বুকমার্ক চারা হলো যখন

বুকমার্ক চারা হলো যখন
বুকমার্ক চারা হলো যখন

জানুয়ারির শীতার্ত সকাল। রোদ ছিল। তবে উষ্ণতা ছিল না তাতে। ঢাকায় তখন শীতের ধুলা মেখে গাছের পাতারা গাঢ় সবুজ রংকে প্রায় লুকিয়ে রেখেছে। ব্যালকনিতে বসে বই পড়ছিলাম। ছোট্ট গৃহকর্মী মেয়েটি টবে বেড়ে ওঠা ফুলগাছ কটির যত্ন করছিল। ডাল-পাতা ছেঁটে দিল। ভেজানো ন্যাকড়া দিয়ে গাছের পাতার ধুলা মুছে সাফ করল। মাটি খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ঝুরঝুর করছিল।

একটা পাতা তুলে আমাকে দেখিয়ে বলল, ‘জানেন এই গাছে ফুল মাঝরাতে ফোটে আবার রাতেই বুজে যায়।’

: কী নাম এর বলো তো?

: নাইট কুইন।

এই সময় কল বেল বেজে উঠল। ছোট্ট মেয়েটি পাখির মতো উড়ে গেল দরজার দিকে। তেমনি দ্রুত ফিরে এল।

: আপনার কাছে একজন এসেছেন।

নাইট কুইনের ভারী পাতাটা বুকমার্ক করে বই বন্ধ করে উঠলাম। বান্ধবীর সঙ্গে কথার খই উড়ল। চা আর ভাজাভুজিতে মন মাতল। ওকে জিজ্ঞেস করলাম, নাইট কুইন দেখেছ?

: বলধা গার্ডেনে দেখেছি গাছটা, ফুলটা জুন-জুলাই মাসে রাতে ফোটে, বলধা গার্ডেনে গেলেই গাছটা দেখতে পাবে।

: আমি বহুদিন আগে ওই শৌখিন জমিদারের বলধা গার্ডেনে গিয়েছিলাম। নাইট কুইনের কথা খেয়াল নেই, তবে আজ ব্যালকনির ঝুলন্ত বাগানে নাইট কুইন চেনা হলো।

: চলো তো দেখি।

বান্ধবী আমার ভাবির গাছপালাপ্রীতি দেখে চমৎকৃত হলো। বলল, অবাক কাণ্ড! জমিদার শখ করে দূর বিদেশ থেকে দুষ্প্রাপ্য সব গাছপালা এনে একদিন বাগান সাজিয়েছিলেন। সে সৌন্দর্যের এক কণা ব্যালকনিতে আসন গেড়েছে!

আমি বললাম, সাধারণ মানুষের সুন্দরের আকাঙ্ক্ষাও মেটাচ্ছে আজ। সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়েছে জমিদারের বাগান থেকে সাধারণের আঙিনাতেও, তাই না। আসলে প্রকৃতির সুন্দরে সব মানুষের অধিকার আছে।

: আর প্রকৃতির সুন্দর বেঁচে থাকে ও ছড়ায় মানুষের ভালোবাসা ও যত্নেই।

মনে পড়ল রাশিয়ার শহর লেনিনগ্রাদ বর্তমানের সেন্ট পিটার্সবুর্গে অবস্থিত অ্যারমিতাজ আর রুশ সম্রাট পিটার দ্য গ্রেটের প্রাসাদ ভ্রমণের সুযোগ হয়েছিল একবার। এ ছিল জৌলুশ-চাকচিক্য, মনোহর শিল্প আর বিপুল বিত্তের অপূর্ব এক প্রদর্শনী, যা সম্রাটের কুক্ষিগত ছিল একদিন। বর্তমানে সাধারণ মানুষের মুগ্ধ দৃষ্টিপাতে নন্দিত হয় প্রতিদিন। মনে মনে ভাবলাম, বলধা গার্ডেনের নাইট কুইন ঝুলন্ত বারান্দার টবেও আদর-যত্নে প্রাণ পেয়েছে। আর অ্যারমিতাজের একটি চিত্রকর্মের রেপ্লিকাও আদর-যত্নে তৈরির জন্য শুধু সৌন্দর্য পিয়াসি চিত্তই যথেষ্ট নয়, অঢেল বিত্তেরও দরকার। সবচেয়ে বড় কথা, ওই জড় চিত্রকর্ম ঘরে ঘরে রাখার কোনো প্রয়োজন আছে কি? বরং গাছ, যার প্রাণ আছে, যে আমাদের বিশুদ্ধ অক্সিজেন জোগায়, তাকে ঘরের আঙিনায় ও বারান্দাতে ঠাঁই দেওয়া একটি উত্তম কাজ, জরুরি কাজ।

অ্যারমিতাজের মনোরম শিল্পকর্ম ও চোখ ধাঁধানো চাকচিক্যের মতোই স্মরণীয় হয়ে আছে সেই সময়ের লেনিনগ্রাদ আজকের সেন্ট পিটার্সবুর্গের ‘হোয়াইট নাইট’ বা ‘সাদা রাত্রি’। তারিখটি ছিল ২১ জুন। রাত ১২টাতেও দিনের আলো পুরোপুরি নিভে অন্ধকার হলো না। সেই সাদা রাতে যুদ্ধহীন (ভিয়েতনাম যুদ্ধ শেষ হয়েছে বেশ কবছর, আমেরিকা-রাশিয়া নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি করায় মেতেছে যা সল্ট-১, সল্ট-২ বা স্ট্র্যাটেজিক আর্মস লিমিটেশন ট্রিটি নামে পরিচিত) শান্তি ছাওয়া পৃথিবীতে আলো না জ্বালিয়ে দেশে মায়ের কাছে চিঠি লিখছিলাম। দূর থেকে একদিকে ভেসে আসছিল রুশ সম্রাজ্ঞী আর চাষাভুষা অতিমানবের মতো শক্তিমান রাসপুতিনের প্রণয় নিয়ে গাঁথা ‘বনি এম’-এর গান ‘রা রা রাসপুটিন লাভার অব দ্য রাশান কুইন’ আর অন্যদিকে সেই সময়ের ভীষণ জনপ্রিয় রুশ গায়িকা আলা পুগাচিওভার গাওয়া ব্রিটিশ রাজা সপ্তম জর্জের প্রেমের কারণে বাধ্য হয়ে সিংহাসন ত্যাগের ইঙ্গিতবাহী গান ‘রাজা ভালোবেসে বিয়েও করতে পারে না’ (কারল নি মঝেত ঝেনিৎসা প্যো লুভ্যি)। এবার গাওয়া আমার প্রিয় গান ‘ক্যান ইউ হিয়ার দ্য ড্রাম ফেরন্যান্ডো’ও বাজাচ্ছিল কেউ। আবছা আলোকিত অপার্থিব ওই ‘সাদা রাত’ আর সেই গান অমনি ভাবে আর কোনো দিন ফিরে আসবে কি?

বুকমার্ক চারা হলো যখন
বুকমার্ক চারা হলো যখন

জানুয়ারির শেষে দেশ ছেড়ে মেলবোর্নে পৌঁছালাম। এয়ারপোর্টে নেমে গ্রিন চ্যানেল দিয়ে পার হওয়া হয় না। আপনজনের দেওয়া ভালোবাসার বোঝা সোনা মুগ, সরু চাল না হলেও চিংড়ি, পনির, মিষ্টি কিছু না কিছু নিয়ে রেড চ্যানেলের সন্দেহপ্রবণ গম্ভীরমুখী কাস্টম বাবুদের সঙ্গে মোলাকাত পর্ব শেষ করে তবেই ছাড় পাওয়া। আগেরবার ‘ডেইরি প্রোডাক্টস নট অ্যালাউড’ বলে ফরমায়েশ দিয়ে বানানো অষ্টগ্রামের পনির বড় চিমটা দিয়ে ধরে ময়লার বালতি বা রাবিশ বিনে ফেলেছিল।

এবার চিংড়ি মাছ ও খুব হালকা কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো হ্যান্ডিক্রাফটসের একটি দেয়ালচিত্র ছাড়া আর কিছু নাই। মনে মনে ভেবে রেখেছি দেয়ালচিত্রটি নিয়ে ঝামেলা করলে ‘কোয়ারেন্টাইন’ করার খরচ দিয়ে রেখে আসব। পরে গিয়ে নিয়ে আসব। চিংড়িমাছ রান্না করা থাকে বলে কখনই ঝামেলা ফ্যাসাদ করে না।

এবার চিংড়ির সুস্বাদু গন্ধে কাস্টম বাবু অভিভূত হলেন মনে হলো। বাবু সাহেব জানালেন, চিংড়ি ছাড়া যাবে না। তবে রাবিশ বিনেও ফেললেন না।

আমি বললাম, গতবারও চিংড়ি আটকায়নি কিন্তু...।

কথা শেষ করার আগেই অনুমোদিত জিনিসের ছাপানো লিফলেট মতো কাগজের মার্জিনে কলম দিয়ে প্রন লিখে কাগজটা আমার হাতে গছিয়ে দিয়ে আমার স্যুটকেস স্ক্যান করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ফ্রেমে বাঁধানো দেয়ালচিত্র স্ক্যানারে ভেসে উঠল।

কাস্টম বাবু জানতে চাইলেন, কাঠ না প্লাস্টিকের ফ্রেম এটা?

চিংড়ি যাতে ভাবির অনেক ভালোবাসা ও যত্নে মেশানো ছিল, তা আটকে ফেলাতে মনটা ছিল ক্ষুব্ধ। ক্ষুব্ধ মন নিয়ে কপট উদাসীন ভঙ্গিতে বললাম, প্লাস্টিক না কাঠ ঠিক বলতে পারব না, তুমিই দয়া করে দেখো তো, কী এটা?

তিনি বিস্ময় ও অবিশ্বাস নিয়ে আমাকে দেখলেন তবে স্যুটকেস খুললেন না। পাশে রাখা চিংড়িমাছের কনটেইনারের দিকে অসীম মমতা ভরা চোখে (লোভাতুর চোখ কথাটা বড় বিশ্রী শোনায়, ওই কথাটা তাই বললাম না) তিনি আবার তাকালেন। তা দেখে আমার মন আরও খারাপ হলো। স্ক্যানারে এবার ধরা পড়ল বই। তার ভেতরে পাতা, নাকি পাতার ছবি আসলে ঠিক কোনটা বোঝা যাচ্ছিল না।

: এটা কি ছবি না বুকমার্ক?

পাতাসহ বই দেখে আমি বিস্মিত আর প্রশ্ন শুনে অপ্রস্তুত। বোকার ভাব ধরে বললাম, নট শিওর খুলেই দেখো।

কথা না বাড়িয়ে তিনি আমার মালপত্র আমাকে সঁপে দিয়ে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। আমার আনা চিংড়িমাছ খেতে খেতে কাস্টম বাবু প্লাস্টিক ও কাঠের পার্থক্য চেনে না যে বোকা, তার কথা মনে করে নিশ্চয় খুব হেসেছেন।

ফিরে আসার দুদিন পর সময় করে বই খুলে দেখি নাইট কুইনের পাতা তখনো শুকায়নি। রংটাও সবুজ, তবে নেতিয়ে পড়েছে কিছুটা। ঢাকা থেকে ফোনে ভাবি চিংড়ি হারানোর দুঃখে সান্ত্বনা আর নাইট কুইনের বিষয়ে দিলেন পরামর্শ। সেই মতো প্রায় মৃত বুকমার্ক পাতার প্রজেক্ট শুরু হলো।

মাস পাঁচেক ঘরের ভেতর জানালার কার্নিশে কাপের পানিতে পাতার গোড়াটা ডুবিয়ে রাখলাম। ধীরে ধীরে নির্জীব পাতা সজীব হলো। তাতে এক সময় শিকর গজাল। ছয় মাস পর অনেক যত্নে শিকড় মেলা পাতা টবে পুঁতে দিলাম। ঘরের বাইরে শেডের নিচে রইল।

দীর্ঘ সময় পর পাতার শরীর থেকে অন্য একটি পাতা উঁকি দিল। তারপর আরেকটি কাণ্ডের মতো মজবুত পাতা বের হলো। বুকমার্ক চারা হয়ে গেল এক সময়ে। সীমান্ত পেরিয়ে এসে এভাবে বুকমার্কের চারা হয়ে যাওয়া অবাক হওয়ার মতো ঘটনা। অপেক্ষা, কবে সে আরও ডাল-পাতায় পল্লবিত হয়ে ফুলের সম্ভার আনবে।

অবাক হয়ে ভাবি, কার ভুলে পাতাটা এসে পড়ল আবার চারাও হয়ে গেল। আমার অজান্তে অর্ধেক পড়া বইটা প্রিয়জনদের কেউ স্যুটকেসে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। কাস্টম বাবুও নিরাসক্তভাবে কর্তব্য পালন করেছিলেন। পাতাটারও বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছাশক্তি ছিল তাই।
---