সারপ্রাইজ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ইলা কখনো তার স্বামী আরমানের কাছ থেকে কোনো সারপ্রাইজ গিফট পায়নি। ওর খুব শখ, বর তাকে হঠাৎ করেই চমকে দেবে। যদিও তাদের অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ।

তাতে কি। এমন আশা কি শুধু প্রেমিক স্বামী থেকে করবে? বাপ মায়ের পছন্দের বর থেকে আশা করতে দোষ কী! অনেকভাবে সে সুযোগও করে দিয়েছে কিন্তু ওই মানুষ বুঝেও যেন বোঝে না।

একে কী বলা যায়? চোখ থাকতে অন্ধ, নাকি বুদ্ধুরাম? হয়তো তিনি তাই।

একসঙ্গে কেনাকাটা করতে গেলে আরমান ইলাকে বলে পছন্দ করতে। ইলা কিছু একটা পছন্দ করে বলতে আসে, আমার পছন্দ হয়েছে, খুবই সুন্দর। কিন্তু দাম যেন একটু বেশি চায়। তুমি একটু দেখ তো।

আসলে ইলা ইঙ্গিত দিয়ে বুঝিয়ে দেয়, তোমার হাতে করে জিনিসটা কিনে আনো।

বর আরমান দোকানদারের সঙ্গে কিছুক্ষণ দাম নিয়ে দরাদরি করে খালি হাতেই ফিরে আসে। ওটা আর নেওয়া হয় না। মনে মনে ইলার মন খারাপ হয়। পরবর্তী কয়েক দিন ইলা অপেক্ষা করে থাকে। কিন্তু আরমান ব্যাপারটা বেমালুম ভুলে যায়। ইলা ভাবে, অন্য দোকান থেকেও তো চাইলে সে কিনে এনে তাকে মুগ্ধ করতে পারে।

কতবার আরমানের সামনে ইলা তার গোলাপ ভালো লাগার কথা বলেছে। কিন্তু আরমান মনে হয় ইলার কথা কখনোই মন দিয়ে শোনে না। নইলে রিকশায় যেতে যেতে যখন ইলা মুগ্ধ হয়ে বলেছে, দেখো দেখো, কী সুন্দর করেই না সব গোলাপ সাজানো!

ওই চমৎকৃত দৃষ্টির বদলে সে কখনো জন্মদিন বা বিয়েবার্ষিকীতে হলেও তো একটা ফুল আশা করতেই পারে। তবে তার আশাটা আশাই থেকে গেছে। বাস্তবতার মুখ দেখে না।

আরমান ভালোভাবেই জানে, ইলার মিষ্টি পছন্দ। কিন্তু সে হাতে করে কখনোই ইলার পছন্দের মিষ্টিটা কিনে আনেনি। উল্টো ইলাকে বলে, যা ভালো লাগে, পছন্দ করে কিনে নিতে পার না?

হুম, পছন্দ হলে নেব। বুকভরা অভিমান নিয়েই যেন সে জবাব দেয়।

কখনোই তো তেমন কিছু কিনতে দেখলাম না। আরমান তা মন থেকেই বলে। বউটার কোনো কিছুর প্রতিই তেমন আগ্রহ নেই বোধ হয়, সে ভাবে।

ইলা একটা গোপন দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বলে, আমি চাই তুমি আমাকে আমার পছন্দের কিছু এনে দাও কিংবা কখনো নিজের পছন্দে হলেও কিছু নিয়ে আসো। কিন্তু তা মুখে বলা হয় না।

একবার তো অফিসের কাজে কক্সবাজার যেতে হয়েছে আরমানকে। ফোন করে যখন সে ইলার কাছে জানতে চায়, তোমার কি কিছু লাগবে? কী আনব?

এত খুশি হয়েছিল ইলা! ও কী উত্তর দেবে ভেবে পায় না। তোমার যা ভালো লাগে এনো।

নাম বললে সুবিধা হতো না? আন্তরিকতার সঙ্গেই জানতে চায় আরমান।

আমার মাথায় কিছু আসছে না এই মুহূর্তে। জবাব দেয় ইলা।

আসলে ওর লজ্জা লাগছিল। এটা–ওটা আনতে বলতে। এখনো সে এসবে অভ্যস্ত হয়নি।

তবে ইলা অনেক কিছু ভেবে রাখে। নিশ্চয় শাল চাদর আনবে, গলার নানান ডিজাইনের সেট আনতে পারে। এসবই তো ওখানে বেশি চলে। তারপর, সুন্দর স্যান্ডেল পাওয়া যায়। গত বছর ওর বান্ধবী ওকে এক জোড়া দিয়েছিল। কক্সবাজার থেকে কিনেছে সে। আরমান জানে, সে তা–ও আনতে পারে।

কিন্তু ব্যাগ খুলে এতগুলো বার্মিজ আচার, বাদাম যখন দেখে, ওর এমন মন খারাপ হয়েছিল। তবে দেখায়নি, বুঝতে দেয়নি আরমানকে। খুশি হওয়ার ভান করেছে উল্টো। তবে সর্বশেষে ওর নাম খোদাই করা চাবির রিংটা যখন ইলার হাতে দেয়, ইলা এবার সত্যিই খুব খুশি হয়। চাদর, স্যান্ডেল, গলার সেটের দুঃখ মুহূর্তেই ভুলে গেছে সে।

এরপরও ইলা খুব বেশি মন খারাপ করে না। অনেকেই আছে এমন বেখেয়াল স্বভাবের। আরমানও হয়তো তাই।

ইলা বাইরে কাজ করে না। সংসারে অসুস্থ শাশুড়িকে দেখাশোনা করতে হয়। সংসারের খরচটা শুধু হিসাব করে আরমান ওর হাতে দিয়ে দেয়। এর থেকেও ইলা দু–তিন শ করে জমাতে চায়। বিয়ের দুই বছর পার হয়ে গেছে এমন নিরামিষভাবে। এবার ইলার হাতে কিছু টাকা জমেছে। খুব বেশি না। মাত্র চার হাজার টাকা।

সামনে বিয়েবার্ষিকী। ইলা কিছু ভেবে নেয়। আরমানকে এবার সে সারপ্রাইজ দিতে চায়। বেচারা দেখে হলেও কিছু শিখুক।

কী কিনতে পারে এই টাকায় ইলা? ম্যারেজ ডের আগের দিন ইলা ওর এক বান্ধবীকে ফোন করে শপিং করতে সঙ্গে যাওয়ার জন্য। শাশুড়ির পাশে বসার জন্য কাউকে ডাকতে চাইলে উনি বারণ করেন। বলেন, তুমি কী কিনতে যাবে যাও। আমি অতটা বুড়ি নাকি যে কাউকে সঙ্গে বসা লাগবে! নিশ্চিন্তে যাও মা।

ইলা খুশিমনে বের হয়ে যায়। তার শাশুড়ি মানুষ ভালো। সব বোঝেন।

দুই বান্ধবী অনেক ঘুরেফিরে, অনেক খুঁজে খুব সুন্দর একটি শার্ট কেনে। জলপাই রঙের। ফরসা আরমানকে ভালোই মানাবে। ভাবে ইলা। দুটি ছবি রাখতে পারবে এমন ফ্রেম নেয়। বড় কিছু মোমবাতিও। দুটি ভালো দেখে ফুলদানিতেই সাত শ টাকা চলে যায়। এত দাম জিনিসপত্রের!

আসার সময় কিছু তাজা গোলাপ আর ওর প্রিয় মিষ্টান্ন লাড্ডু কিনতেও ভোলে না ইলা। সঙ্গে আরমানের প্রিয় জিলাপি। কিন্তু জিলাপির মচমচে ভাব চলে যাবে না তো? দুশ্চিন্তা হয় ওর।

আরমান আসবে রাত সাড়ে নয়টায়। তার আগে ইলা নতুন বেডসিট পেতে রাখে বিছানায়। শার্টটা একবার বিছানায়, আরেকবার বালিশের নিচে লুকিয়ে রাখে। বুঝতে পারে না কোথায় রাখবে। আসামাত্র আরমানের চোখে পড়লে ইলা লজ্জায় পড়বে।

ফুলদানিতে গোলাপগুলো সাজিয়ে রাখে। মোমবাতিও সাজায়। তবে আগুন দেয় না। এসব করতে করতে ও নিজে নিজে লজ্জা পেতে থাকে।

কেমন যেন প্রথম দিনের মতো নতুন বউ লাগছে নিজেকে। আর সে রকম লজ্জানুভূতি। এবার ইলা নতুন একটি শাড়ি পরে আরও গুটিসুটি হয়ে থাকে। শাড়ি বদলিয়ে ফেলবে নাকি গোলাপ মোমবাতি সরিয়ে ফেলবে বুঝতে পারে না। সব যেন একটু বেশি বেশি লাগছে।

শেষে সব যেমন আছে, তেমনই রেখে দেয়। থাক, সুন্দর লাগছে সবকিছু, শাড়িতে নিজেকেও।

আচ্ছা, আরমানের কি এই দিনের কথা মনে আছে? যদি একেবারে ভুলে যায়, তবে তো আমি ভীষণ লজ্জায় পড়ব। মনে মনে বলে সে। এরপর চোখে গাঢ় করে কাজল লাগায়। একটু আইলাইনার দিয়ে টানা টানা করে এঁকেও নেয়। ঠোঁটে লিপজেল লাগায়। সাজ শেষ করে দেখে সাড়ে নয়টা বেজে গেছে।

এখনো আসছে না কেন আরমান।

দশটা বাজে, সাড়ে দশটা। এবার টেনশন হয়। ফোন করে ইলা। কেউ ফোন ধরছে না। রিং বাজতেই আছে। ভয়ে অজানা আশঙ্কায় ওর মুখটা এতটুকু হয়ে গেছে। এমন দেরি তো কখনো হয়নি। ও দৌড়ে শাশুড়ির কাছে ছুটে যায়, ওনার কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে দেয়।

: মা, আপনার ছেলে এখনো আসেনি, ফোন ধরছে না, আমার খুব ভয় লাগছে।

: ওর কাজের জায়গায় ফোন করো।

আরমানের মা অতটা অস্থির হয়ে বউকে ভয় পাইয়ে দিতে চান না​। আর কত কারণেই তো দেরি হতে পারে।

: করেছি। নয়টায় বেরিয়ে গেছে বলল। মা, পুলিশে ফোন করি?

: দাঁড়াও, ওর বন্ধুদের নম্বর আছে ডায়েরিতে। সবাইকে করে দেখ আগে। হয়তো জ্যামে আটকে আছে বা জরুরি কোনো কাজে।

একে একে সব বন্ধুকে ফোন করে ইলা। তারাও আরমানের ফোনে চেষ্টা করতে লাগল। একসময় রিং বাজা বন্ধ হয়ে যায়। ইলা কেঁদে ফেলে এবার, সঙ্গে শাশুড়িও।

ইলার কাজল লেপ্টে বিশ্রী দেখায় ওকে।

তখনই দরজায় কেউ আঘাত করে। ঘড়িতে তখন রাত এগারোটা চল্লিশ মিনিট প্রায়। দুই হাতভর্তি শপিং ব্যাগ হাতে আরমান বাসায় ঢুকেই বলে, তোমার চোখে কী হয়েছে ইলা? এত কালি কেন?

ইলা সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে জানতে চায়, কোথায় ছিলে এতক্ষণ?

মা–বউ দুজনই একসঙ্গে একই প্রশ্ন করে।

আরমান হেসে বলে, তোমার বউকে কখনো কিছু দেওয়া হয় না। আজ বিয়েবার্ষিকী মনে পড়লে, সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য কিছু শপিং করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু ট্রাফিক জ্যামে পড়েই এত দেরি। দশ মিনিটের পথ আসতেই এক ঘণ্টা।

: ফোন ধরলে না কেন?

: সাইলেন্ট ছিল মনে হয়, একটু আগে দেখলাম চার্জ নাই।

মা নিশ্চিত হয়ে আবার ঘুমাতে চলে যান। ওরা ফ্রেশ হয়ে খেয়ে শুতে যায় প্রায় একটায়।

আরমান বলে, কী আনলাম দেখবে না?

: না।
অভিমান করে বলে ইলা।

: কেন?

: আমার এমন সারপ্রাইজের দরকার নাই, যেটাতে আমি টেনশনে, ভয়ে মরি।

আজ প্রথম সারপ্রাইজ পেয়েও ইলা খুশি হতে পারে না। ওর বুকটা এখনো ধুকধুক করছে। যদি খারাপ কিছু হতো! ও ভাবতে চায় না বাকিটা।

ইলা বাতি নিভিয়ে দেবে। এ সময় আরমান বলে, মোমবাতি জ্বালাবে না?

ফারহানা বহ্নি শিখা: পশ্চিম লন্ডন, যুক্তরাজ্য।