আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রই!

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

‘নাইয়ারে নাইয়ের বাদাম তুইলা/ বন্ধু যে চায় চইলা...।’

গঞ্জ থাইক্যা সুজন মাঝি হবায় বাঁশগাড়ির ঘাটে নাও বান্ধে। পিছ ঘর দিয়া ডাক পারে, হিরামন, ও ও হিরামন, মনডা খালি কিতা, কিতা করে, তরে দেখবার আইছি। চানপুর যাওন লাগব, মোল্লাবাড়ির মাইয়ার ফিরাযাত্রা। আমারে সুরুজ মোল্লা খেপ দেওনের কথা কইয়া রাখছে।

আমি একটা পোঁটলার মইধ্যে দুই মুঠ মুড়ি আর কয়ডা মোয়া বাইন্ধ্যা দিই। পাতিলা থেইক্যা কড়কড়া ভাত আর শাপলার ছালুন মুখে তুইল্যা দিই। মরিচ পোড়া দিবার চাইলে মাঝি ফিক কইরা হাইসা দেয়। সময় নাই রে হিরামন, কবে যে তরে ঘরে তুলুম! মালা শাড়ি পিন্দা নয়া বউ সাজবি, আর আমি দুই চোখ ভইরা তরে দেখুম।

তুলশীপুর থাইক্যা ভালা ঘর আইছে। বাজানের অভাবের সংসার। আমি ছাড়াও আরও তিন বইন। বাজানের কপালে চিন্তার রেখ পইড়া গেছে। দাদি সুযোগ পাইলেই গলা হাঁকাইয়া ওঠে, ‘একজন একজন কইরা বিদায় হও, বাপটারে বাঁচাও।’ যেন আপদ বিদায়!

আমি ইত্তা কথা কলিজায় গাঁথি রাখি। আমি ইত্তা কথা পরানে গাঁথি রাখি। ক্যামতে বুঝাই আমি, ক্যামতে বুঝাই। আমার মাঝিরে ছাড়া আমি বাঁচুম না। ‘দাদি গো, ও ও দাদি, হেয় আমার কলিজা, হেয় আমার জান!’

গেরস্ত ঘর পাইলে বাপটার চোখ চান্নির লাহান ফকফকাইয়া ওঠে, গোয়ালভরা গরু, চারচালা টিনের ঘর, পুষ্কুরিণী ভরা মাছ, মাইয়া আমার সুখে থাকব। জিয়ল মাছ বড়ই পছন্দের হিরামনের। ভাবতে ভাবতেই বাপজানের আন্ধার মুখ ঝলমল কইরা ওঠে।

আমি গীত বান্ধি—

‘ও ও মালা সই
তোমারে দুঃখের কথা কই
বাপজানে বিয়া দিব ভাতঘর চাইয়া
আমার মন বইঠা বায় নয়াপুর গিয়া
ও ও মালা সই
তোমারে দুঃখের কথা কই...।’

জেওর পাতি, ধান ঘর, দুই ফসলি জমি, গর্তে জিয়লের জিয়ন...বিছরায় কামরাঙার হাসিমুখ কোন্তায় আমায় ভুলায় না রে...কোন্তায় না! আমি তো আমারে তরে দিয়ালাছি, হুদা আমার খাছাডা আছে, খাছাডা আছে।

‘ও পরান পাখি, হুন দিয়া মন
তুই পাখি চইলা গেলে হইবরে মরণ
আমার হইবরে মরণ
ও পরান পাখি...
বুক আমার ফানা ফানা
চোখ থাকিতেও কানা
তরে ছাড়া আন্ধা আমি
হগলতের জানা...
ও ও পরান পাখি...ও ও পরান পাখি...।

নাক ছাবির হাউস দুই ফসলি জমি, বড় ঘর আর ললাটের ভাঁজে বানভাসি কান্দন হয়ে ক্ষয়ে ক্ষয়ে পড়ে। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রই!