এই ছুটিতে লাস ভেগাসে-দুই

বেলাজিও হোটেলের বাইরে মিউজিকের সঙ্গে সঙ্গে আলোর ঝরনা
বেলাজিও হোটেলের বাইরে মিউজিকের সঙ্গে সঙ্গে আলোর ঝরনা

দ্বিতীয় দিন রুমে হালকা কিছু খেয়ে ৯টার দিকে সবাই নিচে নেমে গেলাম। লবিতে বাকি সব বন্ধু ক্যাডেট পরিবারের সঙ্গে পরিচিত হয়ে আমরা ঠিক করলাম উবার নিয়ে চলে যাব ভেনেশিয়ান হোটেলে। তারপর সবাই চলে গেলাম ভেনেশিয়ান হোটেলে। হোটেলগুলোর সাজ দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম গন্ডোলার কাছে (ভেনিসের বিখ্যাত ছোট ফ্ল্যাট বোটের আদলে তৈরি)। অনেক বছর আগে বাচ্চাদের এনেছিলাম। ওদের মনে নেই কিছু।

আমাদের দলের কেউ কেউ খেতে বসে গেল। আর আমরা চলে গেলাম গন্ডোলা রাইডে। হোটেলে আর্টিফিশিয়াল মেড নীল আকাশ। আশপাশে ছোট্ট ফুলের শহর ইতালি। তার মাঝে আমরা চারজন ভেসে চলেছি। মাঝির গান, মনে হয়েছে আরেকটু বেশি সময় হলে ভালো হতো।

হোটেলে আর্টিফিশিয়াল মেড নীল আকাশ
হোটেলে আর্টিফিশিয়াল মেড নীল আকাশ

পরে হালাল গাইজে খেতে চলে এলাম। এখানে শুনলাম সেলিম ভাইয়ের ছোট্ট বয়সে কানাডায় চলে এসে নিজেকে গড়ে তোলার কাহিনি। অন্য কোনো সময় সেটা বলব। আমি আশপাশের সবাইকে দেখে বুঝি অনেক কিছু শেখার আছে।

ঠিক হলো ভেনেশিয়ান থেকে সার্কাস সার্কাস হোটেলে যাব। ১৫ মিনিটের দূরত্ব। ছোট বাচ্চা যাদের আছে তারা ছাড়া সবাই হেঁটে চলে যাব। গরমে গত ১৮ বছরে আমি অনভ্যস্ত হয়ে গেছি ভুলে গেলাম। ১০৯ তাপমাত্রায় ২০ মিনিট হেঁটে কীভাবে পৌঁছালাম জানি না। শুধু মনে আছে আমার ছেলে নাভান পুরোটা সময় আমার সঙ্গে হেঁটেছে। ছোট্ট আইসক্রিমের স্যাম্পল এনেছে শুধু আমার জন্য। কোনো কোনো শেডে নিজে রোদে হেঁটে মার হাত ধরে রেখেছে। পানির বোতল নিয়ে মা যেন হাইড্রেটেড থাকে, সেটা সে মেক সিউর করেছে। আমার বাবাটা সব সময়ই এমন। মেয়ে নাওয়ার বান্ধবীর সঙ্গে কাছেই ছিল। ২০ মিনিট পর সার্কাস সার্কাসে ফ্রি ট্রাপিজি দেখে যার যার রুমে চলে এলাম।

মিউজিকের সঙ্গে সঙ্গে জল ঝরনা
মিউজিকের সঙ্গে সঙ্গে জল ঝরনা

বিকেলে রেডি হয়ে সবাই উবার নিয়ে বেলাজিও হোটেলে গেলাম। এই হোটেলের বাইরে মিউজিকের সঙ্গে সঙ্গে আলোর ঝরনা, ১৫ মিনিট পরপর। কোনো গান তারা রিপিট করে না। কয়েকটা গান দেখে চলে গেলাম সেই হোটেলের বিখ্যাত বোটানিক্যাল গার্ডেন দেখতে। ফুলে ফুলে সাজানো অপূর্ব বিশাল বাগান দেখে চলে গেলাম মিরাজ হোটেলে ভলকানো দেখতে। অপূর্ব। হোটেলে ফিরে এক্স ক্যাডেটদের আড্ডা তারপর ঘুম। পরদিন বাসে করে সবাই হুভার ড্যাম যাব।

লেখিকা
লেখিকা

সুবীর ভাই ঠিক করেছেন আমরা গাইডেড ট্যুর নেব। সকাল আটটায় মহা কষ্টে হাজির হলাম টাওয়ার টুর সামনে সবাই। আমাদের টুর গাইড মহা হাসিখুশি। আমাদের ৩৪ জন ছাড়াও আরও অনেক ট্যুরিস্ট ছিলেন। ৩৫ মিনিটে পৌঁছে গেলাম হুভার ড্যামে। কীভাবে এত বছর আগে তারা এটা বানিয়েছে শুনে মুগ্ধতা তো ছিলই, সিঁড়ি দিয়ে ব্রিজে উঠতে উঠতে হয়ে গেল এক পশলা বৃষ্টি। ট্যুর গাইড বললেন, ‘তোমরা খুব লাকি। বছরে মাত্র দুবার এমন বৃষ্টি হয়।’

সহনীয় গরম ও মন ভালো করা বাতাস। সঙ্গে অসম্ভব প্রিয় কিছু মানুষের হাত ধরে কয়েক হাজার ফুট ওপরে হাঁটাহাঁটি আর ফটো তোলা সুযোগ পেলেই। বাচ্চারা পালিয়ে থাকতে চেয়েছে ফটো তোলার ভয়ে। ৪০ মিনিট বিরতির পর পথে ১০ মিনিট হুভার ড্যাম লেখা সাইনের সঙ্গে ছবি তুলে চলে গেলাম ভিজিটর সেন্টার। এখানে কেউ কেউ গাইডের সঙ্গে গেল ২০ মিনিট হাইকে। আমি আর পুত্র কন্যা থেকে গেলাম ভেতরে। ছোট্ট স্যুভেনিরের দোকান, সঙ্গে ক্যাসিনো। ৪০ মিনিট পর বাসে চলে এলাম।

হোটেলে পৌঁছে প্রবীর ভাই জানালেন ৪টায় টিপু ভাইর রুমে তিনি শিঙাড়া ও মিষ্টি খাওয়াবেন। আমরা সবাই যাব। কিন্তু ঘুম থেকে কিছুতেই উঠতে পারলাম না ৪টায়। উঠে দেখি আমার হাবি শিঙাড়া, মিষ্টি, আচার নিয়ে এসেছে। সাড়ে সাতটায় সবাই বাফেতে গেলাম।

হুভার ড্যাম
হুভার ড্যাম

ডিনারের পর আমাদের রুমে আড্ডা। বাচ্চারা পাশের রুমে। ছয় বছরের যমজ ভাইবোন আমাদের এত কিছুতেও উঠল না।

টিপু ভাই আমি তুমি, তুমি আমি নিয়ে কী জোক বললেন কেউ বুঝলাম না। শায়লাকে লাগবে বুঝে নিতে। বাচ্চার রিসাইটেলের কারণে সে আসতে পারেনি। এজাজ মডারেট করল। সুবীর ভাই উদ্যোগ নিয়ে ছয় মাসের চেষ্টায় একটা সফল গেট টুগেদার করেছেন। টেমি আর তার নাচ ছিল অনবদ্য। এরপর একে একে তিতাস ভাইয়ের জোক, শায়লা আপু আর রানার কবিতা, প্রবীর ভাইয়ের স্মৃতিচারণা, আমাদের আর মশিউর ভাইয়ের গান, শেষ হতে না চাওয়া আনন্দ মুহূর্ত, তিতাস ভাইয়ের কবিতা, আরও কিছু গান আমাদের আর সবাই মিলে। শেষ করতে হলো সবকিছু রাত দেড়টা দুটার দিকে। অনেকেরই প্লেন ধরার তাড়া আছে সকালে।

হুভার ড্যাম
হুভার ড্যাম

শেষ দিন এ যাত্রায় শেষবারের মতো সবাই লবিতে দেখা করলাম সকাল সাড়ে ৯টায়। এনি আপুর বাসায় যাব। আমরা যারা চলে যাব সেদিন, তারা চেক আউট করে লাগেজ নিয়ে রেডি। কেউ কেউ ওই দিন রাতে বা পরদিন সকালে যাবেন। এনি আপু আমাদের মেডিকেলের, হাবির ক্লাসমেট। আমার বাবুর ১০ মাস বয়স থেকে তার বাসায় আসি আমরা। এনি আপু ও তার হাবি ঢাকা মেডিকেলের তারেক ভাইয়ের আতিথেয়তার কোনো তুলনা নেই। তারেক ভাইয়ের কারণে ডান্সিং ফাউন্টেন, লাভা রক, বোটানিক্যাল গার্ডেন, গন্ডোলা আমাদের আগে দেখা। তাদের বাসার কাছে রেড রক মাউন্টেন আমাদের আগে দেখা।

হুভার ড্যাম লেখা সাইনের সামনে
হুভার ড্যাম লেখা সাইনের সামনে

যা হোক, যার যার গাড়িতে বা উবার নিয়ে রওনা হয়ে গেলাম। লাস ভেগাসে সিরি তেমন কাজ করে না। উবার চালকের পিছে পিছে পৌঁছে গেলাম এনি আপুর নতুন বাসায়। বাচ্চাকে ভাইয়ের বাসায় রেখে গত রাতে এসেছেন সাড়ে ১২টায়। পুরি, লুচি, পরোটা, চিকেন, বিফ, সবজি, রোল, সমোসা, মিষ্টি দেখে বুঝে নিলাম কতটুকু ঘুম তার হয়েছে। কোনো রকম সংকোচ ছাড়া যখন-তখন চলে এসে বিরক্ত করার মতো আবদার খুব বেশি মানুষের কাছে করি না। তাকে দেখে আমার মনে হয় বোনের কাছে এসেছি।

স্বামীর সঙ্গে লেখিকা
স্বামীর সঙ্গে লেখিকা

তারপর শুরু হলো গান। রবীন্দ্রসংগীতের মূর্ছনা, আধুনিক গান, ব্যান্ড সবাই মিলে। আপু আসবেন আমার বুড়ার গ্র্যাজুয়েশন পার্টিতে। কী মজা।

তারপর চলে এলাম বাসার পথে, বিদায় নিয়ে সবার কাছ থেকে। রাস্তায় প্রচণ্ড ভিড় ছিল এবার। গরমও। যশোয়া ট্রি অনেক কাছ থেকে দেখলাম। মাইলের পর মাইল শুষ্ক মরু, মরীচিকা দেখেছি। আমাদের গাড়ি ডিজেলে চলে। পথে একটা গ্যাস স্টেশনে থেমে দেখি ট্রাক ছাড়া কোনো গাড়ির জন্য ডিজেলের ব্যবস্থা নেই। প্রচণ্ড ভিড় সাবওয়েতে। বাচ্চাদের স্যান্ডউইচ তুলে ইঞ্চি ইঞ্চি করে গাড়ি চালাচ্ছি। তবে পালা করে গাড়ি চালানোতে পাওয়ার ন্যাপ নেওয়ায় দুজনের একজনও টায়ার্ড হলাম না।

বন্ধুদের সঙ্গে
বন্ধুদের সঙ্গে

সাড়ে আট ঘণ্টা লাগল পৌঁছাতে। স্যানডিয়েগোতে তেমন ভিড় নেই রোববার রাতে। বাসায় এসে মনে হলো এ কয় দিনে সামার এসে গেছে শেষমেষ। যা হোক আবারও এমন কোনো দিনগুলোর অপেক্ষায় থাকব আমরা। (শেষ)