আমার জীবনের যাত্রা

ভারত ভ্রমণকালে বন্ধুদের সঙ্গে লেখক (ডান দিকে)
ভারত ভ্রমণকালে বন্ধুদের সঙ্গে লেখক (ডান দিকে)

শিক্ষক বলেছেন কিছু একটা নিয়ে লিখতে হবে। কী নিয়ে লিখব, কীভাবে লিখব...। আমি অনেকক্ষণ তা নিয়ে চিন্তা করেছি। তারপরও ভেবে পাইনি কী নিয়ে লিখতে হবে আমাকে। শেষ পর্যন্ত আমার মনে হয়েছে নিজের জীবনের আনন্দ নিয়ে লিখলে কেমন হয়? পথ চলা বা যাত্রা করা আমার জীবনের আনন্দ। আমি বন্ধুদের সঙ্গে বা একা প্রতিদিন যাত্রা করি। কিন্তু যাত্রা কী?

পুরোনো দিন থেকে মানুষ যাত্রা করছে। যেমন ভাস্কো দা গামা, ইনোউয়ে তাদাতাকা যাত্রা করেছেন। তাঁরা শুধু দেশের ভেতরের যাত্রা নয়, বিদেশও ভ্রমণ করেছেন। আর যাত্রা তো অনেকভাবে হতে পারে। যেমন হেঁটে, বাসে, ট্রেনে কিংবা বিমানে—এ রকম নানাভাবে। যদি যথেষ্ট সময় আর টাকা থাকে, তাহলে আমরা যেখানে যেতে চাই সেখানে যেতে পারব। কিন্তু আমার মনে একটা প্রশ্ন আছে। সেটা হচ্ছে, কেন মানুষ যাত্রা পছন্দ করে। আমি সেটা নিয়ে জানতে চাই। আর কেন আমি ভ্রমণ করছি তা নিয়েও চিন্তা করতে চাই।

চেন্নাইয়ের পথে ট্রেনে
চেন্নাইয়ের পথে ট্রেনে

আমি এখন পর্যন্ত আমার নিজের দেশ নিয়ে পাঁচটি দেশ ভ্রমণ করেছি। আমার যাত্রা ছিল জাপান, থাইল্যান্ড, হাওয়াই, লাওস আর ভারতে। এখানে আমি আমার যাত্রার অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখে যাত্রা নিয়ে চিন্তা করব।

রেল যাত্রা আমি খুব পছন্দ করি। তাই বিদেশেও প্রায়ই ট্রেনে আমি ভ্রমণ করি। বিশেষত গ্রামাঞ্চলের ট্রেন যাত্রা আমার পছন্দ। ট্রেনের যাত্রায় বিস্ময়কর অনেক কিছু থাকে। আমি ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখা খুব পছন্দ করি। অন্য দেশের প্রকৃতি জাপানের মতো নয়। আবহাওয়া, বাড়িঘর, মানুষের জীবন, সবকিছুই সম্পূর্ণ ভিন্ন। তবে সেসব দৃশ্য দেখে স্বদেশে ফেরার আকুলতা আমি অনুভব করি। প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে কঠিন কোনো চিন্তা আমার মনে দেখা দেয় না। কিন্তু আমার জীবন নিয়ে কিছু কিছু ভাবনা মাঝেমধ্যে মনে দেখা দেয়। আমার ছোটবেলার স্মৃতি, বন্ধুদের কথা, পরিবার আর ভবিষ্যৎ মনে পড়ে যায়। উত্তর দরকার নেই। শুধু চিন্তা করে সময় পার হয়ে যায়। সে রকম সময় আমার পছন্দ। আর ট্রেনে যাত্রীদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়াও খুব মজার। আমার আর তাদের দেশ ভিন্ন। মাতৃভাষাও আমাদের এক নয়। তাই আমি ইংরেজিতে বা তাদের ভাষায় কথা বলি।

গত বসন্তে আমি বন্ধুর সঙ্গে ট্রেনে করে কলকাতা থেকে চেন্নাইতে গিয়েছি। ২৬ ঘণ্টার পথ। খুব দীর্ঘ দূরের যাত্রা সেটা ছিল। সেই ট্রেনে আমাদের সামনে বসেছিল একটি পরিবার। বাবা, মা আর দুই ছেলে। তারাও কলকাতা থেকে তাদের দেশের বাড়িতে যাচ্ছিল। তাদের দেশের বাড়ি কলকাতা নয়। কিন্তু তারা কলকাতায় থাকে। তাই আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলেছি। আমাদের সেই কথাবার্তা থেকে সাধারণ মানুষের জীবন, ভারতের পরিবার আর ভারতে কীভাবে পিতা সন্তানদের সঙ্গে কথা বলে তা নিয়ে অল্প কিছু আমি জানতে পেরেছিলাম।

নিজের তৈরি ওরিগামি হাতে ভারতের বালক
নিজের তৈরি ওরিগামি হাতে ভারতের বালক

আমরা একসঙ্গে ওরিগামি বানিয়েছি। তখন আমি এই দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম যে বড় ছেলেটি ভালো ওরিগামি বানাতে পারে। আমার জানা ছিল না ভারতেও শিশুদের মধ্যে ওরিগামি খুব জনপ্রিয়। আমরা ওরিগামি দিয়ে বিমান আর কপিকল বানিয়েছি। আমার তখন মনে হয়েছে যে বন্ধু হওয়ার জন্য বিশেষ দক্ষতা কিংবা জিনিসের দরকার নেই। শুধু কাগজ দিয়ে আমরা বন্ধু হতে পারি। আমাদের আবার দেখা হবে বলে আমার মনে হয় না। কিন্তু তাদের সঙ্গে সেই অল্প সময়ের দেখা ছিল আনন্দের। আমার স্মৃতি যেটা মনে রাখবে। সেই শিশুদের মনেও যদি আমাদের কথা থেকে যায়, তাহলে জাপান নিয়ে এরা হয়তো আগ্রহী হয়ে উঠবে। এই ভাবনা আমাকে আনন্দ দেয়। মানুষের সম্পর্ক সব সময়ে আমাকে নতুন অনেক কিছু শেখায়। জাপানে এটা আমি জানতে পারিনি।

পরে আরেকটি বিষয় নিয়ে আমি লিখতে চাই। ছোটবেলা থেকে আমি খেতে খুব পছন্দ করেছি। এমনকি দুঃখ পাওয়ার সময়ও সামনে খাবার থাকলে দুঃখ আমি ভুলে যেতাম এবং সেই খাবার আমাকে খুশি করে দিত। তাই ভ্রমণেও আমি খাওয়া-দাওয়া উপভোগ করি। ভারতেও নানা রকম খাবার আর মিষ্টি আমি খেয়েছি। অবশ্যই এখন জাপানে অনেক ধরনের খাবার আমরা খেতে পারি। সেটাও ভালো। কিন্তু বিদেশে গিয়ে সেখানে সেই দেশের খাবার খাওয়া, বিশেষ করে সেই দেশের মানুষের সঙ্গে খাওয়া আরও বেশি বিস্ময়কর। শরীরে শক্তি জোগাতে আর সেই সঙ্গে সংস্কৃতির চর্চায় খাবার জরুরি।

খাদ্যের মধ্যে দেশের ইতিহাসেরও খোঁজ পাওয়া যায়। যখন আমি বিদেশে যাই, তখন দামি কোনো দোকানে আমি খাই না। যেখানে সেই অঞ্চলের মানুষ খাওয়া-দাওয়া করে, আমিও সেখানেই খাই। খাবার খেয়ে আর মানুষের সঙ্গে কথা বলে সেই দেশ সম্পর্কে আরও অনেক কিছু আমি জানতে পারি বলে এটা আমার বেশি পছন্দ। কিন্তু জাপানে রেস্টুরেন্টে অজানা মানুষের সঙ্গে আমি কথা বলি না। অন্য জাপানিরাও ঠিক তাই করে থাকে। জাপানে মানুষের সম্পর্ক তেমন গভীর নয়, বরং অনেক পাতলা। কিন্তু আমার মনে হয় এর অর্থ এই নয় যে, কথা বলতে তারা চায় না। বরং জাপানের সমাজে প্রচলিত নিয়মের কারণে তারা সেটা করতে পারছে না।

চলার পথে মজার খাবার
চলার পথে মজার খাবার

পুরোনো দিন থেকে মানুষ কেন যাত্রা করে আসছে, সবশেষে এ বিষয়ে আমার ধারণা নিয়ে আমি লিখব। আমার মনে হয় এর দুটি কারণ আছে। প্রথমত, অস্বাভাবিক অভিজ্ঞতা এর মধ্যে দিয়ে আমরা লাভ করতে পারি। আমরা সাধারণত দিনে কাজে ব্যস্ত থাকি। তাই সেই জীবনে ক্লান্তি দেখা দিলে অস্বাভাবিক কিছু আমরা চাই। অস্বাভাবিক বিশ্বে গিয়ে মনের সেই অসুখের আরোগ্য আমরা পেতে চাই।

আরেকটি কারণ হলো, মানুষের সম্পর্ক আমরা চাই। আমি লিখছি যে জাপানে মানুষের সম্পর্ক পাতলা। আর তাই পথের যাত্রায় নতুন মানুষের সঙ্গে দেখা পেয়ে, এদের সঙ্গে কথা বলে মানুষ বিশ্বাস করতে চায় যে তারা একা নয়, বিশ্বজুড়ে অনেক বন্ধু তাদের আছে। আমিও আমার ধারণা আরও বিস্তৃত করে নিতে যাত্রাপথের অস্বাভাবিক নানা রকম অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে মানুষকে আরও কাছে থেকে দেখতে চাই। আর আমার এই ধারণা অন্যদের মধ্যে আরও বিস্তৃত করতে পারলে সেটা হবে আমার জন্য আরও বেশি আনন্দের।

অতীতে মানুষ যেমন নিজের মনে দেখা দেওয়া ভাবনা থেকে দূরের পথে যাত্রা করেছে, মানুষের সেই যাত্রা এখনো অব্যাহত আছে। অনেক বেশি মানুষ আজকাল বিদেশে যাচ্ছেন। ফলে আমার বেলায় বলা যায়, সময় হয়েছে নতুন যাত্রা শুরু করার।
...

আকারি মাৎসুওকা: তৃতীয় বর্ষ, বাংলা বিভাগ, টোকিও বিদেশবিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান।