বিয়ের পাত্রী দেখা এবং তারপর

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সন্ধ্যা থেকেই চোখের সামনে ফোন নিয়ে বসে আছি। অপেক্ষায় আছি কখন ঋতু ফোন করবে। একধরনের অস্থিরতায় ভুগছি। মা কয়েকবার এসে খোঁজ নিয়ে গেছেন। বারবার ভাত খাওয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছেন। শেষবার যখন মা এলেন, মাকে বললাম, শোনো মা, কষ্ট করে আসার দরকার নেই। ঋতুর ফোন না পাওয়া পর্যন্ত আমি খাব না।

মা আমার অবস্থা দেখে মুচকি হেসে চলে গেলেন। ঠিক রাত ১১টা ২৫ মিনিট ৩১ সেকেন্ডে ঋতুর ফোন এল। এক রিং হতেই ফোন রিসিভ করলাম।

: কী ব্যাপার আপনি কি ফোন হাতে নিয়েই বসে ছিলেন?

: জি, এখন বলেন হ্যাঁ নাকি না।

: কিসের হ্যাঁ–না?

: আপনিই তো বলেছিলেন, ফোন করে জানাবেন আপনি আমাকে বিয়ে করবেন কিনা।

: আসলে আমি এখনো শিওর না।

: কেন?

: সেটা পরে বলছি। তার আগে আমার আজকের ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আমি মেয়েটা আসলে এমন না। শুধু আপনাকে রাগানোর জন্য এমন ব্যবহার করেছি। আমি দেখতে চেয়েছি আমার বাজে ব্যবহারে আপনি রাগেন কিনা? আর রেগে গেলে আপনার আচরণ কেমন হয়। আমি শুনেছিলাম আপনি নাকি প্রচণ্ড রাগী। অথচ দেখলাম আমার বাজে ব্যবহারেও আপনি রাগলেন না। কেন বলুন তো।

: নরমালি আমি মেয়েদের সঙ্গে রাগ করি না। আমার মাথায় ঢোকে না একটা ছেলে কেন একটা মেয়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে। পুরুষের বাহাদুরি দেখানোর জন্য যথেষ্ট জায়গা আছে। সেটা কেন একজন নারীর ওপর রেগে বা খবরদারি করে জাহির করতে হবে। আর আপনি তো শুধু নারীই নন আপনি আমার ভালোবাসা। আপনার ওপর রাগ করার তো প্রশ্নই ওঠে না। আপনি হচ্ছেন আমার জীবন রাজ্যের রানি। আমার এ রাজ্য চলবে আপনার হুকুমে। আপনার রাগ, ক্ষোভ, শখ, আহ্লাদ, অভিমান করার নিরাপদ জায়গা হলো আমার এ রাজ্য। আমি হলাম এ রাজ্যের সেনাপতি। যার কাজই হলো রানির নিরাপত্তা দেওয়া। দুনিয়ার সব বিপদ থেকে রানিকে আগলে রাখা।

: আপনি এত ভালো কেন?

: গুগলে সার্চ করুন। উত্তর পেয়ে যাবেন।

: মানে কী?

: সরি মজা করলাম।

: আরেকটি কথা খালাকে নিয়ে খাবারগুলো খেয়েছেন সে জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

: মাইগড এ কথা আপনি জানলেন কী করে?

: আপনি হয়তো খেয়াল করেননি, আমাদের পাশের টেবিলে দুটো ছেলে ও একজন মহিলা বসেছিলেন। ওরা কারা জানেন?

: আমি কীভাবে জানব?

: ছেলে দুটো আমার কাজিন। আচ্ছা অনুমান করেন তো মহিলাটি কে হতে পারে?

: নিশ্চয় আপনার বান্ধবী?

: ঠিক বলেছেন। আমার সবচেয়ে প্রিয় ও ক্লোজ বান্ধবী। যে আমার সব কথাই জানে। আমার জীবনের এমন কোনো গোপন কথা নেই যা সে জানে না। এমনকি আমার দেখা–অদেখা সব স্বপ্নের কথাও সে জানে। এবার আসল কথা বলি, উনি শুধু আমার বান্ধবীই নন উনি আমার মা।

: আপনি ফাজলামি করছেন, তাই না! এই পিচ্চি মহিলা আপনার মা হয় কীভাবে?

: আমি সিরিয়াস। আসলে মায়ের খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছে। মা খুবই সুন্দরী বলেই আমার নানা তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেন। আর আমার জন্মের সময় মায়ের বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর। নিশ্চয় ভাবছেন, মাকে কেন নিয়ে এসেছিলাম। আসলে মা আমার সব ব্যাপারেই খুবই সিরিয়াস। যার কারণে গতকাল আপনাকে সামনাসামনি দেখে যাচাই করার জন্যই আমার দুই কাজিনকে নিয়ে গিয়েছিলেন। কাল আমি চলে আসার পর আপনি যতক্ষণ ছিলেন মা আপনার সব কর্মকাণ্ড ফলো করেছেন।

: তা ওনার পর্যবেক্ষণের রিপোর্ট কি পজিটিভ?

: মা আমাকে কী বলেছে জানেন?

: কী?

: আমি যদি আপনাকে বিয়ে না করি, তাহলে উনি নাকি আমাকে আর বিয়েই দেবেন না।

বলেই ঋতু রিনঝিন করে হেসে উঠল। আমার মনে হলো, আমি হাসি নয় রবিঠাকুরের গানের সুর শুনলাম।

: আলহামদুলিল্লাহ। যাক মনে শান্তি পেলাম। তাহলে আপনি রাজি?

: না, আমি সে কথা একবারও বলিনি। তবে বলতে পারেন আমি ৮০ ভাগ রাজি।

: বাকি ২০ ভাগ কী করলে রাজি হবেন?

: আমার দুটো শর্ত আছে, তা যদি মেনে নেন তবে বাকি ২০ ভাগও রাজি হয়ে যাব।

: আপনার যেকোনো শর্তে আমি রাজি। বলে ফেলেন।

: না মুখে বলব না। আমার লজ্জা করবে। আমি লিখে জানাব।

: ঠিক আছে টেক্সট করুন।

: না। তা–ও সম্ভব না। শুনুন একটু আগে আমার শর্ত দুটো কাগজে লিখে একটি খামের ভেতরে রেখেছি। কাল যখন দেখা হবে তখন পাবেন।

: কাল কি দেখা হচ্ছে?

: অবশ্যই। কাল আমরা একই রেস্টুরেন্টে দেখা করছি।

: কখন আসবেন?

: একটার সময়।

: খালাকে কি তার স্বামীসহ আসতে বলব।

: আপনি তো খালাকে বলেছেন আমি রাজি হলে খাওয়াবেন। যেহেতু আমি এখনো হ্যাঁ বলিনি, তাই কাল বলার দরকার নেই। কাল যদি হ্যাঁ বলি তাহলে পরের দিনের জন্য দাওয়াত দেবেন।

: কাল কি আপনি একাই আসবেন, নাকি...।

: অবশ্যই না। আমার মা থাকবেন। ও আপনাকে তো একটা কথা বলা হয়নি। আজ আপনি বাসায় যাওয়া পর্যন্ত আমার দুই কাজিন কিন্তু আপনাকে ফলো করেছে।

: কেন! আমি কোথায় কোথায় যাই না যাই তা দেখার জন্য। নিশ্চয় ভেবেছেন আমি হয়তো কোনো আজেবাজে জায়গায় যাব।

: সরি আমার মন এতটা ছোট না। আসলে আমিই ওদের ফোন করে বলেছিলাম আপনি বাসায় না পৌঁছানো পর্যন্ত আপনার আশপাশে থাকতে। যাতে রাস্তায় আপনি কোনো বিপদে না পড়েন। আর পড়লেও যেন ওরা আপনাকে সাহায্য করতে পারে।

কথাটা শুনেই মনটা এক অনাবিল শান্তিতে ভরে গেল। আসলে মেয়েরা যখন কাউকে আপন করে নেয় বা আপন ভাবে তখন তাকে সব বিপদ থেকে আগলে রাখতে চায়। এই রকম ভালোবাসা শুধু মেয়েদের পক্ষেই সম্ভব।

: আচ্ছা একটা অনুরোধ করি। কাল কি একটা নীল শাড়ি পরে আসা যায়?

: আমি তো শাড়ি পরতে পারি না।

: ওকে কোনো সমস্যা নেই। এটা কোনো বিষয় না। শুধু আপনি এলেই চলবে।

পরদিন বেলা তিনটা। আমি রেস্টুরেন্টের ভেতর–বাইরে পায়চারি করছি। ঋতু বা ঋতুর মা কাউকেই দেখছি না। ঋতুর মুঠোফোনে বারবার ফোন করছি। কিন্তু ফোনটি বন্ধ। একধরনের অস্থিরতা কাজ করছে মনের ভেতর। হঠাৎ ঠিক ৩টা ৫ মিনিটে একটি অচেনা নম্বর থেকে টেক্সট মেসেজ পেলাম। একটি ঠিকানা এবং তার নিচে লেখা আমি ঋতুর মা। অজানা বিপদের শঙ্কায় মনটা কেঁপে উঠল। সঙ্গে সঙ্গেই রওনা দিলাম।

ঢাকা মেডিকেল কলেজে আইসিইউর সামনে পৌঁছাতেই ঋতুর মা আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করলেন। কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, বাবা আমার সব শেষ। আমার পাখিটা মনে হয় আর বাঁচবে না।

অনুভব করলাম তাঁর চোখের জ্বলে আমার জামা ভিজে যাচ্ছে। আমি ভেবে পাই না মেয়েরা এত জল কীভাবে চোখে লুকিয়ে রাখে। আমি এখনো জানি না ঋতুর কী হয়েছে। কিন্তু তাঁর কান্না দেখে মনে হলো কে যেন আমার কানে ফিসফিস করে বলছে, মেঘ তোরও সব শেষ।

ঋতুর মার কান্নার আওয়াজে নার্সরা খুবই বিরক্ত। তাদের চোখেমুখে বিরক্তির সে ভাব ফুটে উঠেছে। আমি বুঝি না নার্সরা কেন জানি খুব সহজেই সবকিছুতেই বিরক্ত হয়ে যায়। হতে পারে নার্স রুলবুকে হয়তো লেখা আছে, সব সময় মুখে বিরক্তির ভাব ধরে রাখতে হবে। একজন নার্স ইশারা করে বোঝালেন, আইসিইউর সামনে থেকে সরে যেতে। আমি তাঁকে নিয়ে আইসিইউর সামনে থেকে সরে এসে ওয়েটিং রুমে গিয়ে বসলাম। পেছনে পেছনে ঋতুর বাবাও এলেন। আসার পর থেকেই খেয়াল করছি, তিনি নীরবে চোখের জল ফেলছেন আর বারবার চোখ মুছে যাচ্ছেন। পুরুষ মানুষের এই এক সমস্যা একটু চিৎকার করে কাঁদতেও পারে না।

: মা, ঋতুর কী হয়েছে?

আমার প্রশ্ন শুনে ঋতুর মা চোখ মুছলেন। তারপর একটু সময় নিয়ে বলতে শুরু করলেন:

মেয়েটি আমার সারা রাত ঘুমায়নি। সারা রাত আমাকে আর ওর বাবাকে জ্বালাতন করেছে। আজ কীভাবে সাজবে, টিপ পরবে কিনা, চুল কী বাঁধবে নাকি খুলে রাখবে হাজারো প্রশ্ন। ওর এই ছেলেমানুষি দেখে আমরা মুখ টিপে হেসেছি। মাঝরাতে হঠাৎ রুমে এসে বলল, ‘মা এই মাত্র সিদ্ধান্ত নিলাম আমার ঋতু নাম পাল্টে ফেলব। আমার নাম রাখব বৃষ্টি।’

হঠাৎ কেন এমন সিদ্ধান্ত নিলি?

‘শোনো যেহেতু ওর নাম মেঘ, তাই আমার নাম বৃষ্টি। আমি মেঘের বৃষ্টি। একদম সহজ হিসাব। জানি তোমাদের দেওয়া নাম পরিবর্তন করলে তোমরা রাগ করবে। কিন্তু আমার করার কিছু নাই।’

বলে ঋতু নিজেই হাসতে লাগল। আমি বললাম, আমরা এত দিন এত কষ্ট করে তোকে মানুষ করলাম, আজ তুই সব ভুলে গেলি ওই ছেলের জন্য। উত্তরে বলেছিল, ‘মা তুমি বুঝবে না। আমি আজ কতটা খুশি। আমি কল্পনায়, স্বপ্নে ঠিক যেমন মানুষকে চেয়েছি ও ঠিক সে রকম। একটুও বেশিও না একটু কমও না।’

বাবা তুমি ওকে বলেছিলে শাড়ি পরে আসতে। আমার নীল শাড়ি নেই। সকালে ওর বাবাকে নিয়ে মার্কেটে গিয়ে নীল শাড়ি কিনে এনেছে। ও কখনো শাড়ি পরেনি। দীর্ঘ সময় ব্যয় করে শাড়ি পরিয়ে দিয়েছি। ওর বাবা বলেছিল গাড়িতে করে নামিয়ে দিয়ে যাবে। বলল, না বাবা তুমি গেলে আমি লজ্জা পাব। আমি মাকে নিয়ে রিকশা করে যাব। ওকে নিয়ে রিকশা করে আসছিলাম। হঠাৎ বলল, ‘মা মেঘের জন্য ফুল কিনব।’

আমি রিকশায় বসেছিলাম। ফুল কিনে রাস্তা পার হয়ে রিকশার দিকে আসছিল। হঠাৎ পেছন থেকে একটি বাস এসে...। আমার চোখের সামনে আমার পাখিটা ছিটকে পড়ল রাস্তায়। আমি কিছুই করতে পারলাম না।

আবারও চোখে জলের বন্যা নামল এক হতভাগ্য মায়ের। নিজেকে সংযত করলাম। ঠিক করলাম আমি এই অসহায় বাবা-মায়ের সামনে এক ফোঁটা জলও ফেলব না।

: এখন কী অবস্থা? ডাক্তার কী বলেছে?

আমি কাঁপা কাঁপা গলায় ঋতুর বাবাকে প্রশ্ন করলাম।

: মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে কোমায় চলে গেছে। পুরো শরীরে আর কোনো রেসপন্স নেই। শুধু চোখের পাতা মাঝে মাঝে একটু কাঁপছে। ডাক্তার বলেছেন ব্রেনে রক্ত জমেছে। দ্রুত অপারেশন করতে হবে। না হলে বাঁচানো যাবে না। আমি ডাক্তারকে প্রশ্ন করেছিলাম, অপারেশন করলে কি আমার মেয়েটা বাঁচবে? ডাক্তার বলেছেন সম্ভাবনা মাত্র দশ ভাগ। ওর যে অবস্থা এ ধরনের রোগী সাধারণত বাঁচে না। একমাত্র মিরাকলই পারে ওকে বাঁচাতে।

: বাবা বলেন তো আমি ঋতুকে বিদেশে নিয়ে যাই।

: আমিও তাই চেয়েছিলাম। কিন্তু ডাক্তার বললেন, এই অবস্থায় সম্ভব না। ওরা এখন অপারেশনের ব্যবস্থা করছে।

একটু পরেই আমরা ডাক্তারের রুমে গিয়ে বসলাম। ডাক্তার কিছু পেপার দিয়ে সই করতে বললেন। আর বললেন, আমরা চেষ্টা করছি। তবে খুব বেশি কিছু আশা করবেন না। আপনারা মানসিকভাবে যেকোনো সংবাদ শোনার জন্য প্রস্তুতি নিন। আমি জানি আমার হয়তো এভাবে বলাটা ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু যেটা সত্য সেটা তো বলতে হবে। নিন পেপারগুলো সই করে দিন।

: স্যার আমি কি পেপারগুলো সই করতে পারি?

: আপনি রোগীর কী হন?

একটু ভাবলাম। কী বলব বুঝলাম না। পাঁচ সেকেন্ড পর উত্তর দিলাম, আমি ওর হাজব্যান্ড।

ঋতুর বাবা-মা দুজনেই আমার দিকে চমকে তাকালেন। এরপর ঋতুর মা আমার কাঁধে হাত দিয়ে একটু চাপ দিলেন। বুঝলাম তিনি আমাকে অনুমতি দিলেন। আমি সবগুলো পেপারে সই করলাম। এর মধ্যে একটি পেপার আছে, যেটা সই করতে গিয়ে আমার বুকটা কেঁপে উঠল। ওই পেপারে সই করাটা পৃথিবীর যেকোনো আপনজনের জন্যই কষ্টকর।

: স্যার আমি কি অপারেশনের আগে একটু ওকে দেখতে পারি।

ডাক্তার কী যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, মাত্র দুই মিনিট। একটি কথা মনে রাখবেন, কোমায় থাকা রোগী আপনার সব কথাই শুনবে, বুঝবে। শুধু জবাব দিতে পারবে না। তাই এমন কিছু বলুন যাতে রোগী মনে সাহস পায়। যেন তার মধ্যে বেঁচে থাকার তীব্র ইচ্ছে জেগে ওঠে। ওই জিনিসটাই আমাদের বেশি দরকার। আর সবাই মিলে আল্লাহকে ডাকুন।

ডাক্তারের রুম থেকে বের হয়ে ঋতুর মাকে বললাম, মা ঋতুর ব্যাগটা কোথায়?

: কেন বাবা।

: সম্ভবত ওই ব্যাগে আমাকে লেখা ঋতুর একটা চিঠি আছে।

ঋতুর মা একটু পরে এসে আমার হাতে একটি খাম দিলেন। খামটার গায়ে কিছুটা রক্ত লেগে আছে। এটা ঋতুর শরীরের রক্ত। খামের ভেতর থেকে একটি কাগজ বের করলাম। সেখানে লেখা, আমার দুটি শর্ত:

১) আমার কমপক্ষে পাঁচটি বাচ্চা লাগবে। অবশ্য এর বেশি হলেও সমস্যা নাই।
২) প্রতিদিন আমার কপালে একটি চুমু দিতেই হবে। এমনকি ঝগড়া করে কথা বন্ধ থাকলেও।
এই শর্ত দুটি মানলেই আমি আপনাকে বিয়ে করব।
ইতি
ঋতু, সরি ঋতু না বৃষ্টি

চিঠি পড়ে ভাঁজ করে পকেটে রাখলাম। তারপর নার্সের সঙ্গে আইসিইউতে ঢুকলাম। নার্স আমাকে আইসিইউতে ঢুকিয়ে দিয়ে বের হয়ে গেল। যাওয়ার আগে ইশারায় দুটো আঙুল দেখিয়ে গেল। মানে সময় মাত্র দুই মিনিট।

মনে হলো একটা পরি ঘুমিয়ে আছে। সারা শরীর সাদা চাদরে ঢাকা। লাইফ সাপোর্টের যন্ত্রপাতি লাগানো। ঠিক করেছি একটুও কাঁদব না। মাথার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম।

ঋতুর বন্ধ চোখের পাতার দিকে তাকিয়ে বললাম, আচ্ছা ব্যাপারটা কী হলো, বললেন একটার সময় আসবেন। আমি সেই সকাল থেকেই রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসে আছি। নিজে তো গেলেন না। উল্টো আমাকেই আসতে হলো। আর একটি কথা আমি আপনার দুটো শর্তেই রাজি। আমি ঠিক করেছি পাঁচটি না, যে পর্যন্ত আল্লাহ তৌফিক দেয় বাচ্চা নিতে থাকব। ইনশা আল্লাহ দরকার হলে প্রতিবছর একটা করে হবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এত বাচ্চার তো একসঙ্গে নাম চেহারা মনে রাখতে পারবেন না। দেখা যাবে আপনি ভুলে আমার এক বাচ্চাকেই দুবার গোসল করিয়ে দিয়েছেন। গরমকালে কোনো সমস্যা নাই, কিন্তু শীতকালে তো সমস্যা। বাচ্চার তো ঠান্ডা লেগে যাবে।

একটু থামলাম, মনে হলো চোখের পাতা একটু নড়ল। হতে পারে আমার দেখার ভুল। আমার বুকের ভেতর থেকে কান্না ঠেলে বের হয়ে আসতে চাচ্ছে। মনে মনে চোখকে বললাম, প্লিজ আর একটি মিনিট ধৈর্য ধর। এরপর তুই ইচ্ছে মতো কাঁদিস।

সরি আমি আপনার অনুমতি না নিয়েই একটা কাজ করে ফেলেছি। আপনার স্বামী হিসেবে সব পেপারে সই করেছি। এখন ডাক্তার–নার্স সবাই জানে আমি আপনার স্বামী। আর একটা কথা মরার চিন্তা বাদ দেন, তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যান। আপনি মরলে কিন্তু আমার বাবা-মা আমাকে অন্য কোথায় বিয়ে দিয়ে দেবে। আপনি কি চান আপনার স্বামীর আবার বিয়ে হোক?

নার্স দরজা দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে ইশারা করল বের হতে। তারপর আবার দরজা বন্ধ করে দিল।

বৃষ্টি, আপনার কপালে একটা চুমু দিতে ইচ্ছে করছে। অনুমতি দেবেন? কিছু বলতে হবে না। শুধু চোখের পাতাটা একটু নড়ালেই হবে। তাহলেই বুঝব আপনি অনুমতি দিয়েছেন।

আমি অবাক হয়ে দেখলাম, পরপর দুবার চোখের পাতাটা কাঁপল। আমি মাথা ঝুঁকে কপালে আলতো করে একটি চুমু দিলাম। মাথা সোজা করে যখন তাকালাম, দেখলাম ঋতুর বন্ধ চোখের কোন বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ছে। বুঝতে পারছি আমার চোখ আর কথা শুনবে না। যেকোনো মুহূর্তে বন্যা নামবে। কিন্তু আমি ওকে আমার অশ্রু দেখাতে চাই না। দ্রুত আইসিইউ থেকে বের হয়ে এলাম। কারও সঙ্গে কোনো কথা বললাম না। সরাসরি রাস্তায় এসে ফুটপাতেই বসে পড়লাম। দুই চোখে জোয়ার নামল। ওপরে তাকিয়ে দেখি আকাশে অনেক মেঘ। হঠাৎ করেই বৃষ্টি নামল। সবাই বৃষ্টি থেকে বাঁচতে ছোটাছুটি করছে। আমি ফুটপাতেই বসে রইলাম। বৃষ্টিতে আমার পুরো শরীর ভিজে যাচ্ছে। ঘাড় ঘুরিয়ে ডান দিকে তাকাতেই দেখলাম আমার থেকে কয়েক হাত দুরে দুটো ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। ওরাও বৃষ্টিতে ভিজছে। বুঝলাম ওরা ঋতুর সেই দুই কাজিন। যারা আমাকে পাহারা দিচ্ছে। কারণ ঋতু চায় না তার মেঘের কোনো বিপদ হোক।

বি: দ্রষ্টব্য: পৃথিবীটা টিকে আছে ভালোবাসায়। নারীকে সম্মান করুন, ভালোবাসুন। দেখবেন তার ভালোবাসা সব সময় আপনাকে পাহারা দেবে, আগলে রাখবে।

এ রচনার আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: https://www.prothomalo.com/durporobash/article/1284276