নোবেলজয়ী মানরোর ছোটগল্প নিয়ে আলোচনা

পাঠশালার আসরে অ্যালিস মানরোর নির্বাচিত ছোটগল্প নিয়ে আলোচনা
পাঠশালার আসরে অ্যালিস মানরোর নির্বাচিত ছোটগল্প নিয়ে আলোচনা

কানাডার টরন্টোয় হয়ে গেল শিল্প-সাহিত্য-বিজ্ঞান-দর্শনচর্চার প্ল্যাটফর্ম পাঠশালার ত্রয়োদশ আসর। নোবেলজয়ী ও সমকালীন ছোটগল্পের দিকপাল অ্যালিস মানরোর নির্বাচিত ছোটগল্প নিয়ে বসেছিল এবারের আসর। আলোচক ছিলেন মানরোর 'অ্যামান্ডসান' ও 'ডে অব দ্য বাটারফ্লাই' গল্পের অনুবাদক উম্মে কুলসুম রত্না।

আসর সঞ্চালনা করেন ফারহানা আজিম শিউলী। গত বৃহস্পতিবার (২০ জুন) সন্ধ্যায় এগলিনটন স্কয়ারের টরন্টো পাবলিক লাইব্রেরিতে এ আসরের আয়োজন করা হয়।

অ্যালিস মানরোর নির্বাচিত ছোটগল্প নিয়ে আলোচনা করছেন উম্মে কুলসুম রত্না
অ্যালিস মানরোর নির্বাচিত ছোটগল্প নিয়ে আলোচনা করছেন উম্মে কুলসুম রত্না

মূল আলোচনা পর্বে উম্মে কুলসুম রত্না অ্যালিস মানরোর ‘রানঅ্যাওয়ে’, ‘ডিয়ার লাইফ’ ও ‘সিলেক্টেড স্টোরিজ’ বই তিনটি থেকে একটি করে মোট তিনটি নির্বাচিত ছোটগল্প 'অ্যামান্ডস্যান’, ‘প্যাশন’ ও ‘দ্য বিয়ার কেইম ওভার দ্য মাউন্টেন’ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন।

উম্মে কুলসুম রত্না বলেন, দক্ষিণ-পশ্চিম ওন্টারিওর অ্যামান্ডসানের এক স্যানিটারিয়াম স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি নিয়ে ভিভিয়েনের আগমন, কিশোরী ম্যারি, সেখানকার ডাক্তার রেড্ডি ফক্স, ডাক্তারের সঙ্গে ভিভিয়েনের রোম্যান্টিক সম্পর্ক, বিয়েপূর্ব যৌন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া, বিয়ে করতে হান্টসভিলে যাওয়া, কিন্তু সম্পর্কটা পরিণতি পেতে পেতে অন্য মাত্রায় উত্তরণ—এই নিয়ে শাশ্বত এক প্রেমের গল্প অ্যামান্ডসান।

অ্যালিস মানরোর নির্বাচিত ছোটগল্প নিয়ে আলোচনা করছেন উম্মে কুলসুম রত্না
অ্যালিস মানরোর নির্বাচিত ছোটগল্প নিয়ে আলোচনা করছেন উম্মে কুলসুম রত্না

আর অন্য রকম ভালোবাসার গল্প ‘প্যাশন’। গ্রেস নামের এক নারী, তার বর্তমান, বর্তমান থেকে অতীতের জীবনস্মৃতি খুঁড়ে আনা, ছাত্রজীবন থেকে প্যাশনের পিছে ছোটা, অটোয়ায় এক হোটেলে গ্রীষ্মকালে কাজ করতে গিয়ে কটেজে থাকতে আসা ট্রাভার্স পরিবারের সন্তান মৌরির সঙ্গে প্রেম, এই পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, পড়ুয়া মিসেস ট্রাভার্সের সঙ্গে অসম বন্ধুত্ব, প্রথাগত প্রেমের বাইরে মৌরির সৎভাই ডাক্তার নীলের সঙ্গে অদ্ভুত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া, গ্রেস ও নীলের পলায়ন, নীলের আত্মহত্যা, গ্রেসের জীবনের নতুন বাঁক—এসব নিয়েই প্যাশনের গল্প।

অন্যদিকে জটিল এক ভালোবাসার গল্প ‘দ্য বিয়ার কেইম ওভার দ্য মাউন্টেন’। ফিওনা ও গ্রান্টের পরিচয়-প্রণয়-বিয়ে, তার বহু বছর বাদে বয়স্কা ফিওনার আলঝেইমার রোগ, চিকিৎসার জন্য মেডোলেইকে যাওয়া, সেখানে অব্রে নামের আরেক রোগীর সঙ্গে ফিওনার জড়িয়ে পড়া, বিয়ের বাইরেও নারীসঙ্গে অভ্যস্ত গ্রান্টের ফিওনার জন্য অব্রের স্ত্রী ম্যারিয়েনের কাছে অব্রেকে ভিক্ষা চাইতে গিয়ে কৌশলগত কারণে ম্যারিয়েনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া, জীবনের নানান বাঁক আর চরিত্রগুলোর নানা রকম মানবিক-নিষিদ্ধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া—এসব নিয়েই দ্য বিয়ার কেইম ওভার দ্য মাউন্টেন গল্প।

আলোচনার শুরুতে ফারহানা আজিম শিউলী অ্যালিস মানরোর পরিচিতি ও তাঁর ছোটগল্পের বিশেষত্ব তুলে ধরেন
আলোচনার শুরুতে ফারহানা আজিম শিউলী অ্যালিস মানরোর পরিচিতি ও তাঁর ছোটগল্পের বিশেষত্ব তুলে ধরেন

উম্মে কুলসুম রত্না মানরোর লেখার নানান দিক তিনটি গল্পের সঙ্গে যুক্ত করে, নিজের ব্যাখ্যাসহ দারুণভাবে গল্পগুলোর নির্যাস তুলে এনেছেন অত্যন্ত সীমিত সময়ের মধ্যেও।

পাঠশালার আসরে মানরোর তিনটি বই ‘রানঅ্যাওয়ে’, ‘ডিয়ার লাইফ’ ও ‘কালেকটেড স্টোরিজ’ থেকে তিনটি গল্প নির্বাচন করা হয়। গিলার পুরস্কারপ্রাপ্ত ‘রানঅ্যাওয়ে’ বইটির নামটি নিয়ে মানরো খুব মজার অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন সিবিসি রেডিওতে। বইটির নাম এক শব্দের। কিন্তু এর ঠিক আগের বইটির নাম ছিল ‘হেইটশিপ ফ্রেন্ডশিপ কোর্টশিপ লাভশিপ ম্যারেজ’। অতিরিক্ত লম্বা নাম দেওয়ায় এর পরের বইতে তিনি ঠিক করেন, খুব ছোট, এক শব্দের নাম দেবেন বইয়ের, এমনকি এর প্রতিটি গল্পেরও। ‘রানঅ্যাওয়ে’ বইয়ে গল্প আছে মোট ৮টি। এর মধ্য থেকে নির্বাচন করা হয় ‘প্যাশন’ গল্পটি। ডিয়ার লাইফ মানরোর সবশেষ গ্রন্থ। এই বইয়ের গল্পগুলো একটু ছোট ছোট। এতে ‘ডিয়ার লাইফ’ শিরোনামে মানরোর আত্মজৈবনিক একটি গল্প আছে। বইটির ১৪টি গল্প থেকে নেওয়া হয়েছে অ্যামান্ডসান গল্পটি। আসরের আলোচক রত্না বাংলায় অনুবাদ করেছেন, যা ২০১৭ সালে বাংলাদেশের মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত ‘অ্যালিস মানরো: নির্বাচিত গল্প’ বইটিতে সন্নিবেশিত আছে। আর মার্গারেট অ্যাটউডের দীর্ঘ ভূমিকাসহ ‘কালেকটেড স্টোরিজ’ বইটির ১৭টি গল্প থেকে নির্বাচন করা হয় ‘দ্য বিয়ার কেইম ওভার দ্য মাউন্টেন’ গল্পটি। গল্পটি আসলে ‘হেইটশিপ ফ্রেন্ডশিপ’ বইতে আছে। পরে এই সংকলনটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মানরোর সবচেয়ে আলোচিত, জনপ্রিয় ও বিখ্যাত এই গল্পটির চলচ্চিত্রায়ণ হয় ২০০৬ সালে।

নোবেলজয়ী, সমকালীন ছোটগল্পের মাস্টার, শর্ট স্টোরি লিজেন্ড, লিটারারি জায়েন্ট, লিভিং লিটারারি ট্রেজার, কানাডিয়ান সাহিত্যিক অ্যালিস মানরোকে নিয়ে, তাঁর সৃষ্টি নিয়ে আলোচনার জন্য, তাঁর বিশাল সাহিত্য সম্ভারের কিছুটা স্বাদ পেতে টরন্টোর সাহিত্য অনুরাগীরা একসঙ্গে হয়েছিলেন পাঠশালার এবারের আসরে। আলোচক উম্মে কুলসুম রত্নার আন্তরিক, সাবলীল ও বিশ্বাসযোগ্য উপস্থাপনায় উপস্থিত বিদ্যোৎসাহীরা অনায়াসে ভ্রমণ করেন মানরোর গল্পের চরিত্রগুলোতে।

এর আগে আলোচনার শুরুতে সঞ্চালক ফারহানা আজিম শিউলী অ্যালিস মানরোর পরিচিতি ও তাঁর ছোটগল্পের বিশেষত্ব তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ২০১৩ সালে ছোটগল্প রচনার জন্য অ্যালিস মানরো নোবেল পুরস্কার পান। সাহিত্যের এই শাখা থেকে এর আগে খুব কম লেখকই নোবেল পেয়েছেন। উল্লেখ্য, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ও উইলিয়াম ফকনার ছোটগল্পের জন্য বিখ্যাত হলেও নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন উপন্যাসের জন্য। কানাডার প্রথম ও নোবেলের ১১৮ বছরের ইতিহাসে মানরো ১৩তম নারী। মানরোকে সমকালীন ছোটগল্পের মাস্টার অভিহিত করেছে নোবেল কমিটি। বলা হয়ে থাকে, ছোটগল্প বিশ্বসাহিত্যে প্রশংসিত হলেও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি তেমন নেই। নোবেলপ্রাপ্তির পরপরই নোবেল কমিটির পক্ষ থেকে মানরোর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের ঘটনা। এই প্রাপ্তিতে ছোটগল্পও সম্মানিত হয়েছে।

নোবেল পুরস্কার নিতে মানরো সশরীরে উপস্থিত ছিলেন না। তাঁর বড় মেয়ে শিলা পুরস্কার গ্রহণ করেন। নোবেল কমিটির পক্ষ থেকে আগে থেকে রেকর্ড করা মানরোর আধঘণ্টার একটা সাক্ষাৎকার ওই অনুষ্ঠানে দেখানো হয়।

মানরো নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগে আরও কিছু সম্মানজনক পুরস্কার লাভ করেন। এর মধ্যে আমেরিকার দ্য ন্যাশনাল বুক ক্রিটিকস সার্কেল অ্যাওয়ার্ড, দ্য পেন অ্যাওয়ার্ড ফর এক্সিলেন্স ইন শর্ট ফিকশন ও কমনওয়েলথ রাইটার্স প্রাইজ বেস্ট বুক অ্যাওয়ার্ড ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। আর কানাডার সব প্রধান লিটারারি পুরস্কার তিনি পেয়েছেন। গভর্নর জেনারেলস লিটারারি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন তিন তিনবার। ১৯৬৮ সালে প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ‘ড্যান্স অব দ্য হ্যাপি শেডস’, ১৯৭৮ সালের ‘হু ডু ইউ থিংক ইউ আর’ এবং ১৯৮৬ সালের ‘দ্য প্রোগ্রেস অব লাভ’ বইয়ের জন্য। কানাডার সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার স্কোশিয়া ব্যাংক গিলার পান দুবার। ১৯৯৮ ও ২০০০ সালে ‘দ্য লাভ অব এ গুড উইমেন’ ও ‘রানঅ্যাওয়ে’ গ্রন্থের জন্য। এই পুরস্কার ১৯৯৪ সাল থেকে কানাডিয়ান ঔপন্যাসিক ও গল্পকারদের দেওয়া হয়। ২০০৯ সালে মানরো পান নোবেলের পর সর্বোচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ‘ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল’ পুরস্কার-লাইফটাইম বডি অব ওয়ার্কের জন্য। আর ২০১৩ সালে পান নোবেল।

বিশ্বখ্যাত রাশিয়ান সাহিত্যিক আন্তন চেকভ ও ফরাসি সাহিত্যে রিয়ালিজম ধারার জনক গুস্তাভ ফ্লোবেয়ারের সঙ্গে তুলনা করা হয় মানরোর কাজ। মানরোর লেখার ধরন সুপার রিয়েলিস্টিক ও তিনি আমেরিকান পেইন্টার এডওয়ার্ড হপারের দ্বারা অনুপ্রাণিত।

মানরোর জন্ম ১৯৩১ সালের ১০ জুলাই। ওন্টারিওর উইংহ্যামে। কৃষক পরিবারে জন্ম তাঁর। বাবা ছিলেন ফক্স ফার্মার। আর মা স্কুল টিচার। স্কচ-আইরিশ নেইবারহুডে ও উইংহ্যামের প্রাকৃতিক নিসর্গে বেড়ে ওঠেন তিনি।

পাঠশালার আসরে শ্রোতারা
পাঠশালার আসরে শ্রোতারা

ওন্টারিওর লন্ডনের ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন ওন্টারিওতে দুই বছরের আর্টস স্কলারশিপ নিয়ে পড়েন মানরো। বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বর্ষে পড়াকালে পরিচয় ও প্রণয় হয় ওন্টারিওর ওকভিলের উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান জেমস মানরোর সঙ্গে। ১৯৫১ সালে জেমস মানরোকে বিয়ে করে চলে যান কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রদেশের ভ্যাংকুভারে। ১৯৬৩ সালে ভ্যাংকুভার থেকে চলে যান ভিক্টোরিয়ায়। সেখানে স্বামী-স্ত্রী মিলে গড়ে তোলেন বইয়ের দোকান ‘মানরো বুকস’। স্টোরটা এখনো দারুণ চলছে। তিন কন্যা সন্তানের জননী অ্যালিস মানরো জেমস মানরোর সঙ্গে ১৯৭২ সালে ডিভোর্সের পর ফিরে আসেন ওন্টারিওর লন্ডনে। ১৯৭৬ সালে জেরাল্ড ফ্রেমলিনকে বিয়ে করে ওন্টারিওর ক্লিন্টনে স্থায়ী হন।

মানরোর ছোটগল্প সংকলন ১৩টি, একটি উপন্যাস আর সাতটি সিলেক্টেড স্টোরিজ বা কম্পাইলেশন। ছোটগল্প সংকলনগুলোর মধ্যে রয়েছে: ড্যান্স অব দ্য হ্যাপি শেডস (১৯৬৮), সামথিং আই হ্যাভ বিন মিনিং টু টেল ইউ (১৯৭৪), হু ডু ইউ থিংক ইউ আর (১৯৭৮), দ্য মুনস অব জুপিটার (১৯৮২), দ্য প্রোগ্রেস অব লাভ (১৯৮৬), ফ্রেন্ড অব মাই ইয়ুথ (১৯৯০), ওপেন সিক্রেটস (১৯৯৪), দ্য লাভ অব এ গুড উইমেন (১৯৯৪), হেইটশিপ ফ্রেন্ডশিপ কোর্টশিপ লাভশিপ ম্যারেজ (২০০১), রানঅ্যাওয়ে (২০০৪), দ্য ভিউ ফ্রম ক্যাসল রক (২০০৬), টু মাচ হ্যাপিনেস (২০০৯) ও ডিয়ার লাইফ (২০১২)। ১৯৭১ সালে প্রকাশিত ‘লাইভস অব গার্লস অ্যান্ড উইমেন’কে উপন্যাস বলা হলেও এটি আসলে বেশ কয়েকটি আয়-সম্পর্কিত গল্পের সমন্বয় এবং এর প্রতিটি সেগমেন্ট স্বয়ংসম্পূর্ণ।

‘দ্য নিউইয়র্কার’, ‘দ্য আটলান্টিক মান্থলি’ ও ‘দ্য প্যারিস রিভিউ’ ইত্যাদি বিখ্যাত পত্রিকায় মানরোর গল্প নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে এবং তাঁর গল্প বিশ্বের ১৩টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

মানরোর গল্পের কাহিনির ওপর ভিত্তি করে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে কয়েকটি। মার্থা, রুথ অ্যান্ড এডি (১৯৮৮), এজ অব ম্যাডনেস (২০০২), অ্যাওয়ে ফ্রম হার (২০০৬), হেইটশিপ অ্যান্ড লাভশিপ (২০১৩) ও জুলিয়েটা (২০১৬)। ২০১৫ সালে মানরোর সম্মানে কানাডায় ডাকটিকিট বের করা হয়।

মানরোর লেখালেখির শুরু কিশোর বয়স থেকেই। পড়তেন প্রচুর ও স্কুলে যাওয়া-আসার পথের লম্বা সময়টুকু তিনি গল্পের প্লট নিয়ে ভাবতেন।

ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় থাকাকালে ছোট তিন সন্তান নিয়ে সংসার সামলে লেখালেখি করাটা খুব সুখকর ছিল না মানরোর জন্য। কিন্তু তিনি সচেতনভাবে লেখক হতে চেয়েছেন। চেয়েছেন বাইরের জগতে গৃহিণী ছাড়া অন্য পরিচয়ে পরিচিত হতে। টিভি চ্যানেলে ২০১৫ সালের এক একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, একসময় লিখতে না পারায় তিনি বিষণ্নতা রোগে আক্রান্ত হন। তবে সবকিছু পিছে ফেলে অদম্য চেষ্টাতেই তিনি আজকের মানরো হয়ে উঠেছেন।

ফারহানা আজিম শিউলী বলেন, ‘মানরোর লেখায় আমরা পাই দক্ষিণ-পশ্চিম ওন্টারিওর ফিকশনাল ল্যান্ডস্কেপ, যেটিকে বলা হয় কানাডিয়ান এক্সপেরিয়েন্স, সাউদার্ন ওন্টারিও এক্সপেরিয়েন্স। অধিকাংশ গল্পেরই পটভূমি দক্ষিণ-পশ্চিম ওন্টারিওর হিউরন কাউন্টি, যাকে বলা হয় মানরোর কাউন্টি। অর্থাৎ বলা চলে, তাঁর লেখায় একধরনের রিজওনাল ফোকাস আছে। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তাঁকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, “আই অ্যাম নট ইয়েট ডান অর ফিনিশড উইথ ইট। দেয়ার ইজ স্টিল টু ডিসকভার।” ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার ২০ বছর বাদ দিলে মানরোর পুরো জীবনই কেটেছে এই অঞ্চলে।’ উল্লেখ্য, রিজওনাল লেখকের তকমা মানরোর খুব অপছন্দ।

মানরোর লেখায় আমরা সাধারণ জায়গার সাধারণ মানুষের গল্প পাই। তাঁর ‘ফ্রেন্ড অব মাই ইয়ুথ’ বইটি বের হওয়ার পরপর ১৯৯০ সালে সিবিসি টেলিভিশনের এক সাক্ষাৎকারে সাংবাদিক রেক্স মারফি এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে মানরো বলেন, ‘সাধারণ টার্মটাই প্রবলেমেটিক। সবাই-ই এবং সবকিছুই কোনো না কোনোভাবে অসাধারণ।’ নোবেল কমিটির করা ভিডিওতে ছোট শহরের বিশেষত্ব জানতে চাইলে মানরো বলেন, ‘এনি লাইফ অর সারাউন্ডিংস ক্যান বি ইন্টারেস্টিং অ্যান্ড স্পেশাল অ্যান্ড আই ফাইন্ড ট্রিমেনডাস ইন্টারেস্ট ইন ইট।’

ফারহানা আজিম শিউলী বলেন, মানরোর লেখা সহজ ও সরল। এই সারল্যের ভেতর দিয়েই তিনি মানব জীবনের ও মানুষের আচরণের শাশ্বত জটিলতা তুলে আনেন দারুণ মুনশিয়ানায়। নোবেল ঘোষণার সময় সুইডিশ একাডেমির পারমানেন্ট সেক্রেটারি পিটার এংলান্ড বলেন, দিস ফ্ল্যাট, কানাডিয়ান, অ্যাগ্রিকালচারাল ল্যান্ডস্কেপ, উইথ ইটস ব্রড রিভারস অ্যান্ড সিমিংলি ব্ল্যান্ড, স্মল টাউনস ইজ হোয়্যার মোস্ট অব হার শর্ট স্টোরিজ আনফোল্ড। বাট দ্য সেরেনিটি অ্যান্ড সিম্পলিসিটি আর ডিসেপটিভ ইন এভরি ওয়ে।

মানরোর লেখা একেবারেই বাহুল্যবর্জিত। লেখায় বাহুল্য বা অলংকার বর্জন প্রসঙ্গে মানরো ১৯৯০ সালের সিবিসি টেলিভিশনের সাক্ষাৎকারে বলেন, নিজ লেখায় ভাষার বিন্দুমাত্র মারপ্যাঁচ পেলেই তিনি তা কেটে বাদ দিয়ে দেন, যাতে তা গল্পকে কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত না করে।

মানরোর গল্পের নারী চরিত্রগুলো শক্তিশালী, ঋজু, অন্তর্জ্ঞানী, প্যাশনেট। অনেকটা মানরোরই প্রতিচ্ছবি যেন। ২০০৬ সালে প্রকাশিত ‘সিলেক্টেড স্টোরিজ’-এর ভূমিকায় বিশ্বখ্যাত কানাডিয়ান সাহিত্যিক মার্গারেট অ্যাটউড লিখেছেন, ‘মানরো উইমেন আর নট নাম্ব টু দেয়ার হার্ট, রাদার দে আর ট্রুথফুল টু দেয়ার হার্ট।’ নোবেল কমিটির ভিডিওতে মানরো জি এইচ লরেন্স এমনকি টলস্টয়ের মতো তাঁর অতিপ্রিয় লেখকদের নারী চরিত্র নির্মাণ নিয়ে সমালোচনা করেন, সেই সময়কার প্রেক্ষিত বিবেচনায় নিয়েও।

স্মৃতি একটা বড় উপকরণ মানরোর লেখায়। তিনি পাঠকদের স্মৃতি নদীতে ও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সামনে-পেছনে ভ্রমণ করান।

পাঠশালার আসরে অংশগ্রহণকারী
পাঠশালার আসরে অংশগ্রহণকারী

ফারহানা আজিম শিউলী বলেন, মানরোর গল্পের আরেক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যৌনতা। ২০০৪ সালে প্রকাশিত গ্রন্থ রানঅ্যাওয়ে গিলারের জন্য শর্ট লিস্টেড হলে, সিবিসি রেডিও থেকে মানরোর একটা লম্বা সাক্ষাৎকার ধারণ করা হয় তাঁরই প্রিয় গোদেরিচ শহরের কফি শপে বসে। জিজ্ঞেস করা হয়, ২০০১ সালে প্রকাশিত ‘হেইটশিপ ফ্রেন্ডশিপ কোর্টশিপ লাভশিপ ম্যারেজ’ বইয়ের নয়টার মধ্যে সাতটা গল্পেই ইনফাইডালিটি-বিয়েবহির্ভূত যৌন সম্পর্ক, কেন? তিনি বলেন, যৌনতার ব্যাপারটা তিনি প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে লেখেন ও বিশ্বস্ত থাকতে চেষ্টা করেন। মানুষ কীভাবে এর মধ্য দিয়ে যায়, কী চিন্তা করে, কী অনুভব করে ইত্যাদি তিনি তুলে আনতে চান। তবে, এই বিবাহপূর্ব যৌনতা ও বিবাহবহির্ভূত শারীরিক সম্পর্ক এতটাই স্বাভাবিকভাবে গল্পের শরীরে মিশে থাকে যে পাঠক রীতিমতো হোঁচট খেতে পারেন।

মানরোর গল্পে আমরা প্রথাগত প্রেম পাই না। ন্যায়বোধ-নৈতিকতাও ভিন্ন মাত্রায় উপস্থিত তাঁর লেখায়। রোমাঞ্চ, ঝুঁকি, গোপনীয়তা, জটিলতা, রহস্যময়তা, শূন্যতা, বিপন্নতা, এক জীবনের ভেতর গুপ্ত অন্য জীবন, একই মানুষের অনেক সত্তা, ইনোসেন্ট বনাম অপরাধী জীবন, অপরাধবোধ—এসব অপূর্ব দ্যোতনায় উঠে আসে মানরোর গল্পের পরতে পরতে।

মানরোর গল্পের আরেকটি দিক, ফ্লাইট বা পলায়ন। গল্পের চরিত্রগুলো বিভিন্ন সম্পর্ক ও যাপিত জীবন থেকে পালায়। ২০০৪ সালে সিবিসি রেডিওর সাক্ষাৎকারে মানরো বলেন, তারা পালায় নিশ্চিত থেকে অনিশ্চিতের পানে। এই পলায়ন সব সময় শুভ ফল বয়ে আনে না। অনেক খেদ থাকে, ভুল থাকে, আক্ষেপ থাকে। তারপরও চরিত্রগুলো পলায়নের ঝুঁকি নেয়। বিশেষ করে, তাঁর প্রজন্মের নারীদের অনেকের মধ্যে এটি দেখা যায়। তারা একসময় আবিষ্কার করে, মধ্যবয়স উপস্থিত, রুটিনমাফিক জীবন, বাচ্চাকাচ্চা পালন, কোনো উত্তেজনা নেই-তরঙ্গ নেই। তাই তাদের জীবনে আগে আসে মধ্যবয়স, পরে যৌবন-তারুণ্য, আর সেই জীবনের স্বাদ নিতে তারা রোমাঞ্চে জড়িয়ে যায়, ঝুঁকি নেয়।

মানরোর গল্পে আমরা প্রায়ই বিয়োগান্ত, করুণ, বিষাদময় পরিসমাপ্তি দেখতে পাই। নোবেল কমিটির সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, কিশোর বয়সে শিশুসাহিত্যের জন্য জগদ্বিখ্যাত ড্যানিশ সাহিত্যিক হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান এন্ডারসনের ‘লিটল মারমেইড’ পড়ে, মারমেইডের পরিণতিতে ভীষণ কষ্ট পান তিনি। রাজপুত্রের জন্য প্রাণপাত করা মারমেইডের শেষ পর্যন্ত পানিতে করুণ মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে না পেরে তিনি নিজেই মারমেইড ও রাজপুত্রের বিয়ে দিয়ে, অতঃপর তাহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল ধরনের সুখী পরিসমাপ্তি টানেন। কিন্তু পরে একসময় পড়েন এমিলি ব্রন্টের ওয়েদারিং হাইটস-এর মতো ক্ল্যাসিক। এরপর তিনি রিভার্স সিদ্ধান্তে আসেন, বিষাদময় পরিণতিও দারুণ হতে পারে।

২০০৪ সালে সিবিসি রেডিওর সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞেস করা হয়, ‘রানঅ্যাওয়ে’ বইটির অধিকাংশ গল্পের পরিণতি মর্মভেদী যন্ত্রণার-ভায়োলেন্স, মৃত্যু, আত্মহত্যা, প্রিয়জন হারানো। তবে কি তাঁর গল্পগুলো তমসাচ্ছন্ন? তিনি বলেন, মানুষের জীবনে ট্র্যাজেডি খুব স্বাভাবিক বিষয়। বলেন, দিস আর নট স্যাড স্টোরিজ বাট সাম স্যাডনেস ইন ইট। ইট ডাজন্ট মেইক মাই রিডারস ডিপ্রেসড।

মানরো তাঁর লেখায় ব্যক্তির জীবনের ঘটনাগুলো না বরং তুলে আনেন ব্যক্তিকে৷ তিনি গল্পটাই বলতে চান। আর গল্প বলতে গিয়ে চলে আসে ব্যক্তির জীবনের নানা ঘটনা-ভালোবাসা, যৌনতা, প্রতারণা, প্যারেন্টহুড, মা-মেয়ের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক, মৃত্যু, বার্ধক্য, যৌবনপ্রাপ্তি ইত্যাদি।

ফারহানা আজিম শিউলী বলেন, মানরোর গল্পের শেষে আমরা নাটকীয় মোড় পাই। নাটকীয় ও আকস্মিক মোড় কিন্তু খুব সাবলীল। মানরোর ভাষায় যা চাপিয়ে দেওয়া না কিংবা ওই অর্থে পূর্ব-পরিকল্পিতও না। তিনি শুধু গল্পটা বলার পরিকল্পনা নিয়ে লেখা শুরু করেন। বাকিটুকু গল্পের প্রয়োজনেই আসে। আর নাটকীয় মোড় সেভাবে উপন্যাসে আনা সম্ভব না বলে লেখার ফর্ম হিসেবে ছোটগল্পেই তিনি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। ছোটগল্পকার হয়ে ওঠা অবশ্য ছিল ঘটনাচক্রে।

মানরোর গল্পগুলো কি আত্মজৈবনিক? ১৯৭৩ সালে অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত কানাডিয়ান লেখক ও কালচারাল অ্যাকটিভিস্ট গ্রায়েম গিবসন ১১ জন কানাডিয়ান সাহিত্যিকের সাক্ষাৎকার লিখিত প্রকাশ করেন। সেখানে মানরো বলেন, গল্পগুলো আত্মজৈবনিক না, বরং কিছুটা ব্যক্তিগত বলা চলে। তাঁর জীবনের ইভেন্টগুলো—ডিপ্রেশন, বিশ্বযুদ্ধে কানাডার অংশগ্রহণ, ফার্ম জীবনে বাবার পশু হত্যাসহ নানারকম দ্বন্দ্ব, পারকিনসনস-আক্রান্ত মায়ের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন, স্কুলজীবন, প্রাকৃতিক নিসর্গ, নিজ সন্তানের মৃত্যু, ছোট শহরের মানুষের জীবনযাত্রা, মেয়েদের গার্হস্থ্য জীবনের বাইরে কিছু একটা হয়ে ওঠার প্রতিবন্ধকতা, এসব ঘুরে ফিরে এসেছে তাঁর গল্পগুলোতে।

আলোচনার পর এক সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর পর্বে আলোচক রত্নার সঙ্গে অংশ নেন আসরে আসা সুধীজনেরা।