আমার মিসর ও ইউরোপ ভ্রমণ

ছাদ থেকেই পিরামিড, স্ফিংকস সব দেখা যেত
ছাদ থেকেই পিরামিড, স্ফিংকস সব দেখা যেত

বিদেশে বেড়াতে আমার অনেক ভালো লাগে। বিদেশে গিয়ে নতুন সংস্কৃতি জানা ও মানুষ দেখা আমার পছন্দ। কেন, তা আমি নিজেই জানি না। আমি বাংলাদেশি। কিন্তু জাপানে আমার জন্ম। ২০ বছর ধরে আমি যে জাপানেই আছি, সেটা একটা কারণ হতে পারে। কিন্তু আমি নিশ্চিত যে বিদেশে যেতে আমার আসলেই ভালো লাগে।

জাপানি স্কুলে জাপানি ভাষাতেই আমি পড়াশোনা করেছি। সেখানে আমার সব বন্ধুই ছিল জাপানি। তবে বাড়ির কাছে কয়েকজন বাংলাদেশি বন্ধু আমার ছিল। কিন্তু তারাও জাপানিতে কথা বলে। আমিও তাদের সঙ্গে জাপানিতে কথা বলতাম। পরিবারের সঙ্গে যখন বাংলাদেশে যেতাম, তখন সবার সঙ্গে একটু একটু বাংলায় কথা বলতাম। ছোটবেলা থেকেই তাই জাপানি আমার প্রথম ভাষা ছিল।

গত ২০ বছরে আমি কয়েকটা দেশে ঘুরেছি। বাংলাদেশ অবশ্যই এর মধ্যে আছে। এ ছাড়া আমেরিকা, আয়ারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুর—এসব দেশও ঘুরেছি। আর গত ফেব্রুয়ারি মাসে এক বন্ধুর সঙ্গে মিসর ও ইউরোপে গিয়েছি। ইউরোপে গ্রিস, ফ্রান্স, ও স্পেনে আমরা যাই। পুরো ফেব্রুয়ারি মাস ধরেই আমরা ঘুরেছি। এই ভ্রমণ ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের এক ভ্রমণ।

পিরামিডের ভেতরে ঢুকতে যাওয়ার সময় এলাকার ছেলেরা আমাদের পেয়ে খুশিতে ছবি তোলার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিল
পিরামিডের ভেতরে ঢুকতে যাওয়ার সময় এলাকার ছেলেরা আমাদের পেয়ে খুশিতে ছবি তোলার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিল

এই ভ্রমণের সূচনা আমার স্পেনে যাওয়ার ইচ্ছা থেকে। টোকিও বিদেশবিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বন্ধুর স্পেন ভ্রমণের ফেসবুক পোস্ট দেখে সেই আগ্রহ আমার মনে দেখা দেয়। এ ছাড়া স্পেনের লা লিগা নামের ফুটবল লিগের খেলা দেখতে পছন্দ করি। তাই সেই লিগের খেলা দেখার ইচ্ছাও আমার ছিল। আমি ছোটবেলা থেকে মেসিকে অনেক পছন্দ করতাম। তাই বার্সেলোনার খেলা দেখা ছিল প্রধান একটি উদ্দেশ্য।

সেই বন্ধুর ফেসবুক পোস্ট দেখার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু করলাম সঙ্গী খোঁজ। ইনস্টাগ্রামে এ নিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা ছিল এ রকম—আগামী শীতের ছুটিতে স্পেন ও অন্য কোনো দেশে যাব। কে আমার সঙ্গে যাবে? পোস্ট দেওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমার সেই বন্ধু এসে উপস্থিত হয়। জাপানের বাড়িতে থাকার সময় যে কলেজে আমি যেতাম, সেখানেই সেই বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। প্রথম বর্ষে একই ক্লাসে আমার পেছনে সে বসেছিল। সেই সূত্রে আমাদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তার পছন্দের খেলাও ফুটবল। কলেজের ফুটবল ক্লাবে সে সব সময় খেলত। তারও স্পেনের লা লিগা পছন্দ। কিন্তু তার পছন্দ রিয়াল মাদ্রিদ। স্পেনের লা লিগায় বার্সেলোনা ও রিয়াল মাদ্রিদ ১০০ বছরের বেশি আগে থেকে একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী। ‘এল ক্লাসিকো’ নামে এই দুই দলের খেলা স্পেন জুড়ে দেখা হয়। এই খেলা হলে সব সময় আমরা সেই খেলা নিয়ে কথা বলতাম। মাঝেমধ্যে বেশি কথায় গরম হয়ে ঝগড়াও করতাম।

তার সঙ্গে গত বছরের আগস্ট মাসে আমার আবারও দেখা হয় দুই বছর পর। ভ্রমণ নিয়ে কথা বলার জন্য আমরা দেখা করি। কোন কোন দেশে গিয়ে আমরা ঘুরব, শুরুতে সেটা ঠিক করে নিতে হয়েছে। আমাদের দেখা হওয়ার আগেই মেসেজে কথা বলে ঠিক করেছিলাম, স্পেন, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, ইতালি ও জার্মানিতে আমরা যাব।

আর্ক দ্য ত্রিয়োমফ থেকে প্যারিস শহর
আর্ক দ্য ত্রিয়োমফ থেকে প্যারিস শহর

তার সঙ্গে দেখা করার আগে সেই সব দেশের পর্যটনের বইও আমি কিনেছিলাম। কিন্তু তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎ আমার ইচ্ছা হলো মিসর যাওয়ার। গিজার পিরামিড দেখার ইচ্ছা থেকেই সেই ভাবনা। আমরা কলেজে থাকতে দুজনেই আমরা বিশ্বের ইতিহাস পড়তে পছন্দ করতাম আর এ কারণেই মিসরে যাওয়া আমরা ঠিক করে ফেলি। অন্য দেশগুলোতে যাওয়ার পাশাপাশি একই ভ্রমণে মিসরে গেলে অনেক টাকা জোগাড় করতে হবে বলে সুইজারল্যান্ড, ইতালি ও জার্মানি যাওয়ার চিন্তা আমরা বাদ দিই।

শেষ পর্যন্ত আমরা ঠিক করি, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথমে মিসর, এরপর ট্রানজিটের জন্য গ্রিস এবং সেখান থেকে ফ্রান্স ও স্পেনে যাব। ভ্রমণ–পরিকল্পনা ঠিক হয়ে যাওয়ার হওয়ার পরপরই আমরা বিমান টিকিট খুঁজতে শুরু করি। টিকিটও একসময় কিনে ফেলি। নিজেদের মতো করে কোথায় কোথায় আমরা ঘুরব, পরের কয়েক মাসে তা আমরা ঠিক করেছি। এভাবে আমাদের ভ্রমণের সময় এসে পড়ে।

প্রথমে আমরা গিয়েছি মিসরে। গিজার পিরামিডের সামনের এক হোটেলে আমরা ছিলাম। সকালের নাশতা থেকেই আমাদের খাওয়াদাওয়া হোটেলের ছাদেই করেছি। ছাদ থেকেই পিরামিড, স্ফিংকস সব দেখা যেত (ছবি ১)। প্রথম দিনে কায়রোর পুরোনো শহরে আমরা গিয়েছি। প্রাচীন ও সুন্দর অনেক মসজিদ সেখানে আছে। বিদেশি পর্যটকও সেখানে অনেক দেখেছি। এদের বেশির ভাগই ছিল ইউরোপীয় ও চীনা। জাপানি অনেক কম দেখতে পেয়েছি।

আলহামরা প্রাসাদ
আলহামরা প্রাসাদ

গিজার পিরামিডে প্রতিদিন রাতে পিরামিডের ইতিহাস বর্ণনা করে অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়। প্রতিদিন ইংরেজিতে সেটা হলেও ইংরেজির পাশাপাশি চীনা, স্প্যানিশ, ফরাসি ও আরবিতে ভাষাতেও পালাক্রমে একেক দিন সেটা প্রচার করা হয়। ইতিহাসের বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে পিরামিডগুলোতে আলো জ্বালানো হয়। সেই বর্ণনা শুনতে শুনতে আমরা হুঁকা খেয়েছিলাম। কিন্তু আমার কাছে একটুও ভালো লাগেনি। পরের দিন আমরা অবশেষে পিরামিডে গিয়েছি। ভেতরে ঢুকতে যাওয়ার সময় এলাকার ছেলেরা আমাদের পেয়ে খুশিতে ছবি তোলার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিল (ছবি ২)।

ভেতরে ঢুকতেই পর্যটকদের জন্য উটের ব্যবস্থা করে দেওয়া একজন আমাদের কাছে আসে এবং কিছুক্ষণ কথা বলে আমাদের উট নিয়ে পিরামিডের আশপাশে ঘুরিয়ে দেখায়। প্রথমবার উটের পিঠে উঠেছিলাম বলে একটু ভয় আমার করছিল। কিন্তু খুব মজা পেয়েছি।

মিসরে ভ্রমণ শেষ করে এরপর আমরা যাই ফ্রান্সে। তবে যাওয়ার পথে আমাদের গ্রিসে ট্রানজিট ছিল। সেখানে এথেন্সেও ঘোরার কথা ছিল আমাদের। কিন্তু আমার বন্ধুর শরীর অনেক খারাপ হয়ে যাওয়ায় আমরা আর কোথাও যাইনি।

আলহামরা প্রাসাদ
আলহামরা প্রাসাদ

ফ্রান্সে পৌঁছে সেদিনই আমরা প্যারিসের নটর ডেম গির্জা, আইফেল টাওয়ারে গিয়েছি। নটর ডেম গির্জা খুব সুন্দর। কয়েক মাস আগের ঘটনা শুনে আমার খুব দুঃখে হয়েছে। আইফেল টাওয়ারে রাতে গিয়েছিলাম। খুব ঠান্ডা ছিল। কিন্তু টাওয়ারের ওপর থেকে যেই দৃশ্য দেখেছি, সেটা দেখে যেন ঠান্ডার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। পরের দিন আমরা লুভর মিউজিয়ামে গিয়ে সারাটা দিন কাটিয়েছি। মোনালিসার সেই বিখ্যাত ছবি সেখানে আমি দেখেছি। অন্য দিনগুলোতে আমরা আর্ক দ্য ত্রিয়োমফ থেকে প্যারিস শহর দেখেছি (ছবি ৩)। ভার্সাইয়ের প্রাসাদও দেখেছি।

প্যারিসের ভ্রমণ শেষ করে আমরা স্পেনে যাই। প্রথমে বার্সেলোনায়। সেখানে আমার বাবার এক আত্মীয় আছেন। তাঁর কাছে আমরা পাঁচ দিন থেকেছি। যেদিন আমরা পৌঁছাই, সেদিনই আমার স্বপ্নের দল বার্সেলোনার ফুটবল খেলা দেখতে গিয়েছিলাম। জার্সি আর কিছু কিছু স্মারক কিনে নিয়ে খেলা দেখেছি। মেসির দেওয়া গোলে বার্সেলোনা সেই খেলায় জিতেছিল। আর তাই আমার অনেক ভালো লেগেছে। পরদিন থেকে অনেক জায়গায় ঘুরেছি, অনেক ধরনের খাবার খেয়েছি। বার্সেলোনায় পাঁচ দিন কাটিয়ে গ্রেনাডায় আমরা গিয়েছি। বার্সেলোনা থেকে প্লেনে দেড় ঘণ্টা লেগেছে। গ্রেনাডায় দেখার জিনিস শুধু একটাই ছিল—আলহামরা প্রাসাদ। কলেজে থাকতে আমরা স্পেনে ইসলামের শাসন নিয়ে পড়েছিলাম। এত সুন্দর জায়গা কখনো দেখিনি (ছবি ৪ ও ৫)।

মাদ্রিদে প্যালেসিও রিয়ালের রয়্যাল প্রাসাদ
মাদ্রিদে প্যালেসিও রিয়ালের রয়্যাল প্রাসাদ

গ্রেনাডায় এক দিন থেকে আমরা বাসে মাদ্রিদ যাই। মাদ্রিদ প্যালেসিও রিয়ালের রয়্যাল প্রাসাদ (ছবি ৬), রিয়াল মাদ্রিদের স্টেডিয়াম, এসব জায়গায় গিয়েছি। আর আমরা ফিরে আসার আগের দিন এক দিনের জন্য টলেডোতে গিয়েছিলাম। মাদ্রিদ থেকে টলেডো যেতে এক ঘণ্টা লাগে। সেই শহর অনেকটা গ্রামের মতো হলেও খুব সুন্দর জায়গা সেটা।

এই ভ্রমণটা আমি অনেক উপভোগ করেছি। আসলেই আরও একবার বার্সেলোনায় আমি যেতে চাই। এবারের গ্রীষ্মে আমি হয়তো যাব। আগামী সেপ্টেম্বর মাসে আমি এক বছরের জন্য লেখাপড়া করতে কানাডায় যাব। পড়াশোনার বাইরে কানাডায় ঘোরাঘুরিও করব অবশ্যই করব। আমার জীবনে এক শটার চেয়ে বেশির দেশে ঘোরার স্বপ্ন আমি দেখছি।

মো. ফাহিমুল আলম: তৃতীয় বর্ষ, বাংলা বিভাগ।