টিউশনির দিনগুলো

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সে অনেক আগের কথা। বছর ২৫ তো হবেই। প্রথমেই বলে রাখি আমার নাম জামাল। যদিও নামের প্রথমে সৈয়দ আছে কিন্তু সৈয়দ তো আর ডাকনাম হতে পারে না। এটা হলো টাইটেল। ডাকনাম হচ্ছে যে নামে মানুষ কাউকে ডেকে শান্তি পায় ও যা আমরাও শুনতে অভ্যস্ত।

সৈয়দ নামের ওপর দিয়ে হ‌ুমায়ূন আহমেদ থেকে শুরু করে অনেক গুরুজন বুলডোজার চালিয়ে গেছেন। ‘বহুব্রীহি’ নাটক দেখার পর আমি নিজেই আসল নাকি নকল সৈয়দের বংশধর তা নিয়ে কিছুটা গবেষণা করেছি। আপাতত যা জেনেছি, তার বাকিটুকু জানতে গেলে ভারতের কাশ্মীর পর্যন্ত যেতে হবে। তার আগে ইরাক, ইরান কিংবা আফগানিস্তানের রুট। ওখান থেকেই নাকি বংশের বিস্তার শুরু হয়েছিল।

পলিমাটির দেশে শুধু মাটিই নয়, মানুষও ভেসে এসেছে বিভিন্ন উৎস থেকে। ভারিক্কির দিক দিয়ে জামাল নামটির ওজন একদমই কম। এ ধরনের নাম হয় সাধারণত রিকশাওয়ালা ও কুলি-মজুর টাইপের মানুষদের। কিংবা বড়জোর স্কুলের বদরাগী স্বল্প বেতনের কোনো শিক্ষকের নাম। এ যুগে নামটা খুব একটা যায় না। তবে কালেভদ্রে সচিব-মন্ত্রীদেরও এ নাম হতে দেখেছি।

আসল ঘটনায় ফিরে আসি। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। পড়ালেখা চালানোর পাশাপাশি একটা টিউশনি করি ঢাকার বাসাবোতে। ছাত্র উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের ইংরেজি মিডিয়ামের ছাত্র। নাম পিনাক। ক্লাস ফোরে পড়ে। সপ্তাহে চার দিন বাসায় গিয়ে পড়াতে হয়। মোটামুটি সব সাবজেক্টেই।

আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রাবণ বাসে চড়ে বাসাবোর বৌদ্ধ মন্দিরের দিকে নেমে কিছুটা হেঁটে গিয়ে ছাত্রের বাসায় কল বেল বাজাই। বেল বাজানোর পর কিছুক্ষণ দৌড়াদৌড়ির শব্দ শুনি। তারপর কিছুটা ফিসফিস করে কথাবার্তা। ছাত্রের মা ও ছেলের বাক্যবিনিময়। প্রায় মিনিট সাতেক অপেক্ষা করার পর আমি ছাত্রের সাক্ষাৎ পাই। মাথা নিচু করে হেলেদুলে পিনাক টেবিলের অন্য প্রান্তে এসে বসে।

বই-কলম নিয়ে টেবিলে আসার পরিবর্তে প্রায়ই দেখতাম অদ্ভুত উপায়ে হাজির হতো। যেমন কোনো দিন মোরগ লড়াইয়ের মতো করে এক পায়ে লাফাতে লাফাতে টেবিলে আসত। আবার কোনো দিন হয়তো হাতে দড়ি কিংবা হাতুড়ি নিয়ে টেবিলে আসত।

পিনাক টেবিলে বসার এক মিনিট পরই ছাত্রের মা আসতেন। তার বিষয় ছিল গত দুই বা এক দিনে ছাত্র কী কী দুষ্টামি করেছে তার একটা সারমর্ম দেওয়া। আর সঙ্গে সঙ্গে আমাকে মনে করিয়ে দেওয়া যাতে আমি ছাত্রকে ইচ্ছামতো শাস্তি দিই। মোটামুটি এই ছিল প্রতিদিনকার পড়ানোর রিচুয়াল। আমিও মনোযোগ দিয়ে ছাত্রের মায়ের অভিযোগ শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তবে কোনো দিনও ছাত্রকে শাস্তি দিইনি। শাস্তি দেওয়া আমার স্বভাব না।

আইডিয়াল স্কুলে থাকা অবস্থায় নিজেই এমন সব শাস্তি পেয়েছিলাম, যে কারণে মনে হতো শাস্তি দেওয়া শিক্ষক হচ্ছে আজরাইলের বন্ধু। স্কুলে থাকতে আমার এক বন্ধু মহান এক উক্তি করেছিল, যেসব শিক্ষক ক্লাসে এসে ছাত্রদের পেটান তাঁরা নাকি বাসায় স্ত্রীদের আদর-আয়েশ, সান্নিধ্য কিংবা ভালোবাসা পান না অথবা তাদের দাম্পত্য জীবন সুখকর নয়। আজ এত বছর পরও আমার মনে হয় বন্ধুর উক্তিটি ছিল বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।

আমি অবশ্য বন্ধুর কাছে জানতে ছেয়েছিলাম, তাহলে তো যে সব শিক্ষিকা ছাত্রী পেটান তাঁদের ক্ষেত্রেও তো একই যুক্তি প্রযোজ্য। অর্থাৎ তাঁরাও স্বামীর সান্নিধ্য বা ভালোবাসা পান না। নিষ্ঠুরতার নমুনা মানুষকে আরও নিষ্ঠুর হতে শেখায়। আমার বিশ্বাস এ কথা যেকোনো জাতির ক্ষেত্রেই তিন সত্য।

গ্রীষ্মের এক ভরদুপুরে আমি শ্রাবণ বাসে চড়ে বাসাবোতে নামলাম। বিকেলে ক্লাস ছিল না বলে ভাবলাম দুপুরে টিউশনি সেরে একবারে বাসায় যাব। প্রচণ্ড গরম। তার ওপর আবার যুদ্ধ করে বাসে চড়তে হয়েছে। এমনিতেই মাথা ও শরীর গরম। আমি কল বেল বাজালাম। কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে গেল। আমি বসলাম। পাশের রুমে যথারীতি দৌড়-ঝাঁপের শব্দ। আমার ছাত্র মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে হাজির হলো। বেশ সময় নিয়ে টেবিলের ওপাশে বসল। সেদিন তার হাতের পাশে ক্রিকেটের ব্যাট আর বল। আমি বললাম এখন থেকে পরবর্তী এক ঘণ্টা ব্যাট আর বল এখানে থেকে নড়তে পারবে না।

: ঠিক আছে স্যার। আমি ওগুলো ধরব না।

ইতিমধ্যেই ছাত্রের মা এসে গত দিনের কিছু ঘটে যাওয়া ঘটনার সারমর্ম দিলেন। পাশাপাশি বলে গেলেন, ওর স্কুলে লম্বা ছুটির আগে অনেক হোমওয়ার্ক দিয়েছে। সেগুলোর মধ্যে কয়েকটি আবার পরের ক্লাসেই নিয়ে যেতে হবে। তার মধ্যে ছিল ‘পিয়নি’ ফ্লাওয়ারের ওপর একটা রচনা। Four Noble Truth about Buddhism-এর ওপর একটা বড় চ্যাপটার পড়ে তার বেশ কিছু উত্তর বের করা। এগুলো ছাড়াও নিয়মিত অঙ্ক ও আরও কিছু বিষয়ে ছাত্রকে সাহায্য করা।

মাস শেষে ১১০০ টাকার টিউশনি অনেক বড় অঙ্কের শোনালেও মাঝেমধ্যে মনে হতো এর চেয়ে ভালো ঢাকার রাস্তায় স্কুটার চালানো। ইংরেজিতে বড় আকারের পিয়নি ফুলের রচনা লেখার চেয়ে আমি স্বচ্ছন্দ বোধ করতাম ‘একটি বটগাছের আত্মকাহিনি’ লিখতে। ঢাকার যে এলাকায় থাকতাম সেখানে কচুরিপানার ফুল ছাড়া জীবনে নামীদামি ফুলের খুব একটা সাক্ষাৎ মেলেনি। যেসব ছেলেমেয়ে ফুল নিয়ে বেশি আহ্লাদিপনা করত, তাদের মনে হতো অস্বাভাবিক। জীবনের প্রতি নিজের অসম্পূর্ণতা কিংবা ব্যর্থতা অনায়াসে অন্যের কাঁধে চড়িয়ে দিতাম। যা হোক, ক্লাস ফোর পড়ুয়া ছাত্রের জন্য আজব আজব বিষয়ে রচনা লিখতে আমাকে রীতিমতো ঢাকা ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিতে গিয়ে বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করতে হতো। অবশ্য এতে করে কিছু কিছু বিষয়ে জ্ঞানলব্ধ হয়েছে।

সেদিন আমার ছাত্র চেয়ারে বসেছে ঠিকই, কিন্তু লক্ষ করলাম তার এক পা প্লাস্টিকের খালি বালতির ভেতর। সে পা নাড়াচ্ছে আর তা থেকে ইচ্ছাকৃত একটা বিরক্তিকর শব্দ তৈরি করছে। সে খুব সম্ভবত আমার ধৈর্য পরীক্ষা করছে। আমি বললাম বালতি থেকে পা বের করে সুন্দরভাবে বসার জন্য। প্রথমবার বললাম। কিন্তু মনে হলো সে আমার কথায় কান দিচ্ছে না। আমি দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করলাম, সে আমার কথা শুনবে নাকি শাস্তি খাবে। ছাত্র তৎক্ষণাৎ খুব হালকা স্বরে উত্তর দিল ‘শাস্তি খাব’।

মনে হলো তার এই উত্তরের সপক্ষে যুক্তি ছিল যে, আমি তাকে কখনোই শাস্তি দিইনি এবং ভবিষ্যতেও সম্ভাবনা নেই। সুতরাং সে বলে ফেলল যে সে শাস্তি চায়। যদিও তার গলার স্বর ছিল হালকা। কালবিলম্ব না করে ওর গালে একটা চড় দিলাম। ও কিছুটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গাল ধরে বসে রইল। আমি ভয় দেখানোর জন্য বললাম, আজকেই ওকে পড়ানোর শেষ দিন। এই হুমকিটা কাজে লাগত বেশ। আমি ওর প্রতি মনোযোগ না দিয়ে রচনা লিখতে মনোযোগ দিলাম। আড়চোখে লক্ষ করলাম সে একইভাবে অনড় হয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে। হঠাৎ চড় হজম করার জন্য হয়তো সময় নিচ্ছে। এভাবে সুনসান নিস্তব্ধতায় প্রায় মিনিট পাঁচেক কেটে গেল।

: আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে গ্রাম থেকে একটা কাজের ছেলে এসেছে। সে ওই বাসায় কাজ করে। নীরবতা ভঙ্গ করে পিনাক কথা বলা শুরু করল।

আমি ওর কথার সূত্র ধরতে পারলাম না। অপেক্ষা করলাম আরও কিছু শোনার জন্য।

ও বলে চলল, বাসায় পানি না থাকলে ও পানি নিয়ে আসে। মাঝে মাঝে বাজার করে দেয়। ডাস্টবিনে ময়লা ফেলে দিয়ে আসে। রিকশা ডেকে নিয়ে আসে। সিঁড়ি দিয়ে ভারী মালামাল ওঠানামা করে। গ্রামে থাকাকালে নাকি ওই ছেলেটা রিকশাও চালাত।

পিনাকের কথা শুনে বিরক্ত হওয়ার চাইতে আমি উৎসাহী হলাম বেশি। তখনো ওর কথার সূত্র ধরতে পারলাম না। কেনই বা সে এসব কথা আমাকে বলছে। ওই কাজের ছেলের বৃত্তান্ত শুনে আমি কী করব। একটু বিরতি নিয়ে পিনাক তার কথার শেষ ব্যাকটি উচ্চারণ করল। ওই কাজের ছেলেটির নাম জামাল।

পুনশ্চ: পিনাক এখন একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়। থাকে ঢাকায়। বিয়ে করেছে। একটা ছোট্ট বাচ্চার বাবা। আমি কল্পনা করি ব্যস্ততা ভরা জীবনে এক বৃষ্টিভেজা সকালে তাড়াহুড়ো করে পিনাক ক্লাসে যায়। খুব মনোযোগ সহকারে সুনসান নিস্তব্ধতায় সে লেকচার দিয়ে চলে। হঠাৎ সে লক্ষ করে, কোনো ছাত্রী তার লেকচার উপেক্ষা করে বাইরের জানালায় বৃষ্টিভেজা পৃথিবী উপভোগে ব্যস্ত। তাকে লক্ষ্য করে সে বলে ওঠে, মাই ডিয়ার লেডি, আই নো, রেইন ইজ বিউটিফুল বাট মাই লেকচার ইজ মোর ইমপরট্যান্ট। প্লিজ পে অ্যাটেনশন টু মি।
---

জামাল সৈয়দ: মিনেসোটা, যুক্তরাষ্ট্র। ই–মেইল: <[email protected]>