আমার ধর্ম

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

আমাদের দেশে ধর্ম খুব দৃঢ় নয়। কেউ কেউ বলে থাকেন ‘শবানুগমন ধর্ম’ হচ্ছে আমাদের ধর্ম। মানে শবানুগমন বা কারও মৃত্যুর পর শেষকৃত্যের অনুষ্ঠান ছাড়া ধর্ম পালনের জন্য আমরা আর তেমন কিছু করি না। কিন্তু আমাদের অনেক সংস্কৃতি বা অভ্যাস ধর্ম থেকে জন্ম নিয়েছে। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে সে রকম অনেক কিছু এখনো আছে। এ সবকিছুর মধ্যে বিশেষ একটা সংস্কৃতি আমাদের আছে। সেটা হচ্ছে ‘অবন’।

আগস্ট মাসের ১৩ থেকে ১৬ তারিখ পর্যন্ত অবন পালন করা হয়। বলা হয়, অবনের সময় আমাদের পূর্বপুরুষেরা বাড়িতে ফিরে আসেন। এই সময়ের আগে শসা আর বেগুন দিয়ে ঘোড়া আর গরু তৈরি করতে হয়। কেননা আমাদের তৈরি করা সেই ঘোড়ায় চড়ে পূর্বপুরুষেরা আসবেন। অবনের প্রথম দিন আমরা বাড়ির বাইরে আগুন জ্বালাই বা আলো রেখে দিই। বাড়িতে ফেরা পূর্বপুরুষেরা যেন পথ হারিয়ে না ফেলেন, সে জন্য আমরা এ রকম করি। পূর্বপুরুষেরা যখন আমাদের কাছে আসেন, তখন পরিবারের সবাই মিলে আমরা ভালো খাবার একসঙ্গে খাই। অবনের শেষের দিন বেগুন দিয়ে তৈরি করা গরুতে চড়ে তাঁরা আকাশে ফিরে যান।

আমার দাদু চলে গেছেন দুই বছর আগে। তাঁর মৃত্যু ছিল আমার জন্য কারও প্রথম মৃত্যুর অভিজ্ঞতা। এর আগে পর্যন্ত আমি ছোট ছোট টিকটিকি বা মাছের মরে যাওয়ার কথা জেনেছি। কিন্তু দাদুর মৃত্যু ছিল সেগুলো থেকে একদম আলাদা। আমার জানা আছে, যারা জীবিত, তারা প্রত্যেকেই নশ্বর। তবে প্রকৃতপক্ষে মৃত্যুর সত্যিকার অর্থ আমার জানা ছিল না। মৃত্যু, সে যে তোমার বিশ্বকে বিনষ্ট করে দেয়! দাদুর চলে যাওয়ায় আমার বিশ্বও নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, আমি কেঁদেছিলাম।

দাদুর সঙ্গে ছোটবেলায় লেখক
দাদুর সঙ্গে ছোটবেলায় লেখক

আমার জন্মের প্রথম দিন থেকে দাদু ছিলেন আমার কাছের মানুষ। কিন্তু এখন তিনি নেই। হারিয়ে গেছেন আমাদের কাছে থেকে। আবার দেখা করতে বা কথা বলতে পারব না। এ কথা ভেবে আমার খুব কষ্ট হয়েছে তখন। তাই আবারও প্রিয়জন হারানোর কথা মনে হলে আমার ভয় হয়। কিন্তু দাদুর শবানুগমন বা অন্ত্যেষ্টির অনুষ্ঠানে পুরোহিত বলেছেন, ‘তোমার দাদু অভিভাবক হয়ে আকাশ থেকে তোমাকে দেখবেন। তোমাদের জন্য সব সময় আশীর্বাদ করবেন, তোমাদের তিনি রক্ষা করবেন।’ পুরোহিতের সেই কথা শুনে আমার মন একটু হালকা হয়েছে। মনে হয় সেদিন আমি প্রথমে ধর্মের গুরুত্ব কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছি।

দাদুর শেষকৃত্যের অনুষ্ঠান হয়ে যাওয়ার কয়েক দিন পর আমার দিদিমা একদিন হঠাৎ করে বলেছিলেন, ‘হৃদয়ের মধ্যে ধরে রাখা দেবতাকে আমি প্রতিদিন দুবার উপাসনা করি।’

আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘কী প্রার্থনা করেন, দিদিমা?’ উত্তরে তিনি বলেছেন, ‘প্রার্থনা নয়, আমি বলি ধন্যবাদ।’

পারিবারিক সমাধিতে
পারিবারিক সমাধিতে

দেবতাকে কেউ নিজের মধ্যে জন্ম দিতে পারে কি? হাস্যকর শোনালেও সেদিন আমি এটা নিয়ে উপহাস না করার চেষ্টা করেছি।

দিদিমার কাছে তাই আমার প্রশ্ন ছিল, ‘কী জন্য ধন্যবাদ বলেন?’

‘সকালে ঘুম থেকে উঠেছি সে জন্য আমি ধন্যবাদ বলি। বয়স ৯১ হয়ে গেছে, অনেক কিছু আমি এখন আর করতে পরি না। তবে তারপরও এই যে কিছু করতে পারছি, সে জন্য আমি কৃতজ্ঞ। সামান্যক্ষণ জীবনযাপন করে আমি জেনেছি যে আমি নিজের শক্তিতে আমি বেঁচে থাকি না। তাই সকালে বলি, আজও যে ঘুম থেকে উঠতে পারলাম, সে জন্য অনেক ধন্যবাদ। আর রাতে বলি, আজ যে একটি দিন শান্ত জীবন কাটাতে পারলাম সে জন্য ধন্যবাদ, খুব ধন্যবাদ।’

কামাকুরায় পরিবারের সঙ্গে
কামাকুরায় পরিবারের সঙ্গে

দিদিমার কথা প্রথমে আমার কাছে খুব হাস্যকর মনে হয়েছিল। কিন্তু পরে আমি ভেবে দেখেছি, আমার দিদিমা ঠিকই বলেছেন। প্রত্যেক ধর্মেই মানুষ নিজের হৃদয়ে দেবতা তৈরি করে নেয়। বাইবেল বা অন্য ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে কিংবা মহামানবের কথা শুনে মানুষের নিজের মনে দেবতা জায়গা করে নেন আর মানুষ পূজা করে নিজের ধর্মের সেই দেবতাকে। আমিও তাই করছি। আমার মনে দেবতা হয়ে আছেন আমার দাদু। তিনি আমাকে দেখছেন সব সময়। তাই খারাপ কিছু আমি করতে পারি না। কিংবা যখন আমার দুঃখ হয়, তখন আমি ভাবতে পারি যে, দাদু আমার কাছেই আছেন।

আমার পরিবার বৌদ্ধধর্মের আচার অনুসরণ করে অন্ত্যেষ্টি পালন করেছে। তবে বৌদ্ধধর্ম নিয়ে তেমন বেশি কিছু আমাদের জানা নেই। আমি হলাম সাধারণ জাপানি। আমার ধর্ম তবে কি কেবলই শবানুগমনের ধর্ম?
---

ইউরিয়ে এন্দো: শিক্ষার্থী, টোকিও বিদেশবিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়, তৃতীয় বর্ষ, বাংলা বিভাগ।