয়ে গেল। রাস্তার পাশে আলো ঝলমলে অনেক রকমের দোকান। চেনা-অচেনা ট্রপিক্যাল ফল সাজানো। রঙিন অর্কিডসহ বিভিন্ন রকম ফুলের সমাহার। বরফের কুচিতে সাজানো কাঁচা মাছ আর সি-ফুডের দোকান। পোশাকের দোকান, স্যুভেনিরের দোকান, গরম স্ন্যাক্সের দোকান, ফেন্সি রেস্তোরাঁ। পথের দুপাশে ব্যস্ত গতিতে মানুষ হাঁটছে, অনেক ট্যুরিস্টও আছে। আমিও হারিয়ে গেলাম তাদের ভিড়ে। হেনরির কথা, কাজের কথা পুরোপুরিই ভুলে গেলাম।

পরদিন ভোরবেলা সময়মতো তৈরি হয়ে নিলাম। সারা দিন প্ল্যান্টে থাকার জন্য জিনস আর গাঢ় রঙের টি-শার্ট পরলাম, পায়ে স্নিকার জুতা। তারপর পাশের রুমে হেনরিকে ডাকতে গেলাম। কোনো আওয়াজ নেই। কিছুক্ষণ দরজায় কড়া নাড়ার পর হেনরি এসে দরজা খুলল। বিছানার কম্বল গায়ে জড়িয়েই উঠে এসে দরজা খুলেছে সে। নাক-চোখ লাল, চুল উসকোখুসকো। কাশি আরও বেড়েছে। দরজা খুলে দিয়ে আমাকে দরজায় দাঁড় করিয়ে রেখেই সে আবার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। মুখে কোনো কথা নেই, ভালো সময়েই ঠিকমতো কথা বলতে চায় না সে, আর এখন তো মনে হচ্ছে কিছুটা ঘোরের মধ্যে আছে। কিন্তু এ কী দশা, অসুস্থ নাকি! অসুস্থ হওয়ার আর সময় পেল না।

আমার মাথায় হোটেলের ছাদ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা। একটু পরে মিটিং। আমি তো কিছুই জানি না! থাইল্যান্ডের প্ল্যান্টে ঠিক কী ধরনের সমস্যা হয়েছে, সে সম্পর্কেও আমার পরিষ্কার ধারণা নেই। পুরোটা ভাসা-ভাসা। অবশ্য কোনো অজুহাত নেই না জানার। চাইলেই জেনে বুঝে তৈরি হয়ে আসতে পারতাম। কিন্তু তা করিনি। নিজের পরনির্ভরশীল স্বভাবকেই দোষারোপ করতে হবে। পুরোটা সময় হেনরির ভরসায় বসে না থেকে নিজে উদ্যোগ নিয়ে কিছু জানার চেষ্টা তো করতে পারতাম। কিন্তু নিজেকেই বা পুরো দোষ দিই কেন। আমি তো এক্সপার্ট নই। এসবের কিছুই তো আমি পারি না। হাতে-কলমে কাজ করার তেমন কোনো অভিজ্ঞতা নেই আমার। আর অন্যদের মতো নতুন জিনিস চটপট শেখার ক্ষমতাও নেই। আমি স্লো-লার্নার। তা ছাড়া কারও নির্দেশ ছাড়া স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে কাজ করার অভ্যাস বা সাহস কোনোটিই আমার নেই। পাছে ভুল করি, সেই ভয়ে নতুন সমস্যা সমাধানের চেষ্টায় নিজেকে না জড়িয়ে নিরাপদ থাকি। হেনরির অসুস্থতা নিয়ে আমার কোনো দুশ্চিন্তা হলো না। বরং নিজের চিন্তায় দিশেহারা হয়ে গেলাম। ছোটবেলার সাঁতার শেখার সময়কার স্মৃতি মনে পড়ল। যেন বড়দের কেউ হঠাৎ পুকুরের গভীর পানিতে ঠেলে দিয়েছে, প্রাণের মায়া থাকে তো নিজে সাঁতরে পার হয়ে এসো।

কিন্তু এখন এসব ভাবনার সময় নেই। একটু পরেই প্ল্যান্ট থেকে কেউ আসবে আমাকে নিতে। হেনরির যে অবস্থা তাতে মনে হয় না সে আজ বিছানা ছেড়ে উঠতে পারবে। হেনরির কথা ভুলে নিজের রুমে ফিরে গেলাম। ল্যাপটপে লোড করা পুরোনো সব ই-মেইল খুঁজে পড়া শুরু করলাম। প্ল্যান্টে কী সমস্যা হয়েছে, তা বোঝার চেষ্টা করলাম। কিছু কিছু জিনিস নোট করলাম। কয়েকজন কি-পারসনের নাম মনে রাখলাম। ইতিমধ্যে রুমের ফোন বেজে উঠল, ফ্রন্ট ডেস্কের মেয়েটা জানাল মারিও এসেছে।

স্থানীয় প্ল্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার মারিও। দেখে মনে হলো অল্প বয়স, হাসিখুশি চেহারা। পথে যেতে তার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হলো। শেভির জানালা দিয়ে রাস্তায় নতুন শহরের দালানকোঠা দেখিয়ে মারিও এটা-সেটা বলছিল। দৃষ্টি বাইরে থাকলেও আমি কিছুই দেখতে পেলাম না। মাথায় ভেতরে সবকিছু এলোমেলো ঘূর্ণির মতো ঘুরছে।

প্ল্যান্টে গিয়ে দেখলাম সেখানে কারওই হেনরিকে নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। তারা শুধু জানে আমেরিকার হেড কোয়ার্টার থেকে দুজন এক্সপার্ট এসেছে। এক্সপার্টের কাজ হলো সমস্যা সমাধান করা। আমাকে পেয়ে তারা সবাই আমাকেই এক্সপার্ট ঠাওর করে সবকিছু বর্ণনা করতে লাগল। মনে ভাবলাম, ‘তোমরা অযথাই সময় নষ্ট করছ, আমি কোনো বিশেষজ্ঞ নই, বরং বিশেষভাবে অজ্ঞ একজন মানুষ। আমি এই কোম্পানিতে সদ্য চাকরি পেয়েছি। তা ছাড়া আমি একা একা নিজের বুদ্ধিতে কোনো সমস্যা সমাধান করতে পারি না, আমি শুধু অন্যের নির্দেশ অনুসরণ করি।’ কিন্তু আমার মনের কথাগুলো কণ্ঠ থেকে শব্দ হয়ে বের হলো না।

মিটিং শেষে ওরা আমাকে প্রোডাকশন লাইনের কাছে নিয়ে গেল। আমাদের পার্টের রিজেকশন রেট ৩০ শতাংশ। দ্রুত ঠিক না করা গেলে আমাদের কাস্টমার বড় গাড়ির কোম্পানিগুলোর প্রোডাকশনও বন্ধ হয়ে যাবে। ব্যবসা আর গুডউইলের বিরাট ক্ষতি।

অনেক মানুষের চোখ আমার দিকে। তবু অস্বস্তি ভুলে গিয়ে সমস্যা বুঝতে মনোযোগ দিলাম। এই প্রথম সমস্যাগুলোকে নিজের হিসেবে গ্রহণ করলাম। এটা এখন আমার সমস্যা। ঠাঁইবিহীন পানিতে যেভাবে হোক পড়েছি, সাঁতার কেটে কোনো উপায়ে ঘাটে পৌঁছতেই হবে।

অন্তত সমস্যার উৎস যদি শনাক্ত করা যায়, তাহলে সমাধান বের করার মতো মানুষ হয়তো এখানেই আছে। চোখ বন্ধ করে দীর্ঘনিশ্বাস নিয়ে নিজের ওপর অসীম ভরসা নিয়ে কাজে মন দিলাম। সংকোচ কাটিয়ে সবাইকে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে শুরু করলাম। সাধারণ সব প্রশ্ন। কবে শুরু হলো। কীভাবে হলো। এই পার্টগুলোর লাইফ সাইকেল কী? কোথায় শুরু কোথায় শেষ? কী কী প্রসেসের মধ্যে দিয়ে যায়? কী কী ভেরিয়েবল আছে? ইদানীং নতুন কী করা হচ্ছে যার ফলে এই সমস্যা দেখা দিতে পারে ইত্যাদি। কিছুটা ব্যাকগ্রাউন্ড জানার চেষ্টা করলাম। সমস্যা সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন ডিপার্টমেন্টের ইঞ্জিনিয়ারদের মতামত আলাদা। এক টিমের ইঞ্জিনিয়াররা অন্য টিমের ইঞ্জিনিয়ারদের দিকে দোষারোপ করার প্রবণতা লক্ষ করলাম। আবার প্রোডাকশন কর্মীদের কথার সুরে মনে হলো, তারা ঠিকই জানে সমস্যা কীভাবে সমাধান করতে হবে। কিন্তু ইঞ্জিনিয়াররা তাদের কথায় গুরুত্ব দেয় না।

মারিওর সঙ্গে আলাপ কিছুটা ঘনিষ্ঠ হলে জানলাম, এখানে তাদের কাজের চাপ অনেক বেশি। কখনো কোনো সমস্যা দেখা দিলে ভেবেচিন্তে তা সমাধান করার মতো সময় কারও থাকে না। বরং জোড়াতালি দিয়ে সাময়িকভাবে তা সমাধান করে কাজ চালিয়ে নেওয়া হয়। সমস্যার মূল কারণ অর্থাৎ root cause শনাক্ত না করে তাৎক্ষণিকভাবে ‘আগুন নেভানো হয়’ বটে তবে একই কারণে পরবর্তী সময়ে আবারও আগুন লাগার আশঙ্কাগুলো রয়েই যায়। সবার সঙ্গে কথা বলে প্ল্যান্টের গ্রিজমাখা টেবিলে বসেই কাগজ কলম নিয়ে সেগুলো নোট করলাম। এভাবেই সারা দিন পার হয়ে গেল।

রাতে হোটেলে ফিরে চিন্তা করছিলাম কোথা থেকে শুরু করব। কোথাও পড়েছিলাম ‘a problem clearly stated is a problem half solved’, প্ল্যান্টের প্রোডাকশনজনিত সমস্যাটিকে পরিষ্কার করে লেখার চেষ্টা করলাম। Toyota Motor Company-র ‘5 why methodology’ নামে একটি জনপ্রিয় পদ্ধতি আছে, এই পদ্ধতিতে বারবার (অন্তত পাঁচবার) ‘why’ প্রশ্ন করা হয় যতক্ষণ পর্যন্ত সমস্যাটির একটি পরিষ্কার সংজ্ঞা দাঁড় করানো হয়। যেমন সমস্যা হলো কলে পানি নেই। প্রশ্ন: কেন কলে পানি নেই? উত্তর: কারণ ছাদের ট্যাংকে পানি নেই। প্রশ্ন: কেন ছাদের ট্যাংকে পানি নেই? উত্তর: কারণ পানি তোলার পাম্প কাজ করছে না। প্রশ্ন: কেন পাম্প কাজ করছে না? উত্তর: পাম্পের মোটর চলছে না। প্রশ্ন: কেন মোটর চলছে না? উত্তর: মোটর পুড়ে গেছে। ইত্যাদি। এবার বোঝা যাচ্ছে সমস্যার গোড়ায় রয়েছে মোটর পুড়ে যাওয়া অতএব মোটর সারালেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

অবশেষে সমস্যাটির শুধু একটি শিরোনাম দিতেই গভীর রাত নাগাদ বসে ভাবলাম। প্রথম দিনে অন্তত কিছুটা অগ্রগতি হলো। হেনরি সুস্থ হয়ে উঠলে কাল থেকে সেই বাকিটা সামাল দিতে পারবে।

পরের দিন সকালে হেনরির খোঁজ নিতে গিয়ে তাকে প্ল্যান্টের আপডেট দিলাম। ভাবলাম, আমি ‘অর্ধেক’ কাজ করেছি, সমস্যার শিরোনাম দিয়েছি, এবার হেনরির সমাধানের পালা। কিন্তু তার অসুখ আরও বেড়েছে মনে হলো, জ্বর-কাশি-হাঁচি মিলে কাবু হয়ে পড়েছে সে। আমার কথা তার মাথায় কতটা পৌঁছাল কী জানি। তবে তার ঘোর-লাগা চাহনি দেখে নিজেকেই প্রশ্ন করলাম ‘are you sure you can’t solve this by yourself?’ তারপর কিছুটা অনিশ্চিত মনে একাই প্ল্যান্টের উদ্দেশে রওনা দিলাম।

সমস্যা শনাক্ত করার পর এবার তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের পালা, সমস্যা যে আসলেই রয়েছে তার প্রমাণ কী? সে জন্য কিছু ডেটা সংগ্রহ করতে হবে। প্ল্যান্টের কিছু ইঞ্জিনিয়ার আর প্রোডাকশন কর্মীকে সঙ্গে নিয়ে সবার পরামর্শ সাপেক্ষে টেস্ট প্ল্যান তৈরি করলাম। ডজন ডজন পার্ট নিয়ে সেগুলোতে কিছু ফ্যাক্টর অপরিবর্তিত রেখে কিছু কিছু ফ্যাক্টর পরিবর্তন করা হবে। ভিন্ন ভিন্ন ভেরিয়েবল সেট করে একেক টিম সেগুলো টেস্ট করবে তারপর সেই টেস্টগুলোর ফলাফলের ডেটা অ্যানালাইসিস করে দেখা হবে ফ্যাক্টরগুলো পরিবর্তন করার ফলে ডিপেন্ডেন্ট ভেরিয়েবলগুলো অনুমান অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়েছে কি না। তারপর সেই তথ্য থেকে সমস্যার উৎস শনাক্ত করা হবে। তারপর কীভাবে সেই কারণগুলোকে দূর করে সমস্যা সমাধান করা যায়, সেই ব্যবস্থা করা হবে।

রাতে হোটেলে ফিরে সারা দিনের সংগ্রহ করা ডেটাগুলো প্রসেস করে ক্লু খুঁজলাম। কোনো ভেরিয়েবল পরিবর্তন করলে কোনো ডাটা পরিবর্তন হয়, তা পর্যবেক্ষণ করে অনুমান অনুযায়ী কিছু ক্লু পাওয়া গেল। ফোনে আমেরিকায় দু-একজন সহকর্মীর সঙ্গে পরামর্শ করলাম। প্ল্যান্টের সবার সহযোগিতায় পরের দুদিনও কাজের আশানুরূপ অগ্রগতি হলো।

অনিশ্চিত পরিণাম আর সম্ভাব্য ব্যর্থতার শঙ্কা ভুলে পুরোপুরি মনোনিবেশ করে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি। কোনো রকম জটিলতা ছাড়াই ছোট ছোট ধাপে সহজ পদ্ধতিতে এগিয়ে ক্রমেই সমস্যার গোড়ায় পৌঁছাতে পেরেছি। যদিও শেষরক্ষা হয়নি এখনো, তবু কিছুটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে। আমরা আমেরিকায় ফিরে গেলে এখানকার ইঞ্জিনিয়াররা নিজেরাই আরও কিছু অনুসন্ধানের পর হয়তো সমাধান করতে পারবে বাকিটা।

সবচেয়ে বড় কথা, হঠাৎ লক্ষ করলাম নিজের মাথার ওপরে চেপে থাকা পাহাড়ের বোঝা কিছুটা কমেছে। নিজের পরনির্ভরশীলতার গ্লানি নিয়ে অন্তত ফিরে যেতে হবে না। এই সমস্যাটির পুরোপুরি সমাধান করতে না পারলেও নিজের মনে ভরসা পেলাম, প্রয়োজন হলে আমিও পারি, চাইলে আমি একাই পারি।

কয়েক দিনের টানা কাজের পর বাড়ি ফেরার জন্য মন উচাটন হয়ে পড়েছে। কাল সন্ধ্যায় আমাদের ফেরার ফ্লাইট।

শেষদিন ভোরবেলা আমার রুমের দরজায় খট খট শব্দ। হেনরি দাঁড়িয়ে আছে। গত কয়েক দিন শেভ না করাতে তার মুখে কাঁচা পাকা দাঁড়ি। কদিন তার ওপর বেশ ধকল গেছে। তবে চেহারায় তরতাজা ভাব দেখে মনে হলো তার ফ্লু সেরে গেছে। হেনরির পাশে মারিও দাঁড়িয়ে। সে এসেছে আমাদের শহর ঘুরে দেখাতে। হেনরির সাইট-সিইং লিস্টে কিছু গন্তব্য ছিল, আমরা বাড়ি ফেরার আগে সেগুলো দেখে যাব। তিনজন মিলে সেই উদ্দেশে রওনা দিলাম।

শহর ছাড়িয়ে মাঝারি আকারের একটি বৌদ্ধমন্দির, তার ভেতরে বিশাল আকারের এক মূর্তি। নিরেট সোনার তৈরি বুদ্ধমূর্তি! শান্ত, সৌম্য, আবেদনময় চাহনি, সরাসরি যেন আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু রহস্যময় হাসি হাসছে বৌদ্ধ।

মূর্তির সামনে কাচের বাক্সে এক টুকরো কাদামাটি সাজিয়ে রাখা। তার সঙ্গে কাগজে লেখা মূর্তির ইতিহাস। ইতিহাস পড়ে খানিকটা আশ্চর্য হয়ে গেলাম। মূর্তির সঙ্গে নিজের মিল খুঁজে পেলাম।

আধুনিক ব্যাংকক শহর তৈরির সময় শহরের বিভিন্ন জায়গায় হাইওয়ে তৈরির প্রকল্প শুরু হয়। সেটা ছিল ১৯৫৭ সাল। হাইওয়ে তৈরির পথে পড়াতে একটি বৌদ্ধমন্দির তখন স্থানান্তর করার প্রয়োজন হয়। সেই মন্দিরে ছিল বিশাল এক বুদ্ধমূর্তি, তবে মাটির মূর্তি। সেই বিশাল মাটির মূর্তি সরানোর জন্য বিশাল ক্রেন আনা হয়েছে। কিন্তু মূর্তিটি এতই ভারী যে, ক্রেন দিয়ে তোলার সময় তাতে ফাটল তৈরি হয়। সেই সময় শুরু হয় মুষলধারে বৃষ্টি। পবিত্র মূর্তিটি সংরক্ষণের জন্য মন্দিরের শীর্ষস্থানীয় মংক বৃষ্টি না থামা পর্যন্ত মূর্তিটি নামিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। বৃষ্টির পানিতে ভিজে মূর্তিটি যেন নষ্ট না হয় সে জন্য সাময়িকভাবে ক্যানভাসের তাঁবুর নিচে ঢেকে রাখা হয়।

রাতে মূর্তির অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার জন্য টর্চ লাইট নিয়ে হেড মংক তাঁবুর নিচে যায়। টর্চের আলো মূর্তির ফাটলের ভেতরে পড়লে মংক লক্ষ করে, ফাটলের নিচে কিছু একটা চকচক করছে। কৌতূহলবশত সে হাতুড়ি বাটালি দিয়ে মূর্তিটি খুঁড়তে শুরু করে। একটু একটু করে বাইরের কাদার পুরু আবরণ খুঁড়ে ফেলার পর ভেতর থেকে পরিপূর্ণ সোনার মূর্তিটি বের হয়ে আসে।

প্রচলিত গল্প আছে কয়েক শ বছর আগে বার্মিজ (বর্তমানে মিয়ানমার) সেনারা একবার থাইল্যান্ড দখল করার প্রয়াস চালায়। থাইল্যান্ডের সিয়ামিজ মংকরা এই বার্মিজ আক্রমণের খবর জানতে পেরে তাদের মূল্যবান এই স্বর্ণমূর্তিটিকে পুরু কাদার আবরণে ঢেকে রাখে যেন বার্মিজরা মূর্তিটি শনাক্ত করতে না পারে এবং লুট করে না নিতে পারে। সেই আক্রমণে বার্মিজরা সব মংককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে তবে মাটির আবরণের আড়ালে লুকানো এই স্বর্ণমূর্তির কথা সবার কাছে অজানা রয়ে যায়। তারপর কয়েক শ বছর পর ১৯৫৭ সালে সেই মংক হাতুড়ি বাঁটালি দিয়ে কাদার আবরণ সরিয়ে সোনার মূর্তিটি আবিষ্কার করার পর সবাই পুরোনো ইতিহাস জানতে পারে।

মূর্তি দর্শন শেষে বিস্ময় নিয়ে আমরা পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দিলাম।

রাতের ব্যাংকক নগরীর সীমানা ছাড়িয়ে আমাদের প্লেন ক্রমেই আকাশে উড়ছে। বিমানবালা ফ্লাইট সেফটির ডেমো দেখাচ্ছে। এবারও হেনরি আমার পাশের সিটে। এবার আমি জানালার পাশে। শেভ করাতে এখন তাকে ঝরঝরে দেখাচ্ছে। গলায় কাঠের পুঁতির মালাগুলো রয়েছে এখনো, মুখে সামান্য হাসির আভাস। পরনে ব্যাংককের ফুটপাত থেকে কেনা গেরুয়া পোশাক। কিছুটা বৌদ্ধ মংকের মতো দেখাচ্ছে তাঁকে। ল্যাপটপের ঢাকনা খুলে কী যেন ভাবছে। ওর দিকে কিছুটা হেলে আমি ওর অন্ধকার স্ক্রিনে আড়চোখে নিজেকে এক ঝলক দেখে নিলাম। আঙুল দিয়ে চুল ঠিক করলাম।

ল্যাপটপের স্ক্রিনে দেখা নিজের চেহারায় কিছু একটা মিসিং মনে হলো। ঠিক মিসিং নয় বরং একটা ফাটলের আভাস। তার আড়ালে ঝাপসা কিছু একটা চকচক করছে মনে হলো। আবার তাকালাম। ভয়, সংকোচ আর আত্মবিশ্বাসের অভাবে নিজের চারদিকে যে আবরণ নিয়ে সারা জীবন ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, তাতে কিছুটা ফাটল ধরেছে মনে হলো। কোনো সবুজ চোখের আইরিশ ‘মংক’ সেই পুরু আবরণে ফাটল তৈরি করে দিয়েছে নিজের অজান্তেই।

আমাকে তার ল্যাপটপের স্ক্রিন আয়না হিসেবে ব্যবহার করতে দেখে এবার সে ঘাড় ঘুরিয়ে সরাসরি আমার দিকে প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকাল। আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হাসি হেসে তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ’! হেনরি কিছু না বুঝতে পেরে চোখ কুঁচকে আমার দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে রইল। আমি আবার হাসলাম।