মানসাংক

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

তাহদিয়া বড্ড ঝামেলায় আছে। অনেক চেষ্টা করেও সে হিসাব মেলাতে পারছে না। দুই আর দুই যোগে যে চার হয় কিংবা এক শ থেকে আশি বিয়োগ দিলে যে বিশ হয়, সে তো ছোটবেলাতেই মা বেশ করে শিখিয়ে দিয়েছিল। ভাইয়া তার চেয়ে ছয় ক্লাস ওপরে পড়ত। সব সময় সে নামতা মুখস্থ করতে সাহায্য করত তাহদিয়াকে। তারপরও ছিল স্কুলের মিস। কঠিন কঠিন সব লসাগু, গসাগু এক নিমেষে সমাধান করে দিত। তাহদিয়া সব সময়ই প্রথম সারির ছাত্রী ছিল। তাহলে এখন স্কুল-কলেজ-ভার্সিটি সব পাস দিয়ে এ রকম হাবা গঙ্গারাম হয়েছে কেন সে? সামান্য হিসাব মেলাতে পারছে না।

সমস্যার শুরু হয়েছিল ছেলেবেলাতেই। কিন্তু তাহদিয়া সেটা টেরই পায়নি। সমস্যাকে কেউ যখন জীবনের স্বাভাবিকতা হিসেবে ধরে নেয়, তখন সেটার সমাধান করাটা দুরূহই বটে। নানি খুব শখ করে আরবি-বাংলা অভিধান ঘেঁটে, দুজন হুজুরের সঙ্গে সলাপরামর্শ করে নাম রেখেছিলেন তাহদিয়া। তাহদিয়া শব্দের অর্থ যে শান্তি আনে। বাবা-মাও নাম নিয়ে বেজায় খুশি। একে তো আরবি সুন্দর নাম রাখাই চলতি, তার ওপর এত চমৎকার অর্থ। দুই-দুইটা ছেলের দুষ্টুমিতে তাঁদের জীবন অতিষ্ঠ। শান্ত মিষ্টি তাহদিয়া তাদের জীবনে বসন্ত-বিকেলের বাতাসের মতো পরশ বোলাল।

তাহদিয়া অবশ্য তার নামের অর্থ নিয়ে ছোটবেলায় বেশি মাথা ঘামায়নি। দুই ভাইয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তার দুষ্টুমিতেও বাড়ি থাকত উত্তাল। তবে ছয়-সাত বছর বয়স থেকেই সেটা কমে গেল। কথায় কথায় মা বলতেন, ‘কী নাম রাখল যে আম্মা, এত হাড় জ্বালানি মেয়ের নাম তাহদিয়া হয়?’ বাবা মাথায় হাত বোলাতেন, ‘মারে, মেয়েদের এত চঞ্চল হতে হয় নারে মা, খুব সমস্যা হবে।’

তাহদিয়া বাবা-মা-ভাইদের ছাড়া জীবন কল্পনাই করতে পারে না। সুতরাং নামের সঙ্গে সংগতি রেখে সে ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে গেল। তবে শুধু বাবা-মায়ের কথায় সে শান্ত হয়ে গেল, এ রকম ভাবাটা অত্যন্ত অন্যায়। আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী এমনকি তার দুই ভাইও তাকে খুব করে বুঝিয়ে শান্ত করল।

তারপরও মনের ভুলে মাঝে মাঝে সে ঝামেলা করে ফেলত। ক্লাস ফোরে পড়াকালে একদিন পাশের বাসার ক্লাস সিক্সে পড়া ছেলেকে ধরে দিয়েছিল পিটুনি। একেবারে কুংফু স্টাইলে। চারজন বাচ্চা সাক্ষী দিয়েছিল, সেই ছেলে নাকি একেবারে উড়ে গিয়ে পাঁচ হাত দূরে পড়েছিল। পিটুনি দেওয়ার কারণ হচ্ছে ওই ছেলে তাহদিয়া আর তার বান্ধবীর চুল টেনেছিল।

ফ্ল্যাট বাড়িতে আলোড়ন সৃষ্টি করা সেই ঘটনার সমাপ্তি হয়েছিল খুবই যোগ্যভাবে। ছেলের বাবা-মা তাহদিয়াদের বাসায় এসে ‘কী ডাকাত মেয়ে রে বাবা’ বলে বেশ চেঁচিয়ে গেলেন। তাহদিয়ার আব্বা-আম্মা মাথা নিচু করে শুনে গেলেন আর সরি বললেন। তাঁরা বিদায় হওয়ার পর পারিবারিক সভা বসানো হলো। প্রথমে রাগারাগি ও পরে আদর করে তাহদিয়াকে বোঝানো হলো, মারামারি করতে হয় না, বিশেষ করে ছেলেদের সঙ্গে তো একেবারেই না। দোষ যারই হোক। এ রকম কিছু হলে বাবা-মাকে জানাতে হবে। তাঁরাই ব্যবস্থা নেবেন।

পরের সপ্তাহেই সেই ছেলে তাহদিয়ার সাধের সাইকেল ভেঙে দিল প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। তাহদিয়া চাইলেই ছেলের সাইকেল ভেঙে দিতে পারত। কিন্তু সে তা না করে কাঁদতে কাঁদতে এসে বাবা-মাকে নালিশ করল। তার কান্না দেখে বাবা নতুন পেনসিল বক্স কিনে দিলেন, বড় ভাইয়া কমিকস এনে দিল আর মা আনন্দিত স্বরে বললেন, ‘বেশ হয়েছে। অনেক দিন থেকেই ভাবছিলাম সাইকেলটা ফেলে দিতে হবে। ডেঞ্জারাস রাস্তাঘাট, সাইকেল না চালানোই ভালো।’ কিন্তু কেউই সেই ছেলের বাসায় যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করল না। বাচ্চা ছেলেরা একটু–আধটু দুষ্টুমি করেই। সে জন্য কেউ নালিশ করতে যায় নাকি? শুধু মেজ ভাই সান্ত্বনা দিল, সে গিয়ে ছেলের বারোটা বাজিয়ে আসবে। তারপর একসময় তাহদিয়াও ভুলে গেল সাইকেলটার কথা।

স্কুলের ভলিবল টিমে চান্স পেয়েছিল তাহদিয়া। ফুফু এসে বাগড়া দিলেন। বেশ করে বাবা-মাকে বুঝিয়ে বললেন যেসব মেয়েরা লাফালাফি করে তারা গেছো বান্দর হয়, বড় হলে বিয়ে হয় না। মা আঁতকে উঠে খেলা বন্ধ করে দিলেন। এক আত্মীয় কথা বললে অন্যরাও কথা বলবে।

ক্লাস নাইনের লাজুক চেহারার এক ছেলে একটা চিঠি কোন ফাঁকে ব্যাগের পেছনে ঢুকিয়ে গেল তাহদিয়া টেরই পায়নি। সেই চিঠি পড়ল মায়ের হাতে। নিউটনের তৃতীয় সূত্র মেনে তাহদিয়ার বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে খেতে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। তাহদিয়ার মা দশ রকমের নাশতা বানিয়ে বাসায় মেয়ের বন্ধুদের ডাকলেন যাতে মেয়ের মন খারাপ না হয়। কিন্তু ঝিমলি, ঊর্মি আর বুশরাদের সামনে মুখটা ছোট হয়েই রইল মেয়ের।

তাহদিয়ার বাবা-মা পড়াশোনার ব্যাপারে বেশ সিরিয়াস ছিলেন। বিশেষ করে সায়েন্সের বিষয়গুলোতে তাহদিয়া খুব ভালো হওয়ায় তার বাবা ভাবলেন মেয়েকে পদার্থবিজ্ঞানে পড়িয়ে বিজ্ঞানী বানাবেন। তবে মায়ের ইচ্ছা অন্য রকম। ডাক্তার না হলে মেয়েদের নাকি মানায় না। বিজ্ঞানী তো হবে আউলা চুলের বাউলা ছেলেরা। সাদা অ্যাপ্রোন আর গলায় স্টেথো নিয়ে তাহদিয়াকে কী সুন্দরটাই না লাগবে। ভাইয়া হইচই করল বুয়েটের জন্য। তার নিজের ভার্সিটিতে বোনকে আনার জন্য কোচিংয়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রাইভেট টিউটরেরও খোঁজ নিয়ে ফেলল।

সবার মুখ রক্ষার্থে তাহদিয়া সবকিছুতেই চান্স পেয়ে বসে রইল। তার বাবা ঢাকা শহরের সবাইকে মিষ্টি খাওয়ানো শেষ করে জেলা শহরের আত্মীয়দেরও মিষ্টি পাঠাতে লাগলেন। সে মাসে ফোনের বিল এল দ্বিগুণ। তাহদিয়ার মা তার লতায় পাতায় পরিচিতদেরও ফোন করে এক ঘণ্টা ধরে গল্প করলেন মেয়ের ভালো রেজাল্টের খবর দিতে গিয়ে। এলাকার মায়েরা তাঁদের এইচএসসি পড়ুয়া বাচ্চাদের ধরে নিয়ে এলেন তাহদিয়ার পানি পড়া নেওয়ার জন্য। অনেক তর্কবিতর্ক আর মিটিংয়ের পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো তাকে ডাক্তারই বানানো হবে। ওটাই মেয়েদের জন্য সবচেয়ে ভালো। তাহদিয়ারও আপত্তি ছিল না। ডাক্তার হয়ে যদি একটু মুক্ত শ্বাস নেওয়া যায়, ক্ষতি কী?

হঠাৎ ফুপুর গলা শুনে তাহদিয়ার হিসাবের খাতায় আরেকটা ঢ্যাঁড়া পড়ে। বেশ ক্ষুব্ধ গলায় ফুফু বলছেন, ‘এই বিয়ে দেওয়াই ঠিক হয়নি। আমি আগেই বলেছিলাম।’ তাহদিয়া ভীষণ অবাক হয়ে ফুফুর দিকে তাকিয়ে থাকে। হিসাব মিলছে না। এই বিয়ের সম্বন্ধ যখন এসেছিল তখন ফুফুই তো সবচেয়ে বেশি সমর্থন দিয়েছিলেন। ছেলের বাবার ঢাকায় তিনখানা বাড়ি, দেশের বাড়িতে একরে একর জমি। ছেলের মা দামি ব্র্যান্ড ছাড়া কোনো জিনিস ব্যবহার করেন না। ছেলে বুয়েট থেকে পাস করা ইঞ্জিনিয়ার।

ফুফু বলেছিলেন একমাত্র পাগলেই এই সম্বন্ধকে না বলবে। তাহদিয়ার বাবা-মা-ভাই কেউ পাগল নয়। তাই কেউ না বলেনি। ছেলের সঙ্গে দুই দিন বাইরে বেড়িয়ে তাহদিয়া বলেছিল, ‘ছেলেটা যেন কেমন, ভালো লাগছে না। এই ছেলেকে বিয়ে করব না।’ তার ফুফু বিরক্ত গলায় বলেছিলেন, ‘তবে কি তুই আশা করিস যে তোর জন্য আকাশ থেকে ছেলে আসবে? রাজপুত্রও তো তোর পছন্দ হচ্ছে না।’ মা রাগ করে খাওয়া বন্ধ করে দিলেন। বাবা মাথা চুলকে বললেন, ‘কেমন-কেমন আবার কী?’ ‘কেমন-কেমনের’ সংজ্ঞাটা মুখে এলেও তা বলতে না পারায় তাহদিয়া কিন্তু কিন্তু মনেই বিয়ে করে ফেলল। আসলেই তো, আর যদি ছেলে না পাওয়া যায়? বান্ধবীদের সবার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। লোকে কী বলবে?

ফুফুকে কড়া একটা উত্তর দেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও তাহদিয়ার মুখ দিয়ে কিছু বের হলো না। আজীবনের ভদ্রতা বাধা দিল। তার ওপর মা এমনিতেই কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন। তাহদিয়া কিছু বললে সবাই মাকেই দুষবে। মাকে কষ্ট দিতে ইচ্ছে করছে না। যদিও মার ওপরও তার রাগ কম নয়। তার মা হিসাবে বিশাল গরমিল লাগিয়েছেন। কিছুক্ষণ আগে কাঁদতে কাঁদতে বলেছেন, ‘আমাকে বললি না কেন তুই? কেন লুকিয়ে রাখলি এত দিন?’

তাহদিয়া এতটাই অবাক হয়েছে যে কিছু না বলে হতাশ চোখে তার মায়ের দিকে তাকিয়েছিল। আরমান যেদিন তাকে প্রথম চড়টা মেরেছিল সেদিনই সে কাঁদতে কাঁদতে তার মাকে ফোন দিয়েছিল। সবকিছু শুনে তার মা বলেছিলেন, ‘তুই একটু সামলে কথা বলবি না?’

তাহদিয়া দুঃখ আর অপমান ভুলে অবাক হয়ে কান্না থামিয়েছিল। ‘আমি?’

‘হ্যাঁ তুই। ছেলে কাজ থেকে বাসায় ফিরেছে, তোকে না দেখলে মেজাজ তো খারাপ হবেই। একে দেরি করে ফিরেছিস তার ওপর তর্ক লাগিয়েছিস?’

‘গাইনির ট্রেনিংয়ের অবস্থা জানো তুমি আম্মা? বিকেলে কী জ্যামটা থাকে রাস্তায়। আমি তো ইচ্ছে করে দেরি করিনি। আর সে তো জেনেশুনেই ডাক্তার বিয়ে করেছে।’

‘সে তো বুঝতে পারছি রে মা। কিন্তু সংসার এত সহজ না। সংসার করতে গেলে স্যাক্রিফাইস করতে হয়। সবাই করে রে মা।’

‘আম্মা তাহলে আমাকে কী করতে বলো তুমি? ট্রেনিং ছেড়ে দেব? আমি তো গাইনিতে ক্যারিয়ার করতে চাইনি। তোমরাই তো জোর করলে যে মেয়েরা গাইনিতে গেলেই ভালো।’

‘না, তা ছাড়বি কেন! একটু কাজ কমিয়ে দে। সবদিকই তো সামলাতে হবে।’

অপমান ভুলে সবদিকে সামলাতে গিয়ে নাভিশ্বাস অবস্থা হয়েছে তাহদিয়ার। হাসপাতালে ম্যাডাম-স্যারদের ভ্রুকুটি, কলিগদের বিরক্তি আর বাসায় থমথমে পরিস্থিতি। তিন মাস পর তো ট্রেনিং সে ছেড়েই দিয়েছিল অন্তত একদিকে পরিপূর্ণ হওয়ার আশায়। তাতেও কী কোনো লাভ হয়েছিল?

বাহুতে কারও কাপড়ের স্পর্শ পেয়ে তাহদিয়া আড়চোখে দেখল। তার বান্ধবী রুনি। তাহদিয়া মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ঠিক সময়ে কেউ পাশে থাকুক আর না থাকুক, সান্ত্বনা দেওয়ার মানুষের অভাব নেই। যা ভাবা তা–ই। তাহদিয়া শুনল রুনি ফিসফিস করে তার কানের কাছে বলছে, ‘আমাদের আগে বলবি না এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে?’ রুনি আর সে মেডিকেল কলেজের বন্ধু। ১২ বছরের বন্ধুত্বকে অচেনা মনে হয়েছিল যখন রুনি তাকে এক সন্ধ্যায় জোর করে বাসায় দিয়ে গিয়েছিল। আর এখন যখন আরমানের সঙ্গে ছাড়াছাড়ির সবকিছু সে পাকাপোক্ত করে ফেলেছে, তখন সে বলছে কেন তাহদিয়া তাকে জানায়নি!

ঠিক নয় মাস আগে এক সন্ধ্যায় তাহদিয়া রুনির বাসায় উদ্‌ভ্রান্তের মতো হাজির হয়েছিল। ট্রেনিং ছেড়ে দেওয়ার পর মনটাও মরে গিয়েছিল। উঠতে বসতে ‘তুমি তো কিছুই করো না’, ‘বসে বসে অন্ন ধ্বংস করো আরও’, ‘কিছুই না করলে অন্তত বাচ্চা নাও’ এসব কথায় অস্থির হয়ে উঠেছিল সে। পলিসিস্টিক ওভারি আছে ঠিক তখনই ধরা পড়ায় পরিস্থিতি আরও গম্ভীর। ডাক্তার হয়েও সে কেন নিজের রোগ ধরতে পারল না? ইঞ্জিনিয়ার ননদ ফোড়ন কাটে, তবে কী নকল করে পাস করেছে তাহদিয়া? আরমান বিরক্ত। শোনা যাচ্ছে এই রোগ ট্যাবলেট খেলেই সাত দিনে সারার মতো না। বাচ্চাকাচ্চাও নাকি হওয়া সমস্যা। সেদিন সন্ধ্যায় তাহদিয়া তাঁর চরিত্রের একদম বিপরীতে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিল। আরমান পরে কসম কেটে বলেছে, সে নাকি দেয়ালের উদ্দেশে চায়ের কাপটা ছুড়ে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু তা লক্ষ্যচ্যুত হয়ে লেগেছিল তাহদিয়ার কপালে।

ওড়না চাপা রক্তাক্ত কপালটা দেখে রুনি শিউরে উঠেছিল বটে, তবে তাতে কষ্টের চেয়ে আশঙ্কা ছিল বেশি। তাহদিয়া যে আর ফিরে যায়নি। সমাজে একা থাকার চেয়ে তো মরে যাওয়া ভালো, একি বিদেশ? অনেক বুঝিয়ে রুনি তাহদিয়াকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছিল। আরমানের অপরাধী মুখ দেখে রুনি ফিসফিস করে বলেছিল, ‘মানুষ কি ভুল করে না! যে তার ভুল বুঝতে পারে সেই প্রকৃত মানুষ। তুই একটু মানিয়ে নিতে পারবি না? আর খবরদার কাউকে এসব বলিস না কিন্তু।’ নাহ, আসলে তাহদিয়ারই ভুল। পারিবারিক সহিংসতা যে একটি লজ্জার ও গোপনীয় বিষয় সেটা সে কেন বুঝতে পারল না?

দীর্ঘদিন পর তাহদিয়ার কাছে অনেক মানুষ এসেছে। ছাড়াছাড়িও বিয়েশাদির মতোই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। পার্থক্য হচ্ছে বিয়েবাড়িতে সবাই সেজেগুজে আনন্দ–ফুর্তি করতে যায়। আর এখানে নিস্তব্ধতার ফাঁকে ফাঁকে ফুঁপিয়ে কান্না।

মেজ ভাই আমেরিকা থেকে আসতে পারেননি, বড় ভাইয়া ভীষণ খেপেছেন। তাহদিয়াকে ধরে তিনি শক্ত ঝাঁকুনি দিলেন, ‘হারামজাদার এত বড় সাহস আমার বোনের গায়ে হাত তোলে! মাটিতে গেঁথে ফেললি না কেন তুই শয়তানটাকে?’ এত দুঃখের মাঝেও তাহদিয়া হেসে ফেলল। তাহদিয়া আরমানকে মাটিতে গেঁথে ফেলবে? গাউছিয়াতে একবার ভাইয়া তাহদিয়া আর তার বান্ধবী আয়েশাকে ইদের বাজার করতে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে এক লোক বিশ্রীভাবে তাহদিয়ার গায়ে হাত দিচ্ছিল। তাহদিয়া ভয়ে গুটিয়ে যাচ্ছিল। প্রতিবাদ করতে না শেখায় কিছু বলতেও পারছিল না। হঠাৎ আয়েশা টের পেয়ে লোকটার শার্ট খামচে ধরে হইচই শুরু করেছিল। সে লোককে পুলিশে দেবেই। তখন ভাইয়াই তো সর্বাগ্রে গিয়ে লোকটাকে চলে যেতে দিয়েছিল। মাঝখান থেকে আয়েশার সঙ্গে বন্ধুত্ব গেল ভেঙে। তা অবশ্য এমনিতেই ভাঙত। কারণ বাসায় ফিরেই ভাইয়া বলল, ‘তোর বান্ধবী তো সুবিধার না! এভাবে কেউ হইচই করে? মেয়েদের একটু শান্ত থাকা ভালো। কী এমন হয়েছে যে পাড়া জাগাতে হবে? ওর সঙ্গে আর মিশিস না।’ আর আজকে ভাইয়া কী চমৎকারভাবে সুর বদলে ফেলল।

শুধু বাবা আজ কিছু বলছেন না, তাহদিয়ার দিকে তাকাচ্ছেনও না। মুখ নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে আছেন। তাহদিয়ার বুক ফেটে কান্না এল, বাবা কী কাঁদছেন? ভীষণ ইচ্ছে হলো তাহদিয়ার বাবার হাতটা ধরতে। ঠিক তখনই ফুফার গলাখাঁকারি শোনা গেল, ‘দেখেন ভাইসাহেব, আপা, অনেক সময় তো পার হয়ে গেল। এখন আমাদের কাজ শুরু করা দরকার। কাজ তো কম নয়। মৌলভি ডাকতে হবে, গোসলের ব্যাপার আছে। আমি গাড়ির ব্যবস্থা করি, তাহদিয়াকে আপনাদের বাসায় নিয়ে যাওয়া দরকার।’

ভাইয়া দাঁড়িয়ে গেলেন। ‘কিন্তু ফুফা, অনীক তো এখনো রওনাই দেয়নি। ও কি তাহদিয়াকে দেখবে না? বারডেমে কথা বললে হয় না?’

ফুফু মাথা নাড়েন, ‘এখন যেটা দরকার তাহদিয়ার সেটা হচ্ছে দোয়া। বারডেমে রেখে তুই বোনটাকে কষ্ট দিবি?’

ভাইয়া আরও কিছু কথা বলল। তাহদিয়া ইচ্ছে করে কান বন্ধ করে ফেলল। আর শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে না এসব তর্ক-বিতর্ক। গত এক বছরে মেজ ভাইয়ার একটা সেকেন্ড সময় হয়নি ফোন করে খবর নেওয়ার। আজ কেন তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে সে হিসাব মেলানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে লাভ নেই। তাহদিয়া ছোটবেলার মতো আর মানসাংকে পাকা নেই।

সময় গড়িয়ে যায়। তর্ক স্তিমিত হয়। কান্নার শব্দ থেমে যায়। শুধু ঘড়ির কাঁটা ক্রমাগত শব্দ করে চলে টিক টিক টিক টিক।

শেষ পর্যন্ত সবাই একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। আর দেরি করা চলে না। মৃতদেহ এভাবে ফেলে রাখলে আত্মার কষ্ট হয়। শান্ত মেয়েটিকে আর কষ্ট দিতে আর কারও মন সরে না। তাহদিয়া শান্তির নিশ্বাস ফেলে। খেলা তো সাঙ্গ হয়েছে অনেক আগেই, তবে এখন কেন মিছে অভিনয়?

হঠাৎ সবকিছু ছাপিয়ে তাহদিয়া তার বাবার গম্ভীর কণ্ঠ শুনতে পায়, ‘না।’

চারদিক শান্ত নিস্তব্ধ হয়ে যায় এক নিমেষে। না? এই না-এর অর্থ কী? কেউ একজন অনুচ্চ কণ্ঠে প্রশ্নটি করে ফেলে।

‘না অর্থ হচ্ছে না, আমার মেয়ে এখনই কবরে ঢুকবে না। ইমন, পুলিশে ফোন দে।’

ভাইয়া হতভম্ব হয়ে ভাবির দিকে তাকায়। ভাবি তাকায় মার দিকে। মা মুখ থেকে আঁচল সরান। ‘তুমি এসব কী বলছ? পুলিশ ডাকবে মানে? আমার মেয়ের সম্মান নাই? ওরা এসে আমার মেয়েকে মর্গে পাঠাবে, কাটাছেঁড়া করবে। আমি প্রাণ থাকতে আমার মেয়ের সঙ্গে এসব হতে দেব না।’

‘তাহলে আমার মেয়ের মৃত্যুর জন্য তোমাকেও দায়ী করে মামলা করব। যে আমাকে বাধা দেবে, তারই নাম মামলায় আসামি হিসেবে যাবে।’

ভাইয়া আবারও চেষ্টা করে, ‘আব্বা, আপনি বুঝতে পারছেন না। তাহদিয়া আত্মহত্যা করেছে। এখানে পুলিশ এলে ঝামেলা বাড়বে বৈ কমবে না। আরমান বা ওর পরিবারের কোনো দোষ প্রমাণ হবে না। আইনজীবী এসে তাহদিয়ার নামে সম্ভব অসম্ভব সব মিথ্যা কথা বলবেন, পত্রিকায় নিউজ হবে। আমরা সমাজে মুখ দেখাতে পারব না। আমরা যা–ই করি, তাহদিয়াকে তো আর ফিরে পাওয়া যাবে না।’

তাহদিয়া খুব আগ্রহ নিয়ে তার বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে। বাবাও তো শান্ত মেয়ে ভীষণ পছন্দ করে। বাড়তি ঝামেলা একদম পছন্দ করেন না। এখন বাবা কী বলবেন?

‘তাহদিয়া যে আত্মহত্যা করেছে তার প্রমাণ কী? আমার মেয়ের কপালে তাহলে এটা কিসের রক্ত? তার বাহুতে কিসের কালশিটে দাগ?’ একটু দম নিয়ে আবার তিনি বলে চলেন, ‘আমি চাই আমার মেয়ের ময়নাতদন্ত হোক। যদি এটা আত্মহত্যাও হয়, আমি চাই যে তাকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিয়েছে, তার শাস্তি হোক। আমি ভুল করেছি। তোমাদের সবাইকে ভুল করতে দিয়েছি। ছোটবেলাতেই যদি সেই সাইকেল ভাঙা ছেলেটির বাবাকে আমি প্রতিবাদ জানিয়ে আসতাম, তবে আমার মেয়ে তার সঙ্গে যা যা হয়েছে, সেসব কিছুই লুকাত না। তাকে বাসায় বসে থাকার জন্য উৎসাহ না দিয়ে যদি বাইরে যেতে দিতাম, তবে তার সাহস বাড়ত। তাকে অন্যায় লুকানোর শিক্ষা না দিয়ে যদি প্রতিবাদ করার শিক্ষা দিতাম, তবে আমার মেয়ে আজকে মাটিতে শুয়ে না থেকে আমার জন্য প্রতিবারের মতো শরবত বানিয়ে এনে পাশে বসে থাকত।’

কথা বলতে বলতে আনোয়ার সাহেব ফুঁপিয়ে ওঠেন, ‘আমি এসব আমার তাহদিয়ার জন্য করছি না। আমি আমার দোষে মেয়েকে হারিয়ে ফেলেছি। আমি এসব করতে চাই যাতে আর কোনো বাবা তার তাহদিয়াকে না হারায়। ইমন, পুলিশে খবর দে। আর কেউ যেন তাহদিয়াকে স্পর্শ না করে। পুলিশ আসার আগে কেউ কোনো কিছু স্পর্শ করবে না।’

কেউ টের পেল না, শান্ত একটা মেয়ের অশান্ত মন হঠাৎ করে প্রথমবারের মতো নিঝুম গাঁয়ের প্রান্তে অবস্থিত ভুলে যাওয়া পুকুরের পাড়ে বসা চুলে দুই বেণি করা কিশোরীর মতো প্রশান্তিতে ভরে গেল; স্মিত হাসিতে উজ্জ্বল সে মুখের প্রতিবিম্ব ফুটে উঠল পুকুরের ধীরস্থির সবুজ জলে। তারপরও কেন যেন চোখের কোণে বাষ্প জমে। তাহদিয়া জোর করে বাষ্প সরানোর চেষ্টা করে। আর তাহদিয়া কাঁদবে না, কখনো না।
...

সামারা তিন্নি: ভিক্টোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া।