জুনিয়রের বাবা

ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

এ দেশে নিজের বাচ্চার নাম জুনিয়র অমুক রাখার চল আছে। আমার কলিগ আনা ফিলিপাইনের মেয়ে। খুব এফিসিয়েন্ট হাসিখুশি মানুষ। তিনটি বাচ্চা। বড় দুটি ছেলে আর মেয়ে কলেজে যাই যাই করছে। ছোট্ট বাচ্চাটার নাম জুনিয়র।

আনা আমার ফেসবুকেরও বন্ধু। ওর সবচেয়ে বেশি পোস্ট দেখি জুনিয়রকে নিয়ে। ভেবে নিয়েছিলাম বড় দুটির চেয়ে জুনিয়র অনেক ছোট। তাই কিউটনেস থেকেও আনার এত উচ্ছ্বাস তাকে নিয়ে। ছোট্ট সে সাইকেল চালাচ্ছে। ক্যানডি নিয়ে বিছানার নিচে লুকিয়ে খাচ্ছে। ঘুমের সময় বিছানায় লাফাচ্ছে। মানে চরম দুরন্তপনা তার। একবার ক্যানডিবার দিলাম তাকে। বহু কষ্টে ডক ফা–র–হা–না বলে ফেসবুকে ধন্যবাদ জানাল। ভাবলাম ছোট মানুষ, তার ওপর এত দাঁতভাঙা বিদেশি নাম, বলেছে তাতেই খুব খুশি।

আনা সব সময়ই তার হাবির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তার রান্না করা খাবার আমাদের সঙ্গে শেয়ার করে। তার বাগানের ফুল আমাদের রুমে দিয়ে যায়। সেদিন এক রোগীর হার্টের স্ট্রেস টেস্ট হওয়ার জন্য বসে আছি। নরমাল হলে বাসায় পাঠিয়ে দেব। ঘোর বর্ষা নেমেছে। লবির ওয়েটিং রুমে (কাচঘর) বসে উদাস নয়নে তাকিয়ে রইলাম। বাসায় ফেরার সময়ে আজকে ছাতাটা ভুল করে ফেলে যাব। আর গাড়িতে বাজবে আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে...।

লেখিকা
লেখিকা

আনা হেঁটে যাচ্ছিল হাসপাতালের দিকে। আমাকে দেখে দাঁড়াল। বলল কী ব্যাপার বসে আছ যে? বললাম বৃষ্টি দেখতে বসেছি। রোগী রুমে না আসা পর্যন্ত এখানেই থাকব ভাবছি। পোর্টেবল কম্পিউটারে টাইপ করছি। আনা বসল। বলল, আজ মনটা খুব খারাপ। তোমার সঙ্গে শেয়ার করতে চাই। খুব অবাক চোখে তাকালাম হাসিখুশি মেয়েটার দিকে। বলল, জুনিয়রকে ফার্স্ট গ্রেড থেকে সেকেন্ড গ্রেডে প্রোমোশন দেবে না। সামনের সপ্তাহে প্রিন্সিপালের সঙ্গে মিটিং। মনে হলো না, ঠাট্টা করছে ও। বললাম, কেন? বলল, বাচ্চাটা অটিস্টিক, ওর লার্নিং ডিজঅ্যাবিলিটি আছে। ক্লাসের কোনো কিছুর সঙ্গে সে তাল মেলাতে পারছে না। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম, ছোট্ট জুনিয়র যার হাসিতে পুরো দুনিয়া হাসে সে অটিস্টিক?

আনা বলল, হ্যাঁ। দুই বছরে প্রথম ডাক্তার বলেছে ওর স্পিচ থেরাপি লাগবে। ওর ফিলিপিনো হাবি, যে কিনা অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে, তখনো তার প্রচুর টাকা স্টুডেন্ট লোন। জুনিয়রকে নিয়ে পার্কে চলে গেল। তিন ঘণ্টা পর ফিরে এসে বলল, ‘আনা তুমি আর আমি দুজনেই এত হাই ডিমান্ডিং কাজ করি, জুনিয়রের অনেক ঘণ্টা থেরাপি সেশন। ওকে কে দেখাশোনা করবে? আমি ঠিক করেছি, ফুল টাইম বাবা হয়ে থাকব। কোনো দিন যদি জুনিয়র নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে তাহলেই আমার ক্যারিয়ার আবার গড়ার চেষ্টা করব।’

জানলাম তাঁর অক্লান্ত চেষ্টায় জুনিয়র এখন কথা বলে, এ বছর না পারলেও পরের বছর হয়তো বা সেকেন্ড গ্রেডে যাবে সে। অনেক রকম বাবা দেখেছি আশপাশে, ভালো, কেয়ারিং কিন্তু নিজের সবকিছু ভুলে বাসায় বসে থাকা? বললাম, বাবা দিবসের অনেক শুভেচ্ছা ছোট্ট জুনিয়রের বাবাকে। কেন যেন মানস চোখে দেখলাম ছোট্ট জুনিয়রের খুব উজ্জ্বল একটা ভবিষ্যৎ। ভাগ্যিস সেদিন ঝুম বৃষ্টি ছিল তখনো। যখন হেঁটে পার্কিং লটের দিকে যাচ্ছিলাম। কিছু চোখের পানি কারও দেখার বিষয় না।