গার্মিশে ঘ্যাও ম্যাও-এক

গার্মিশ-পার্টেনকির্শেন
গার্মিশ-পার্টেনকির্শেন

পড়াশোনায় বিরাট অ্যালার্জি। তাই জায়গাটা সম্পর্কে কোনো রকমে গুগলীয় বাটি চালান না দিয়ে, মানে পড়াশোনা না করেই বাকিদের পিছু পিছু চলে এসেছি নিশ্চিন্তে। জড়ভরত আর কাকে বলে। তার ওপর আছে কুখ্যাত পরজীবী স্বভাব। আসার আগে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে ভুলে গেছি। দুটি আধুলি আর দশ ইউরোর খানতিনেক নোট ছাড়া পকেট গড়ের মাঠ। এই তথ্য ছেলের বাবাকে জানানোর পর তিনি রীতিমতো বিরক্ত, ‘এই তোমার এক স্বভাব, সব ভুলে যাও। জানোই তো অনেক জায়গায় ডেবিট কার্ড নেয় না এরা।’ কথাটা শেষ হলো ভ্রুকুটি দিয়ে। ধূর্ত আমি অবশ্য রাগলাম না। পিঁপড়া কখনো অ্যাফিডের ওপর রাগ করে না।

তবে কোনো কিছুর খোঁজখবর না নিয়ে এসে লাভ হয়েছে। যা দেখি, লাগে ভালো। দুই বন্ধু পরিবার মিলে বেড়াতে এসেছি। মিউনিখ থেকে এক শ কিলোমিটারের মতো দূরে গার্মিশ-পার্টেনকির্শেন। চোস্ত এক বাভারিয়ান শহরতলি। ঢাকা, চট্টগ্রাম ইত্যাদি বিভাগের মতো জার্মানিও অনেকগুলো ভাগে ভাগ করা। বাভারিয়া বা বায়ার্ন তেমনই একটা রাজ্য, মিউনিখ যার রাজধানী। বলে রাখি, বাভারিয়ানরা মাঝেমধ্যে ‘নোয়াখালী বিভাগ চাই’-এর আদলে ‘স্বাধীন বাভারিয়া দেশ চাই’ ধোঁয়া তোলে। যদিও তাদের এই ধোঁয়া হালে পানি পায় না কখনই।

গার্মিশ অঞ্চল স্কি রিসোর্ট হিসেবে বিখ্যাত। একবার শীতকালীন অলিম্পিকও হয়েছিল এখানে। দুর্দান্ত মধ্য জুনের ইউরোপীয় ফুটি ফাটা গরমে এমন ঠান্ডা ঠান্ডা জায়গায় আসতে পেরে আরাম লাগছে। পাহাড়ি পথ বেয়ে হাঁটছি। সঙ্গী টিপটিপ বৃষ্টি। সামান্য এগিয়ে লাল শামিয়ানা তোলা ঘোড়ার গাড়ি চোখে পড়ল। এখানকার পর্যটন আকর্ষণ। হুড়মুড়িয়ে তাতে চেপে বসলাম। নইলে সঙ্গের দুই শিশু পর্যটক ঘ্যাও ম্যাও জুড়ে দিতে পারে। টাট্টু ঘোড়া থাকতে নবাব পুত্রদের তো আর হাঁটিয়ে নিতে পারি না।

এদের ভেতর বড়ে নবাব হলো চার বছরের তাফসু মিয়া। তার স্বভাবে কুংফু কুংফু ভাব আছে। বয়সে ছোট কাউকে পেলেই সে কুংফুর প্যাঁচ কষে ঘাড় মটকে দিতে যায়। আর ছোটে নবাবের নাম নুর। বয়স গুনতে গিয়ে আঙুল তিনে এসে থেমে যায়। তার নামের আগে আবার একটা সম্ভ্রান্ত ‘সৈয়দ’ আছে। তবে একটু পরপর আলজিহ্বা কাঁপিয়ে ‘ভ্যাক কান্না’ নামের সিগনেচার কান্নাটা যখন সে শুরু করে, তখন তার সৈয়দ বংশীয় ইজ্জতের একেবারে ভরাডুবি ঘটে যায়।

পার্টনাখক্লাম বলে জায়গাটা দেখতে যাব সবাই। পাহাড়ের মধ্য দিয়ে উত্তাল জলধারা ফেনা তুলে সুতীব্র গতিতে ছুটে চলে গেছে। ভালো বাংলায় যাকে বলে গিরিসংকট। ইতস্তত করছি। স্থূল রকমের উচ্চতাভীতি আছে। গিরিসংকট দেখতে গিয়ে নিজেই কোন সংকটে পড়ি আল্লাহ মালুম। বৃষ্টিটাও জেঁকে বসেছে। তাই পথের পাশেই বনেদি চেহারার রেস্তোরাঁটায় আশ্রয় নিলাম। ঠিক হলো প্রথমে ছেলেদের বাবারা ঘুরে আসবে। আর অবধারিতভাবে আমরা, মায়েরা ছানা আগলে রেস্তোরাঁর মাছি মারব।

এদিকে নুর আর তাফসুকে শান্ত বসিয়ে রাখা দায়। একজন তানসেন হয়ে হেঁড়ে গলায় গান ধরে তো আরেকজন জাকির হোসেনীয় তালে তবলা ঠোকে টেবিলে। পরিষ্কার দেখতে পেলাম, কাঠখোট্টা জার্মান বুড়োদের আড়চোখে বিরক্তির ঝিলিক। আমরাও চটজলদি ভুরু কুঁচকে কপট বিরক্তি টেনে তাদের সঙ্গে যোগ দিলাম। ভাবখানা এমন যে এই ত্যাঁদোড় শিশুদের আমরা চিনি না। এরা কারা? বাবা-মা এদের এটিকেট-সহবত কিছু শেখায়নি নাকি?

এই সুযোগে দুজন তাদের ভজন থামিয়ে টেবিলের তল দিয়ে পালিয়ে গেল। মিনিটখানেক পর আরামদায়ক নীরবতা কানে বাজতেই দেখি দেয়ালের তাকে বসানো মোমবাতিগুলো উল্টে পুরো রেস্তোরাঁ পুড়িয়ে ফেলার বন্দোবস্ত করছে তারা। রে রে করে ছুটে গিয়ে বাকি মোমবাতি সব ফুঁ মেরে নিভিয়ে দিলাম। জিজ্ঞাসু ওয়েটার এগিয়ে আসতেই অজুহাত দেখালাম, ‘মাফ করবেন, আগুন লাগিয়ে দেওয়া এদের হাতের খেলা।’ আন্তরিক চেহারার লোকটা সহাস্যে বললেন, ‘আরে, বাচ্চাকাচ্চারা একটু প্যাড়া দেবেই, ব্যাপার না।’ তবুও লজ্জায় সংকুচিত হলাম। এদের হুপহাপ লঙ্কাকাণ্ড দেখলে স্বয়ং হনুমানও লজ্জা পাবেন। আমরা তো কোন ছার!

গার্মিশ-পার্টেনকির্শেন
গার্মিশ-পার্টেনকির্শেন

খানিক বাদে ধোঁয়া ওঠা আলুর স্যুপ চলে এল। জার্মান খাবার এর চেয়ে আর জার্মানতর হতে পারে না। এই বস্তু খেলে মনে হবে, কিসের আলু ভর্তা আর কিসের আলু ভাজি! আর আলু তো আলু। সঙ্গে মিহি কুচি কাঁচা মরিচ আর এক চিপ লেবু হলে মুগ মসুরের ডালকেও কনুই দিয়ে ধাক্কা মেরে বাংলার ঘরে ঘরে এই স্যুপ মহামারি আকারে ছড়িয়ে যেতে পারে অবলীলায়। যা হোক, দুই স্বৈরাচারীর যথেচ্ছ চ্যাঁচামেচি আর হুটোপুটির মধ্যে বহু কসরত করে বেহেশতি খানাটা নামিয়ে দিলাম। আফসোস, বাচ্চারা বেহেশতি স্বাদের মর্ম বুঝল না। স্যুপ না, যেন জোর করে যুদ্ধবন্দীদের জন্য রাঁধা ঘ্যাট খাওয়াচ্ছি তাদের। জবরদস্তির ফল হিসেবে উগরে দিতে দিতে কোনো রকমে ঢোক গিলে কাজ সারল।

ছেলেদের বাবারা ফিরে এল আধভেজা হয়ে। এবার আমরা যাব। নুরের ঘুম পাচ্ছে। সে বেঁচে গেল। তাকে হিংসে হচ্ছে। খুব চেষ্টা করলাম নিজের যাওয়াটাও এড়ানোর। নুরের মা মৌরি আপুর চাপাচাপিতে রাজি হতে হলো। বেজার মুখে তাফসুকে হাতে ঝুলিয়ে রওনা দিলাম। অথবা সেই আমাকেই হাতে ঝুলিয়ে রওনা দিল। কারণ একটু পরের দৃশ্যে দেখা গেল, সে হাত ধরে আছে আর আমি অন্ধকার পাহাড়ি সুড়ঙ্গের ভেতর হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটছি। অন্ধের যষ্টি! বাংলা ভাষা আসলে সব ভাষার বাপ।

জান হাতে নিয়ে ফিরে এলে জানতে চাওয়া হলো, কেমন দেখলাম পার্টনাখক্লাম গিরিসংকট। মৌরি আপুর ঝটপট উত্তর, ‘উফ্, দারুণ।’ ওদিকে আমি তখনো ঘুরন্ত মাথাটাকে বাগে আনতে পারছি না। উঁচুতে ওঠা অবধি পাঁচে দেওয়া সিলিং পাখার মতো বন বন ঘুরছে তো ঘুরছেই। একমাত্র লম্বা একটা ঘুমই এই বন বন থামাতে পারে।

কিন্তু ঘুম কি আর কপালে লেখা আছে? হোটেলে ফিরে এসেছি। ছানাগুলো চরম হইহুল্লোড় জুড়ে দিয়েছে। সামাল দিতে গিয়ে কালঘাম ছুটে যাচ্ছে তাদের মায়েদের। ছানাদের বাবাদের কোথাও দেখা যাচ্ছে না। কিনে আনা খাবার খেয়ে দেয়ে ভোজবাজির মতো শূন্যে মিলিয়ে গেছে। দুঃখে পড়ে মনে মনে বললাম, ‘হে খোদা, তোমার সিস্টেমে পরজন্ম বলে কিছু থাকলে একবার ছেলের বাবা হয়ে জন্মাতে চাইতাম। গা ভাসিয়ে কী চমৎকার দুলকি চালে জীবন কেটে যাচ্ছে এদের।’

নুর আর তাফসুকে ধরে বিছানায় পুরতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়ে পায়ের বুড়ো আঙুলটা নাচাতে নাচাতে চরম উদাস চোখে তাদের মারামারিটা দেখছি। একটু আগে যেটা নিরীহ ক্যাট ফাইট হিসেবে শুরু হয়েছিল, সেটা এখন হিংস্র বুল ফাইট পর্যায়ে চলে গেছে। একজন বুনো ষাঁড় সেজে মেঝেতে খুর ঘষে শিং বাগিয়ে ঢুঁ মারার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আরেকজন ষাঁড় খ্যাপাতে নাকের ডগায় ফ্ল্যামিঙ্গো নাচ জুড়ে দিয়েছে। ফ্ল্যামিঙ্গো বাবাজি ঢুঁয়ের আঘাতে ফর্দাফাই হওয়ার অন্তিম মুহূর্তে পা বাড়িয়ে আলতো ল্যাং মেরে ষাঁড়টাকে উল্টে দিলাম। উল্টে গিয়ে ষাঁড়ত্ব হারিয়ে গগনবিদারী মাতমে এই আশি বর্গমিটারের ডুপ্লেক্সটা মাথায় তুলে ফেলল তাফসু মিয়া।

হাসির মতো কান্নাও সংক্রামক। তবে হাউমাউয়ের সঙ্গে চ্যাও ভ্যাও যোগ করে কান্নাকাটির মতো সাধারণ ব্যাপারকে রীতিমতো ক্ল্যাসিক উচ্চাঙ্গসংগীতের মর্যাদায় পৌঁছে দিল পেশাদার অপেরাশিল্পী সৈয়দ নুর। আলজিহ্বা কাঁপানো কান্নার ভেতরে আবার কঠিন অভিযোগও ভেসে এল, ‘তাফসু ভাইয়াকে ধাক্কা দিলে কেন, ও তো আমাকে জাস্ট একটু টোকা দিত। আমরা খেলছি, বোঝো না কেন, রিম?’ ছোট শিশুরা কেন যেন আমাকে আন্টি বা খালামণি না ডেকে সরাসরি নাম ধরে ডাকে। এই রহস্যের উত্তর মেলে না। হয়তো তারা ধরে নেয়, বুদ্ধিগত দিক থেকে আমি তাদের কাছাকাছি লোক। বড়দের সঙ্গে তবু ভড়ং করে চালিয়ে দিই কোনোমতে। কিন্তু এদের কাছে ঠিক ধরা খেয়ে যাই। যা হোক, নুরের কথায় নিজের ছেলেকে ল্যাং মেরে ফেলে দেওয়ার অপরাধে মনটা সামান্য খচখচিয়ে উঠল। আত্মপক্ষ নিয়ে বললাম, ‘তাফসু তো বালিশের ওপর পড়েছে, ব্যথা পায়নি একটুও।

তর্কাতর্কির মধ্যে নুরের মা এসে তাকে আলগোছে নির্বিকার তুলে নিয়ে গেল। পোলাপানের কুম্ভীরাশ্রু মায়েরা চেনে। দেখাদেখি সাহস পেয়ে মিনিট দু-একের চেষ্টায় আমিও আরেকজনকে বগলদাবা করে আটকে ফেললাম। সারা দিন প্রচুর ঘোরাঘুরি হয়েছে। এখন ছানাপোনা ঘুম পাড়িয়ে নিজেরা গা এলিয়ে দিতে পারলে বাঁচি, এমন অবস্থা। (চলবে)

ড. রিম সাবরিনা জাহান সরকার: গবেষক ইনস্টিটিউট অব প্যাথোলজি, স্কুল অব মেডিসিন, টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি মিউনিখ, জার্মানি।