রঙের কাব্য সবুজ

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

আট বছরের জন্মান্ধ ছেলেকে নিয়ে বাবা ইমামুদ্দিন বের হয়েছেন। অনেক দিন ছেলেকে নিয়ে বাইরে যাওয়া হয়নি। ছেলের ইচ্ছেতেই বাবা আজকে বের হলেন। ইমামুদ্দিন সাহেবের একটুও ইচ্ছে করে না, তার এই অন্ধ ছেলেকে নিয়ে বাইরে যেতে। কী হবে ওকে নিয়ে বাইরে গিয়ে। ও তো কিছুই দেখতে পায় না। কোনো মানে হয়? না হয় না।

তবুও যেতে হচ্ছে। ছেলে অনেক দিন ধরেই বায়না ধরেছে, বাবা বাইরে যাব, বাইরে যাব। আজকে তাই ইমামুদ্দিন কাজ থেকে ফিরেছেন আগেই। ছেলেকে নিয়ে নদীর ধারে বেড়াতে যাবেন। আজকে তিনি ছেলেকে নিয়ে নদীর ধারের সবুজের অরণ্যে ঘুরে বেড়াবেন। ছেলে দেখতে পায় না তাতে কী? নিজে তো দেখতে পান।

ছেলের জন্মের পর থেকে তিনি কোনো দিন একবারও প্রাণ খুলে হেসেছেন বলে মনে হয় না। অন্ধ ছেলের বাবা হওয়ার কী যে কষ্ট, তা কি আর অন্যেরা বুঝবে? বুঝবে না। বাইরে বের হলেই পরিচিত লোকজনের একই কথা, একই প্রশ্ন, উপদেশ, ‘কী ইমামুদ্দিন সাহেব, ছেলের চোখ কি আর ভালো হলো না? এই যুগে এসব কী আর কোনো ব্যাপার ইমামুদ্দিন সাহেব। ভালো ডাক্তার দেখান। ডোনার খোঁজেন, চোখ রিপ্লেসমেন্ট করান। এভাবে আর কত দিন?’

ইমামুদ্দিনের এসব কথা ভালো লাগে না। একদমই না। তিনি বাবা, তার চেয়েও কি অন্য মানুষের বেশি কষ্ট? তার চেয়েও কি অন্যেরা বেশি জানেন? ইমামুদ্দিন এই ছেলের চোখ ভালো করার জন্য কত কী করেছেন, করে যাচ্ছেন। মাঝে মাঝে এই সব অতি উৎসাহী লোকজনকে ধরে মারতে ইচ্ছে করে। তা তো আর সম্ভব না। বরং তাদের কথার উত্তর না দেওয়াই উত্তম এবং তিনি আজকাল তা-ই করেন।

ছেলেকে তিনি আজকে বাসা থেকে পুরোটা পথ একদম কাঁধে করে নিয়ে এলেন। আহা কী আলোঝলমলে রৌদ্রকরোজ্জ্বল বিকেল। এইতো একটু দূরেই সবুজ ধানের খেত। দখিনা বাতাসে ধানের সবুজ ডগাগুলো কেমন আছড়ে পড়ছে। কী অপরূপ ঢেউখেলানো এই দৃশ্য। অনেক দিন পর প্রকৃতির এমন কাছাকাছি এসে তিনি যেন মিশে যেতে লাগলেন প্রকৃতির সঙ্গে। এক নিমেষেই ফিরে গেলেন তার ফেলে আসা শৈশব-কৈশোরে। এইতো কদিন আগের কথা। তার বাবাও ঠিক এমনি করেই তাকে কাঁধে করে বেড়াতে নিয়ে যেতেন। বাবা তো আর নেই। কিন্তু স্মৃতিগুলো কত অমলিন।

ছেলে বাবার কাঁধে বসে বাবার গলার দুই পাশ দিয়ে দুই পা ঝুলিয়ে দিয়ে জোরে মাথার চুল টেনে ধরে আছে। একটু এগিয়ে গিয়ে ইমামুদ্দিন ছেলেকে আস্তে করে কাঁধ থেকে নামিয়ে নিলেন। অনেক যত্ন করে ছেলেকে সবুজ ঘাসের ওপর বসিয়ে দিলেন। এবার খুব মনোযোগ দিয়ে ছেলেকে দেখতে লাগলেন। কী সুন্দর দেখতে তার ছেলেটা। চোখের দিকে তাকিয়ে কে বলবে এই ছেলেটা জন্মান্ধ, কিছু দেখতে পায় না।

ইমামুদ্দিনের বুকের ভেতরটা কেমন হুহু করে উঠল। ছেলেকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরলেন। কপালে, গালে, চোখে আদর করলেন। অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে থাকলেন।

ছেলে এবার মুখ খুলল, ‘বাবা, আমরা কোথায় এসেছি? বাতাস খুব ভালো লাগছে। তুমি আমাকে এত আদর করছ কেন বাবা? তোমার কি খুব মন খারাপ?’ ইমামুদ্দিন ছেলের এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন না। তার গলা ধরে আসে। ছেলেকে আবারও জড়িয়ে ধরেন। ছেলে আবারও প্রশ্ন করে, ‘বাবা আমরা কোথায় এসেছি?’ এবার তিনি বলেন, ‘আমরা নদীর ধারে বেড়াতে এসেছি। দেখো চারদিকে কী সুন্দর সবুজ আর সবুজ।’

ছেলে বাবাকে বলে, ‘বাবা আমিতো দেখতে পাই না। আচ্ছা বাবা সবুজ দেখতে কেমন? বলো না বাবা সবুজ কেমন দেখতে? আমাকে বুঝিয়ে বলো।’ এবারে ইমামুদ্দিন অনেকটাই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। ইমামুদ্দিনের বুদ্ধিতে ঠিক আসে না একজন জন্মান্ধ মানুষের কাছে রং কেমন। একজন জন্মান্ধ আসলে কল্পনাতে কী দেখে? আদৌ কি কিছু দেখে? খুব জানতে ইচ্ছে করে। ইমামুদ্দিনের মনে হয় তিনি যদি তার ছেলের মনের মধ্যে প্রবেশ করতে পারতেন তাহলে বুঝতেন জন্মান্ধ এই ছেলেটি আসলে কী ভাবে, অথবা কল্পনায় কী দেখে। আজকে ছেলেকে বোঝাতে হবে সবুজ আসলে কেমন দেখতে।

ইমামুদ্দিন বললেন, ‘বলছি বাবা দাঁড়াও।’ তিনি অনেকগুলো সবুজ ঘাসের ডগা ছিঁড়ে নিলেন। একটু দূরে লতিয়ে ওঠা কলমি গাছের কয়েকটি পাতাও ছিঁড়ে নিলেন। তিনি পাতাগুলো ছেলের হাতে দিয়ে বললেন, ‘এইগুলো হলো সবুজ।’ ছেলে খুব মনোযোগ সহকারে পাতাগুলো হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে অনুভব করল। অনেক বড় একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন চোখেমুখে ফুটে উঠল। বাবাকে জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা আমিতো সবুজ বুঝতে পারছি না।’

এবার ইমামুদ্দিন ছেলের খুব কাছে চলে এলেন। কয়েকটি সবুজ পাতা নিজের হাতে নিয়ে ছেলের নরম হাতও পাতার ওপরে রাখলেন। বললেন, ‘দেখো বাবা সবুজ হলো এমন। গাছের পাতা, নরম, সতেজ, সুন্দর।’ এটুকু বলে একটি কলমি পাতার ডগা ছেলের গালে ছোঁয়ালেন। বললেন, ‘বাবা, এটা হলো সবুজ।’ ছেলে কলমির সবুজ ডগা নিজের গালে চেপে ধরে রইল অনেকক্ষণ। এবার ইমামুদ্দিন গাছের কয়েকটি মরা পাতা কুড়িয়ে আনলেন। রোদে শুকিয়ে যাওয়া মরা পাতাগুলো ছেলের হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন, ‘এগুলোও পাতা কিন্তু এগুলো সবুজ না। কারণ এগুলো শক্ত, খসখসে, এগুলো মৃত, এগুলো হলো বাদামি।’

ছেলে একটু অবাক হয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করল, ‘সবুজ মানে কি জীবিত?’ বাবা বললেন, হ্যাঁ। ছেলে বলল, ‘তাহলে আমরা কি সবুজ? আমি কি সবুজ? তুমিও কি সবুজ?’ ইমামুদ্দিন এবারে একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘হ্যাঁ বাবা তুমি সবুজ। তুমি একদম সবুজ।’ ছেলে বলল, ‘আর তুমি?’ ‘আমিও সবুজ, তবে তোমার চেয়ে একটু হালকা সবুজ।’ এইটুকু বলেই ইমামুদ্দিন ঘাবড়ে গেলেন, ছেলে যদি জিজ্ঞেস করে বাবা হালকা সবুজ কেমন। নাহ ছেলে আর সেটা জিজ্ঞেস করল না।

ইমামুদ্দিন ছেলেকে এবারে দখিনা বাতাসে দোল খাওয়া ধানখেতের একদম পাশে নিয়ে গেলেন। নিজের ও ছেলের কান একদম ধানগাছের কাছাকাছি স্পর্শ করালেন। এবারে ছেলেকে বললেন, ‘তুমি কি কিছু শুনতে পাচ্ছ?’ ছেলে প্রথমে না করে পরে জানাল, হ্যাঁ সে কিছু শুনতে পাচ্ছে। ঘাসের ওপর থেকে কান সরিয়ে এবারে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখন শুনতে পাচ্ছ?’ ছেলে বলল, না। তখন ইমামুদ্দিন বললেন, ‘ঘাসের সঙ্গে কান লাগিয়ে যে শব্দ তুমি শুনতে পাচ্ছ, ওটাও সবুজ।’ ছেলে মাথা নাড়ল। এমন সময় হঠাৎ করে একটু দূরে ফুলে ফুলে ভরে ওঠা তিলের খেতে কয়েকটা সুইচোর পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ শুনতে পেল। ছেলে কান খাঁড়া করে সেদিকে মনোনিবেশ করে বাবাকে জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা, ওই শব্দটাও কি সবুজ?’ বাবা বললেন, ‘হ্যাঁ, ওই শব্দ যে পাখিটা করছে ওই পাখিটাও সবুজ। পাখিরা সবুজ গাছে থাকে, তাই পাখির শব্দ সবুজ। তবে সব পাখি সবুজ না।’ ছেলে পরবর্তী প্রশ্ন করার আগেই ইমামুদ্দিন একটা উত্তর ঠিক করে রাখলেন।

ইমামুদ্দিন ভাবতে লাগলেন, ছেলেকে কি তিনি সবুজ বোঝাতে পেরেছেন? নাহ, হয়তো পুরোপুরি না। ভাবতে লাগলেন আরও কীভাবে তিনি ছেলেকে সবুজ রং বোঝাবেন। এবারে তিনি ছেলেকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, ‘বাবা তুমি কি সবুজ বুঝতে পারো এখন?’ ছেলে উত্তর দিল, ‘একটু একটু পারি।’ এবারে তিনি ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি তোমার মাকে খুব পছন্দ করো?’ ছেলে মাথা নাড়ল। বাবা জিজ্ঞেস করলেন, ‘অনেক পছন্দ করো?’ ছেলে এবার আরও জোরে মাথা নাড়ল। ‘এখন তুমি কি ভাবছ, তোমার মা সঙ্গে থাকলে আরও ভালো হতো?’ ছেলে বলল, হ্যাঁ। ‘আচ্ছা অন্যদিন তোমার আম্মুকেও সঙ্গে নিয়ে আসব। কিন্তু এই যে তুমি তোমার আম্মুকে ভালোবাসো, আম্মু সঙ্গে না থাকলে তোমার খারাপ লাগে, আম্মু তোমাকে আদর করে, আম্মুকে মিস করো, এই সবই হলো সবুজ।’ ছেলে এবার খিলখিল হেসে উঠল। ‘বাবা, আর তোমাকে যে আমি পছন্দ করি, সেটাও কি সবুজ না?’ ইমামুদ্দিন মুচকি হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ বাবা, সেটাও সবুজ।’

‘বাবা, তোমরা তো অনেক রঙের কথা বলো—লাল, নীল, সাদা, কালো, হলুদ, অরেঞ্জ, আরও কত কী। সবুজ রং দিয়েই যদি এত কিছু হয় তবে সব রং দিয়েই কি এমন অনেক কিছু হয়?’ ইমামুদ্দিন ছেলের প্রশ্নে একটু অবাক হলেন। তিনি কী অনেক জটিল করে ছেলেকে রং বোঝাচ্ছেন? ছেলেকে বললেন, ‘হ্যাঁ বাবা, রং হলো এমন একটা জিনিস, রং দিয়ে সবকিছুকেই ব্যাখ্যা করা যায়। আবার সবকিছু দিয়েই রংকেও ব্যাখ্যা করা যায়। রং আছে বলেই মানুষ স্বপ্ন দেখে। রঙের প্রত্যাশাতেই মানুষ বাঁচে।’ ছেলে হা করে বাবার মুখে রদিকে তাকিয়ে রইল। বাবাও নিজেকে সামলে নিলেন।

ছেলে বাবাকে বলল, ‘ঠিক আছে বাবা, আমাকে এবার নীল রঙের কথা বলো।’ ইমামুদ্দিন ছেলেকে আবারও কাঁধে তুলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। বললেন, ‘আজকে আর না বাবা। আরেক দিন তোকে নীল রং চেনাব।’ ছেলে দুই পা বাবার গলার ওপাশে নামিয়ে নিয়ে অনেক জোরে বাবার মাথার চুল টেনে ধরে পরম নিশ্চিন্তে বসে রইল। ছেলের কল্পনাজুড়ে এখন শুধুই সবুজ আর সবুজ।
---

নুরুল হুদা পলাশ: সাস্কাতুন, সাস্কাচেওয়ান, কানাডা। ইমেইল: <[email protected]>