কাননে কুসুমকলি-তিন

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

‘হাই লেডিস, আই নো দিস ইজ ফান, বাট ইট হার্টস ট্রি!’ যেইমাত্র গাছে চড়লাম, অমনি কোত্থেকে এক ভদ্রমহিলা এসেই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে কী বিষম উৎকণ্ঠায় বলে গেলেন কথাগুলো। খানিকটা বিব্রত হয়ে পড়ি কী মরি করে নেমেই পড়ি, না ছবি তুলি—এমন একটা দ্বিধার মধ্যে থেকেও সঙ্গিনীকে চোখ টিপলাম ফটাফট ক্লিক করে যাও তো সেল ফোনের ক্যামেরায়। ছবি হলো, দস্যিপনায় মেতে থেকে আনন্দ, হই হুল্লোড়ও কিছু কম হলো না। তবুও মনের কোণে একটা খচখচানি রয়েই গেল।

প্রতিবছর মে মাসের মাঝামাঝি দিগন্তবিস্তৃত আকাশের দিকে মুখ উঁচিয়ে চেরিফুল ফোটে। শহরের পশ্চিম কোণের একখানা বিশাল পার্কের দীর্ঘ রাস্তার দুই ধারে বসন্তের আগমনী গান গেয়ে সারে সারে দাঁড়িয়ে থাকে চেরিরা। জীবন আর জীবিকার ফাঁক গলিয়ে কত কী-ই তো দেখা হয় না চক্ষু মেলিয়া। তেমনি করে কখন যে শীত-বসন্ত পেরিয়ে আবার পাতা ঝরার কাল এসে চলেও যায়, টের পাই না। এবারই প্রথম খুব ঘটা করে চেরি ফোটা দেখতে গিয়েছিলাম। হঠাৎই কিশোরীবেলাকে ছুঁতে ইচ্ছে করল খুব। যেই না ইচ্ছেপূরণের উনুনে তা দিলাম, অমনি পড়বি তো পড় মালির ঘাড়ে।

গাছেরও যে প্রাণ আছে, এ কথা প্রথম জেনেছিলাম ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াকালে, বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর জীবনকথা পড়েই। তবুও এই নির্জলা সত্যটি বোধে আর বিশ্বাসে আনতে এত বছর লাগল আমার। তাই আমি সেই আগন্তুক নারীর মতো করে বুঝিনি গাছে চড়লে গাছও ব্যথা পায়।

পাঠক নিশ্চয়ই ভাবছেন এই অপ্রাসঙ্গিক গল্পের অবতারণা কেন? আদতে এটি মোটেই অপ্রাসঙ্গিক নয়। কেননা, মাতৃ প্রকৃতিকে যে ভালোবাসতে হয়। প্রকৃতিতে মানুষের সুস্থ সুন্দর জীবনযাপনের জন্যই অন্যান্য পশুপাখি-জীবজন্তু ও গাছপালা, মোট কথা সব জীবের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা, সবার বাঁচার অধিকারকে সম্মান করা, সব প্রাণের অস্তিত্বকে স্বীকার করে নিয়ে আমাদের যে বিশাল এই পৃথিবী, আর মনুষ্য জীবন এই শিক্ষা আমাদের জীবনে যে কতটা জরুরি, তা আমরা শিখিইনি। আমাদের পাঠ্যক্রমের কোথাও এমন ভালোবাসা তৈরির কোনো প্রক্রিয়া আছে কি না, জানা নেই। আর থাকলেও আমাদের শিক্ষকেরা তার কতটুকুই বা ব্যবহার করেন, সে বিষয়ে বিস্তর গবেষণার দাবি রাখে।

বলা বাহুল্য, বিশ্বব্যাপী শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের বিজ্ঞানভিত্তিক যেসব পদ্ধতি রয়েছে সেগুলো প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত শিক্ষার দর্শন তত্ত্ব দ্বারা স্বীকৃত। সেই স্বীকৃত পাঠদানের পদ্ধতিসংবলিত একই বই পড়েই আমাদের দেশের শিক্ষকেরাও শিক্ষকতার ডিগ্রি লাভ করে থাকেন। গোলমালটা কেবল পাঠদানের প্রক্রিয়া কিংবা কৌশলগত উপস্থাপনায়।

শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের ক্ষেত্রে এখানকার শিক্ষকেরা অতি যত্ন ও গুরুত্বের সঙ্গে অবলম্বন করেন জীবনঘনিষ্ঠ শিক্ষাদান প্রক্রিয়ার ওপর। বস্তুত, তাঁরা শ্রেণিকক্ষে যা-ই শিখবে তা বস্তুজগৎ, চারপাশের জীবন ও পরিবেশের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হবে এবং তার উপযোগিতাও নিজেদের জীবনে দেখতে পাবে। এমনকি বয়সের সঙ্গে সঙ্গে পেশাগত জীবনের দক্ষতাগুলোও সম্পূরক হিসেবে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকে, যা আদতেই তাদের জীবনের জন্য জরুরি নয়, তেমন বিষয়বস্তু না থাকে পাঠ্যক্রমে, না শেখানো হয় শ্রেণিকক্ষে।

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

পাঠ্যক্রম কেবল একটি গাইডলাইন! শিক্ষকের কাজ হলো নানা কৌশলে শিক্ষার্থীর জ্ঞান-দক্ষতা উন্নয়ন করা, যাতে তারা নির্ধারিত বয়সে কাঙ্ক্ষিত যোগ্যতায় উন্নীত হতে পারে। সেটি করতে গিয়ে শিক্ষক শ্রেণিকক্ষের সঙ্গে জীবনের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপনের সূত্র তৈরি করে দেন। একজন শিক্ষার্থীর কোমল মনে যখন মানুষ, জীবজন্তু-গাছপালার জন্য প্রেম জাগিয়ে দেওয়া যায়, তখন সেই শিশুটি বড় হয়ে ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্রের প্রতি যে প্রেম-দায়িত্ব অনুভব করবে, যেভাবে নিজের অনুভূতিকে একাত্ম করবে, তার চারপাশের জগতের সঙ্গে সেটাই তাকে আলোর পথে নিয়ে যাবে। তাকে দিয়ে জগতের বড় কোনো ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ হয়ে যাবে। তবে, ব্যতিক্রম তো জগতেরই নিয়ম।

শ্রেণিকক্ষে পাঠ দানকালে শিক্ষক বিষয়বস্তুর সঙ্গে বস্তুজগতের এবং জীবনের যে যোগসূত্র স্থাপন করেন, তার একটা ছোট্ট উদাহরণ দিলে বিষয়টি সুস্পষ্ট হবে। ধরা যাক মা দিবসের কথা। এই দিবসকে ঘিরে স্কুলে শিশুরা নানা রকম কার্ড, খেলনা বানায়, ছবি আঁকে, চিঠি লিখে মাকে ভালোবাসার কথা বলে, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। এসব কাজ আমাদের কাছে কখনো সখনো হাস্যকর মনে হলেও কৃতজ্ঞতাও যে সুন্দর করে প্রকাশ করতে হয়, সে মা-বাবা হলেও, সেই শিক্ষাটা এই দিবসকে ঘিরে শিশুরা পেয়ে যায়। এই দুই লাইন কথাই হয়তোবা বাবা-সন্তান, মা-সন্তানের জীবনে সম্পর্কের মোড়ও ঘুরিয়ে দিতে পারে। কিছু কথা আমাদের জীবনে বলা হয়ই না কোনো দিন! সেসব বলার দরকার।

আবার বীজ থেকে যে চারাগাছ জন্মে, সেই ধারণার সঙ্গে মা ও সন্তানের সম্বন্ধ, মায়ের যত্ন, সন্তানের জন্য বাড়তি খাবার কিংবা সন্তানের সঠিক পরিচর্যার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি সম্পৃক্ত করা হয়। শিশুরা শ্রেণিকক্ষে বীজ বপন করে নিজেদের যত্নেই চারা তৈরি করে। মা দিবসে প্রতি শিশু নিজেদের উৎপাদিত চারা গাছ (ফুলের) মাকে উপহার দেয়।

মজার ব্যাপার হলো, মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে মা দিবস উদযাপিত হয়। এখানকার ঋতু বৈচিত্র্যের সঙ্গে মিল রেখে এই মে মাসই চারা রোপণের উপযুক্ত মৌসুম। শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে খেলার ছলে গাছ লাগিয়ে আমাদের জীবনের সঙ্গে ঋতু বৈচিত্র্যে ও আমাদের ভূমিকাবিষয়ক সব অনুষঙ্গের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে বাস্তব ও পরিবেশভিত্তিক যে জ্ঞান লাভ করল, তা সারা জীবনের জন্য ওদের মনে রেখাপাত করে রইল। আর এর পেছনের কারিগর হলেন শিক্ষক। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের দেশে এমন মেধাবী শিক্ষক আছেন কি? আমার বিশ্বাস, মেধা কোনো সমস্যা নয় আদতে, সমস্যা আমাদের মননে-মানসে আর কাঠামোতে।

একইভাবে ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে লিখন একটি গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা। মূলত লিখন, পঠন, বচন, শ্রবণ—এই চার দক্ষতার পরিপূর্ণ সমাহারই ভাষার প্রাণ। আমাদের শিক্ষাপদ্ধতিতে অন্য ভাষা তো দূরে থাক, লজ্জাজনকভাবেই সত্যি, আমাদের অনেকেই শুদ্ধ বাংলা লিখতে ও বলতে পারি না। অথচ, সে বিষয়ে আমাদের উন্নাসিকতারও অভাব নেই। আমরা নির্লজ্জভাবেই ভুল বাংলা লিখি ও সেটিকে অগৌরবেরও কিছু মনে করি না। আমরাই পৃথিবীতে একমাত্র জাতি, যারা মাতৃভাষার অধিকার আদায়ে একদিন জীবন দিয়েছিলাম। আবার আমরাই সেই জাতি, যারা ভাষার জগাখিচুড়ি শব্দ ব্যবহার করে কথা বলি, লিখি; আমরাই সবচেয়ে বেশি অবহেলা করি আমাদের মাতৃভাষাকে। এরও অন্তর্নিহিত কারণ আমাদের মুখস্থবিদ্যায় পাণ্ডিত্য অর্জনের জন্য ‘দরিদ্র শিক্ষাব্যবস্থা’।

প্রকৃতপক্ষে, আমরা বুঝে, অনুধাবন করে, আত্মস্থ করে কোনো কিছুই শিখি না। ভাষা বিকাশের মৌলিক দক্ষতার ক্ষেত্রেও আমরা নির্ভর করি মুখস্থবিদ্যার ওপর, যা ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে কোনোভাবেই বিজ্ঞানভিত্তিক তো নয়ই বরং শিখনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। খুব মনে পড়ে, আমাদের পরীক্ষায় আসত ‘অমুক কবিতার প্রথম আট লাইন মুখস্থ লেখ’ (বাংলা ও ইংরেজি) কিংবা ‘তিন দিনের ছুটি চাহিয়া প্রধান শিক্ষকের নিকট আবেদনপত্র লেখ’। এসব বিষয় কেন বাংলা ও ইংরেজিতে আমাদের পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত ছিল, যার রহস্য অদ্যাবধি উদঘাটন করতে পারিনি।

বাংলা ও ইংরেজিতে আমাদের দ্বিতীয় পত্র নামক যে বিষয়টি থাকত, আমি খোঁজ না নিয়েই বলতে পারব আমাদের সময়ের সব শিক্ষার্থী এই দ্বিতীয় পত্র নামক বিষয়টিকে কী নিদারুণ যন্ত্রণার আকর মনে করত। এই দ্বিতীয় পত্রের আওতাভুক্ত যেসব বিষয় ছিল তার অনেক কিছুই হয়তো ভাষা শিক্ষার জন্য জানা জরুরি ছিল। তবে ব্যাকরণিক তাত্ত্বিক জ্ঞানের বিষয়টি কোনোভাবেই আমাদের বয়সী শিক্ষার্থীদের জানা জরুরি ছিল না, সেটা নির্দ্বিধায় বলতে পারি। উল্লেখ্য, কেন থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নম্বরের সঙ্গে ভার্বের পরে এস বা ই-এস যুক্ত হবে এখানকার শিশুরা কোনো দিনই তা মুখস্থ করে না। ওরা জানেই না টেন্স কত প্রকার কী কী? ওদেরকে পার্টস অব স্পিচ কাকে বলে জিজ্ঞেস করলে ওরা আকাশ থেকে পড়বে। অথচ ক্লাস ফোর থেকেই আমরা এসব মুখস্থ করেছিলাম। তথাপিও দুই লাইন শুদ্ধ ইংরেজি লিখতে আজও কলম ভাঙে আমাদের। আর মাতৃভাষা বাংলার যে কী হাল, তার কথা না-ই বা বললাম।

আমরা ১০ থেকে ১২টি রচনা মুখস্থ করে ফেলতাম দুই ভাষাতেই যাতে পরীক্ষায় কমন পড়ে। চাকরির দরখাস্ত, জীবনবৃত্তান্ত লিখন এসবও মুখস্থ করতাম নিম-তিতা জেনেও। আজও মেলাতে পারি না সেই সব রচনা মুখস্থ করে আমাদের জীবনে কোন অর্জনটা হয়েছিল। ভাগচক্রে আজ আমি ইংরেজি ভাষাভাষী একটি দেশে বাস করি। তাই বলছি, আদতে ইংরেজি বাংলার থেকেও অধিকতর সহজ ভাষা, যতটুকু ভয় পেয়েছি শৈশবে ইংরেজি শিখতে, তা কেবলই আমাদের শিক্ষাদান পদ্ধতি-প্রক্রিয়ার অবদান। বিশ্বব্যাপী ভাষা শিক্ষার কতগুলো মৌলিক পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া আছে, যা অনুসরণ করলেই ভাষা শিখন জলবৎ তরলং হয়ে যায়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সত্য, আমাদের শিক্ষকেরাও তা কোনো দিনই শেখেননি।

এখানকার শিশুরা যখন থেকে ঠিকঠাক বর্ণমালা লেখাও শেখে না, তখনই সৃজনশীল লিখন লেখে। ছবি এঁকে গল্পের মাধ্যমে লেখে। শিশু তার কল্পনার কথা, ভালোবাসার কথা, ইচ্ছের কথা বলে, আর সেসব ছবিতে আঁকতে চেষ্টা করে। সব শিশুর অঙ্কন দক্ষতা এক রকম না হলেও ক্ষতি নেই। শিক্ষক খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে শিশুর কথার ঝুড়িকে শিকড়সুদ্ধ বের করে আনেন। ছোট্ট ঘটনাকে গল্পের আকারে রূপ দিতে সহায়তা করেন। শিশুর গল্প বানানো শেষ হলে ছবি দেখিয়ে বর্ণনা করে। আর শিক্ষক ছবির নিচে শিশুর জন্য লিখে ফেলেন। এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে যত দিন শিশু নিজের মতো করে মুক্ত লেখার যোগ্যতা অর্জন না করে। যখন সে নিজেই মুক্তভাবে দুই-তিন প্যারা লেখার দক্ষতা অর্জন করে, তখন শুরু হয় আদর্শ লিখনের অন্যান্য ব্যাকরণ শিক্ষণ। এর আগে মুক্ত লেখায় বানান ভুলও গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয় না। মূলত শিশুদের উৎসাহ দিতেই, লেখার প্রতি অনীহা এবং ভয় দূরীকরণের লক্ষ্যেই এই প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়ে থাকে।

লেখিকা
লেখিকা

শিশুর পঠনকে সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে প্রতি সপ্তাহে একদিন স্কুল লাইব্রেরিতে একটি পিরিয়ড হয়ে থাকে। সেখানে শিশুরা সম্মিলিতভাবে গল্প পাঠে অংশ নেয়। নানা রকম ডকুমেন্টারি দেখে, ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে শিশুতোষ গল্প, বিজ্ঞানভিত্তিক নানাবিধ আবিষ্কার নিয়ে আলোচনা হয় কিংবা কোনো মহামানবের জীবনী নিয়েও আলোচনা হয়। আলোচনা শেষে শিশুদের প্রশ্ন করা হয় এবং শিশুরাও প্রশ্ন করে শিক্ষককে। লাইব্রেরি থেকে শিশুরা নিজেদের পছন্দমতো বই নিতে পারে বাসায় পড়ার জন্য। এই পঠনের জন্য শিশুদের একটি রিডিং লগ মেনটেইন করতে হয়। কোন বই পড়ে সে কী শিখেছে, তা লিখতে হয় সেই রিডিং লগে। অর্থাৎ পঠন থেকে ভাষার বোধগম্যতা অর্জনের জন্য এই রিডিং লগের ব্যবস্থা।

আমাদের শৈশবে দ্রুতপঠন নামে একটি বই পাঠ্য ছিল। অতীব খটমট ভাষায় জটিল গল্পের আধার সেই পুস্তিকা আদতেই ছিল মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা! আমাদের নির্ধারিত বিষয়ের বাইরে লাইব্রেরিতে পাঠদানের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। বরং গ্রামাঞ্চলের স্কুলগুলোতে লাইব্রেরি বলতে আমরা বুঝতাম শিক্ষকদের বসার, গল্পগুজব করার রুম। সেখানে কোনো বই থাকে বলে দেখিনি কখনো। থাকলেও সেই বই পাঠ্য কি অপাঠ্য এবং তাতে শিক্ষার্থীদের অধিকার আছে কি না, সেই প্রশ্নই আসেনি মাথায় কোনো দিন।

সেই কৈশোরেই জেনেছিলাম, আমাদের শিক্ষা জীবনঘনিষ্ঠ নয়, বাস্তবতার নিরিখে পাঠ্যক্রম প্রণয়ন করা হয় না, আমাদের শিক্ষা বিজ্ঞানভিত্তিক নয়। আজও শিক্ষাক্ষেত্রে সমস্যার কথা উঠলে একই রকম আলোচনাই উঠে আসে। সম্প্রতি ড. জাফর ইকবাল স্যারের একটি লেখায় তিনি বলেছেন, ক্লাস নাইনের সাধারণ বিজ্ঞান বই তিনিই বোঝেন না, শিক্ষার্থীরা কীভাবে বুঝবে?

অতএব, আবারও সেই একই কথা। যে শিক্ষা জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, যে শিক্ষার ব্যবহার, গুরুত্ব নেই, আমাদের প্রতিদিনের জীবনে সেই শিক্ষা বাস্তবসম্মত নয়, সময়োপযোগী তো নয়ই। দেশ এগিয়েছে অনেক ক্ষেত্রে, সেই দাবি যেমন আমরা করতেই পারি, তেমনি আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রকে ঢেলে সাজানোর সময় অনেক আগেই হয়েছে। আমাদের সামনে এখন অনেক চ্যালেঞ্জ এগিয়ে যাওয়ার জন্য। একুশ শতকের গ্লোবাল চ্যালেঞ্জকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের যেতে হবে আরও বহু দূর। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুস্থ সুন্দর একটি আগামী নির্মাণে আমাদের শিক্ষাও হয়ে উঠুক লড়াইয়ের বড় হাতিয়ার। হোক যুগোপযোগী, বাস্তবসম্মত। আর সে জন্য চাই যথাযথ উদ্যোগ, সঠিক পরিকল্পনা এবং তার যথার্থ বাস্তবায়ন। অর্থ-সম্পদের অপ্রতুলতাই শিক্ষাক্ষেত্রে যেন শেষ কথা হয়ে না দাঁড়ায়, তেমন প্রত্যাশা এখন সময়ের দাবি।

আমাদের তৈলাক্ত বাঁশবাহী বানরের জীবন নির্বাসনে যাক। পাটিগণিতের পাতা থেকে মুছে যাক সুদকষা। শতকরার জঞ্জালে ভরা হিসাব! আমরা পাই একটি গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ড শিক্ষাব্যবস্থা, যার বিষয় নির্বাচন, শিক্ষাক্রম, পাঠ্যক্রম এবং শিক্ষাদানের গোটা প্রক্রিয়া হবে যুগোপযোগী ও আধুনিক।

আমাদের ক্রিকেটের ইতিহাস খুব সুদীর্ঘ নয়। তবুও ক্রিকেটই আজ বিশ্ব মানচিত্রের অতি ক্ষুদ্র এই দেশকে চিনিয়েছে সারা পৃথিবীর লাখ লাখ ক্রিকেটপ্রেমীকে। আমরা প্রমাণ করেছি আমরা চাইলেই পারি। তেমনি একদিন আমাদের উন্নত শিক্ষার কৃতিত্বের জন্যও সারা বিশ্ব চিনবে আমাদের। তেমন একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি আমি। বিশ্বাস করতে চাই সেদিন আর খুব দূরে নয়। কেবল শুরুটা করা দরকার। ভালো থেকো প্রিয় বাংলাদেশ। ভালো থাকুক আমাদের সন্তানেরা। (চলবে)

ধারাবাহিক এ রচনার আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন