ভিনদেশি তারা-এক

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

মার্কিন মুলুকে এবার আমার প্রথম ঈদ নয়। তবে কিছু কারণে এবার সত্যি ঈদের আমেজ টের পেলাম এখানে। সে প্রসঙ্গে নাই বা গেলাম। আর প্রায় দিন আটেক পরেই সেমিস্টার শেষ। পরীক্ষার প্রস্তুতির অতিরিক্ত চাপের ফাঁকে থেকে থেকে পরিবার আর বন্ধুমহলের খোঁজ নেওয়া, হাজার কাজের ভিড়ে এ কাজটি আমাকে সব সময় চাপমুক্ত থাকতে সাহায্য করে।

ঈদুল ফিতর মানেই প্রচুর শুভেচ্ছাবার্তা আর হরেক নকশার কার্ড। দুই দিন ধরে থেকে থেকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি বা শুভেচ্ছার জবাব দিচ্ছি। সেদিন জবাব দিতে দিতে আচমকা চোখ পড়ল দুটো বিশেষ বার্তায়।

একটাতে ছোট্ট সুন্দর নকশার পাশে লেখা—‘ভীষণ ভীষণ মনে পড়ে তোমায়, আপু। জানি তুমি আমায় ভুলে যাওনি, ঈদ মোবারক।’

আরেকটায় উজ্জ্বল একটা কার্ডের পাশে ছোট্ট চিঠি—‘কোথায় আছ তুমি আপু? বাংলায় না বিদেশ? তুমি আমার দেশে আসবে না ঘুরতে? ঈদ মোবারক।’

বার্তার পাশে থাকা দুটো অতি প্রিয় মুখের ছবিতে অপলক দৃষ্টি ফেলে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। একটায় বাদামি চুলের দুষ্টুমি মাখা মিষ্টি তরুণী মুখ, অপরটি পরিপাটি পোশাকের ছিমছাম তরুণ। একই জবাব দিলাম দুজনকে, ওর হান, আয়েশা...ভালো আছ তো? আজও মনে আছে আমাকে তোমাদের? ভেবেছি ভুলে গেছ।

এবার দুজনের জবাবেই অভিমান, ‘তুমি আমাদের ভুলেছ বুঝি? আমরা তোমার সব খবর রাখি, হুম!’

স্মৃতির ডানায় ভর করে উড়ে গেলাম আজ থেকে প্রায় সাত বছর আগে, ২০১৩ সালে। আমি তখন ঢাকা শহরের কোনো এক ইংরেজি ভাষা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত। আমার কাজ হিসাব দেখা, ছাত্র ভর্তি, আরও হাজার টুকিটাকি। অ্যাডমিন ম্যানেজারের দায়িত্ব আমাকে টানত না মোটেও। যতই ভালো বেতন হোক টাকাই কি সব নাকিরে ভাই?

হাঁপিয়ে উঠতাম। অগ্রজপ্রতিম ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে গিয়ে বায়না ধরতাম মাঝেমধ্যে, আমি অ্যাডমিন করব না আআআআ। আমিও ক্লাস নেব আপনার মতো। আমার কাঁদুনিতে হাসতেন দাদা। সবুর করোগো ফাল্গু নাই, তোমার জন্য আমার কাছে কাজ আছে...। আপাতত এই খাতাগুলো দেখে দাও দেখি, লক্ষ্মী বোন আমার!

আমি তো ততক্ষণ ভেতরে-ভেতরে ফুটছি, ধুত্তরি খাতা, ও সবাই পারে...। দাদা, আপনি না...একটা যা তা!

রসিক দাদা আমার রাগের আগুনে ঘি ঢালতেন। রোসো, বোনটি, রোসো, এখানটাতে বস, চা খাবে?

আরে, মানে...যাচ্ছেতাই! দেন দেখি চা-ই খাই। কী আর করা!

এমনই একদিন বেলা ১১টা প্রায়। আচমকা অফিসে বিদেশিনী ঢুকতে দেখে চমকে উঠলাম। পথ ভুলে নাকি? সঙ্গে বাঙালিও? ব্যাপারখানা কী?

মাঝবয়সী নারীর পরনে রুচিশীল মুসলিম পোশাক। সঙ্গে থাকা কিশোরীটি আমার নজর কাড়ল। দিঘল রেশমি বাদামি চুল। আর চোখ দুটোয় অদ্ভুত সারল্য মাখা। এর পোশাকে একটু পশ্চিমা ধাঁচ হলেও অনেক মার্জিত। মুখে পেশাদারি হাসি টেনে জিজ্ঞেস করলাম, কীভাবে সাহায্য করতে পারি?

তাঁরা জবাবে মিষ্টি হাসলেন শুধু। বলতে শুরু করলেন সঙ্গে থাকা বাঙালি ভদ্রলোক। তাঁর এক শ প্রশ্নের উত্তর একে একে দিতে লাগলাম। ফি কত, কী কী ক্লাস আছে, কদিন ক্লাস নেওয়া হবে ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি তো মনে মনে বলি এ কী কাণ্ড! আমি তো সাধারণত বাঙালি ভর্তি করি বিভিন্ন ধরনের ইংরেজি শিক্ষা কোর্সে। তবে এরা কী চান?

আবারও অবাক হওয়ার পালা। এটুকু বুঝেছি, সামনে বসা দুজন মানুষ সম্পর্কে মা ও মেয়ে। তবে, ওই বাঙালি ভদ্রলোকের সঙ্গে এই মাতা-কন্যার কিচিরমিচির ভাষার কথোপকথন, আমার এক বর্ণও বোধগম্য হচ্ছে না যে!

দোভাষীর শরণাপন্ন হলাম—এঁরা ঠিক কি বলছেন বোঝাবেন আমায়?

জানলাম, একমাত্র কন্যার মুখে ইংরেজি ফোটাতে চান মা। ঢাকা শহরের কোনো এক অভিজাত এলাকার বিশাল এক রেস্তোরাঁর চারজন মালিকের একজনের স্ত্রী তিনি। স্বামী কর্মসূত্রে বাংলায়। কন্যাটি এখন থেকে বাবা-মায়ের সঙ্গে বাংলাদেশেই থাকবে বেশ কিছুদিন। তিন ভাইবোনের সবার ছোট এ মেয়েটি সবার অসম্ভব আদরের। ভাইদের ছেড়ে বেশ কষ্টে আছে সে। ইংরেজি ওর পড়াশোনার জন্য লাগবে। আর সময় কাটানোও কারণ।

কন্যাটির চোখের কোণে অজানা আতঙ্ক। ছোট্ট প্রশ্ন ছুড়লাম—বেশ মিষ্টি তো তুমি। কী নাম তোমার? রিনরিনে কণ্ঠে জবাব এল আইশে নুর গুনেজ। আমার মনে প্রশ্ন, এ আবার কেমন নাম গো মা? কৌতূহল মেটালেন দোভাষী—আপু, ওর নামটা বাংলা করলে আয়েশা নুর দাঁড়াবে।

আয়েশা? বাহ, বেশ নাম। তা কোথায় তোমার ধাম? উত্তর এল, ইস্তাম্বুল, তুরস্ক!

এর মাঝে পাশে রাখা ফোন বেজে উঠল। জানি দাদা হয়তো এদের ব্যাপারে কিছু বলবেন। ফোন কানে তুলতেই অনুরোধ, ফাল্গু, তোমার সামনে বসা অতিথিদের আমার ঘরে পাঠাও। পেছন পেছন পায়ে-পায়ে নিজেও ঢুকে যাও।

অ্যাঁ? এখন এই কিচিরমিচিরের সঙ্গে আবার আমি কেন ভাই? কী চাই?

কোনো প্রশ্ন নয়...রুমে এসো, বুঝবে। দাদার গলার স্বরে হালকা আদেশের সুর। বুঝলাম, টুঁ–শব্দটি করা চলবে না এবার। বাধ্য বিড়ালছানার মতো ঢুকে পড়লাম ঘরে।

আমি যে প্রতিষ্ঠানের অ্যাডমিন ম্যানেজার ছিলাম, ২০০২ সালে, সেই একই জায়গা থেকেই ইংরেজির বেশ কিছু কোর্স করেছিলাম। তখন আমি একেবারেই ছোট্ট। ফ্রক পরা, দুই বেণি দোলানো, হাতে কাচের চুড়ি, পায়ে নূপুর ঘোরানো। ছোট্ট মুঠিতে আব্বুর হাত ধরে ক্লাস করতে যেতাম।

দাদার বাবা ছিলেন আব্বুর প্রায় সমবয়সী। আমি ক্লাসের ফাঁকে দূর থেকে উপভোগ করতাম ভিন্ন ধর্মের দুই সমবয়সীর নির্ভেজাল বন্ধুত্ব। ক্লাসে দাদা একদিন প্রশ্ন করে বসেছিলেন, তোমার ইংরেজি মাধ্যম না? তবে এ কাজ কেন? তোমার জন্য তো সহজ হওয়ার কথা এসব।

জানা জিনিস আবার জানতে চাই যে স্যার। জানার কোনো শেষ নাই যে স্যার! আমার ত্বরিত জবাব।

সে বয়সে ছড়া লিখতে ভালোবাসতাম, আজও বাসি। আমার কথায় খেলার ছলে বসানো এমন ছন্দের মিল uncle–এর (দাদার বাবা) কান এড়াত না। তিনি আব্বুকে উদ্দেশ করে বলতেন, আমরা না হয় সমবয়সী বন্ধু, বুঝলাম, এদের দুজনের তো বয়সের আকাশ-পাতাল তফাত। তবু কিছু কিছু ব্যাপারে এমন মিল ঘটল কী করে?

আমার এসব খেলার জবাব ভালোই জানতেন দাদা। উত্তর দিতেন পাল্টা ছন্দে। বাংলা নয়, ছোট ছোট এমন কিছু ইংরেজি ছন্দের খেলা থেকে বাকি সহপাঠীরা তখন নতুন শব্দ টুকে নিচ্ছে অর্থসহ, পড়তে পড়তেই হেসে গড়াচ্ছে সবাই, খেলায় জিতলে মিলত পুরস্কারও।

আমার আগ্রহে আব্বুও উৎসাহ পেতেন। ইশু, পড়াবি এখানে? কোনো দিন সুযোগ হলে?

আমি মনে মনে বলতাম, সে রকম ছাত্রছাত্রী পেলে কেন নয়? মুখে ফুটত, আরে বাবা আগে নিজে শিখে নিই, পরে না শেখানো। সে যাক, গল্পে ফিরি।

আমার এই শিক্ষক, চাকরিদাতা, বড় ভাই বা বন্ধু যাই বলি, তাঁকে ছোট থেকে চিনি বলেই জানি, ইনি যেমন স্নেহপরায়ণ, ঠিক তেমনি রেগে আগুন তেলেবেগুন হয়ে একমুহূর্তে ছাঁটাই করতে দ্বিধা করেন না মোটেও। তাঁর রাগ মানেই দশ নম্বর মহাবিপৎসংকেত।

আয়েশা আর তার মায়ের আরেক দফা কিচিরমিচির শুরু হলো। আমি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরেও টেনশনে ঘামছি। চোখ গেল দরজায় সাঁটানো একটা পোস্টারের দিকে। ইংরেজি পোস্টারটি বাংলা অনুবাদ করলে হয়—‘অসম্ভব বলে, আমি সম্ভব’(Impossible says: I’m possible)।

জানলাম, আয়েশার জন্য পুরুষ নয়, নারী শিক্ষিকা চাই তার মায়ের। দোভাষী জানতে চাইলেন, আপু, আপনি পারবেন?

মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। হে খোদা, এবার কী? বাঙালিদের না হয় ইংরেজি না বুঝলে বাংলা অনুবাদ করতে পারব, এর বেলা? আয়েশার যেমন এ লিখতে এলাহিকাণ্ড, আমিও যে তুর্কির ত জানি না, কী করে পার হব ভাষার হিমালয়? কোন জাদুতে?

আর এর মধ্যে দাদা বলে বসেছেন, ওকেই দেব আপনার মেয়ের জন্য। চিন্তা করবেন না মা।

আয়েশার মা তার মেয়ের জন্য এক মাসের কোর্স ফি বাবদ যে টাকার অঙ্কটি ধরালেন আমায়, তা একজন সাধারণ ছাত্রের ফির প্রায় তিন গুণ। মা–মেয়ে সদর দরজা পেরোতেই হা রে রে রে করে তেড়েফুঁড়ে উঠলাম আমি, এ কী করলেন, দাদা? আপনি জানেন না আমি কী পারি কী পারি না? দড়ি বেঁধে কুয়োয় ফেলে দিলেন যে বড়? আপনার কোনো পাকা ধানে মই দিয়েছি আমি?

ভদ্রলোক আমাকে বিপদে ফেলে দিব্যি হাসছেন দেখি। আরে আরে ফাল্গু নাই, মাথা গরম করতে নাই। অসম্ভব বলে, আমি সম্ভব! এখন তুমিও করবে, অসম্ভবকে সম্ভব। বলেছিলাম না, তোমার জন্য কাজ আছে আমার কাছে? এই কাজের কথাই বলছিলাম আমি। তুমি না পড়াতে চাও? এটা তোমার নিজস্ব ক্লাস যাও। আমাকে পাশে পাবে, তবে এই মেয়ের মূল দায়িত্ব তোমাকেই নিতে হবে।

আমার কান ভোঁ ভোঁ করছে তখন। ধুত্তরি ছাই, রঙ্গ দেখে মরে যাই, আপনার সঙ্গে কোনো কথা নাই!

হাসলেন দাদা। কথা নাই না? দেখাই যাক না! (চলবে)