আমাদের ফেরা না ফেরা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

জাপানপ্রবাসী ছেলের সঙ্গে বিয়ের সুবাদে বিয়ের দুই বছর পর এক বছরের ছেলেকে নিয়ে জাপান পাড়ি জমাই ২০১২ সালে। এখনো মনে পড়ে দিনটির কথা। আগস্টের এক ঝলমলে বিকেলে জাপান পা রেখেছিলাম। চারপাশের পরিবেশ ও ঝকঝকে দেশ দেখে মুহূর্তেই ভালো লাগা তৈরি হয়েছিল দেশটির প্রতি।

পরিকল্পনা ছিল, ছেলের যখন স্কুলে ভর্তির সময় হবে তখন দেশে চলে আসব। বাচ্চার পড়াশোনা, ইসলামি মূল্যবোধ, আদবকায়দা ইত্যাদি দেশেই শেখাব। যত সমস্যাই থাকুক, বাংলাদেশ আমাদের দেশ। কারণ দেশের মানুষের আন্তরিকতা, পরিবারের প্রতি যে মমতা সেটা বাচ্চাদের মধ্যে জাপান বড় করলে হবে কিনা সে ভয়ে।

এর মধ্যে আমার মেয়ের জন্ম হলো জাপানে। ছোট দুটো বাচ্চাকে একা পালন করতে যতটা কষ্ট হবে ভেবেছিলাম, তেমন কষ্ট হয়নি। কিছুটা বড় হলে ওদের জাপানিজ ডে কেয়ার সেন্টারে দিলাম সময়ের চাহিদার কারণে। কারণ ঘরে বসে ওরা খুব বিরক্ত করত। মোবাইল, কার্টুন এসবের প্রতি অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছিল। আর আশপাশে বাঙালি বাচ্চারাও সবাই ডে কেয়ারে যেত। তাই ওখানে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। ডে কেয়ারে অনেক সামাজিক নিয়মকানুন শিখতে লাগল। সঙ্গে জাপানিজ ভাষা। বাংলা ভাষা যেন ভুলে না যায়, সে জন্য বাসায় সারাক্ষণ বাংলা বলতাম আমরা দুজনে। কারণ বাংলা আমাদের প্রাণের ভাষা। যে ভাষার জন্য আমার ভাইয়েরা প্রাণ দিয়েছিল।

কিছুদিনের মধ্যে আমিও চাকরিতে ঢুকে গেলাম। দেশটার প্রতি কেমন যেন ভালো লাগা তৈরি হয়ে গেল। সবকিছু কত সুন্দর নিয়মমাফিক চলে। ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে মিলিয়ে জীবন চলতে ভালোই লাগছিল। রাস্তায় একা চলার পথে কোনো উটকো ঝামেলা নেই। রাতবিরাতে বাচ্চা নিয়ে একা পার্কে ঘুরে বেড়ালেও মনে ভয় নেই। তিনবার পার্স হারিয়ে যাওয়ার পরও ফিরে পাওয়া। আশপাশে অনেক বাঙালি পরিবারের সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়া। দেশীয় উৎসব পালনে দেশের মতো আনন্দ পাওয়া। ছুটির দিনে একে অন্যের বাসায় দাওয়াত খাওয়া। বড় ছুটি পেলে দূরে কোনো বাঙালি পরিবারের সঙ্গে একসঙ্গে হওয়া। ভালো আয় করা। ভালোই কাটছিল দিনকাল।

এর মধ্যে ছেলের ছয় বছর হয়ে দেল। কী করব, দেশে ফিরে যাব, না জাপানে স্থায়ীভাবে থাকব। এ চিন্তায় যেন দিশেহারা হয়ে গেলাম। অনেকে বলত, এ দেশে বাচ্চা মানুষ করলে জাপানিজদের মতো আবেগহীন হবে। বুড়ো বয়সে বাবা মাকে একা রাখবে। আর বাচ্চারা প্রাপ্তবয়স্ক হলে নিজের মতো চলবে। যেখানে বাংলাদেশে বিয়ের আগ পর্যন্ত ছেলেমেয়েরা পরিবারের সঙ্গে থাকে। হঠাৎ কোনো কারণে ভিসার সমস্যা বা অসুস্থ হলে কীভাবে চলব? কারণ জীবনযাপন অনেক ব্যয়বহুল। সবচেয়ে বড় কথা ইসলামি শিক্ষার সুযোগ সীমিত। আর যেগুলো আছে খুব ব্যয়বহুল। মসজিদ অনেক দূরে। ইচ্ছা করলেও যাওয়া কঠিন। অন্যদিকে জাপানিজ স্কুলগুলোতে ইংরেজি শিক্ষাও নেই।। শুধু জাপানিজ পড়ালেখা। কী করব? দেশ থেকে অনেকে বলত এখন ভালো লাগছে, কিন্তু একটা সময় মনে হবে, সময় থাকতে কেন দেশে ফিরে এলাম না?

এ দেশে এসে সবাই শুধু কাজ পাগল হয়ে যায়। কাজের প্রতি গুরুত্ব দিতে গিয়ে পরিবারকে সময় কম দেয় সবাই। মেয়েকে যদি এ দেশে বড় করি তবে নিজেদের মতো করে পারব কি তৈরি করতে?

আমরা দুজনেই একটা জিনিস ভাবতাম। আমরা তো ২৫ বছর পার হওয়ার পর দেশ ছেড়ে ছিলাম। দেশের সংস্কৃতি, ইসলামি মূল্যবোধ সব দেখেই তো দেশ ছেড়েছি। এখানে শুধু ওদের সংস্কৃতি, যেটাতে একবার অভ্যস্ত করে ফেললে আর শেখার সুযোগ নেই। বিশেষ করে সকালবেলায় ওরা যে মাথা নিচু করে স্কুলে সবাইকে ‘ওহায়ো গুজাইমাস’ (শুভ সকাল) বলা শেখাত বাচ্চাদের, এটা আমার ভালো লাগত না। ইসলামে এমন করে মাথা নিচু করার শিক্ষা নেই। সে জন্য ছেলেমেয়েকে বলতাম, শুধু মুখে বলবে শিক্ষককে, মাথা নিচু করবে না। আবার কখনো মনে হতো আমরা মুসলমান বলে এ দেশে সংখ্যালঘু। কিন্তু আমার দেশে আমরাই ছিলাম সংখ্যাগরিষ্ঠ। যদিও বাইরে থেকে এসব বিষয়ে ওদের বিভেদ চোখে পড়ত না।

মনে আছে একদিন এক জাপানিজ কিশোর আমার বাসার দরজায় ‘ইসলাম’ লেখা দেখে জানতে চেয়েছিল আমরা কি মুসলমান? ‘হ্যাঁ’ উত্তর শুনে বলল, মুসলমানরা শুধু গলা কেটে মানুষকে মেরে ফেলে। সে ইশারায় আমাকে তলোয়ার দিয়ে মানুষ কাটার কথা বোঝাল। আমি বললাম সব মুসলমান এমন না, কিছু দুষ্ট লোক এটা করে। সে আর কিছু বলল না। দেশে থাকলে আমরা এসব প্রশ্নের সম্মুখীন কখনো হতে হতো না। তবুও অন্য অনেক সুযোগ সুবিধা জাপানেই ভালো ছিল দেশের চেয়ে।

এর মধ্যে অনেককে দেখলাম জাপানে স্থায়ী হয়ে গেছে। বাচ্চাদের জাপানে পড়াশোনা করাচ্ছে। এসব বাচ্চাদের দেখলে আমার কিছুটা নিঃসঙ্গ মনে হতো। কারণ জাপানে এরা শুধু তাদের বাবা মার ভালোবাসা পায়। দাদা–দাদি, স্বজন সবার ভালোবাসা এরা পেত না। এদের বাবা মারা আজ দেশীয় এ উৎসব, কাল সে উৎসব পালন করে যেত। বাচ্চারা হয়তো সেখানে যেত, কিন্তু ট্যাব বা গেমস নিয়ে ব্যস্ত থাকত অথবা চুপচাপ থাকত। দেশীয় খাবারের চেয়ে এরা যেন জাপানিজ খাবারই বেশি পছন্দ করত। এরা একবার দেশি কালচার, আবার স্কুলে গেলে জাপানিজ কালচার দুটোর ভিড়ে যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলত।

তবে জাপানে বড় হওয়া বাংলাদেশি সব মেয়ে বাচ্চাদের শালীন আর দেশীয় পোশাক পরানোর দিকে নজর রাখেন তাদের অভিভাবকেরা। যেটা আমার ভালো লাগত। যারা জাপানেই বাচ্চা বড় করছেন তাদের আমি প্রায়ই জিজ্ঞেস করতাম, ছেলেমেয়েকে এ দেশে বড় করতে তাদের কাছে কোনো সমস্যা মনে হয় কিনা? কেউ বলতেন কী সমস্যা, ওদের কালচারই শিখবে। বাংলা পারে না, ইংরেজিও তেমন নেই, তবে ভবিষ্যৎ কী? বলতেন এ দেশে পড়লে এখানেই ভালো জব পাবে বড় হলে। আবার কেউ বলতেন, সমস্যায় পড়ে থেকে যাচ্ছি। কী হবে সময়ই বলে দেবে।

আমার মনে যদিও অন্যদের দেখে ক্ষীণ ইচ্ছা জাগত জাপানেই বাচ্চাদের বড় করব, কিন্তু তাদের বাবা একদম রাজি ছিলেন না। বলতেন, এখন এত পরিশ্রম করছি, আর দশ বছর পর সেটা শরীর নাও দিতে পারে। তখন বাচ্চাদের পড়ালেখার মাঝপথে কীভাবে দেশে ফিরে যাব? কারণ এ দেশেতো শুধু জাপানিজ পড়ালেখা। জাপানে পরিবার নিয়ে থাকা সব বাঙালিই ভাবেন একসময় দেশে ফিরে যাব। তাই জাপানে তারা অস্থায়ী সংসার গড়েন প্রথমে। ভাবেন দেশেই তো যাব। কিন্তু দেশে গিয়ে কী করবেন? সেই চিন্তায় আবার মত বদলায়। এভাবেই অনেকে থেকে যান।

এত কিছু ভাবতে ভাবতে গত বছরের শেষে জাপানে পিআর পেয়ে বাচ্চাদের বাবাকে জাপান রেখে দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম। সত্যি যেদিন জাপান থেকে বাংলাদেশে আসার টিকিট কেটে ফেললাম, তখন আমার এত দিনের সংসার ছেড়ে আসতে খুব কষ্ট লাগছিল। মাথায় চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল, এখানে আমার মেয়ের জন্ম ও বেড়ে ওঠা, এসব ছেড়ে আবার নতুন করে দেশে সব শুরু করতে হবে, একা পারব তো? তখন ওদের বাবা আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন, বছরে একবার দেশে আসবে। আমিও বাচ্চাদের স্কুল ছুটি হলে বছরে একবার জাপান আসব। দেশে ওদের দাদা–দাদিও যে ওদের অপেক্ষায় দিন গুনছিলেন।

সত্যিই একদিন দেশে এসে বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করে দিলাম। আহ, কী শান্তি! চারদিকে কত মানুষ। নিজের আত্মীয়দের সঙ্গে যখন খুশি দেখা সাক্ষাৎ হয়। ইচ্ছামতো বাংলা কথা শোনা যায় সারা দিন। মন খুলে সারা দিন বাংলায় কথা বলি সর্বত্র। মনে হলো সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি। জাপান অস্থায়ী ছিলাম বলে মনমতো আসবাব কিনে ঘর সাজাতে পারিনি। বাচ্চারাও বাংলা আরও ভালো করে শিখল। প্রতিবেশী বাচ্চা আত্মীয় সবার সঙ্গে ভালো সময় কাটাতে লাগল।

ছেলে আমার নিজেই তখন বলত, জাপান আমার দেশ না, আর যাব না। ঈদের ছুটিতে দাদাবাড়িতে, নানাবাড়িতে গিয়ে শিকড়ের সঙ্গে মিশে গেল। কত চাচা, মামা, খালা সবার যে কত ভালোবাসা পেল। ছেলে তখন বলত, এখানে কত মানুষ আমাদের বাসায় আসে, আমরাও কত মানুষের বাসায় বেড়াতে যাই, কিন্তু জাপানে কে আছে?

স্কুলে গেলেও চিন্তা নাই, কারণ সবাই খুব আদর করত বাচ্চাদের। কিন্তু পড়ার চাপটা যেন বেশি মনে হলো। এর মধ্যে নিয়মিত হুজুর বাসায় এসে আরবি পড়ানো শুরু করলেন। যেমন পরিবেশ চেয়ে ছিলাম সব দিতে পেরেছিলাম। জাপান থেকে তখন কিছু ভাবি ফোন করে বলতেন, খুব ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমরা তো বাচ্চা স্কুলে দিয়ে আটকে গেছি। নিজের দেশে যেটা শিখাতে পারবেন সেটা জাপানে কখনো পারবেন না। মনে আছে এক ভাবি বলেছিলেন, আমিও দেশেই ফিরে যাব। যেন মরলে দেশে কবর হয়। আবার কেউ বলতেন, এত সুযোগ ছেড়ে কেন দেশে এলেন? কিছুদিন থাকেন, দেখবেন আর ভালো লাগবে না। জাপানে বাচ্চা পড়ালে ওখানেই ভালো চাকরি পেত। ঘরে নিজেরা সঠিক শিক্ষা দিলে বাচ্চারাও ভালোভাবে বড় হতো।

দেশে এসে আমারও ভালো সময় কাটতে লাগল। স্কুল, কলেজজীবনের বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, ঘোরাঘুরি বোনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ দিনকাল ভালোই চলছিল। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই জাপানের জন্য মন খারাপ লাগছিল বাচ্চাদের। এখানে তেমন পার্ক নেই। ইচ্ছামতো খেলা যায় না। রাস্তায় নামলে চারদিকে শুধু গাড়ি। মনে হয় কোনো গাড়ি এসে এখনই পিষে মারবে। বাচ্চাদের কিছু খাওয়ালে মনে হতো, ওটা ভেজাল, শরীরে সইবে তো? অনেক ক্ষেত্রে দেশ অনেক এগিয়ে গেলেও দেশে সব থেকে আমার কাছে যেটা বড় সমস্যা মনে হলো, সেটা হলো খাদ্যে ভেজাল। যেটা জাপানে চিন্তা করতে হতো না।

বন্ধু–আত্মীয় কারও সঙ্গে দেখা হলে বলত, দেশে সব দুই নম্বরী, কোনো শান্তি নাই। কেন এসেছি জাপান ছেড়ে? আমি বলতাম, তোমাদেরও বিদেশ গেলে মনে হবে দেশ ভালো। সবচেয়ে অবাক লেগেছে, যখন কুমিল্লায় হাসপাতালে একদিন এক ডাক্তারও বললেন, সুযোগ যখন আছে, তখন জাপানের মতো পরিচ্ছন্ন দেশে সেটেল হওয়াই ভালো। খাবারদাবার কত ভালো। দেশে বাচ্চাদের পড়ালেখা, চাকরি অনেক প্রতিযোগিতা, সর্বত্র ভেজাল। আমি তখন বললাম, আমাদের আবার জাপান ফিরে যাওয়ার সুযোগ আছে। তিনি বললেন, তাই করেন।

তখন আবার নতুন করে দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে গেলাম। আমার এক বন্ধু ডেনমার্কে স্থায়ী বাস করে। তাকে জিজ্ঞেস করতাম, যেখানে ইংরেজি নেই, বাচ্চাদের আরবিও শিখতে হয় অনলাইনে, সে দেশে কেন থেকে গেলে? ও বলত, ডেনমার্কে খুব শান্তি লাগে। জানতে চাইতাম বুড়ো হলে কী করবে? ওর সপ্রতিভ উত্তর, আমার বাচ্চাদের সঙ্গেই থাকব। আর আমি দেশে না জাপান কোথায় স্থায়ী হব সারাক্ষণ শুধু এই চিন্তাই করতাম। ওর কথায় যেন ভরসা পেলাম।

এদিকে আমাদের পাঠিয়ে একা শূন্য ঘরে কাজ থেকে এসে ওদের বাবার মন টিকছিল না। বাচ্চাদের ফেলে যাওয়া খেলনা, জামাকাপড় দেখে তার শুধু মন খারাপ হতো। আমাদের পাঠিয়ে তার বাবা–মার কাছে বাচ্চাদের জন্য শিশুর মতো কেঁদেছিল। সে–ও অস্থির হয়ে গেল আবার জাপান আনার জন্য। বলত এই মুহূর্তে বাংলাদেশে গিয়ে আমার পক্ষে কিছু করা সম্ভব না। অনেকেই ফিরে গিয়ে বিশাল অঙ্কের টাকা লোকসান দিয়েছে ব্যবসা করতে গিয়ে। তাই তোমরাই চলে আস। বাসা পরিবর্তন করাতে মসজিদও কাছে এখন। আরবি শেখার সুবিধা আছে। আবারও সেই সিদ্ধান্তহীনতা কী করব? জাপান ফেরত যাব না বাচ্চাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে দেশেই থেকে যাব। তখন ওদের বাবা বলত, এত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বর্তমানের সুন্দর সময়টা কেন নষ্ট করব? কদিন আর বাঁচব? তাই আবার শেষমেশ মত পরিবর্তন করে এই দেশ, এত মানুষের ভালোবাসা ছেড়ে জাপানেই ফেরা। এটাই শেষ ফেরা কিনা জানি না?