ভিনদেশি তারা-দুই

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

কিছুটা নিমরাজি হয়েই আয়েশার ক্লাসে ঢুকলাম। গোলাপি টপ আর সাদা প্যান্টে বেশ লাগছিল। চুলগুলো উঁচু করে ঝুঁটি বাঁধা। মায়াভরা মুখটাতে রাজ্যের বিষণ্নতা।

: বাহ, একদম পুতুল লাগছে তোমায়, বার্বি পুতুল, মাশ আল্লাহ।

: এলো (Hello) ফাগুনই আবু...কেমন আছ?

হালকা চমকালাম। আবু নয় সোনা, আপু। It’s not a B, it is a P. আয়েশা মাথা নাড়ল, বুঝেছি। ‘আপু মানে কী বল তো? তুমি অবশ্য আমাকে চাও তো মিস বলতেও পারো। আর ফাগুনই নয়, ফালগুনী। বলতে বলতেই চুলগুলো ঘেঁটে দিলাম একটু। উদ্দেশ্য, ওকে নিজের সঙ্গে কিছুটা স্বচ্ছন্দ করা। যাতে তার ভেতর কোনো ধরনের হীনম্মন্যতা কাজ না করে। নিজেকে ওর জায়গায় ফেলে চিন্তা করার চেষ্টা করলাম। ওর বয়সটা ফেলে এসেছি খুব বেশি দিন হয়নি। এ বয়সী আমি কী করতাম এমন ভিনদেশ, ভিন্ন ভাষার অথই সাগরে পড়লে?

এবার আমার প্রশ্নের জবাব এল—আবু...আবু...না, না, আপু। আপু মানে আব্লা!

আব্লা? আমি এবার হলাম ক্যাবলা। মানে কী?

Turkey…B sista…Abla.

প্রথম ক্লাসে শেখানোর আগে নিজেই শিখলাম নতুন কিছু। তুর্কি ভাষায় বড় বোনকে আব্লা বলে। বেশ।

ওর জন্য আমাকে দেওয়া হলো রংচঙে শিশু শ্রেণির বই। দেখলাম, ইংরেজি অনেক অক্ষরের উচ্চারণে ভুল আছে। কিছু অক্ষর জানাও নেই তার। মাত্র ১১টা অক্ষর জানে সে। পড়তে পড়তেই চোখে জল, ‘আপু, আমি যে জানি না...I no no Inglizze (I don’t know English). You…you min (Do you mind)?

আমার মাথায় তখন ঘুরছে সেই পোস্টার। অসম্ভব বলে, আমি সম্ভব। আয়াতুল কুরসি পড়ছি মনে মনে, ‘আল্লাহ, পথ দেখাও!’

আমাদের ক্লাসটার দরজা খোলা ছিল। পাশের ঘরে অন্যদের ক্লাস চলছিল। আমরা যেখানে বসেছিলাম, অন্য ছাত্ররাও দেখতে পাচ্ছিল আমাদের। আচমকা একজনের কথা কানে এল—‘imported মাল...। জসসস তো, আইল কবে রে?’

কণ্ঠটা পরিচিত। এ ছেলেকে কিছুদিন আগে আমিই ভর্তি করেছি অন্য একটি কোর্সে। অশ্লীল ইঙ্গিতটা কার প্রতি করা আমার বুঝতে বাকি রইল না। ইচ্ছে করছিল, চাবুকে পিঠের চামড়া তুলে নিই। আমি এমনিতে শান্ত। রেগে গেলে এই আমিই ভয়ংকর কালবৈশাখী। অনেক কষ্টে সামলে নিলাম নিজেকে। মুঠোফোনে টোকা দিতেই পিয়ন (শামিম) এসে দাঁড়াল দরজায়। তত দিনে আমাকে ভালোই চেনে সে।

জি ম্যাডআম (ম্যাডাম)। কী লাগবে?

কাগজে কয়েকটা শব্দ লিখলাম শুধু। জানি যার বোঝার তিনি বুঝে নেবেন—I need my class in a completely isolated room, to make her comfortable. Permit me.

কাগজটা পাঁচ ভাঁজ করে বাড়িয়ে দিলাম, জায়গামতো যাও।

শামিম বেরিয়ে যেতেই বাজল ইন্টারকম: ফাল্গুনাই? হলো কী ভাই?

বলতে গিয়েও বললাম না কিছু। কী দরকার নালিশের? ‘কী হলো জানা নাই, আলাদা ঘর চাই।’

এরপর আমাদের জায়গা হলো একেবারে ভেতরের ঘরে। যার দরজা বন্ধ করলেও সমস্যা নেই। শামিম দেখি দরজা ছেড়ে নড়ছে না। কী রে ছেলে? ‘ম্যাডআম স্যারে কইসে দাঁড়াইতে।’ হাসলাম, ঠ্যাং খাও (thank you) শামিম।

কী বললাম শামিম বুঝেছে ঠিকই। তবু প্রশ্ন: ম্যাডআম ঠ্যাং খামু? কিয়ের ঠ্যাং খামু?

ওকে টাকা দিয়ে বললাম, হোটেল থেকে মুরগির ঠ্যাং কিনে খেতে। খুশিতে ভুসি হয়ে চলে গেল সে। (এরপর থেকে যত দিন আয়েশা ছিল, সেই এক বছর থেকে শামিম আসত কীভাবে কী করি দেখতে, সে নিজেই করত আমার সব ফুট ফরমাশ।

সেদিন শামিম চলে যেতে বন্ধ দরজার আড়ালে তাই করলাম। যা আগে কোনো দিন করিনি বাড়িতে পড়তে আসা কোনো ছাত্রীর সঙ্গে (ছাত্র তো প্রশ্নই আসে না)। হালকা হাতে আয়েশাকে বুকে টেনে ছোট্ট স্নেহ চুম্বন আঁকলাম কপালে: Learn, know. Can you? মিষ্টি হাসি, I can, apu.

ওকে Jump বোঝাতে নিজেই লাফিয়ে উঠলাম। বই থেকে ছবি দেখিয়ে প্রশ্ন করলাম: কোথায় তোমার eyes? Toes কোনটাকে বলে? Knee কই? Elbow চেন? অনেক সময় লাগলেও নির্ভুল উত্তর দিল আয়েশা। একদিন cook বোঝাতে হাঁড়ির ছবি এঁকে দেখালাম। Float বোঝাতে গ্লাসের পানিতে কাগজ ছিঁড়ে ভাসিয়ে দেখালাম। আয়েশার আগ্রহের কমতি ছিল না। Float শেষ করে দেখালাম Boat. তখনই প্রশ্ন, আপু, Boat…Float?...River?

এবার শুরু বাক্য গঠন—Boats float in the river.

প্রতিবার কিছু একটা পারলেই আয়েশার সেই দুষ্টু মিষ্টি হাসি—I can, আপু।

আমি প্রতিবার সালাম জানাতাম অদম্য সেই প্রাণশক্তিকে—Yes of course you can, sweetheart.

ধীরে ধীরে দিন যায় আর আয়েশার বিষণ্নতার আবরণ খসে যেতে থাকে। প্রতি মাসে নতুন করে ফি দিয়েই ভর্তি হয় সে। প্রথম দিনই বুঝেছিলাম, এ মেয়েটি দারুণ আবেগী, আমারই মতো। আমি ভাষার পাহাড় ডিঙাতে ওর এই আবেগকেই কাজে লাগিয়েছিলাম। যতই আদর করি, যত কাছে টানি আয়েশার উৎসাহ, আগ্রহ ততই বাড়ে। আমিও জড়াই মায়ার বাঁধনে।

শব্দ, বাক্যের সীমানা পেরিয়ে তত দিনে ব্যাকরণের অন্য দিকগুলোও শেখাচ্ছি ওকে। Synonyms (সমার্থক শব্দ) আর Antonyms (বিপরীত শব্দ) এ দুটো জানলেও ওর প্রিয় ছিল Homonyms (প্রায় সম উচ্চারিত ভিন্নার্থক শব্দ)। আয়েশা একেকটা শব্দ শেখে আর উচ্ছ্বাস! আপু, দেখ, এক রকম! এই লাফ–ঝাঁপ দেখে ওর নাম দিয়েছিলাম ফড়িং। তাতে তার আপত্তি নেই মোটেও: Grasshopper? Jump on grass? Nice, apu.

এর মাঝে একদিন দেখি, একজন নয়, সাতজন তুর্কি সুপুরুষ অন্য একটি ক্লাসজুড়ে বসে আছে। এরা ঠিক ছোট নয় বয়সে, প্রায় আমার সমবয়সী সব। আরে কাহিনি কী? কোথা থেকে উড়ে এল এরা?

আবার সেই ক্রিং ক্রিং টেলিফোন, হ্যালো হ্যালো হ্যালো, কী হলো গো দাদাভাই? বলো বলো বলো।

আবার আমার বাড়ল বুকের ধুকধুকানি। এতজন আমদানি হলো কোথা থেকে? এদের অন্য কোথাও রপ্তানি করেন না গো দাদা...আমার যে আয়েশা নিয়ে আরও বহু কিছু করা বাকি!

ভদ্রলোকের আবারও সেই অভয় দেওয়া হাসি—‘ফাল্গুনাই, এবার যে বলতে হয় বিদায় অ্যাডমিন, এবার এদের সবাইকে নিয়েই কাটুক তোমার দিন। Foreign students দের গোটা ডিপার্টমেন্ট তোমার। এ সংখ্যা আরও বাড়বে। যে মেয়ে আয়েশাকে সামলাতে পারল, এরা তার কাছে কিছুই না। এখন থেকে তোমার চেকে টাকার অঙ্ক বাড়বে, বাড়বে অন্য অনেক সুবিধাও।

পদোন্নতি কার না পছন্দ? তবু শঙ্কা, ‘দাদা গো, এবার আপনার ফাল্গু সত্যিই নাই!’

দাদা হাসেন—নাই? তাই? কিন্তু আমার তো তা মনে হয় নাই!

অগত্যা কী আর করা। সপ্তাহে চার দিন আমার কাটে আয়েশাকে বুকে নিয়ে নেচে–গেয়ে। আর বাকি দুই দিন আমাকে ঘিরে থাকে ওরহান, মুজাহিদ, ইউসুফ, ইউনুস, বুরাক, তাশকিন আর নুরুল্লাহ। এরা এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পর্যায়ের ছাত্র। আয়েশার থেকে একটুখানি বেশি জানে এরা, তবু কাঁচা। একই ধরনের উপকরণ দিয়ে এদের তো বোঝানো যাবে না। এদের মনের ভেতর তবে ঢুকি কী করে?

আমার যত যাই কাজ থাকুক না কেন, যে মুহূর্তে শামিম চেঁচায়—ফাল্গুনী ম্যাডআম আপনার ফড়িং আইসে। আমি অমনি সবকিছু ফেলে দৌড়। আমাদের সেই নির্দিষ্ট ঘরটিতে। ‘I am right here for you Ayesha!’

ওর জন্য শুক্রবার বাইরে না গিয়ে খুঁজে বের করি হরেক রকম শব্দ ও কথোপকথনের খেলা। আমাকে যদি এখন বলা হয় দিন–রাত কেবল বইয়ে মুখ গুঁজে পড়ে থাকাকেই শিক্ষা বলে, আমি মানতে পারব না। আমার সব সময়ে—‘বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর, সবার আমি ছাত্র, পাখির কাছে, ফুলের কাছে, শিখছি দিবারাত্র।’ শিক্ষিকা হয়েও সেই একই পথে চলার চেষ্টা করেছি।

ডিজনি কার্টুন আমার সব সময় প্রিয়। কারণ এখানে উজ্জ্বল রঙের পাশাপাশি খুব সহজ ইংরেজি থাকে। যা আয়েশার মতো ছাত্রীর জন্য একদম ঠিক।

আমি ডিজনি কার্টুন থেকে গান খুঁজে বের করতাম আমার ফড়িংয়ের জন্য। সেই গানের লিরিক ভিডিও থেকে শূন্যস্থান পূরণের কাজ তৈরি করতাম। ল্যাপটপে গান ছেড়ে দিয়ে বলতাম—‘Let’s be music smart now, shall we?’

আয়েশা হাসত, তার সেই মনকাড়া হাসি, আপু, আমি গান ভীষণ ভালোবাসি।

ওকে যে শুধু ইংরেজি দিয়েই শেষ হতো কাজ, তা তো নয়। ওর আবদারেই মাঝে মাঝে গেয়ে উঠতাম—‘আমি আকাশে পাতিয়া কান, শুনেছি শুনেছি তোমারই গান, আমি তোমারে সঁপেছি প্রাণ, ওগো বিদেশিনী...।’

যেই গাইতাম—‘তোমায় দেখেছি...হৃদি মাঝারে...’ অমনি প্রশ্ন: ‘Can you really see me in your heart, apu?’

পাল্টা প্রশ্ন ছুড়তাম—‘কী মনে হয় রে মেয়ে?’

আয়েশা উত্তর দিত না। মুখ লুকাত আমার বুকে। অস্ফুটে বলত—‘I love you too apu.’ (চলবে)

দ্রষ্টব্য: আয়েশার জন্য ব্যবহার করা গান দিলাম। আমার পাঠকেরা চাইলে শুনে দেখুন