আমাদের অটিজম পরিক্রমা-দুই

লেখিকা ও আবরার
লেখিকা ও আবরার

সময় গড়িয়ে যেতে লাগল। ডে কেয়ারের সহপাঠীদের সঙ্গে আবরারের সংকোচ সামান্য কাটলেও সহজভাবে কারও সঙ্গে কথা বলতে বা খেলতে আগ্রহ প্রকাশ করছিল না। তবে আমি আর এহসান হাল ছাড়িনি। তার সঙ্গে বিভিন্নভাবে কথা বলতাম ক্রমাগত।

২০১৩ সালের জুলাই মাস। তখন আবরারের বয়স তিন বছর। হালিফ্যাক্সের আইডব্লিউকে শিশু হাসপাতালে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে চিকিৎসকেরা আমাদের জানালেন, আবরার একজন অটিস্টিক শিশু। মনে পড়ে বাসায় ফিরে সবার অগোচরে সেদিন কী অঝোরে কেঁদেছিলাম। অনেক কষ্টের পর একটি ক্ষীণ আশা নিভৃতে লালন করেছিলাম, হাসপাতালে চূড়ান্ত পরীক্ষা শেষে কোনো ইতিবাচক ফলাফল হয়তো পাব। কারণ চিকিৎসকেরা অভয় দিয়েছিলেন, যেহেতু কম বয়সেই বিষয়টি নির্ণয় হয়েছে, নিয়মিত থেরাপির মাধ্যমে হয়তো উন্নয়ন সম্ভব।

আবরার অটিস্টিক শিশু, এটা চূড়ান্তভাবে জানার পর তখন বাংলাদেশে কয়েকজন জানিয়েছিলাম আমাদের সন্তানের এই বিশেষ অবস্থার বিষয়ে। দু-একজন মানসিক সাহচর্য দিয়েছিলেন। আমাদের সন্তানকে নিয়ে বাংলাদেশের চেনা পরিচিত গণ্ডির মধ্যে অযাচিত সমালোচনা, ভ্রান্তি আর মুখরোচক আলোচনার ঝড় উঠল।

দুঃখজনক হলেও সত্য আমরা গঠনমূলক সমাধানের চেয়ে আক্রমণাত্মক সমালোচনায় আমরা বেশি স্বস্তি অনুভব করি। আর বিষয়টি যদি একজন নারীর জীবনকেন্দ্রিক হয়, তবে তো পোয়াবারো। তখন তা আরও মুখরোচক বিষয়ে পরিণত হয়। এ প্রসঙ্গে হ্যালিফ্যাক্সের একটি অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ না করে পারছি না। আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে ভারতীয় বংশোদ্ভূত একজন নারী বাস করতেন। পেশায় ছিলেন গবেষক। তিনি আবরারের বিষয়টি জানার পর আমরা ওঠানামার জন্য যে লিফট ব্যবহার করতাম, তিনি সেই লিফট পরিহার করতেন। তাঁর এই সংস্কারবদ্ধ আচরণের বিষয়টি আমি পরবর্তী সময়ে হাউজিংয়ের একটি সামাজিক গ্রুপকে জানিয়েছিলাম।

কানাডিয়ান পাবলিক হেলথ ডিপার্টমেন্ট থেকে কর্তব্যরত নার্স ও কয়েকজন সমাজকল্যাণকর্মী নিয়মিত বাসায় আসতেন। তাঁদের মধ্যে কেটি নিকারসন, মেরি স্লোবাকান আর নার্স জোয়ান ম্যাকডোনাল্ডের আন্তরিক সহমর্মিতা, ভালোবাসা আর সাহচর্যের প্রতি আমি বিশেষ কৃতজ্ঞ। সন্তানের এই বিশেষ পরিস্থিতিতে কীভাবে দুঃখ ভুলে বাস্তবভিত্তিক ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গঠন করতে হবে, সে বিষয়ে তাঁরা আমাকে আন্তরিকভাবে নির্দেশনা দিতেন। আমাদের মনোবল গড়ে তোলার ও জীবন সম্পর্কে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে তাঁদের ভূমিকা ছিল অনন্য। তাঁদের নির্দেশনা আর নিজেদের চেষ্টায় আমি আর এহসান অটিজম–সংক্রান্ত বিভিন্ন বই, গবেষণা তথ্য সংগ্রহ করে মোটামুটি ভালো ধারণা লাভের চেষ্টা করি। প্রতিটি দিনই একেকটি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতাম।


অটিস্টিক শিশু হিসেবে শনাক্ত হওয়ার কিছুদিন আগে থেকেই আমরা আবরারকে ডা. শ্যারন মেরির কাছে নিয়ে যেতাম। তিনি আচরণ থেরাপিস্ট বা স্পিচ বিকাশে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। সপ্তাহে একবার যেতাম। তিনি সহজ শব্দযোগে কীভাবে বাক্য গঠন করতে হয় সে বিষয়ে আমাদের দুজনকেই নানা নির্দেশনা দিতেন। তিনি আবরারের আগ্রহের দিক অনুসারে লাল–সবুজ রঙের নানা রকম সংখ্যা দিয়ে বস্তুর অবস্থান, আকার, ঘটনা সংযোগ ঘটিয়ে আলোচনা করতেন। প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি ছোট ছোট সহজবোধ্য শব্দ দিয়ে কথোপকথন শুরু করেছিলেন। যেমন who, what, were when, what is, where ইত্যাদি ছোট ছোট জিজ্ঞাসা ও স্থানবাচক, সময় শব্দের সমন্বয়ে আলোচনা করতেন।

ডা. শ্যারন মেরির পাশাপাশি প্রি–স্কুলে তিনজন আচরণ থেরাপিস্ট আবরারকে আচরণের বিকাশজনিত বিষয়ে শিক্ষা দিতে লাগলেন। তাঁরা সপ্তাহে চার দিন স্কুলে যেতেন। এর ব্যয়ভার আমরা বহন করতাম। তাঁদের নিয়মিত ভালোবাসা ও সহমর্মিতা পূর্ণ প্রকাশ, শিক্ষা, আবরার ধীরে ধীরে শব্দচয়ন ও বাক্য গঠন শুরু করল।

বাবার সঙ্গে আবরার
বাবার সঙ্গে আবরার

বর্তমানে আবরার তার ভাই রাফির সঙ্গে হ্যালিফ্যাক্সের স্থানীয় একটি স্কুলে পড়ে। সপ্তাহে একবার স্কুলের অধীনে পরিচালিত বিশেষ শিশুদের জন্য আর্লি লার্নিং সেন্টারের কিছুটা সহায়তা পায়। কানাডায় স্কুল পর্যায়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে এই সুবিধাগুলো বেশ ভালো। সার্বিক বিচারে অবশ্য তা পর্যাপ্ত নয়। তবে কিছুটা স্বস্তি বোধ করি গত কয়েক বছর অর্থনৈতিক কিছুটা সংগতি হওয়ায় আবরারকে প্রাক বা প্রি স্কুল পর্যায় থেকে বিভিন্ন রকম আচরণ গত থেরাপি ও প্রশিক্ষণের আওতায় রাখতে পেরেছি।

হ্যালিফ্যাক্সের অটিজম নোভাস্কশিয়া নামের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের একজন বিশেষজ্ঞ আমাকে জানিয়েছিলেন, যদি কেউ বলে তোমার সন্তানের সমস্যা সব ঠিক হয়ে গেছে, তাতে খুব প্রাণিত হবে না। তারা হয়তো বা সাময়িক সান্ত্বনা দানের জন্য অথবা তাদের অজ্ঞানতা থেকে এ কথা বলবে। অটিজম সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য নয়। সন্তানকে কোনো সময় একা রাখবে না। তাকে নিঃশর্তভাবে ভালোবাসবে আর নিয়মিত প্রশিক্ষণের মধ্যে রাখবে।

বর্তমানে আমাদের আবরার আগের চেয়ে মোটামুটি ভালোভাবে ভাবের আদান প্রদান করে। সংখ্যা আর গণনার প্রতি তার আগ্রহ লক্ষ করা যায়। তাকে নিয়ে একটি স্বাভাবিক জীবন গড়ার প্রয়াসে প্রবাসের কঠোর বাস্তবতায় আমাদের নীরব এক ভিন্নধর্মী যুদ্ধ চলছে অবিরত। জানি না কত দিন পারব। আমার তেমন অবসর মেলে না। তবে এর মাঝেই লিখছি। আমি কানাডার বাংলা সংবাদমাধ্যমে প্রতিনিধিরূপে সম্পৃক্ত আছি। একই সঙ্গে কানাডার মূলধারার সাহিত্যগ্রন্থ ভাষান্তরের কাজ করছি।

আমি দুটি শিশুর সঙ্গেই যাপিত জীবনের নানা বিষয় আলোচনা করি আর বিভিন্ন প্রশ্ন করি। আমরা সর্বতো চেষ্টা করি আবরারকে স্বতঃস্ফূর্ত রাখতে। প্রতিদিন সকালে তাকে আমরা প্রাণভরা হাসি উপহার দিই। সে নির্ভরতার ক্ষেত্র পেয়ে প্রায়ই কিছুটা আড়ষ্ট ভঙ্গিমায় একান্তে এসে আমাদের গালে আদরের স্পর্শ দেয়। তার এই অনুভূতির প্রকাশ আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। এহসান যে আবরারের সব সময়ের শ্রেষ্ঠ বন্ধু তাকে আর আমাকেও সে নিবিড় ভালোবাসার আবেগে জড়িয়ে ধরে। স্কুলের শিক্ষকেরা ক্লাসে কিছুদিন আগে আবরারের সহপাঠীদের মাঝে বিশেষ বৈশিষ্ট্যের শিশুদের প্রতি গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টির জন্য এক আয়োজন করে। এই আয়োজনে বিশ্বখ্যাত শিশুতোষ কার্টুন ও পাপেট সিরিজ সিসমে স্ট্রিট কার্টুনে ‘জুলিয়া’ নামক একটি বিশেষ অটিস্টিক চরিত্রের সমস্যা ও অপার সম্ভাবনা দিককে প্রদর্শন করা হয়েছে।

নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও থেরাপির মাধ্যমে আবরারের অনেকটাই ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। শুভানুধ্যায়ী সবার হাসি আমাদের শক্তি জোগায়। অটিজম কোনো সময়েই নিরাময়যোগ্য নয়। অটিজমে আক্রান্তদের নিয়ে বাবা-মার ও পরিবারের অন্য সদস্যদের জীবনভর ভিন্নধর্মী এক যাত্রার মানসিক প্রস্তুতি নিতে হয়। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে যাঁরা অটিজমে আক্রান্ত হন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো না কোনোভাবে ভ্রান্ত সংস্কার আর সচেতনতার অভাবে প্রতিমুহূর্তে তাঁরা নিগৃহীত হন। ফলে অনেকেই হতাশায় পর্যবসিত হন। মনে রাখা প্রয়োজন সবাই মানুষ। স্বাভাবিকভাবে বাঁচার দিকটা তাঁদের মানবিক অধিকার। দেশে ও বিদেশে আমার নিকট পরিচিতজনের জীবনে লক্ষ করেছি নানা সংস্কার আর ভ্রান্ত ধারণার। উদাসীনতার বশবর্তী হয়ে এ রকম বৈশিষ্ট্যের অধিকারী সন্তান বা সদস্যকে পরিবারের সবার অন্তরালে রাখা হয়। সমাজের অসম রীতিগুলোকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে আমরা অনেক মূল্যবান প্রাণকে অবমূল্যায়ন করি।

লোকলজ্জা, সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব এবং পর্যাপ্ত শিক্ষা ও প্রয়োজনীয় থেরাপির সীমিত ক্ষেত্র অটিজম আক্রান্তদের সঠিক ও সহজাত বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। তাই পরিবেশ ও সমাজের সর্বত্রই অটিজমবান্ধব পরিস্থিতি সৃষ্টি করা উচিত। মা বাবাকেও এ ক্ষেত্রে উদাসীন হলে চলবে না। বরং ধারণ করতে হবে যথেষ্ট ধৈর্যশীল উদার ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি।

কানাডায় সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিশেষ চাহিদার মানুষদের জন্য খুব বেশি না হলেও তুলনামূলকভাবে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির ও নানান প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে। থেরাপি ক্ষেত্রটি আরও অনেক বেশি মাত্রায় সব বিশেষ চাহিদার শিশুর জন্য সহজলভ্য করার জন্য সমাজকর্মীরা অবিরত প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। অধিকাংশ প্রদেশে অটিজম নিয়ে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের অলাভজনক সামাজিক সংগঠন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো অটিজম স্পিকস কানাডা, অটিজম সোসাইটি কানাডা ও কানাডিয়ান ন্যাশনাল অটিজম ফাউন্ডেশন।

বাংলাদেশেও আগের চেয়ে অটিজম সচেতনতার দিকটি তুলনামূলকভাবে উন্নত হয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ হোসেন বাংলাদেশ জাতীয় অটিজম উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান। তাঁর উদ্যোগে সরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে চালু হয়েছে অটিজম রিসোর্স সেন্টার। অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন তাঁদের উন্নত প্রশিক্ষণ দেওয়ার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠন করা হয়েছে সেন্টার ফর নিউরো ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড অটিজম ইন চিলড্রেন। শিশু হাসপাতালে রয়েছে শিশু বিকাশ কেন্দ্র।

বর্তমানে গ্রামাঞ্চলে সমাজকল্যাণকর্মীরা এ বিষয়ে নানা রকম জনসচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কর্মপরিচালনা করছেন। দেশে অনেকে অটিজম আক্রান্তদের উন্নয়ন ও সঠিক প্রশিক্ষণ বিকাশে নিরলসভাবে কাজ করছেন। তবে সার্বিকভাবে একটি ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টিতে বাংলাদেশের সমাজে এ ক্ষেত্রে অনেকটা পথ অতিক্রম করা বাকি আছে।

অটিজম নিয়ে এ আলোচনার ইতি টানব কানাডার পার্লামেন্টের পোয়েট লরিয়েট জর্জ এলিয়ট ক্লার্কের কবিতা দিয়ে। তাঁর অনুমতি নিয়ে আমি কবিতাটি বাংলায় অনূদিত করেছি।

প্রসঙ্গ অটিজম
জর্জ এলিয়ট ক্লার্ক

সক্ষম ক্ষমতায়নের লব্ধ ব্যতিক্রমী চিন্তা সক্ষম
আলোকিত এক মানুষ
যার জন্ম, ভিন্ন মতাদর্শের স্বর্গীয় কল্প সুষমায় আপ্লুত,
যে স্থানে গাঙচিল গোলাপি গর্জন তোলে,
বৃষ্টিধারা প্রায়ই যেন এক গ্রিক ভাষার শব্দধ্বনি শোনায়...
তুমি যে রকম গতানুগতিক ঢঙে ভাব অটিজম কিন্তু তা নয়:
এটা অনেকটা ব্যক্তির জাদুতাড়িত স্বপ্ন আর অন্য কয়েকটি সম্ভাবনার মতো:
একজন মা কতটা কমলা বর্ণ ধারণ করতে পারেন যখন তাঁর রান্না করা তরল স্যুপ
অনেকটা মোজার্টের কোনো সুরসৃষ্টি আর রাগের মতো ছলকে উদ্‌গিরণ হয়—
আর সেই সংগীতের সারবস্তু নাগরিক আইনের জটিল বর্মতুল্য আগ্রাসী পিরানহা মাছের লেলিহান আক্রমণ থেকে পরিত্রাণ পেতে শেখায়—ইত্যাদি।
তীক্ষ্ণবুদ্ধির অটিজমের জগতে সবকিছুই এক বৈচিত্র্যময় শিল্পরূপ পায়।
অটিস্টিক মনন কাঠামোর মানুষের হৃদয় কোনো এক অনুপম সুরধারা সৃষ্টি করে,
তাই কোনো মামুলি বা খসড়া চিন্তাধারায়, সজীব অন্তর্দৃষ্টি অথবা নিছক শিল্পকলা
যা বিস্মিত এক হৃদয়পট থেকে উৎসারিত—
তাই অনেকটা সেভাবে সে এক কবির হৃদয়ের মানসপটে আলোকিত চিহ্ন রেখে যায়।
–––