আমাদের অটিজম পরিক্রমা

আবরারের সঙ্গে লেখিকা
আবরারের সঙ্গে লেখিকা

অটিজম বর্তমানে কোনো অজানা বিষয় বা নতুন প্রত্যয় নয়। বিশ্বের অধিকাংশ দেশের জনগণই এর সঙ্গে কমবেশি পরিচিত। এটি কোনো ব্যাধি নয় বরং মানুষের শরীরের স্নায়বিক বিকাশের ঘাটতিজনিত একটি অবস্থামাত্র।

অটিজমে আক্রান্তদের সাধারণত কয়েকটি বৈশিষ্ট্য থাকে। এরা একাকী নিজস্ব জগতে বিচরণ করতে আগ্রহী হয়। গুছিয়ে কথা বলতে সক্ষম হয় না। তাঁদের কথা বলায় অস্পষ্টতা থাকে। অনেকের বাক্‌ক্ষমতা প্রায় থাকে না। অন্যের কোনো প্রশ্নে সাড়া দেয় না। বিশেষ কোনো একটি বিষয় ও খাদ্যের প্রতি অনুরক্ত থাকে। একই কাজ বারবার পুনরাবৃত্তি করে। কোনো বিশেষ গন্ধ বা শব্দের প্রতি অতিমাত্রায় সংবেদনশীলতা আর ভীতি। কারও চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে বা ভাব বিনিময়ে অনীহা। কোনো একটি নির্দিষ্ট রুটিন নিয়মে চলে। আর এর পরিবর্তন হলে রাগ প্রকাশ করে। অন্যের অনুভূতি সঠিকভাবে বুঝতে অক্ষম হয় বা দীর্ঘ সময় নেয়। এগুলো হলো অটিজম আক্রান্তদের খুব সাধারণ বৈশিষ্ট্য। যা জন্মের ১৮ মাস বা তিন বছর বয়স থেকে লক্ষ করা যায়। অটিজমের আরেকটি লক্ষণ হলো খাদ্যের প্রতি অনীহা।

অটিজম আমার জীবনের এক ব্যতিক্রমী ও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত অধ্যায়ের রূপকার। আমাদের কানাডায় আগমন ২০০৫ সালের ডিসেম্বর মাসে। ২০১০ সালের জুলাই মাসে কানাডার হ্যালিবার্টন আমরা যমজ দুটি সন্তান—আবরার ও রাফির মা–বাবা হই। তাদের জন্মমুহূর্তের সেই অনুপম অপার্থিব আবেশের রেশ, অনন্য অনুভূতি আর কোলজুড়ে আসা ফুটফুটে দুই শিশুর অপলক নিষ্পাপ দুই জোড়া চোখ নিমেষেই আমাকে প্রায় ৯ মাসের যাপিত জীবনের দিকগুলো প্রায় ভুলিয়ে দিয়েছিল।

এর কয়েক বছর আগে অটোয়ায় অবস্থানকালে আমার প্রথম গর্ভধারণের পর গর্ভপাতের অভিজ্ঞতা হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই মানসিক ও শারীরিকভাবে সেই সময়টাতে অনেকটা বিপর্যস্ত ছিলাম। দুঃখজনকভাবে এই বিশেষ শারীরিক অবস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল এক বিপরীতমুখী অভিজ্ঞতা। সেটি হলো দেশের নিকট আত্মীয়দের পক্ষ থেকে গর্ভপাতের বিষয়টি নিয়ে নেতিবাচক অভিমতের ঝড়। দু-একজন প্রকৃত শুভাকাঙ্ক্ষীকে বাদ দিলে দেশে নিকটজনদের অযাচিত সমালোচনা, কৌতূহল, মিথ্যা সংস্কার তাড়িত ভ্রান্ত ব্যাখ্যার ফলে অনেকটা বিব্রতবোধ করতাম।

হ্যালিফ্যাক্সে আমাদের বাচ্চা জন্মের ছয়–সাত মাস পর থেকেই লক্ষ করলাম আমার দুই বাচ্চার মধ্যে দশ মিনিট আগে যে ভূমিষ্ঠ হয়েছে অর্থাৎ বড় শিশুটি আবরার হাসনাত এহসান, তুলনামূলকভাবে কম সক্রিয়। চারপাশের কোনো শব্দ বা পরিবর্তনের প্রতি তার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া কম অথবা প্রায় নেই বললেই চলে। রাতের অন্ধকার ও অন্যান্য পরিবর্তনকে সে সহজভাবে নিতে পারত না।

প্রবাসে একই সময়ে দুই সন্তান পালন কর্মে ক্লান্ত আমি নিজেকে আনমনে প্রবোধ দিতাম, হয়তো বা আবরার শান্ত স্বভাবের। আমরা দুজন নানা কথোপকথনের মাধ্যমে আবরারের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবের বিকাশ ঘটাতে চেষ্টা চালাতাম। আবরার ওর বাবা এহসানের কাছে অনেকটা সময় থাকত। আমার পাশাপাশি এহসানও যথেষ্ট সময় দিয়েছে। আমরা দুজন নানা কথোপকথনের মাধ্যমে আবরারের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবের বিকাশ ঘটাতে চেষ্টা চালাতাম। জন্মের পর থেকেই আবরার বাবার সঙ্গে অধিকাংশ সময় ঘনিষ্ঠ। বাবা এখন পর্যন্ত তার সব সময়ে পরম নির্ভরতার স্থান। দ্বিতীয় সন্তান রাফিকে অধিকাংশ সময় আমি লক্ষ রেখেছি। এভাবে দুজনে দুটি সন্তানের দায়িত্বভার ভাগ করে নিয়েছি।

সপরিবার লেখিকা
সপরিবার লেখিকা

কিন্তু ক্রমান্বয়ে লক্ষ্য করলাম, আবরারের বিষয়টি আমরা যতটা সহজ ভেবেছি, আদৌ তেমন নয়। রাফির মোটামুটি স্বাভাবিক একটি শিশুর মতো হাসিখেলার মধ্যে বিকাশ ঘটেছিল। অপর দিকে আবরার তার বয়সী কোনো শিশুর সঙ্গে সহজভাবে মিশতে আগ্রহী নয়। সে নিজেকে ক্রমেই গুটিয়ে নিচ্ছিল। শিশু আবরার নিজের জগতে নির্দিষ্ট একটি গণ্ডিতে আবদ্ধ রেখে চলতেই পরম স্বস্তি অনুভব করত।

নতুন মা-বাবা হিসেবে আমাদের শিশুর সঠিক পরিচর্যা–সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ও তথ্য দিতে হ্যালিফ্যাক্সের পাবলিক হেলথ নার্স ও সমাজকল্যাণ বিভাগের কর্মীরা বাসায় আসতেন। তাঁদের কয়েকজন আবরারের আচরণের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ার অভাবের বিষয়টির প্রতি বিশেষভাবে আমাদের মনঃসংযোগ করতে অনুরোধ করেন। তাঁরা এ প্রসঙ্গে আমাদের কয়েকটি বই ও খেলনা দেন। পাশাপাশি মা-বাবার করণীয় নানা আচরণের ধারণা দেন। আমরা নানা রকম আচরণ কর্মে বিকাশে সহায়ক খেলনা (Activity Toy), বই সংগ্রহ ও কথোপকথনের চর্চা চালিয়ে যেতে শুরু করলাম।

আমার জীবনসঙ্গী এহসান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরি থেকে ছুটি নিয়ে অটোয়ার কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স সমাপ্ত করে হ্যালিফ্যাক্সের ডালহৌসি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছিল। সীমিত আয়ে আমাদের জীবন নির্বাহ করতে হতো। হ্যালিফ্যাক্সে আমাদের পরিচিতজনের গণ্ডি ছিল অনেক ছোট। এ সময় আমাদের সহায়তায় এগিয়ে আসেন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক ফজলে সিদ্দিক স্যার। তিনি ছিলেন ডালহৌসি বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ও নিউ বার্নসউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্কুলের প্রাক্তন ডিন। তাঁর আন্তরিক সহায়তায় এহসান পিএইচডি গবেষণার পাশাপাশি ডালহৌসি বিশ্ববিদ্যালয়ে লোকপ্রশাসন আর ব্যবস্থাপনা বিভাগে খণ্ডকালীন ও অস্থায়ী কোর্স শিক্ষক হিসেবে পড়ানোর সুযোগ পায়। দেশ থেকে আনা আমার সঞ্চিত সামান্য কিছু অর্থ আর এহসানের সেই সীমিত উপার্জনের ওপর নির্ভর করে অতিবাহিত হচ্ছিল আমাদের জীবনচক্র।

কানাডায় আসার আগে বাংলাদেশে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন ও জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগে নেদারল্যান্ডসের সহায়তাপুষ্ট একটি প্রজেক্টে কিছুদিন কর্মরত ছিলাম। তবে নানা বাস্তবতায় কানাডায় পেশাগত জীবনে প্রবেশ করিনি। লেখালিখি করতাম। আমার দুটি বই প্রকাশিত হয়েছে। একটি ‘জেন্ডার শব্দকোষ’ ও অপরটি নারীর ক্ষমতায়নে গ্রামীণ ব্যাংকের ভূমিকাবিষয়ক। আমি নরওয়ে থেকে ‘জেন্ডার উন্নয়ন’ বিষয়ে এমফিল শেষ করে এসেছিলাম। তার ধারাবাহিকতার কানাডায় পিএইচডি করার অভিপ্রায়ে হ্যালিফ্যাক্সের সেন্ট মেরিস বিশ্ববিদ্যালয়ে উইমেন স্টাডিজ বিভাগে পড়া শুরু করেছিলাম। তবে শারীরিক অবস্থা, সন্তান ও সংসারকে প্রাধান্য দেওয়াটা বেশি প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। ফলে আমাকে এই অধ্যায়ের ইতি টানতে হয় অনেকটা বাধ্য হয়েই।

সন্তান জন্মদানের পর আমার দুই হাতের কবজিতে অবশ বোধ করতাম। চিকিৎসকেরা এ অবস্থাকে ‘কার্পেল টানেল সিনড্রম’ বলে চিহ্নিত করেন। আমার হাতের কবজিতে দুই মাসের ব্যবধানে অস্ত্রোপচার করতে হয়। কিছুটা কর্মক্ষমতা ফিরে পেলেও তা আগের মতো নয়। প্রায় ভগ্ন শারীরিক অবস্থা আর অর্থনৈতিক দোটানার নানা আশা–নিরাশা, দ্বিধা–দ্বন্দ্বের দোলায় আবরার ও রাফিকে নিয়ে ভিন্ন সামাজিক ও ভৌগোলিক পরিমণ্ডলে এক কঠোর সংগ্রামের পথ পাড়ি দিচ্ছিলাম।

প্রবাসে দুই সন্তানের মা হওয়ার পর সারা দিনের অপরিসীম ক্লান্তি শেষে প্রয়োজনীয় বিশ্রামের সুযোগ মেলেনি। প্রায়ই নির্ঘুম কেটে যেত রাত। আমাদের বাচ্চা দুটির নিষ্পাপ দুই মুখাবয়ব, হাসি আর বিশেষ করে রাফির স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণচাঞ্চল্য আমাকে মনোবল জোগাত। বাচ্চা দুটির জন্মের প্রায় ৯ মাস পর আট মাসের জন্য দেশ থেকে আমার শাশুড়ি এসেছিলেন। আর দ্বিতীয়বারের মতো বাবুদের প্রায় চার বছর হওয়ার পর তিনি কয়েক মাসের জন্য আমাদের সঙ্গে থেকেছিলেন। এই দুই ছেলেকে নিয়ে কানাডার প্রবাসের জীবনে সার্বিকভাবে বিগত প্রায় ৯ বছরের ভিন্নধর্মী সংগ্রাম দুজনকেই যৌথভাবে চালাতে হয়েছে।

আবরার আর রাফিকে নিয়ে আমাদের দিনগুলো অতিবাহিত হচ্ছিল। তবে আবরারের স্বাভাবিক ইতিবাচক বিকাশ ও মনঃসংযোগের মাত্রার তেমন উন্নতি লক্ষ করলাম না। তবে মা হিসেবে বিশেষভাবে অনুভব করতাম ওর চোখের একটি ব্যতিক্রমী ভাষার আবেদন আছে। তবে সেটার প্রকাশ খুব স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত নয়। বিষয়টি আমরা আমাদের চিকিৎসককে দ্রুত অবহিত করেছিলাম। পাবলিক হেলথ বিভাগের নার্স যাঁরা মাঝেমধ্যে নবজাতকের বিকাশের দিকনির্দেশনা দিতে আমাদের বাসায় আসতেন, তাঁরাও এই দিকটির ওপর আমাদের লক্ষ করতে বলেন।

আবরারের আত্মবিশ্বাসের মাত্রা বৃদ্ধির জন্যই প্রায়ই তাকে নিজের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে বলতাম, আবরার খুব ভালো সব পারে। আবরার কিছু প্রকাশ না করলেও লক্ষ করতাম সে কোনো এক ভরসার স্থান খুঁজে পেত। কিছুটা সন্ত্রস্ত হলে সে অপলক তাকিয়ে থাকত। মিষ্টি স্নিগ্ধতার রেশ জড়ানো হাসি ছড়িয়ে দিত। নির্মল স্নেহের প্রকাশ যেকোনো মানুষ মাত্রেই আর শিশুরা দ্রুত অনুভব করে। আর অটিস্টিক শিশুরা অনুভূতি খুব সূক্ষ্ম হয়। তাদের প্রতি কেউ আন্তরিকভাবে ভালোবাসা প্রকাশ করলে সেটাও দ্রুত অনুভব করে।

চিকিৎসকের পরামর্শ মতো আমরা আবরারের চোখের প্রতি দৃষ্টি রেখে উত্তর দিতাম আর নিয়মিতভাবে প্রশ্ন করতাম। যাতে করে সে অপরের সঙ্গে ভাব বিনিময়ের দিকটি রপ্ত করতে পারে। আমাদের সীমিত আয়ের সেই দোটানার সংসারে বাচ্চা দুটিই অবধারিতভাবে একমাত্র অনাবিল আনন্দের উৎস উঠল। আমরা দুজনই কোথায় বের হলেই জীবনের কঠিন বাজেটের কথা ভুলে বাচ্চাদের জন্য প্রয়োজনীয় খেলনা ও বই কিনতাম। সেই সময় হ্যালিফ্যাক্সে আমরা ডালহৌসি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট হাউজিংয়ে থাকতাম। সেখানে নিচতলায় একটি দিবা শিশু পরিচর্যা যত্ন কেন্দ্র বা ডে কেয়ার ও প্রি স্কুল ছিল। ভাগ্যক্রমে সেখানে আবরার ও রাফিকে ভর্তি করার সুযোগ মিলল। রাফি খুব চটপটে আর সব বিষয়ে করিতকর্মা স্বভাবের।

আবরারের সঙ্গে আমরা কী করি, সে দিকটা রাফি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করত। ছোট রাফির বন্ধুত্বপূর্ণ নানা উদ্যোগ আবরারের বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে দরকারি ছিল। তাদের প্রি স্কুলের অভিজ্ঞ শিক্ষকেরা জানালেন শুধু রাফির সঙ্গে কথোপকথন নয় বরং আবরারকে সবার সঙ্গে মিশতে হবে। ডে কেয়ারে নিয়মিত যাওয়ার ফলে অনেক শিশুর সঙ্গে পারস্পরিক সংযোগে সামান্য হলেও আবরারের সংকোচের মাত্রা কাটাতে সাহায্য করেছিল।

আবরার অতিরিক্ত মিষ্টি, টক, ঝাল, তৈলাক্ত কোনো রকম শক্ত প্রোটিন–জাতীয় খাবার খেতে পারে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অটিস্টিক বাচ্চাদের মুখ ও শরীরের স্নায়ু সংবেদনশীল থাকে। তাদের অতিরিক্ত আলো, শব্দ বা মসলাজাতীয় খাবার খুব কঠিন অথবা অতিরিক্ত বোঝার সমতুল্য হয়। যা Sensory Overload রূপে চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিশেষ পরিচিত। তাই প্রায় তেল-মসলা–বিবর্জিত সাধারণ ও ভিন্ন কায়দায় আবরারের খাবার তৈরি করার দিকটি আমরা রপ্ত করলাম।

(বাকি অংশ আগামীকাল পড়ুন)