ফুলের বাগান

ফুলের বাগান
ফুলের বাগান

বাংলাদেশের গ্রামীণ মানুষের সৌন্দর্যবোধ খুবই তীক্ষ্ণ। গ্রামের এমন কোনো বাড়ি পাওয়া যাবে না যে বাড়ির উঠানের কোণে ছোট একটা ফুলের বাগান নেই। এমনকি যিনি কুঁড়েঘরেও বাস করেন তাঁরও কুঁড়েঘরের কোনায় কিছু ফুলগাছ লাগানো থাকে। সেসব ফুলের সবগুলোই গ্রামীণ ফুল। শহরে এসব ফুল বিলুপ্তপ্রায়।

গ্রামীণ ফুলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুন্দর ছিল মোরগ ফুল। এটা একটা ডাঁটাগাছের মাথায় ফুটে থাকে। দেখতে অবিকল মোরগের পেখমের মতো। আরও একটা খুবই সাধারণ ফুল ছিল। নাম ঘাস ফুল। এলাকাভেদে কেউ কেউ টাইম ফুলও বলে থাকেন। এই ফুলটার বিশেষত্ব হচ্ছে, এটার যেকোনো অংশ মাটিতে পুঁতে দিলেই গাছ হয়ে যায়। এরপর সেটা ডালপালা বিস্তার করে চারদিকে ছড়াতে থাকে। সকালবেলার একটা সময়ে একসঙ্গে যখন অনেক ঘাস ফুল ফোটে তখন দেখতে ভারি সুন্দর লাগে।

গেটে আমরা লাগাতাম গেট ফুল। এই ফুলটার বিশেষত্ব হচ্ছে এটার লতানো গাছ। এই লতা বেয়ে বেয়ে বাড়িতে আগমনের গেটটাকে একসময় ঢেকে ফেলে। হঠাৎ দেখলে মনে হয় যেন শুধু ফুলগাছ দিয়েই এই গেটটা বানানো। ছোট ছোট গাঢ় লাল বর্ণের বোঁটাওয়ালা ফুল। এগুলো শতভাগ গ্রামীণ ফুল।

ময়না ফুফুর হাত ধরে আমার ফুল বাগান করার শিক্ষা। কীভাবে মাটি নিড়ানি দিয়ে ফুলের বীজ লাগাতে হয়। কখন পানি দিতে হয়। তিনি যখন ফুলের বীজ সংগ্রহের জন্য অন্য পাড়ায় যেতেন আমি ছিলাম তাঁর নিত্যসঙ্গী। তিনি বছরের একটা সময় ভিটে কুমোরের পূজা করতেন। বাড়ির বাইরে একটা জায়গায় কাদা দিয়ে খুব ছোট একটা ঘর বানাতেন। তারপর প্রতিদিন সেখানে পুজো দিতেন।

পুজো দেওয়ার প্রক্রিয়াটা আজ আর মনে নেই পুরোপুরি। আমরা শিমুলগাছের তলা থেকে ফুল কুড়িয়ে নিয়ে আসতাম। তিনি সেটা কেরোসিন বাতির ওপর ধরে গরম করতেন। এরপর সেটার ওপর আঙুল দিয়ে সেটাকে সেই ছোট ঘরটার মেঝেতে ফোঁটা দিতেন। লাল-কালো হরেক রকমের ফোঁটা দিয়ে ধীরে ধীরে ঘরটা সেজে উঠত। আমাদের আকর্ষণ ছিল পূজা শেষে তিনি যে ভোগটা দিতেন সেটার প্রতি। রাতের বেলাতেই চাল গুড়ের পানিতে ভিজিয়ে রাখতেন। পুজোর শেষে তিনি আমাদের সেটা খেতে দিতেন। গুড়ের পানিতে ভেজার কারণে চালগুলো মিষ্টি মিষ্টি লাগত।

এটা ছিল আমাদের গোঁড়া মুসলিম বাড়ির নিয়মিত একটা আচার। পুজো, ভোগ যে শব্দগুলো ব্যবহার করলাম এটা শিখেছি অনেক বড় হয়ে এবং জেনেছি এটা অন্য একটা ধর্মের আচার।

ফুলের বাগান
ফুলের বাগান

নদী যখন রাতারাতি আমাদের দেশান্তরি করে শহরতলিতে পাঠিয়ে দিল তখনো আমার মনে ফুল বাগানের স্বপ্ন রয়ে গেছে এবং হয়তো থাকবে আমরণ। উঠানের মাঝামাঝি একটা চারকোনা জায়গা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে ঘিরে সেখানে বিভিন্ন রকমের ফুলগাছ লাগিয়ে দিলাম। তাতে অনেক ফুলও ধরত। কিন্তু উঠানের মাঝামাঝি হওয়াতে বাড়ির গরু–ছাগলের হাত থেকে গাছগুলোকে রক্ষা করাই ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এটা নিয়ে প্রায়ই মায়ের সঙ্গে আমার লেগে থাকত।

সেই ছোট্ট বাগানটাতে ছিল প্রায় সব রকমের ফুলের গাছ। গাঁদা, রক্ত গাঁদা, বিভিন্ন রকমের পাতাবাহারসহ আরও অনেক ফুলের গাছ। আমার মাধ্যমিকের শরীফ স্যারের বাসায় ছিল বিরাট এক ফুলের বাগান। আমি মাঝেমধ্যেই স্যারের কাছ থেকে বিভিন্ন ফুলের চারা চেয়ে নিয়ে আসতাম। এভাবে দেখতে দেখতে আমার ছোট বাগানটুকু আমার অন্যতম খেলার সাথিতে পরিণত হয়েছিল। পরে কীভাবে সেই বাগান বিলুপ্ত হলো সেটা আজ আর মনে নেই।

বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির ছাদে বাগান করে সেই অভ্যাসটা ধরে রাখার একটা চেষ্টা চালালাম। সেটাতে আমার নিত্যসঙ্গী ছিল ছোট শ্যালিকা তান্না আর পরে তার সঙ্গে যোগ দেয় তাহিয়া। আমাদের সেই বাগানেও আমরা রাজ্যের ফুলগাছ নিয়ে এসে লাগিয়েছিলাম। এমনকি সাভারের এক নার্সারি থেকে একটা ক্রিসমাস ট্রি পর্যন্ত নিয়ে এসে লাগিয়েছিলাম। সেটা হয়তো এত দিনে বেশ বড় হয়ে গেছে।

আমাদের সেই বাগানের ফুল দিয়ে আমরা একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করতাম। কাগজের তৈরি শহীদ মিনার আর আমাদের নিজেদের গাছের ফুল বাড়তি হিসেবে খুব ভোরে আমি আর তাহিয়া বের হয়ে পড়তাম শিমুল ফুলের খোঁজে। সেটা ছিল খুবই ছোট একটা শহীদ মিনার। কিন্তু আমরা পরিপূর্ণ সম্মান দিয়ে পালন করতাম। আমরা সবাই খালি পায়ে একে একে শহীদ মিনারে ফুল দিতাম। তারপর আমরা সেটা সারা দিন ওভাবেই রেখে দিতাম।

দেশান্তরি হওয়ার পর ফুলের প্রতি ভালোবাসা আরও কয়েক গুণ বেড়ে গেল। এর কারণ এখানকার প্রকৃতি। এখানে বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন রকমের ফুল ফোটে। ঠিক যেমন গ্রামবাংলায় ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি রং বদলায়। এ ছাড়া সবাই নিজের বাড়ির আঙিনায় বিভিন্ন রকমের ফুলের বাগান করেন ঠিক গ্রামবাংলার মানুষের আদলে।

আমরা যেহেতু ভাড়া বাসাতে থাকতাম সেখানে বাগান করতে হলে বাজার থেকে টব কিনে আনতে হবে। সেটা সমস্যা না। সমস্যা হচ্ছে সেটা কোথায় রাখা হবে। তারপরও একটা গাঁদা ফুলের টব কিনে নিয়ে এসে বাসায় ঢোকার দরজার পাশে রেখে দিলাম। কিন্তু এভাবে টবে বাগান করে আসলে সাধ মেটে না। তাই একদিন বাসার মালিক দেব দাকে সব লজ্জা ঝেড়ে ফেলে বলেই ফেললাম, ‘দাদা, আমরা কি এখানে ফুলের গাছ লাগাতে পারি? দাদা খুশি হয়ে বললেন, অবশ্যই। আমিই লাগাতাম, কিন্তু এত ব্যস্ত থাকি যে আর সময় করে উঠতে পারি না।’

আর আমাদের পায় কে। গিন্নি পাশের এক বাসা থেকে বেশ কিছু কসমস ফুলের চারা নিয়ে এল। আমি আর তাহিয়া মহা উৎসাহে সেগুলো রোপণ করতে লেগে গেলাম। এরপর প্রতিদিন সকাল–বিকেল রুটিন করে কখনো আমি কখনো গিন্নি আবার কখনো তাহিয়া ফুলের গাছে পানি দিতাম। আর সপ্তাহান্তে আমি অথবা গিন্নি নিড়ানি দিয়ে ঘাসগুলো তুলে ফেলতাম। দেখতে দেখতে গাছগুলো বেড়ে উঠল। কিন্তু তত দিনে আমাদের বিদায়ের ঘণ্টা বেজে গিয়েছে। নতুন বাসায় আসার পরও মাঝেমধ্যেই আগের বাসার সামনে ঢুঁ মারতাম শুধু ফুলগাছগুলোকে দেখার জন্য। ফুলগাছগুলোতে ফুল ফুটতে দেখে আমি আর তাহিয়া অনেক আনন্দ পেয়েছিলাম।

বর্তমানে যে বাসায় আছি সেই বাসার কর্তাও অনেক শৌখিন মানুষ। তিনি নিজেই এক বিশাল ফুলের বাগান করে রেখেছেন। সারা বাড়ি বিভিন্ন রকমের গোলাপ ফুলের গাছ দিয়ে ঘেরা। একসঙ্গে যখন সবগুলো গাছে ফুল আসে সেটা একটা নয়নাভিরাম দৃশ্য তৈরি করে। কত রকমের গোলাপ যে আছে তা গুনে শেষ করা যাবে না।

এ ছাড়া আরও অনেক রকমের ফুলগাছ আছে। আরও আছে মরিচগাছ, পেয়ারাগাছ, লেবুগাছ। শত অসুস্থতাও তাঁকে তাঁর বাগান থেকে দূরে রাখতে পারে না। এটা নিয়ে গৃহকর্ত্রীর সঙ্গে লেগেই থাকে। আমরা অবশ্য তাঁদের এই খুনসুটি খুবই উপভোগ করি। আমি আমার এই একজীবনে এমন শিশুর মতো কোমল মনের বাঙালি দ্বিতীয়টি দেখিনি।

যাহোক এত দিনে এমন একজন বাড়িওয়ালা পেয়ে আমরা যারপরনাই আনন্দিত হলাম। আমরা নিজেদের সুখের জন্যই মাঝেমধ্যে ফুলের গাছে পানি দিই, আগাছা বাছি। গৃহকর্তা ও কর্ত্রী অনেকবার নিষেধ করেছেন। কিন্তু আমাদের আসলেই অনেক ভালো লাগে কাজগুলো করতে। এ ছাড়া আমরা নিজেরা কিছু ফুলের গাছ লাগিয়ে দিলাম। এখন কসমসগুলোতে ফুল এসেছে, ঘাস ফুলের গাছগুলোতেও অনেক ফুলে ধরেছে। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে এখানকার ঘাস ফুল শুধুই লাল নয়, হলুদও হয়।

সুন্দর কোনো কিছুর প্রতি মানুষের ভালো লাগা চিরন্তন। সেই জন্যই হয়তোবা মানুষ ফুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়। ফুলের বাগান করে মনের সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তোলে বা তার প্রকাশ ঘটায়। আমার মনে হয় আমরা যদি খুব ছোটবেলা থেকে আমাদের বাচ্চাদের এমন কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত করতে পারি, তাহলে তাদের মনের বিকাশ হবে খুবই স্বাভাবিক ও দ্রুত।

আমি যখন আগাছা পরিষ্কার করি তখন আমার দেড় বছরের ছেলে রায়ান এসে আমার সঙ্গে হাত লাগায়। তাহিয়া ঘাসগুলোকে একত্র করে রাখে। কোন দিন কোন নতুন ফুল ফুটল সেটা তাহিয়া খেয়াল করে। অফিস শেষে বাসায় ফেরার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে সেই খবর দেয়। তখন তার চোখে–মুখে এক অপার্থিব আনন্দ খেলা করে। আমি দেখি আর মনে মনে হাসি। এটা ঠিক যেন আমার শৈশবের সেই গ্রামের বাড়ির দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি। পৃথিবীর সব শিশু বেড়ে উঠুক ফুলের মতো কোমল মন নিয়ে। কারণ, একটু বড় হয়ে গেলেই তো তাকে ব্যস্ত রাখার জন্য হাজারো উপকরণ আমরা তৈরি করে রেখেছি আগে থেকেই। অন্তত শৈশবটা কাটুক একটু ঢিলেঢালাভাবে।